আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান

১০ জুন ২০০৯ বুধবার
 
২০০৯ সনের ১০ জুন বুধবার আমার ও আমার স্ত্রীর বিদেশ যাবার কথা। ঐ দিন ভোর চারটায় টেলিফোনের শব্দে আমার ও আমার স্ত্রী খালেদা বেগম- দু’জনেরই ঘুম ভাঙলো। বড় মেয়ে সুমাইয়া রহমান আমেরিকা থেকে টেলিফোন করেছে আমরা এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হয়েছি কিনা, তা জানতে। সুমাইয়ার টেলিফোনের শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙলো। আগের দিন রাতেই আমার স্ত্রী মালপত্র সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। সময়মত আমরা এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হবো। সুমাইয়াকে সে  কথা বলে আমি ওজু করে মসজিদে গেলাম ফজরের নামাজ আদায় করতে। পৌনে পাঁচটায় ফযরের জামায়াত। নামাজ শেষে ইমাম সাহেবকে জানালাম-আজ আমি লন্ডন যাচ্ছি। সেখান থেকে আমেরিকা ও দুবাই হয়ে ইনশাল্লাহ দেশে ফিরবো। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে দোয়া চেয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
ঘরে এসে এখানে-ওখানে প্রয়োজনীয় দু’চারটি টেলিফোন করার কাজ সেরে নিলাম। তারপর শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি গোছ-গাছের পালা। গত কয়েকদিন ধরেই আমার স্ত্রী সবকিছু গোছ-গাছ করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তবু শেষ মুহূর্তেও কিছু কাজ বাকি থাকে-সেটা চলতে থাকল।
সকাল ৬:৩০ মিনিটে ড্রাইভার এলো। তাকে দিয়ে কাজের মেয়ে জেলাকে পাঠালাম বাস-স্ট্যান্ডে। আমরা যতদিন বিদেশে থাকবো ততদিন সে তার বাড়িতে ছুটি কাটাবে। ওকে বাসে তুলে দিয়ে গাড়ি ছোটমেয়ে আফিয়ার বাসায় রেখে ড্রাইভার ফিরে এলো। ড্রাইভারের দেনা-পাওনা মিটিয়ে এক হাজার টাকা অতিরিক্ত দিয়ে তাকে বিদায় করলাম।
সকাল পৌনে আটটায় আফিয়া এলো তার গাড়ি নিয়ে। ঐ গাড়িতে মাল-পত্রসহ আমরা উঠে পড়লাম। ঠিক আটটায় গাড়ি রওয়ানা হলো এয়ারপোর্টের দিকে। গাড়ির ড্রাইভার শাহজাহান খুব পাকা ড্রাইভার। সে আমাদের নিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জে চলে গেল। সেখানে বিমানের অফিসার রায়হান ও আরো একজন অপেক্ষা করছিল। তারা আমার ছোট মেয়ে জামাই স্কোয়াড্রন লীডার মইনুল হকের সহকর্মী। ছোট জামাই তাদেরকে আমাদের কথা আগেই বলে রেখেছিলো। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রায়হান আমাদের নিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জের মধ্য দিয়ে Check-in counter এ চলে গেল। অন্যজন আমার মালপত্র নিয়ে গেল চেক-ইন করাতে।
রায়হান আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে রেখে সব মালপত্র চেক-ইন করিয়ে আমাদের দু’জনের Boarding Card এনে আমার হাতে দিল। সবকিছু খুব সহজে ও অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হলো।
কাউন্টারে চেক ইন সেরে আমরা ভিতরে প্রবেশ করালাম। রায়হান আফিয়াকেও আমাদের সাথে নিয়ে বসবার ব্যবস্থা করলো। বিমানের EK5 দুবাই থেকে আসতে একটু দেরী করলো। ফলে সাড়ে দশটার বদলে এগারোটায় বিমান ছাড়লো। বিমানে ওঠা পর্যন্ত রায়হান আমাদের সাথেই ছিল। আমাদের কোথাও যেন এতটুকু কষ্ট না হয়, সেদিকে সে সবসময় নজর রাখছিলো। অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী ও কর্মনিষ্ঠ অফিসার। তাই এয়ারপোর্টে আমাদের কোন ঝামেলাই পোহাতে হয়নি।
