লেখকের স্বাধীনতা_মতিন বৈরাগী
একটা ডামাঢোলে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্য নিপতিত হয়ে ভিন্ন সমাজবাস্তবতার সংগে হেরে যাবার ফাঁদে পড়েছে। আবার কিছু কিছু লেখক সমাজতান্ত্রিক সমাজেও আদর্শকে বিশ্বাস না করেই এক ধরণের স্তবস্তুতির শিল্পসাহিত্যের প্রহসনে মেতে সুবিধা নিয়েছে যা অনগ্রসর সমাজে এমনকী ধনতান্ত্রিক সমাজে বা আমাদের মতো পশ্চৎপদ সমাজেও বিদ্যমান।এরা শ্রমিকের জীবন চিত্রায়ন করেছে শ্রমিককে না জেনেই, বা এমন বিষয় নিয়ে যা কেবলমাত্র তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে জোকের মতো কিভাবে লেপ্টে আছে, তা জানতে না চেয়েই। কেবল মাত্র নেতার স্তুতি গেয়েছে পাবার লোভে। তাতে সাহিত্য বা সৃষ্টির যে কী ক্ষতি হয়েছে তা রাশিয়ার শিল্পসাহিত্যে প্রতিফলন ঘটছে।আমাদের সাহিত্যেও প্রকট হয়ে আছে।ফলে আর আসেনা দস্তয়ফস্কি, আসেনা গোগল, নেই পুশকিন। কিম্বা ২০ শতকের বরিসপস্তারনক, অস্ত্রয়ভস্কি, নিকোলাই সলোখভ। তলেস্তয় তো যুগে যুগে আসেনা, সে আসে জনগণের প্রকৃত চাহিদার মধ্যদিয়ে, যেমন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, জার্মান সাহিত্যে গ্যোতে, ফরাসী সাহিত্যে বালজাক, হুগো, ইংরেজি সাহিত্যের মিলটন প্রমূখের এর মত মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণের কেউ। মূলত সাহিত্যশিল্প কেবল মাত্র কোনো একটি সমাজের কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য নয়, বরং যেরকম একটা সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে বিরাজমান সকল শ্রেণিগুলো অস্তিত্বমান, সাহিত্যশিল্পও সমাজের সকল শ্রেণিগুলোর জন্যই দ্বন্দ্ব সংঘাত নিয়েই সৃষ্টি। তাই শিল্প সকলের জন্য। উদ্দেশ্যবিহীন অবশ্যই নয়। এখন কোন উদ্দেশ্য সাহিত্যে শিল্পকলায় লেখক শিল্পীরা প্রতিফলিত করবেন সেটা নির্ণয় দরকার। বাস্তবটা হচ্ছে প্রত্যেক লেখক তার কালের তার শ্রেণির দৃকভঙি থেকে মনষ্ক হয় সৃষ্টির জন্য। সেখানে শ্রেণি ভাঙার মধ্যদিয়ে নতুন সমাজে প্রবেশের যে অঙ্গিকার একজন শিল্পী-লেখকের থাকে তার দৃষ্টিভঙি কেবলমাত্র তখনই বদলাতে পারে যখন সে সচেতন হয়ে সৃজনে নিমগ্ন হয়। তার স্বপ্ন যদি স্পষ্ট জীবনচেতনে চেতনাপ্রাপ্ত না হয় তা হলে তার বিষয়টিও সে ভাবে আলোকিত হয়না এবং রূপকাঠামোতেও একধরণের ‘টাইপ’ তৈরি হবে,মহৎ হয়ে ওঠার সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে।
অন্যদিকে এই জীবনচিত্র যদি চলমান সমাজ গ্রহণ না করে, কিংবা রাষ্ট্র তার স্বার্থক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মনে করে রক্তচক্ষু দেখায় বা এমন কোনো দৃশ্যসৃষ্টি ঘটে যে সমাজের অগ্রগতি কাঠামোর প্রেক্ষাপটে দূর, ধর্মদর্শনআইন চিন্তায় তা সংঘাতের সৃষ্টি করে, তা হলে লেখকশিল্পীর স্বাধীনতার তল সীমিতই হয়ে পড়ে। কারণ রাষ্ট্রেরও ধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার চরিত্রানুযায়ী। লেখক তার দৃষ্টিকে