রোহিঙ্গা সঙ্কট : জাগ্রত বিবেকের হাতছানি_ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান

 
বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার (সাবেক বার্মা)-এর আরাকান, বুড়িং, সীমান্ত শহর মংডু ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ঘরবাড়ি-মসজিদ-ব্যবসাকেন্দ্র দাউদাউ করে জ্বলছে, নিরাপরাধ-নিষ্পাপ মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা-প্রতিবন্ধী কেউ-ই হায়েনার নখর থেকে বাদ পড়ছে না। তাদের অপরাধ তারা মুসলিম! আর যারা হত্যা করছে, তারা গৌতম বুদ্ধের অনুসারী [জীব হত্যা মহাপাপ যাদের ধর্মগুরুর আপ্তবাক্য]। বৌদ্ধধর্মের প্রখ্যাত নেতা দালাইলামা মিয়ানমারের বৌদ্ধদের এ স্বৈরাচারী ও সহিংস আচরণ নিবৃত করতে গৌতম বুদ্ধকে আবার ধরাধামে জন্মগ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান ও বৌদ্ধরা মিলেমিশে এখানে শান্তিতে বসবাস করেন। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এখানে কোনো জাতিগত সংঘাত নেই। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সুচি সরকারের সমর্থনে সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা মুসলিম জনগোষ্ঠী নিধনে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ১৯৩৮ সালে তারা সর্বপ্রথম মুসলিম নিধনে নিমগ্ন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বার্মার উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বার্মা দখল করাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক হারে মুসলমানদের হত্যা করে। ১৯৬২ সালেও এই হত্যাকা- দ্বিতীয়বার সংঘটিত হয়। তৎকালীন শাসক জেনারেল নেউইন মুসলমানদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার হরণ করেন। সে সময় থেকে জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে সহায়-সম্পদ পিছে রেখে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আগমন করতে থাকেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ১৯৭৮ সালে দুই লক্ষাধিক আরাকানী মুসলিম বাংলাদেশে আগমন করেন। রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয়। ফলে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তাদের আরাকানে প্রত্যাবাসন শুরু হয়। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা জীবনের নিরাপত্তা বিধানে স্বদেশভূমি ত্যাগ করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সেই ধারা বর্তমান কাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু অবস্থান করছেন।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ভ্রাতৃপ্রতিম রোহিঙ্গাদের সমস্যার ব্যাপারে অবগত এবং তাদের প্রতি দয়ার্দ্র। রোহিঙ্গারা বর্তমানে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্নরাষ্ট্রে বৈধভাবে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন যাবৎ তারা নিজ বাসভূমে পরবাসীর জীবন-যাপনে নিষ্পেষিত। সমাজে চতুর্থ শ্রেণির নিচে তাদের অবস্থান। তাদের যৎসামান্য জমি-জমা, ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, তা দখল করে নেয়ার হীন মানসে গত বছর থেকে থেমে থেমে, নীরবে, সরবে মুসলিম নিধন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ চলমান বছরের আগস্ট মাসের শেষ দশক থেকে রোহিঙ্গা নামক নিষ্পাপ ও নিরীহ জনতার ওপর ওই সন্ত্রাসীদের অত্যাচারের নির্মম রোলার পরিচালিত হচ্ছে।
আশ্চর্যজনক ইতিহাস হলো ১৯৪৮ সালে অং সান সুচির বাবা জেনারেল অং সান মুসলমানদেরকে বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মকা-ে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। ২০১৬ সালে এসে জেনারেল অং সানের কন্যা কথিত শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচি আরাকান অঞ্চলের মুসলমানদের নাগরিক ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে জাতিগত নিধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। শান্তিতে যিনি নোবেল লোরিয়েট, তিনি কি নৃশংসভাবে মানুষ হত্যার বলীখেলায় সমর্থন দিতে পারেন? তার সামনে হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার দৃশ্য সংঘটিত হলেÑ তিনি তা বন্ধ না করে কীভাবে সাফাই গাইতে পারেন?