প্লেনে আমাদের নির্দিষ্ট সীটে বসে সীট বেল্ট বেঁধে নিলাম আমরা দু’জন। কিছুক্ষণ পরই এমিরেটস এয়ার লাইন্সের এয়ারবাসটি নড়াচড়া শুরু করলো। ধীরে ধীরে অনন্ত নীল মেঘমুক্ত আকাশের দিকে উঠতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডানা মেলে বিমান আকাশে উড়তে লাগলো। মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই আমরা বাংলাদেশের নদী-নালা পরিবৃত সবুজ অঞ্চল পেরিয়ে ভারতের এলাকায় প্রবেশ করলাম। বিমানবালারা এসে আমাদের নানারূপ নরম পানীয় পরিবেশন করে গেল। ওগুলো খাওয়া শেষ করতেই তারা দুপুরের খাবার নিয়ে এল। ভাত, মুরগী, সবজি ও কিছু মিষ্টান্ন। রুচিসম্পন্ন, পরিমিত সুন্দর খাবার। পরিতৃপ্তির সাথে খেলাম। এমিরেটসের খাবারের সুনাম আছে। আমরা সেটা উপলব্ধি করলাম। দুবাই-ঢাকা রুটে এমিরেটস এয়ার লাইন্সের ইনঅগুর‌্যাল ফ্লাইটে আমি বিনা ভাড়ায় একটি রিটার্ন টিকিট পেয়েছিলাম। আমি তখন দুবাই চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদক পদে কর্মরত। সেখানকার যে কয়জন বাংলাদেশী নাগরিক সে ইনঅগুর‌্যাল ফ্লাইটে টিকিট পেয়েছিল, আমি তাদের অন্যতম। সে সময় থেকেই আমি প্রায় প্রতি বছর একবার এরিরেটস-এ ভ্রমণ করেছি, যতদিন দুবাই ছিলাম। তাই এমিরেটস-এর মান সম্পর্কে আমার মোটামুটি ধারণা আছে।
প্রায় পৌনে পাঁচ ঘন্টা আকাশে ওড়ার পর বিমান দুবাই এয়ারপোর্টের মাটি স্পর্ষ করলো। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললাম। বিমান থেকে নেমে ট্রানজিট লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়লাম। দুবাই বিমান বন্দর অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একটি মনোরম স্থান। ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে সারা পৃথিবীতে একমাত্র আমস্ট্যার্ড বিমান বন্দরের পরেই দুবাইর স্থান। লোকাল টাইম ৩.৪৫ মিনিটে আমাদের প্লেন আবার লন্ডনের দিকে যাত্রা শুরু করবে। আমার বড় ছেলে জাহিদ এখন সপরিবারে দুবাই থাকে। আমি তার সাথে টেলিফোনে কথা বললাম। দুবাইতে আমার নাতি আফনানের খবর নিলাম। আমাদের ভ্রমণ-সংক্রান্ত সিডিউল জাহিদকে জানালাম এবং তাকে বললাম আমেরিকায় আমার বড় মেয়ে ও ছোট ছেলেকে আমাদের খবর জানাতে। আমরা প্রায় দু’ঘন্টা দুবাই বিমান বন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জে অপেক্ষা করে তারপর যথাসময়ে কাউন্টারে চেক-ইন করে আবার এমিরেটস-এর বিশাল প্লেনে আরোহণ করলাম। বিমানে বসে সীট বেল্ট বেঁধে নিলাম। প্লেনে আমাদের পাশের সীটটি খালি ছিল। তাই খানিকটা আরামে শুয়ে-বসে আমরা দু’জনে লন্ডনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার প্রস্তুতি নিলাম।
লন্ডন রুটে এমিরেটসের সার্ভিস আরো উন্নত মানের মনে হলো। খাওয়া-দাওয়ার মান আরো ভাল। বেশ পরিতৃপ্তির সাথে খেলাম। দীর্ঘ সাত ঘন্টা পাঁচ মিনিটের পথ। তাই দু’-তিনবার উঠে পায়চারি করলাম। পালাক্রমে দু’জনে কিছুসময়ের জন্য শুয়ে পড়লাম। আমাদের ডান পাশের সীটে তিনটি ছোট বাচ্চা অবিরাম হৈ চৈ-কান্নাকাটি করাতে আমাদের ঘুম হলো না। কিন্তু লম্বা হয়ে কয়েক ঘন্টা শুয়ে কাটানোর ফলে অনেকটা আরাম বোধ করলাম। রাত আটটা বিশ মিনিটে আমরা নিরাপদে লন্ডন হিথ্রো বিমান বন্দরে উপনীত হলাম। প্লেন থেকে নেমে দীর্ঘপথ হেঁটে Immigration counter-এ এসে লাইন লাগালাম। লম্বা লাইন। তবে অবিশ্বাস্য কম সময়ে সবকিছু Clear হলো। Immigration officer-এর নিকট আমি দাঁড়াতেই তিনি আমাকে শুধু দু’টো প্রশ্ন  করলেন ঃ
‘‘Who is your Sponsor?’
‘How long you will stay here?’’
উত্তরে আমি আমার Sponsor-এর চিঠি দেখালাম এবং বললাম আমি দশ দিনের বেশি থাকবো না।
আমার উত্তর শুনে তিনি আমাদের পাসপোর্টে ত্বরিৎ সীল মেরে পাসপোর্ট দু’টি আমার হাতে দিয়ে বললেন, Wish you goodluck. Ok. Go, have a good time.
Immigration Check up-এর নিচের তলায় নেমে নির্দিষ্ট স্থান থেকে খঁমমধমব সংগ্রহ করলাম। তারপর Luggage দিয়ে অর্থাৎ Nothing to Declare লাইন দিয়ে তরতর করে আমরা দু’জনে হেঁটে যাচ্ছিলাম। গেটেই এক মহিলা এসে জিজ্ঞাসা করলো, ‘Anything illigal?’
বললাম ঘড়.
তারপর জিজ্ঞাসা করলো, ‘You have cigarretes?’
বললাম, No. I am not a smoker.
এরপর আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘You have wine?’
বললাম, No. I dont drink
এরপর সে মালপত্র Screenig-এ দিল। তাকে সাহায্য করতে তার আরেকজন সহকর্মী এগিয়ে এল। সে আমার বড় সুটকেসটা হাল্কাভাবে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘What is, inside the box, so heavy?’
বললাম, ভিতরে বই-পুস্তক আছে। আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং লেখক। আমার নিজের লেখা কিছু বই আছে এতে । সে বললো, ‘Religious books?’
তার প্রশ্ন থেকে বুঝতে পারলাম, ‘Religious books?’ বলতে মূলত সে ইসলামী গ্রন্থ বুঝাচ্ছে, যে সম্পর্কে তারা শংকিত। আমার মুসলিম নাম ও চেহারা-সুরত দেখেই তাদের মনে এ প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে বলে আমার মনে হল। মূলত আমার সাথে কোন ধর্মীয় গ্রন্থ ছিলনা। অবশ্য সাধারণভাবে ধর্মীয় গ্রন্থের ব্যাপারে তাদের কোন আপত্তি নেই। কেবল ইসলামী গ্রন্থের ক্ষেত্রেই তারা শংকাগ্রস্ত। তাই বললাম, না, সাহিত্য-বিষয়ক কিছু গবেষণামুলক গ্রন্থ। সে তখন ঐ মহিলাকে ডেকে বললো, ‘Look, this is too heavy to bring it up. He said it contains books, I belive him. Ok’ মহিলাও ঘাড় নেড়ে বললো, Ok. তারপর আমাদেরকে যাওয়ার Signal দিলো। আমরা বিশেষ কোন ঝামেলা ছাড়াই বেরিয়ে এলাম।
বাইরে বের হয়ে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। অসংখ্যা মানুষ আসছে এবং যাচ্ছে। কাউকে চিনি না। কোন রাস্তা  কোনদিকে গেছে, কিছুই জানি না। আমরা অপেক্ষা করছি। মাওলানা আবু আহমদ হিফজুর রহমান এসে আমাদেরকে তার বাসায় নিয়ে যাবার কথা। তিনি টেলিফোনে বলেছিলেন, এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই আমাকে দেখতে পাবেন। সেই আশায়ই ছিলাম এতক্ষণ। কিন্তু তাকে না দেখে হতাশ হলাম। অপেক্ষার সময় দীর্ঘতর হতেই নিজেকে আরো বেশি অসহায় মনে হতে লাগলো। আমি মালপত্র আমার স্ত্রীর জিম্মায় রেখে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। কোথাও টেলিফোন করা যায় কিনা সন্ধান করতে লাগলাম। আমার কাছে পাউন্ড আছে, কিন্তু কোথা থেকে কীভাবে টেলিফোন করা যাবে তা জানি না। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে নিকটবর্তী পাবলিক টেলিফোনবুথ  দেখিয়ে দিল। আমি সেদিকে যেতে উদ্যত হতেই আমার স্ত্রী আমাকে ডেকে বললো, ঐ দেখ আবু আহমদ সাহেব আসছেন। মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা বদলে গেলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। গভীর আবেগে মাওলানা আবু আহমদকে  বুকে টেনে নিলাম। মনে হলো আমি আর অসহায় নই, এ মুহূর্তে তাকে আমার সবচেয়ে আপনজন মনে হলো এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে অবলীলায় বুকে টেনে নিলাম। বিদেশে যিনি অকূলে কূলের সন্ধান দেন, তার চেয়ে আপনজন আর কে আছে?
আবু আহমদের সাথে এসেছেন রাজীব উদ্দীন আহমদ। আবু আহমদের নিজস্ব গাড়ি নেই, লাইসেন্স নেই। তাই তাকে রাজীব উদ্দীনের সাহায্য নিতে হয়েছে। তারা জানালেন রাস্তায় প্রচন্ড যানজট থাকায় আসতে সামান্য দেরি হয়েছে। ঢাকার মত যানজট এখানেও আছে এবং তা অনেক সময় জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। তারা এসেই বললেন, আগে মাগরিবের নামায পড়ে নেই তারপর রওয়ানা হওয়া যাবে। লন্ডনে গ্রীষ্মকালে মাগরিব হলো ৯.২০ মিনিটে। তারা রাস্তায় আটকা পড়ায় সময় মত নামায পড়তে পারেননি। আমরা মুসাফির তাই বাসায় গিয়ে একটু স্বস্তির সাথে এশা ও মাগরিব একসাথে পড়ব। আমাদের একটি সোফায় বসিয়ে রেখে তারা নামায পড়তে গেলেন।
মওলানা আবু আহমদের বাড়ি সিলেটে। তিনি দীর্ঘকাল আবুধাবীতে ছিলেন, একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। আমি যখন দুবাই ছিলাম (১৯৭৭-৯৭) তখনই তাঁর সাথে পরিচয় হয় এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজে পরস্পর পরস্পরের সহযোগী হওয়ায় পরিচয় গভীর ও ঘনিষ্ঠ হয়। আবুধাবী গেলেই তাঁর বাসায় উঠেছি এবং খেয়েছি। তিনি ও তার স্ত্রী উভয়েই অতিশয় অতিথি-বৎসল। তার বাসাকে মনে হতো একটি ছোটখাট হোটেল। আত্মীয়-মেহমান-দেশী ও স্বজনদের ভিড় তার বাসায় সব সময় লেগেই থাকতো। আবু আহমদ দম্পতি সহজেই সকলকে তৃপ্তির সাথে আপ্যায়িত করে আনন্দ পেতেন। বিদেশে সামান্য চাকরি করে এতটা কেউ করে না, করা সম্ভবও নয়। তবু তাদেরকে অম্লান বদনে দিনের পর দিন বছরের পর বছর এটা করতে দেখেছি। এমন কি আবু আহমদের স্ত্রী প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। তা সত্ত্বেও কখনো আবু আহমদ নিজে রান্না করে এবং কখনো রান্না করা অসম্ভব হলে হোটেল থেকে খাবার এনে মেহমানদারি করেছেন। মেহমানদেরকে তার অসুবিধার কথা বুঝতেও  দেননি। তার এ মহত্ত্ব, উদরতা ও কিংবদন্তিতূল্য আতিথেয়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলাম বলেই বহু কষ্টে তার টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে ঢাকা থেকে তার সাথে যোগাযোগ করে এসেছি। আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তার আন্তরিক আতিথেয়তায় আমার সব আশংকা ও হতাশা দূর হয়ে গেল। ২০০১ সনে তিনি আবুধাবী থেকে সপরিবারে লন্ডন এসেছেন। বর্তমানে তিনি বৃটিশ নাগরিক, পূর্ব লন্ডনে একটি মসজিদে ইমামতি করেন, একটি চার বেডরুমের বাসায় থাকেন।
আবু আহমদের সঙ্গী রাজীব উদ্দিনও সিলেটের অধিবাসী। তিনিও বর্তমানে বৃটিশ নাগরিক। ওয়েলস-এ তার ব্যবসা-বাণিজ্য ও পাঁচ বেড রুমের একটি বাড়ি আছে। কিন্তু বর্তমানে পরিবার নিয়ে থাকেন পূর্ব লন্ডনে। আবু আহমদের মসজিদের পাশে তিনি একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। বাংলাদেশে থাকাকালে তিনি ঢাকায় থাকতেন। সেখানে তার এখনো দু’টি বাসা আছে। বাংলাদেশ থেকে এসে তিনি ওয়েলস-এ ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন এবং সেখানে বাড়ি কিনে বসবাস করেন। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দানের জন্যই তিনি বর্তমানে পূর্ব লন্ডনে বাসা ভাড়া করে থাকেন। এতে অতিরিক্ত খরচ হয়, তাকে প্রায়ই ওয়েলস-এ যাতায়াত করতে হয় ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করতে। ওয়েলস-এও ভালো স্কুল-কলেজ আছে। কিন্তু সেখানে দ্বীনী পরিবেশ নেই। তাই ছেলেমেয়েদের দ্বীনী পরিবেশে লেখাপড়া শেখানোর উদ্দেশ্যেই এখানে বাসা নিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভাল যে, পূর্ব লন্ডনে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী বসবাস করে। সেখানে তারা বেশ কয়েকটি মসজিদ, স্কুল-কলেজ ও ইসলামী সেন্টার গড়ে তুলেছে। ইস্ট লন্ডন মসজিদ ইংল্যান্ডের সর্ববৃহৎ মসজিদ। আকারে যেমন বৃহৎ, সৌন্দর্যেও তেমনি মনোলোভা। মসজিদটি এ এলাকার অন্যতম দর্শণীয় স্থাপত্য। আমি ১৯৮৪ সনে যখন প্রথম লন্ডন সফরে যাই, তখন এ মসজিদটি নির্মীয়মান অবস্থায় দেখেছিলাম। এখানে জুমার দিন দূর-দূরান্ত থেকে বাংলাদেশীরা এ মসজিদে আসে নামায পড়তে ও পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করতে। পূর্ব লন্ডনের বিগল্যান্ড স্ট্রীটে অবস্থিত দারুলউলুম মসজিদ এ এলাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। আবু আহমদ হিফযুর রহমান এ মসজিদেরই প্রধান ইমাম। রাজীব উদ্দীন এ মসজিদের মুসল্লী। তিনি ইমাম আবু আহমদের বিশেষ ভক্ত। তাই তার সাথে তিনি চলে এসেছেন এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে। রাজীব উদ্দিনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন আবু আহমদ সাহেব।
মাগরিবের নামায পড়ে তারা আমাদের নিয়ে গাড়ি পার্কিং-এর স্থানে গেলেন। গাড়িতে মাল-পত্র তুলে আমরা চারজন গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে লাগলো। রাজীব উদ্দিন পাকা ড্রাইভার। লন্ডনের পথ-ঘাট তার সব চেনা-জানা। তাই খুব ংসড়ড়ঃযষু তিনি তার গাড়ি চালাতে লাগলেন। তখন রাস্তায় তেমন ভীড় ছিলনা। তাই রাস্তার দু’পাশের সব দৃশ্য দেখতে দেখতে টেমস নদীর পাড়  ঘেঁষে আমরা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পূর্ব লন্ডনে মাওলানা আবু আহমদ সাহেবের বাসায় পৌঁছে গেলাম।
পূর্ব লন্ডনে ওবান স্ট্রীটে মওলানা আবু আহমদের বাসা। দোতলা বিশিষ্ট চার বেডরুমের বাসা। নিচের তলায় ড্রয়িং, ডাইনিং, রান্না, টয়লেট ও একটি বেড। উপর তলায় তিন বেড, এক বাথ। এদেশে টয়লেট-বাথরুমের সংখ্যা কম। সম্ভবত শীতের দেশ বলে, বাথরুমের ব্যবস্থা কম। বাথরুমে, পানির ব্যবহারও কম। টয়লেট পেপার দিয়েই তারা সাধারণত টয়লেটের কাজ সারে। অবশ্য এদেশে বসবাসকারী মুসলমানগণ এর ব্যতিক্রম। শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মুসলমানদের প্রতি ইসলামের বিশেষ নির্দেশ রয়েছে। হাদীসের বাণী- ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ তাই দেখা যায়, পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইংরাজরা অনেক ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করলেও এখানে বসবাসকারী মুসলমানগণ পেশাব-পায়খানা, ওযু-গোছল ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে যথারীতি এবং যথাযথ পানির ব্যবহার করে থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামে ধর্মীয় বিধান হিসেবে গণ্য ফলে এটা ইসলামী সংস্কৃতিরও এক অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। মূলত সংস্কৃতির মূল অর্থ হল পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুরুচি, শুচিতা, পরিশুদ্ধতা ও পরিমার্জনা। সে অর্থে মুসলমানরাই প্রকৃত সংস্কৃতির ধারক।