কেবল সমকালেই সীমাবদ্ধ রাখেন না, সে যেমন অতীতকে অভিজ্ঞতা করে বর্তমানে দাঁড়িয়ে লেখে, লেখে বর্তমানের বিবর্তিত আগামীর রূপ তখন তার বিষয়গুলোও রূপলাভে নতুন কাঠামো দাবী করে, তা পুরণে প্রয়োজন হয়ে পড়ে স্বাধীনতা, কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্র তা দিতে অক্ষম। সে ক্ষেত্রে সাহিত্যপরিসর সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং গতানুগতিক শিল্পসাহিত্য তৈরি হয় যা সময়কে অতিক্রম করতে পারেনা। আবার ভোক্তা হিসেবে পাঠকমন যদি থাকে আচ্ছন্ন চেতনাহীন তা হলে তারা নতুনকে গ্রহণ করতে পারেনা এমন অবস্থায় লেখকশিল্পীর স্বাধীনমন সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ হয়ে আবদ্ধতারই প্রকাশ ঘটায়।কারণ লেখক শিল্পী সমাজেরই মানুষ, যদিও সংবেদনশীল কিন্তু অভ্যেস রুচি ও মনস্কতায় সমাজেরই একজন। গ্রীক সাহিত্য শিল্প যে সে কালে বিকশিত হয়েছিল তা ওই সমাজের কোনো উন্নততর রূপের জন্য নয় বরং সমাজ চাহিদাকে সামনে রেখে বিষয় ও রূপের সমন্নয় ঘটেছিল বলে। তলেস্তয় তার ‘শিল্প কী’ বইয়ে শিল্পসাহিত্যকে গণমূখি করার কথা বলেছেন এবং সমাজচিত্রটি স্পষ্টতর করে সৃষ্টির পক্ষে থেকেছেন। সে কারণে স্বাধীনতা পেতে হলে ক্ষমতাবানদের মোহ ত্যাগ ও দলবাজি অবশ্যই পরিহার্য।এবং রাষ্ট্র শক্তিরও উচিৎ ভালো সাহিত্যের জন্যে ভালো সৃষ্টির জন্য লেখকশিল্পীকে দলবাজি থেকে মুক্ত রাখা।
যদিও এই কথাগুলো এমন সরল রেখায় টেনে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না যে শিল্প-সাহিত্যে শিল্পী বা লেখকের কোনো দায় নেই, তারা স্ব-সাম্রাজ্যের স্বাধীন ব্যক্তি, তাদের সৃজনশীল কাজে কোনো রাজনৈতিক মতবাদ, চিন্তা যুক্ত করবেন না কেবল ধনতন্ত্রের সেবাদাসে পরিণত হয়ে সৃষ্টির জগতে বিরাজ করবেন, সে তাদের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিলেও কতখানি স্বাধীনতা তারা ভোগ করতে পারেন এমন প্রশ্নটি তোলা কোনো অন্যায় বা অপ্রাসংগীক হবেনা। কারণ সমাজ যেমনই হোক ধনতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক মতের একজন ব্যক্তি বেশির পক্ষেই তার সৃজন কর্মকে সেবা প্রবণ করে তুলবেন তার রূপকাঠামোর বিকাশের জন্য, তার মানুষের প্রতি দায়-দায়িত্ব বোধ থেকে, তার জীবন বোধ সেই স্বপ্নের কথাই বলবে যা তার সমাজের জন্য মানবিক এবং কল্যাণকর। এখানে চেতনা জাগৃতির কাজটাই মুখ্য এবং এরজন্যই প্রয়োজন স্বাধীনতা। কারণ যা তিনি ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন তাতে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধতা আছে।
