মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের কালো গেলাফ থেকে ছড়িয়ে পড়ে দ্যুতি_রহমাতুল্লাহ খন্দকার

মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের কালো গেলাফ থেকে ছড়িয়ে পড়ে দ্যুতি_রহমাতুল্লাহ খন্দকার 
x










শেকড় সন্ধানী ইতিহাস গবেষক হিসেবে মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ইতোমধ্যেই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ‘কালো গেলাফ’ রচনার ভেতরে সাহিত্যের নিপুণ কারিগর হিসেবে মননশীল এই লেখকের রাজকীয় উপস্থিতি লক্ষণীয়। সাহিত্যশক্তির সবগুলো লক্ষণ এখানে সুস্পষ্ট। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতার দাবি যতটা প্রবল, ভাষার লালিত্য ও শিল্পবোধ সেখানে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এ গ্রন্থে আবদুল মান্নানের প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি চিত্রকল্প শিল্পবোধে উত্তীর্ণ। ইতিহাসের হিমাগারে পড়ে থাকা অমূল্য রত্নরাজি সাহিত্যরসে মধুর করে পাঠকের দুয়ারে তুলে ধরার এ এক অনন্য প্রয়াস। তার দক্ষ হাতের নিখুঁত বুনন ও জাদুকরি স্পর্শে  অতীত সরব হয়ে ওঠে, ইতিহাস হয়ে ওঠে আরো বাঙ্ময়। 
আবদুল মান্নানের সকল নির্মিতির মূলে এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম ও ইতিহাস-ঐতিহ্য ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। তার ইতিহাসচর্চার মর্মমূলে মানবিকতার নির্মল স্রোত বয়ে চলে অহর্নিশ। তিনি বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আলোকিত ধর্মচেতনা ও দার্শনিক মতবাদের ভেতরে সেই মানবিক মূল্যবোধ খুঁজে চলেন। সকল আলোকিত প্রান্তরে আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় নিজেকে বিছিয়ে দেন আর সঞ্চিত মুঠো মুঠো রোদ আপন মনে ছড়িয়ে চলেন দিনমানব্যাপী। তিনি সবকিছু দেখেন, আপন কুশলতায় রপ্ত করেন। কিন্তু নিজেকে সকল সঙ্কীর্ণতা ও গুষ্টিচর্চার ঊর্ধ্বে রেখে মানুষের কাতারে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হন।
আবদুল মান্নান ইতিহাসের নিবিড় পাঠ থেকে অনুধাবন করেছেন যে, সত্য ও সুন্দরের পক্ষাবলম্বন করা প্রকৃত মানুষের সহজাত গুণ। তার অভিজ্ঞায় আরো ধরা পড়ে যে, যুগে যুগে যত মহামানবের আগমন ঘটেছে তাদের জীবন ও কর্মের মাঝে একটি সাধারণ সাদৃশ্য ও অভিন্ন লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া যায়, আর তা হলো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গর্দানকে জোয়াল মুক্ত ও পিঠের বোঝা হালকা করা এবং মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শেখা। 
মানবিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব মানবজাতির দুঃখ-দুর্দশা, দ্ব›দ্ব-সংঘাত ও রক্তপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভ্রাতৃত্ব, সভ্যতা ও মানবতার উৎসের সন্ধানে আবদুল মান্নানের দৃষ্টি পড়ে পবিত্র মক্কা নগরীর ওপর। এর প্রতিটি ধূলিকণা অসংখ্য কীর্তিমান মহাপুরুষের পদচারণায় ধন্য। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানবতাবাদীরা মক্কা নগরীর এই মিলনমেলায় এসে মানবতার অভিন্ন পতাকাতলে সমবেত হয়ে ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করেছেন। আবার এই নগরীতেই অবস্থিত বিশ্বাসীদের স্মৃতির বন্দর, অস্তিত্বের ঠিকানা ও পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবা। মক্কা উপত্যকার ইতিহাস মানেই তো সভ্যতার শেকড়ে প্রবেশ। বাবা আদম এখানে ইবাদতের কেন্দ্র বানিয়েছেন। হাজেরা এখানে তার সন্তান লালন করেছেন। নবী ইবরাহিম কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেছেন। এ ঘর সারা দুনিয়ার ইবাদত, দাওয়াত ও হেদায়েতের কেন্দ্র। মানবিক সংস্কৃতির সেই মর্মমূলে বসে আমরা স্মরণ করি কাবার কাহিনী। 
‘কালো গেলাফ’ মূলত ভ্রমণকাহিনী-নির্ভর গ্রন্থ হলেও এতে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত নান্দনিক উপস্থাপনায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। লেখক কর্মজীবনের একটা সময় সৌদি আরবে কাটিয়েছেন। মক্কা, মদিনা, তায়েফ প্রভৃতি নগরীর রাস্তা-ঘাট তার চেনা। সবকিছু দেখেছেন সাংবাদিকতার চোখে। সংবেদী মন নিয়ে সবকিছু অবলোকন করেছেন। তিনি ভ্রমণের প্রতিটি রিডিং, প্রতিটি দর্শন ও পাঠের সার-নির্যাস গভীরভাবে আত্মস্থ করেছেন, বিশে¬ষণ করেছেন ইতিহাসের নিরিখে, তুলে ধরেছেন অনুভ‚তিপ্রবণ কথাসাহিত্যের জাদুতে আর অলঙ্কিত করেছেন কাব্যের মহিমায়। 
‘কালো গেলাফ’-কে একটি সংক্ষিপ্ত সিরাত গ্রন্থও বলা যায়। ইসলামের ইতিহাসের বহু ঘটনা ও স্থানের রঙিন বিবরণ সমৃদ্ধ এই বই। জোছনামুখর রাতে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা থেকে যে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময় সে আলোর ঝলকানি লক্ষ করা যায় এ গ্রন্থের শব্দে শব্দে। মক্কা, মদিনা, তায়েফ নগরীর অপূর্ব সৌন্দর্য, হজ্ব, ইবরাহিম, ইসমাইল, হাজেরা, হাজরে আসওয়াদ, আরাফার অপূর্ব দৃশ্য ভেসে উঠবে পাঠকের অন্তর্চোখে। বহু দেশ, জাতি ও ভাষাভাষী মানুষের অপূর্ব মিলনমেলা মক্কা নগরী। সেখানে বহু দেশের জ্ঞানী-গুণীর সাথে তার সাক্ষাৎ। আবদুল মান্নান তাদের হৃদয় সেঁচে তুলে এনেছেন অমূল্য মণিমুক্তা। বইটি পাঠে মনে হবে যেন পাঠক কোনো মিসরি কিংবা সুদূর আফ্রিকার কোনো মানবতাবাদী, হৃদয়বান মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছেন, লাব্বায়িক! আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক! আমি হাজির! হে আল্লাহ আমি হাজির! 
তায়েফের বর্ণনা পড়ে মনে হবে, পাঠক যেন উপনীত হয়েছেন রাসূলে খোদার বিষাদময় স্মৃতিঘেরা তায়েফ উপত্যকায়। সেখানে দেখা হয়ে যাবে তুর্কিস্থানের বাস্তুভিটা ছাড়া হতভাগ্য বহু বনি আদমের সাথে। তারা বলশেভিক বিপ¬বে যুলুমের শিকার। হঠাৎ করে দেখা হয়ে যেতে পারে ইমাম শামিল, হাজি মুরাদ কিংবা বোখারার মুহাজিরগণের সাথে।
কাবাদর্শনে একজন অনুরাগি-বিভাগি ও ভক্তপ্রাণ মানুষের  হৃদয়ের আকুলতা, প্রাণচাঞ্চল্য রূপায়ণের সার্থক শিল্পী আবদুল মান্নান। কাবার সম্মুখে দাঁড়ালে হৃদয়ে ঝড় বয়ে যায়, শিহরন জাগে অস্তিত্বমূলে। সে এক অন্যরকম অনুভ‚তি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে পরিমিত, মসৃণ ও কাশফুলের মতো কোমল শব্দ তুলে এনে অঙ্কন করেছেন সে হৃদয়ানুভ‚তি, আনন্দ-ক্রন্দন : আমি চেতনাহীন জড়বস্তুর মতো প্রবেশ করি প্রাচীন বাক্কা উপত্যকায়। কাঁদছি না। কাঁপছি না। স্বপ্নলীন, অন্য মানুষ। জনহীন পানিহীন নিষ্ফলা বাক্কা প্রান্তরে এখন মক্কা মুকাররমা। কাবার শহর। ওই! ওই তো হাতছানি দিচ্ছে হারামের মিনার! এক অদ্ভুত ঘোরের ভেতর মারওয়া গেট দিয়ে ছুটে যাই হারাম চত্বরে। লাব্বায়িক! আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক! ওই তো চোখের সামনে কালো গেলাফে মোড়ানো কাবা! পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড!’
কাবার গেলাফ কালো। এই কালো থেকেই ছড়িয়ে পড়ে জগৎময় আলো। এখানে বসেই মুসা-ঈসা পেলেন সত্যের পরিচয়।’ এই আলোতেই উচ্ছৃঙ্খল, বিশৃঙ্খল জাহিলি আরবের নরশার্দুলেরা পেয়েছিল মানবতার দিশা। সমবেত হয়েছিল সত্যন্যায়ের পতাকা তলে। আবদুল মান্নান অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সেই কলো গেলাফের আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নিলেন নতুন দিগন্তে পথচলার দৃঢ় প্রত্যয়ে। নিজেকে দেখি কালো গেলাফের আয়নায়। কী আমার পরিচয়? কিসে সাফল্য? কী আমার পুঁজি? আত্মজিজ্ঞাসায় ক্লান্ত আমি।
ভাববিন্যাসের ক্ষেত্রে লেখক ছোট ছোট বাক্যের সরলতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ছোট অথচ সমুদ্রের গভীরতায় রচিত প্রতিটি বাক্য যেন এক-একটি দীর্ঘ কবিতার মহিমা ধারণ করে। এটি কোনো কবিতার বই নয় কিন্তু কাব্যের মহিমায় উৎকীর্ণ। এ গ্রন্থের প্রতিটি চিত্রকল্প হৃদয় ছুঁয়ে যায়। যেন সবুজ ধানক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় দখিনা বাও। তার দোলা লাগে মহাসাধকের অন্তরে। পরিশীলিত ও সাবলীল রচনাশৈলীর স্মৃতিচারণমূলক ঘটনাপুঞ্জের আকর্ষণীয় উপস্থাপন সহজেই বোধের দুয়ারে আলো ছড়ায়, উদ্ভাসিত হয় হৃদয়-মন। প্রাণ নেচে ওঠে, মন ছুটে যায় সুদূর মক্কা, মদিনা, কুফা, দামেস্ক, বসরা ও বাগদাদে। তাই বলে লেখক ভুলে যাননি প্রিয় মাতৃভ‚মির কথা। তার এক চোখে যেন দজলা-ফোরাত আরেক চোখে পদ্মা-মেঘনা। তিনি মক্কা-মদিনার সাথে বাংলাদেশের পুরনো আত্মীয়তার সম্পর্ক তুলে ধরেন।
বোধের গভীর থেকে উৎসারিত আবদুল মান্নানের ভাষাশৈলী একান্ত তার নিজস্ব, সৃষ্টিশীলতার আনন্দে যা বাঙ্ময়, স্রতোস্বিনীর মতো গতিশীল, বেগবান ও স্বকীয় ধারায় পুষ্ট। প্রকৃতপক্ষেই শিল্পবোধে, সৃজনশীলতায়, কল্পনায়, অভিনবত্বে, শব্দের পরিমিত ও পরিশীলিত ব্যবহারে এ গ্রন্থ অনন্য। 
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাঘেরা এই অসাধারণ সাহিত্যকর্ম লেখককে স্মরণীয় করে রাখবে নিশ্চয়। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, ভাষার নিপুণ গাঁথুনি ও নান্দনিক বাক্যবিন্যাসের শৈল্পিক সৌন্দর্য বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। 
সবুজপত্র থেকে প্রকাশিত ২৪৮ পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপার ‘কালো গেলাফ’ বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সবিহ্-উল আলম। মনোরম বাঁধাইয়ে সুখপাঠ্য বইটির মূল্য দুইশত আশি টাকা মাত্র। বইটি পাঠ করে পাঠক আত্ম-আবিষ্কারের সুখ অনুভব করবেন বলে আমার বিশ্বাস। বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার প্রত্যাশা করছি।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.