আবু আহমদ সাহেব আমাদেরকে তার বাসার নিচতলার বেডরুমটি ছেড়ে দিলেন। এই বেডরুমটি আবু আহমদের মেঝ ছেলে ব্যবহার করে। সে দারুলউম্বাহ স্কুলে ক্লাস সেভেনে লেখাপড়া করে। সে মেধাবী ছাত্র। স্কুলের প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রতি বছর। সে স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশোনা করে। খেলাধূলায়ও দারুণ। শ্মশ্র“মণ্ডিত উজ্জ্বল গায়ের রং-বিশিষ্ট সুঠাম দেহের অধিকারী এ তরুণ নিয়মিত নামাজ পড়ে, ইসলামী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। কুরআন ১৬ পারা পর্যন্ত মুখস্ত করেছে।
উপর তলার এক রুমে আবু আহমদের বড় ছেলে আবদুল্লাহ তারেক ও  ছোট ছেলে আহমদ জাবীর থাকে। বড় ছেলেও খুব মেধাবী। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্কলারশীপ নিয়ে পড়াশোনা করেছে। বর্তমানে সে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গেছে আমেরিকায় তার এক আত্মীয়ের বাসায়। ছোট ছেলে আহমদ জাবীর মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ছোট মেয়ে মরিয়ম পড়ে ক্লাস সেভেন-এ। বড় মেয়ে একটি প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করে, বিকালে একটি স্কুলে কুরআন শিক্ষা দেয় প্রতিদিন তিন ঘন্টা। সে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি উত্তমরূপে কুরআন শিক্ষা করেছে, স্কুলে সে কুরআন ক্লাস নেয়। অন্যসব বিষয়েও সে পারদর্শী । কিন্তু কুরআন শিক্ষা দানেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
মাওলানা আবু আহমদের স্ত্রী ইউ.কে. ইসলামী আন্দোলনের মহিলা শাখার সভানেত্রী। নিষ্ঠার সাথে সংসারের সকল দায়িত্ব পালনের পর তিনি বাকি সময় রুটিন মাফিক দ্বীনী আন্দোলনের কাজে ব্যয় করে থাকেন। আবু আহমদও ইউ.কে. দাওয়াতুল ইসলাম সংগঠনের মজলিশে শুরার সদস্য। ইমামতী করার পর বাকি সময় তিনি দ্বীনী কাজে ব্যয় করে থাকেন। কুরআনের দরস প্রদানে তিনি বিশেষ পারদর্শী।
বিদেশে এসে মানুষ সাধারণত টাকা রোজগারের দিকে মনোযোগী হয়। জাগতিক সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশে গা ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু যারা সচেতন মুসলমান, বিশেষত ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত, তারা টাকা রোজগারের সাথে সাথে দ্বীনের প্রচার-প্রসার, দ্বীনী পরিবেশে নিজেদের জীবন ও স্বজন-স্বদেশীদের জীবন কীভাবে পরিচালনা করা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে, কাজ করে, কষ্ট স্বীকার করে এমনকি প্রচুর মালী কোরবানী করে থাকে। সে কারণেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিল তিল করে আজ পর্যন্ত লন্ডন শহরেই প্রায় ৫০/৬০টি মসজিদ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে ইসলামিক সেন্টার, পাঠাগার, জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র, কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা, সভা-সমিতি-সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করে চলেছে। নিজেরা এসব আয়োজনে যেমন অংশগ্রহণ করে, তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকেও তাতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যথায় তারা নিজেরা বিশেষত তাদের সন্তান-সন্ততিগণ বিদেশে বিপরীত আদর্শ, চিন্তা-চেতনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও জীবন ধারার স্রোতে কোথায় ভেসে যেত, তা  চিন্তা, করতেও শিহরিত হতে হয়। মাওলানা আবু আহমদের মত অনেক সচেতন মুসলমান দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যাক্তিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে বিদেশে বিজাতীয় পরিবেশে ইসলামী জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখার অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন। ফলে তারা নিজেদেরকে যেমন বিজাতীয়-বিধর্মীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি তাদের সন্তান-সন্ততি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। এটা কেবল যে তাদের নিজেদের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে তা নয়, সেখানে অবস্থানরত অসংখ্য প্রবাসী মুসলমানগণ এতে উপকৃত হচ্ছেন। এমনকি, অনেক বিধর্মীও তাদেও সহজ-সরল-অনাবিল সুন্দর জীবনযাত্রা দেখে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। তারা নিজেদেরকে ইসলামের প্রতিনিধি হিসাবে গড়ে তুলতে পেরেছেন বলেই পাশ্চাত্য জগতে আজ ইসলামের প্রচার-প্রসার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
মওলানা আবু আহমদের ঘরে এসে, কাপড়-জামা চেঞ্জ করে ওজু করে একসঙ্গে মাগরিব ও এশার কসর নামায আদায় করলাম। খানা রেডিই ছিল। আমরাও ছিলাম ক্ষুধার্ত। তৃপ্তির সাথে খেয়ে সুন্দর নরম তুলতুলে বিছানায় শুয়ে আরামে নিদ্রা গেলাম। সেদিন আর কোথাও যাওয়া হলো না।
শোবার আগে আবু আহমদ সাহেব আমাকে নিচের তলার অবস্থানটি ভাল করে দেখিয়ে দিলেন। প্রথমে ড্রয়িং রুম, তারপর শোবার ঘর, তার পাশে টয়লেট, টয়লেটের সাথে বিশাল রান্নাঘর। রান্নাঘরের একপাশে একটি ডাইনিং টেবিল, তার সাথে চারটি চেয়ার সাজানো। ফ্রিজ খুলে দেখালেন নানা রকমের কাঁচা মাছ, শুটকি মাছ, মাছের নাগেট, গোশতের নাগেট, গোশত, আন্ডা, দুধ, সবজি স্তরে স্তরে সাজানো। মাছ সবই বাংলাদেশের। রুই, কতলা, কই, মাগুর, মৃগেল, বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ ইত্যাদি দেখে আমি তো রীতিমত অবাক। রান্নাঘরের বিভিন্ন পাউরুটি, কনফ্লেক, নানারকম বিস্কুট, কেক, মুড়ি, খই, ফলমূল ইত্যাদি কোন কিছুর অভাব নেই। দেখে মনে হলো, এটা তো রান্নাঘর নয়, যেন রীতিমত একটি সুপার মার্কেট। উনি আমাকে বিনয়ের সাথে বললেন, আমরা তো সবাই ব্যস্ত কে কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই, আপনি এবং ভাবী ইচ্ছামত, প্রয়োজন ও রুচিমত যখন যা খেতে মন চায়, খেয়ে নেবেন। এটাকে নিজের ঘর মনে করে সবকিছু কোন রকম ইতঃস্তত না করেই খেয়ে নেবেন।
আমার তো মনে হল রূপকথার সবপ্রাপ্তির আজব দেশে এসে যেন অকস্মাৎ হাজির হয়েছি। মনে মনে মেজবানের তারিফ করে আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করলাম।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.