ভৌগলিক স্বাধীনতা এখানে কিছুটা ক্রিয়া করলেও অন্যান্যের মতো একজন লেখকশিল্পীর স্বাধীন সত্তার বিকাশ কেবল মাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতার উপর নির্ভর করেনা, করে সমাজ ও রাষ্ট্র কতোখানি তা সহ্য করতে পারবে বা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। যদি সমাজ মানবিক বিকাশে অসমর্থ হয় বা চেতনা লুপ্ত হয়, যদি রাষ্ট্র স্বৈরাচারী মনেবৃত্তিতে তা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং মানুষকে আরো নিগ্রহের মধ্যে ফেলে তা হলে সামাজিক সুবিধাগুলো সংকুচিত হয় এবং শাসকের অন্যায় মনেবৃত্তিগুলো সব কিছুকে গ্রাস করার সাহস দেখায়। সেখানে প্রথমেই তারা খর্ব করে লেখক শিল্পীর প্রকাশের প্রবহমান বৃত্তিকে কারণ সে মনে করে এই প্রকাশ জনগণকে ভিন্নমাত্রায় সংযোজিত করবে এবং তার আবদ্ধ চেতনাকে আলগা করে দেবে। তখন শাসক শ্রেণি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে প্রয়োজনে ভিন্নপন্থা অবলম্বন করে প্রকাশকারীর উপর চাপ তৈরি করে এবং এমনকী তার জীবন সম্পদ ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। সংগত কারণে সৃজনশীলতায় একধরণের আরষ্টতা নেমে আসে।
যদিও আমরা পশ্চিমের সমাজকে কতকটা মূক্ত এবং লেখক শিল্পীদেরকেও মূক্ত ভেবে তাদের সৃষ্টিকে উৎসাহব্যঞ্জক, অনুসরণের চেষ্টা করি, আসলে সেখানেও রয়েছে আরেকধরনের বিপত্তি। পশ্চিম ধনতন্ত্রের চূড়ান্ত বিকৃতিতে প্রবেশ করে শ্রেণি সংকট তীব্র করে তুলেছে। সৃজনশীল কাজ এখন আর তাদের সমাজে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা পায় না।সেখানেও মানুষ পুুঁজিবাদের থাবায় সংকুচিত ও যন্ত্রমানবে পরিণত হচ্ছে। ফলে সামাজিক হতাশা তীব্র হয়ে উঠেছে এবং লেখকশিল্পীরা সেই সংকটের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। এরকম অবস্থায় হাল্কা চটুল সাহিত্যশিল্পই হয়েছে এখন তাদের মৌলিক। ফলে ট্রাস জাতীয় সৃষ্টিই সেখানের মানুষের চাহিদা । বিশ শতকের প্রারম্ভিক দিকে তাদের সৃষ্টিতে জাতীয় চাহিদার যে উপস্থিতি ছিল আজ তা অনুপস্থিত। তারা তাদের ঐতিহ্যকেও বিকৃতির দিকে নিয়ে গেছে। মোটামুটি একটা অরাজক অবস্থার মধ্যে সৃষ্টি নিপতিত হয়ে নানা তত্ত্বের ঘোরে কুল খুঁজছে। কিন্তু কোনো তত্ত্বই স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। সেদিক থেকে লাতিন ভিন্ন মুখ তৈরি করে ইয়োরোপের বাজারে উঠে গেছে, তারা তাদের ঐতিহ্যকে নতুন নিয়মে সাজিয়ে তুলে আনছে সেই সমাজ চিত্র যা ইতিপূর্বে ঘটে গেছে এবং তার রেশ আজো তারা বহন করছে যার মধ্যদিয়ে উঁকি দিচ্ছে তাদের আগামী সমাজাকাঙ্ক্ষা।
বস্তুতো সমাজ নানা ভাঙাগড়ার মধ্যদিয়ে এগুচ্ছে। শিল্পীসাহিত্যিককে অনড় হয়ে পুরানোর দিকে মুখ করে থাকলে চলবেনা। সমাজকে বুঝতে হবে, সমাজকে পড়ে, পরিবর্তনগুলোকে অনুধাবন করতে হবে নির্লোভ নিরাসক্ততায়, এবং সমাজ চাহিদাকে মূল্যদিয়ে বিষয়কে নির্বাচন করতে হবে। বিষয় যথাযথ নির্বাচিত হলে রূপটি সৃজনশীল ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে । যদিও রূপ কখনও কখনও বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তারা পরস্পর পরস্পরের লগ্ন। সেখানেই হলো কোনো ব্যক্তির প্রকাশের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। একজন বর্তমানের স্তুতিতে