মুসলিম বিশ্বের অহঙ্কার, এ যুগের নকিব তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান অত্যন্ত কঠোর ভাষায় অং সান সুচি ও বার্মার সামরিক প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, চেচনিয়ার সরকার মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চেচনিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র বিশ্বের শান্তিকামী স্বাধীন নাগরিকগণ মিয়ানমারের জাতি নিধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বার্মার নিরীহ জনগণের জান-মাল রক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা পালন করছে না। অথচ জাতিসংঘের সুস্পষ্ট বিধানে মানবিক অধিকার হরণকে জঘণ্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চিন ও থাইল্যান্ড বৌদ্ধধর্মের অনুসারী দেশ হিসেবে মিয়ানমারকে এ অপরাধ থেকে সরে আসার ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা না করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে আরাকানের মুসলিম জনগণকে হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তি চিন। তারা মিয়ানমারের অন্যায় কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর’১৭ তারিখে এক বিবৃতি প্রদান করেছে। চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পোং শুয়াং বলেছেন, ‘তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় মিয়ানমার সরকারের পাশে আছে। মিয়ানমার সরকার তাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার যে চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তার পাশে থাকা।’ জাতিসংঘের কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থা রয়টার জানিয়েছে, রোহিঙ্গা সঙ্কটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোনো মাথা গলাক, সেটা চিন চায়না। চিন-প্রশাসনের উপরিউক্ত মতামত বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। আজ চিন যদি উত্তর কোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন তার অবস্থা কী হবে? চিন, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানগণ ইচ্ছা করলে এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে পারেন, কিন্তু তারা তা না করে সেখানে মদদ ও উস্কানি দিচ্ছেন। সব শিয়ালের এক রা’। মুসলমানদের হত্যা করো এবং তাদের সম্পদ নিজেদের দখলে নাও- এই হলো মূলনীতি। জাতিসংঘ, ওআইসি সেখানে নিদ্রামগ্ন, তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে বড়ই সমস্যা। পৃথিবীর সব ঘৃণা একত্রিত করলেও এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। ধিক্কার জানাই এ নোংরা রাজনীতিকে। মানুষের জয় একদিন হবেই। বিদূরিত হবে দুঃশাসন আর অপশাসন।
বাংলাদেশ সরকার ও শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ উদ্বাস্তু-উন্মূলিত আরাকানের আট লাখ নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে মানবিক দৃষ্টিতে গ্রহণ করে তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও অবস্থানের ব্যবস্থা করছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের নিরীহ জনগণকে আশ্রয় দিয়ে যে উদারতার নজির স্থাপন করেছে, তা বিরল। বিশ্ববাসীর উচিত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো এবং এসব শরণার্থীকে নির্বিঘেœ স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতা করা।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ও নিগৃহীত এসব জনগণ আজ ‘রিফিউজি’ নামে চিহ্নিত। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন [ইউএসএইচসিআর] এর ত্রাণ ও সাহায্য এখনও এসব শরণার্থীদের মাঝে পৌঁছেনি। রোদ-বৃষ্টির মধ্যে এখনও তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ওই আকাশের ছাদ। সুনির্দিষ্টভাবে এখনও তাদের আহারের যোগাড় হয়নি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় :
০১.    ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করা।
০২.    জাতিসংঘের কাছে রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থার সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করা।
০৩.    বিশ্বের মুসলিম ও অমুসলিম সব রাষ্ট্রকে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হত্যা, ধর্ষণ ও ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনাসমূহ অবহিত করণ ও মিয়ানমারের প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন।
০৪.    রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন বন্ধের প্রতিশ্রুতি আদায় করা।
০৫.    নিরীহ জনগণকে স্বদেশে নির্বিঘেœ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা।
০৬.   মিয়ানমার সরকার যদি এসব উদ্বাস্তু জনগণকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ না করে,  তাহলে তার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করা।
০৭.    মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যতদিন বাংলাদেশে অবস্থান করবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা নির্বিঘœকরণে টঘঐঈজ এর ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা। ওআইসিসহ মুসলিম বিশ্বের ধনাঢ্য রাষ্ট্রগুলির আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের জনগণকে সামর্থ অনুযায়ী আর্থিক সাহায্য প্রদানে উৎসাহিত করা।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.