যদি মগ্ন থাকে এবং প্রাপ্তি যদি তার মোক্ষ হয় সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতা প্রশ্নটি তার তো দরকার পড়েনা কারণ সে তো স্তুতির জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে আর তাতো শাসকের জন্য নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ। শাসকও ওই লেখকদের উৎসাহ দেয়, খানাপিনার ব্যবস্থা করে, কারণ গৃহপালিতের তো তাই দরকার। এভাবে শাসক লেখকশিল্পীর চরিত্রকে বদলে দেয় যার কোনো নিজস্ব সাম্রাজ্য নেই।
শেকসপীয়র,গেটে,সারভানতেস,বালজাক,পুশকিন এইরকম আরো অনেকে যে সৃজনশীল কাজে জগৎবিখ্যাত হয়ে আছেন তা স্তুতির সাহিত্য বা শিল্পকর্ম-এর জন্য নয়, তা ছিল তৎকালের সামাজিক চাহিদাকে সৃষ্টির সংগে যুক্ত করা, যেহেতু সমাজের বিবর্তনের রূপ বদল ঘটলেও বদল ঘটেনি সমাজ অস্তিত্বের মূল চেহারাটার। কিন্তু সৃজনসম্পৃক্তরা তার মৌলিক ধারাগুলো অনুধাবন না করে অস্থির প্রবণতাগুলোকে উপজীব্য করে সৃজনে সম্পৃক্ত রয়েছেন ফলে একদিকে তাদের স্বাধীনতা যেমন তেমন কোনো দরকারী নয়, তেমনি তারা যে আবদ্ধতায় আছে তাও অনুধাবনে তারা সক্ষম নয়। অথচ একজন ভালো উপন্যাসিক যেমন সমাজচিত্র তৈরি করে নিখূঁতভাবে রাজনৈতিক চেহারাটার মুখোশ উন্মোচন করতে পারেন, তেমনি একজন রাজনীতিবিদও পারেন না।একজন সাহিত্যিক যেমন করে সমাজটা জানেন তেমন রাজনীতির কোনো ব্যক্তিও জানেন না। এই সত্য শিল্পী-সাহিত্যিকরা উপলব্ধি করতে পারলে স্বাধীনতার প্রশ্নটি তার কাছেও পরিমানগত ও গুণগতরূপে ধরা দেবে ।
তাই একজন সৃজনশীল মানুষকে প্রথমেই ভাবতে হবে, যে বিষয়ে তিনি লিখবেন সেই বিষয়ের বাস্তবতা কি ভাবে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বা আবৃত রয়েছে নানা ষড়যন্ত্রকারী শক্তির কাছে। আর তার সমাধানটাইবা কি, সে কি মানুষ, না কি কোনো দেবতার আশির্বাদ। এই বিষয়টি পরিস্কার হলে সৃজনে তার অন-উন্মোচিত দিকগুলো উন্মোচিত হবে। কারণ সৃষ্টি মূলত চেতনা বিকাশের পরম্পরাকে মান্য করে। পতিত সত্তার পক্ষে সমাজকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়, কারণ তার মনে ও জাগরণে রয়েছে প্রাপ্তির লোভ। লোভ থেকে ভালো কিছু তৈরি হতে পারেনা। সে কারণে মোহমুক্ত হয়ে সৃষ্টিতে গভীর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন সকলের আগে। যদিও তা খুব সহজ কাজ নয়, কঠিনই। আর কঠিনেরে ভালো না বাসলে তো কিছুতেই লাভের কোনো পথ পাওয়া যাবেনা।অথচ সাহিত্যের নামে সেই সব ব্যক্তিবর্গকে মহা দাপটে আমাদের চারদিকে দেখছি।
তারপরেও বলতে হবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারীতা নয়। সৃজনের স্বেচ্ছাচারিতাও সমাজ বৃত্তিকে কলুসিত করে, তার বিরাজমান সুন্দর যা তার ঐতিহ্যের অংশ তাকেও ক্ষীণ করে। সে কারণে সাহিত্যিক বা শিল্পীর দায় আছে আর তা একজন রাজনীতিকের চেয়েও অনেক বেশি। অধিকারের সংগে কর্তব্যের ও যোগ আছে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments