বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ১৫তম প্রবাহ

 
কপাল মন্দ হই­লে তা­হার ফলা­ফল ফি­রা­­তে কা­হা­রো সা­ধ্য নাই। মু­সাল নগ­রে আসিয়া হা­সান কয়েক­দিন থা­কি­লেন। জায়েদার ভয়ে গৃহ পরি­ত্যাগ করি­লেন, কি­ন্তু অদৃ­ষ্ট­লি­পি যা­হা, তা­হাই রহিয়া গেল।যখন কপাল টলিয়া যায় দু­ঃখ-পথের পথিক হই­তে হয়, তখন কি­ছু­তেই আর নি­স্তার থা­কে না। এক জায়েদার ভয়ে গৃহ ত্যাগ করিয়া মু­সাল নগ­রে আসি­লেন, কি­ন্তু সেরূপ কত জায়েদা শত্রু­তা সা­­নের জন্য তাঁহার অপে­ক্ষা করি­তে­ছিল, তা­হা কী তি­নি জা­নি­তে পা­রিয়াছি­লেন? এই বি­শ্ব­সং­সা­রে শত্রু­সং­খ্যা যদি আম­রা জা­নি­তে পা­রি, বা­হ্যিক আকা­রে শত্রু মি­ত্র যদি চি­নি­তে পা­রি, তবে কি আর বি­­দের সম্ভা­­না থা­কে? চি­নি­তে পা­রি­লে কি আর শত্রু­রা শত্রু­তা সা­ধন করি­তে পা­রে? সত­র্ক­তা কা­হার জন্য? ইমাম হা­সা­নের ভা­গ্যে সুখ নাই। যে­দিন জয়না­­কে তি­নি বি­বাহ করিয়াছেন, যে­দিন জয়না­­কে নিজ পু­রী­­ধ্যে আনিয়া জায়েদার সহিত এক­ত্র রহিয়াছেন, সেই দি­নই তাঁহার সু­­স্ব­প্ন ভা­ঙ্গিয়া গিয়াছে, সেই দি­নই তাঁহার সু­খসূর্য অস্ত­মিত হইয়াছে। জয়না­বের জন্যই জায়েদা আজ তাঁহার পরম শত্রু। সেই শত্রুর যন্ত্র­ণায় অস্থির হইয়াই হা­সান গৃ­­ত্যা­গী। সেই গৃ­­ত্যা­গেই আর এক শত্রু শত্রু­তা-সা­­নে সু­যোগ। সকল মূলই জয়নাব। আবার জয়না­বই জায়েদার সু­খের সী­মা
মদি­নার সং­বাদ দা­মে­স্কে যা­­তে­ছে, দা­মে­স্কের সং­বাদ মদি­নায় আসি­তে­ছে। ইমাম হা­সান মদি­না ছাড়িয়া মু­সাল নগ­রে আসিয়াছেন, কথাও এজি­দের কর্ণে উঠিয়াছে, অপর সা­ধা­­ণেও শু­নিয়াছে। নগ­রের এক­­ক্ষু­বি­হীন জনৈক বৃ­দ্ধের প্র­ভু মো­হা­ম্ম­দের প্র­তি জা­­ক্রোধ ছিল; শে­ষে সেই ক্রোধ, সেই শত্রু­তা তাঁহার সন্তা­­­ন্ত­তি-পরি­শে­ষে হা­সান-হো­সে­নের প্র­তি আসিয়াছিল। সেই বৃ­দ্ধ প্র­তি­জ্ঞা করিয়াছিল যে, সু­যোগ পা­­লেই মো­হা­ম্ম­দের বং­­­ধ্যে যা­হা­কে হা­তে পা­­বে, তা­হা­রই প্রাণ সং­হার করি­বে। মদি­না পরি­ত্যাগ করিয়া হা­সা­নের মু­সাল নগ­রে আগ­মন বৃ­ত্তা­ন্ত শু­নিয়া সেই ব্য­ক্তি বি­শেষ যত্নে হলা­হল সং­যু­ক্ত এক সু­তী­ক্ষ্ণ বর্শা প্র­স্তুত করিয়া শত্রু­তা­সা­­নো­দ্দে­শে মু­সাল নগ­রে যা­ত্রা করিল। কয়েক দিন পর্য­ন্ত অবি­শ্রা­ন্ত গম­নের পর মু­সাল নগ­রে যাইয়া সন্ধা­নে জা­নিল যে, ইমাম হা­সান নগ­­স্থ উপা­­না-মন্দি­রে অব­স্থান করি­তে­ছেন এবং স্থা­নে আব্বাস প্র­ভৃ­তি কয়েক­জন বন্ধু তাঁহার সম­ভি­ব্যা­হা­রে রহিয়াছে। বৃ­দ্ধ উল্লি­খিত উপা­­না-মন্দি­রের সী­মা­­র্তী গু­প্ত­স্থা­নে বর্শা লু­কাইয়া রা­খিয়া একে­বা­রে হা­সা­নের নি­­­স্থ হইল। ইমাম হা­সা­নের দৃ­ষ্টি পড়িবা­মা­ত্র ধূর্ত বৃ­দ্ধ তাঁহার পদ­­লে পতিত হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলি­তে লা­গিল, "প্র­ভু! আমা­কে রক্ষা করুন। আমি এত­দিন শয়তা­নের কু­­কে পড়িয়া পবি­ত্র মো­হা­ম্ম­দীয় ধর্মের প্র­তি অবি­শ্বাস করিয়াছি। এক্ষ­ণে ঈশ্বর-কৃ­পায় আমার জ্ঞা­­­ক্ষু উন্মী­লিত হইয়াছে। সত্য­­র্মের জ্যো­তিঃ-প্র­ভা­বে মনের অন্ধ­কার দূর হইয়াছে। স্ব­প্নে দে­খিয়াছি যে, ইমাম হা­সান মদি­না হই­তে মু­সাল নগ­রে আসিয়াছেন। সেই স্ব­প্নেই কে যেন আমায় বলিল যে, 'শী­ঘ্র ইমাম হা­সা­নের নি­কট যাইয়া সত্য­­র্মে দী­ক্ষিত হও, পূর্ব পাপ স্বী­কার করিয়া মা­র্জ­নার জন্য ঈশ্ব­রের নি­কট প্রা­র্থ­না কর।ভবি­ষ্যৎ পাপ হই­তে বি­রত থা­কি­বার জন্য ধর্ম­তঃ প্র­তি­জ্ঞা কর।' এই মহা­র্থপূর্ণ স্ব­প্ন দে­খিয়া আমি শ্রী­পা­­­দ্মে আত্ম­­­র্পণ করি­তে আসিয়াছি, যা­হা অভি­মত হয়, আজ্ঞা করুন।"
দয়ার্দ্র­চি­ত্ত হা­সান আগ­ন্তুক বৃ­দ্ধ­কে অনেক আশ্বাস দিয়া বলি­লেন, "আমি তো­মা­কে মো­হা­ম্ম­দীয় ধর্মে দী­ক্ষিত করি­তে এখ­নি প্র­স্তুত আছি।" এই কথা বলিয়াই ইমাম হা­সান তৎক্ষ­ণাৎ তা­হার হস্ত স্প­র্শ করিয়া তা­হা­কে 'বায়েৎ' (মু­­­মান ধর্মে দী­তি) করি­লেন। বৃ­দ্ধও যথা­রী­তি মো­হা­ম্ম­দীয় ধর্মে ঈমা­ন্ (মু­খে স্বী­কার এবং বি­শ্বাস) আনিয়া হা­সা­নের পদধূলি গ্র­হণ করিল। বি­­র্মী­কে সৎপথে আনি­লে মহা­পু­ণ্য। বৃ­দ্ধও এই প্রা­চীন বয়সে আত্মীয়-স্ব­জন, স্ত্রী-পু­ত্র সক­­কে পরি­ত্যাগ করিয়া মু­­­মান-ধর্ম গ্র­হণ করা­তে মা­­নীয় হা­সা­নের বি­শেষ অনু­গৃ­হীত বি­শ্বা­­ভা­জন হইল
দু­ষ্ট­বু­দ্ধি, স্বা­র্থ­পর, নর­পি­শাচ কে­বল কা­র্য উদ্ধা­রের নি­মি­ত্তই-চি­­­নো­রথ পরিপূর্ণ করি­বার আশয়েই, চি­রবৈর-নি­র্যা­তন মা­­সেই অক­পট ভা­বে হা­সা­নের শর­ণা­গত হইল, ইহা সর­­স্ব­ভাব হা­সা­নের বু­দ্ধির অগো­চর। প্র­কা­শ্যে ভক্তি করি­তে লা­গিল, কি­ন্তু চি­রা­ভি­লাষ পূর্ণ করি­বার অব­সর সু­যোগ অন্বে­­ণে সর্ব­দাই সমুৎসুক। আগ­ন্তু­­কে বি­শ্বাস করি­তে নাই, কথা হা­সান যে না জা­নি­তেন, তা­হা নহে; কি­ন্তু সেই মহা­­ক্তি-সু­কৌ­­­­ম্প­ন্ন ঈশ্ব­রের লী­লা সম্প­ন্ন হই­বার জন্যই অনেক সময়ে অনেক লো­কে অনেক জা­নিয়াও ভু­লিয়া যায়-চি­নিয়াও অচে­না হয়
উপা­­না-মন্দি­রের সম্মু­খে হা­সান এবং ইব­নে আব্বাস আছেন। নূতন শি­ষ্য কা­র্যা­ন্ত­রে গিয়াছে।ইব­নে আব্বাস বলি­লেন, "এই যে দা­মে­স্ক হই­তে আগত এক­­ক্ষু­বি­হীন পা­­স্বী­কা­রী বৃ­দ্ধ এবং আপ­নার বি­শ্বা­­ভা­জন নব শি­ষ্য, ইহার প্র­তি আমার সন্দেহ হয়।"
"কী সন্দেহ?"
"আমি অনেক চি­ন্তা করিয়াছি, অনেক ভা­বিয়া দে­খিয়াছি, এই বৃ­দ্ধ শু­ধু­মা­ত্র ধর্মে দী­ক্ষিত হই­তে আসে নাই। আমার বোধ হয়, কোন দু­­ভি­­ন্ধি সা­­­মা­­সে কি­­বা কোন গু­প্ত সন্ধান লই­বার জন্য আমা­দের অনু­­­ণে আসিয়াছে।"
"অস­ম্ভব! তা­হা হই­লে ভক্তি­ভা­বে মো­হা­ম্ম­দীয় ধর্মে দী­তি হই­বে কেন? সা­ধা­রণ ভা­বে এখা­নে অনায়াসেই থা­কি­তে পা­রিত, সন্ধানও লই­তে পা­রিত?"
"পা­রিত সত্য-পা­রিয়াছেও তা। কি­ন্তু বি­­র্মী, না­­কী, দু­ষ্ট, খল, শত্রু কে­বল কা­র্য উদ্ধা­রের জন্য ধর্মের ভাণ করিয়া গু­রু-শি­ষ্য­­ম্ব­ন্ধ বন্ধন করি­তে আসিয়াছে, ইহা­তে আশ্চ­র্যই-বা কী?"
"ভ্রা­তঃ! কোন কথাই নয়। তিন কাল কা­টাইয়া শে­ষে কী এই বৃ­দ্ধ­কা­লে বা­হ্যিক ধর্ম-পরি­চ্ছ­দে কপট বে­শে পা­­কা­র্যে লি­প্ত হই­বে? জগৎ কি চি­­স্থায়ী? শে­ষের দি­নের ভা­­না বল তো কার না আছে? এই বৃ­দ্ধবয়সেও যদি উহার মনের মলি­­তা দূর না হইয়া থা­কে, পা­­­নিত আত্ম­গ্লা­নি যদি এখ­নো উপ­স্থিত না হইয়া থা­কে, কৃত পা­পের জন্য এখ­নো যদি অনু­তাপ না হইয়া থা­কে, তবে আর কবে হই­বে? চি­­কাল পা­­­ঙ্কে জড়িত থা­কি­লে শে­­­শায় অব­শ্যই স্ব­কৃত পা­পের জন্য বি­শেষ অনু­তা­পিত হই­তে হয়। অনে­কেই গু­প্ত পাপ নিজ মু­খে স্বী­কার করে। যে পা­­স্বী­কা­রে প্রা­­বি­নাশ হই­তে পা­রে, ঈশ্ব­রের এমন মহি­মা যে, সে পাপও পা­পী লো­কে নিজ মু­খে স্বী­কার করিয়া আত্ম­বি­­র্জন করিয়া থা­কে। পাপ কি­ছু­তেই গো­পন থা­কি­বার নহে; আবার মন সরল না হই­লেও ধর্মে মতি হয় না, ঈশ্ব­রেও ভক্তি হয় না! যে ব্য­ক্তি ধর্ম-সু­ধার পি­পা­সু হইয়া বৃ­দ্ধ বয়সেও কত পরি­শ্র­মে দা­মে­স্ক হই­তে মু­সাল নগ­রে এতদূর আসিয়াছে, তা­হার মনে কী চা­তু­রী থা­কি­তে পা­রে? মন যে­দি­কে ফি­রাও সেই দি­কেই যায়। ভাল কা­র্য­কে মন্দ ভা­বিয়া বু­দ্ধি চা­­না কর, চি­ন্তা­­ক্তির মতা বি­চার কর, কি দে­খি­বে? পদে পদে দোষ-পদে পদে বি­পদ! চি­ন্তা আবার ভাল দি­কে ফি­রাও, কী দে­খি­বে! সু­ফল, মঙ্গল এবং সৎ। এই আগ­ন্তুক যদি সর­­ভা­বে ধর্ম­পি­পা­সু হইয়া আসিয়া থা­কে, তবে দেখ দে­খি উহার মন কত প্র­­স্ত?ধর্মের জন্য কত লা­লায়িত? বল দে­খি স্ব­র্গ কা­হার জন্য? এই ব্য­ক্তি জা­ন্না­তের যথা­র্থ অধি­কা­রী?"
ইব­নে আব্বাস আর কোন উত্তর করি­লেন না। অন্য কথার আলো­­নায় প্র­বৃ­ত্ত হই­লেন। আগ­ন্তুক বৃ­দ্ধও মন্দি­রের অপর পা­র্শ্বে দাঁড়াইয়া তা­হার লু­ক্কায়িত বর্শার ফল­­টি বি­শেষ মনঃ­সং­যো­গে দে­খি­তে­ছে এবং মৃ­দু স্ব­রে বলি­তে­ছে, "এই তো আমার সময়; এক আঘা­তেই মা­রিয়া ফে­লি­তে পা­রিব। আর যে বিষ ইহা­তে সং­যু­ক্ত করিয়াছি, রক্তের সহিত এক­টু মি­শ্রিত হই­লে কা­হার সা­ধ্য হা­সা­­কে রক্ষা করে? উপা­­নার সময়ই উপ­যু­ক্ত সময়। যে­মন 'সে­­দা' (দণ্ডবৎ হইয়া ঈশ্ব­­কে প্র­ণাম) দি­বে আমিও সেই সময় বর্শার আঘাত করিব।পৃ­ষ্ঠে আঘাত করি­লে বক্ষঃ­স্থ­লে বি­দ্ধ না হই­লে আর ছাড়িব না। কি­ন্তু উপা­­না-মন্দি­রে হা­সা­­কে একা পা­­বার সু­যোগ অতি কম। দে­খি, চে­ষ্টার অসা­ধ্য কী আছে?" ইব­নে আব্বা­সের অল­ক্ষি­তে পা­পি­ষ্ঠ অনে­­ক্ষণ দে­খি­তে লা­গিল। কো­­ক্র­মেই কোন সময়েই বর্শা নি­ক্ষে­পের সময় পা­ইল না
মন্দি­রের দুই পা­র্শ্বে কয়েক­বার বর্শা­­স্তে ঘু­রিয়া আসিল, কি­ন্তু এক­বারও লো­কশূন্য দে­খিল না।বৃ­দ্ধ পু­­রায় মৃ­দু­স্ব­রে বলি­তে লা­গিল, "কী ভ্রম! উপা­­নার সময় তো আরো অধিক লো­কের সমা­গম হই­বে।ইমা­মই সক­লের অগ্রে থা­কি­বে। বর্শার আঘাত করি­লেই শত্রু শেষ হই­বে, কি­ন্তু নি­জের জী­বনও শেষ হই­বে।এক্ষ­ণে হা­সান যে­ভা­বে বসিয়া আছে, পৃ­ষ্ঠে আঘাত করি­লে বক্ষঃ­স্থল পার হই­বে সন্দেহ নাই, কি­ন্তু ইব্নে আব্বাস আমা­কে কখ­নোই ছাড়িবে না। সে যে চতুর, নি­শ্চয়ই তা­হার হা­তে আমার প্রাণ যা­­বে। আব্বাস বড়ই চতুর, এই তো হা­সা­নের সহিত কথা কহি­তে­ছে, কি­ন্তু দৃ­ষ্টি চতু­র্দি­কেই আছে। কি করি, কত­ক্ষণ অপে­ক্ষা করিব, সু­যোগ সময়ই বা কত খুঁজিব? বর্শার পশ্চা­দ্ভাগ ধরিয়া সজো­রে বি­দ্ধ করি­লে তো কথাই নাই, দূর হই­তে পৃ­ষ্ঠ­­ন্ধা­নে নি­ক্ষেপ করি­লেও যে একে­বা­রে ব্য­র্থ হই­বে, ইহাই-বা কে বলি­তে পা­রে?"
বৃ­দ্ধ মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া হা­সা­নের পৃ­ষ্ঠ­দে­শে আঘাত করি­তেই বর্শা সন্ধান করিল।ইব­নে আব্বা­সের চক্ষু চা­রি দি­কে। এক স্থা­নে বসিয়া কথা কহি­তেন, অথচ মনে, চক্ষে চা­রি­দি­কে সন্ধান রা­খি­তে পা­রি­তেন। হঠাৎ আগ­ন্তুক বৃ­দ্ধের বর্শা­­ন্ধান তাঁহার চক্ষে পড়িল। হা­সা­নের হস্ত ধরিয়া টা­নিয়া উঠা­­লেন এবং ধূর্তের উদ্দে­শে উচ্চ কণ্ঠে বলি­তে লা­গি­লেন, "ওরে পি­শাচ! তোর এই কী­র্তি!"
এদি­কে বর্শাও আসিয়া পড়িয়াছে। নি­ক্ষে­­কা­রীর সন্ধান ব্য­র্থ হই­বার নহে। বর্শা-নি­ক্ষে­পে সেই ব্য­ক্তি সবি­শেষ শি­ক্ষিত সি­দ্ধ­­স্ত; কে­বল ইব­নে আব্বা­সের কৌ­­লেই হা­সা­নের পরি­ত্রাণ-বর্শা­টা পৃ­ষ্ঠে না লা­গিয়া হা­সা­নের পদ­তল বি­দ্ধ করিল। ইব­নে আব্বাস কী করেন, দু­রা­ত্মা­কে ধরি­তে যান, কী এদি­কে আঘা­তিত হা­সা­­কে ধরেন। ইমাম হা­সান বর্শার আঘা­তে ভূতলে পড়িয়া গে­লেন; ইব­নে আব্বাস সে দি­কে লক্ষ্য না করিয়া অতি ত্র­স্তে যাইয়া বৃ­দ্ধ­কে ধরি­লেন। বর্শার নি­­টে টা­নিয়া আনিয়া বর্শা দ্বা­রা সেই বৃ­দ্ধর বক্ষে আঘাত করি­তে উদ্যত, এমন সময়ে ইমাম হা­সান অনুনয়-বিনয় করিয়া বলি­তে লা­গি­লেন, "ভাই! প্রিয় আব্বাস! যা­হা হই­বার হইয়াছে, ক্ষ­মা কর। ভাই! বি­চা­রের ভার হস্তে লইয়ো না। সর্ব­বি­চা­­কের প্র­তি বি­শ্বাস করিয়া তাঁহা­কে বি­চা­রের ভার দিয়া বৃ­দ্ধ­কে ছাড়িয়া দাও, এই আমার প্রা­র্থ­না।"
হা­সা­নের কথায় ইব­নে আব্বাস বৃ­দ্ধ­কে ছাড়িয়া দিয়া হা­সা­­কে বলি­লেন, "আপ­নার আজ্ঞা শি­রো­ধা­র্য; কি­ন্তু সর্ব­দা স্ম­রণ রা­খি­বেন, আগ­ন্তু­কের প্র­তি বি­শ্বাস স্থা­­নের এই ফল।" শো­ণি­তের ধা­রা বহি­তে­ছে।উপা­­না-মন্দির রক্তে রঞ্জিত হইয়া লি­খিয়া যা­­তে­ছে-"আগ­ন্তু­­কে কখন বি­শ্বাস করিয়ো না। প্র­কৃত ধা­র্মিক জগ­তে প্রায়ই দে­খি­তে পাওয়া যায় না।" বর্শার আঘা­তে হা­সান অত্য­ন্ত কা­তর হইয়া পড়িলেন। তথাচ বলি­তে লা­গি­লেন, "আব্বাস! তো­মার বু­দ্ধি­কে ধন্য­বাদ! তো­মার চক্ষুরও সহ­স্র প্র­শং­সা! মা­নু­ষের বা­হ্যিক আকৃ­তি দর্শন করিয়াই অস্থি-মা­ংস ভেদ করিয়া মর্ম পর্য­ন্ত দে­খি­বার শক্তি, ভাই! আমি তো আর কা­হা­রো দে­খি নাই! আমার অদৃ­ষ্টে কী আছে জা­নি না! আমি কা­হা­রো মন্দ করি নাই, তথাচ আমার শত্রুর শেষ নাই! পদে পদে, স্থা­নে স্থা­নে, নগ­রে নগ­রে আমার শত্রু আছে, ইহা আগে জা­নি­তাম না। কী আশ্চ­র্য! সক­লেই আমার প্রা­­­ধে অগ্র­সর, সক­লেই সেই অব­­রের প্র­ত্যা­শী! এখন কো­থায় যাই? যে­দি­কে তা­কাই, সেই দি­কেই হন্তা, সেই দি­কেই আমার প্রা­­না­শক শত্রু! যে প্রা­ণের দায়ে মদি­না পরি­ত্যাগ করি­লাম, এখা­নেও সেই প্রাণ সঙ্ক­টা­­ন্ন! কি­ছু­তেই শত্রু­­স্ত হই­তে নি­স্তার পা­­লাম না! আমি ভা­বিয়াছি­লাম, জায়েদাই আমার পরম শত্রু; এখন দে­খি, জগৎময় আমার চি­­­ত্রু।"
হা­সান ক্র­­শঃই অস্থির হই­তে লা­গি­লেন। অস্ত্রের আঘাত, তৎসহ বি­ষের যন্ত্র­ণা তাঁহা­কে বড়ই কা­তর করিয়া তু­লিল। কা­­­স্ব­রে ইব­নে আব্বা­­কে বলি­লেন, "আব্বাস! যত শী­ঘ্র পার, আমা­কে মা­তা­­হের 'রওজা শরী­ফে' লইয়া চল। যদি বাঁচি, তবে আর কখ­নোই 'রওজা মো­বা­রক' হই­তে অন্য স্থা­নে যা­ইব না। ভ্র­মেই লো­কের সর্ব­নাশ হয়, ভ্র­মেই লো­কে মহা­বি­­দ্গ্র­স্ত হয়, ভ্র­মে পড়িয়াই লো­কে কষ্ট ভোগ করে, প্রাণও হা­রায়। ইচ্ছা করিয়া কে­হই বি­­দ্ভার মা­থায় তু­লিয়া লয় না, দু­­খী হই­তেও চা­হে না। আমি মু­সাল নগ­রে না আসিয়া যদি মা­তা­­হের রওজা শরী­ফে থা­কি­তাম, তা­হা হই­লে কোন বি­­দেই পতিত হই­তাম না। কপট ধর্ম­পি­পা­সুর কথায় ভু­লিয়া বর্শা­ঘা­তে আহতও হই­তাম না। ভাই! যে উপায়ে হউক, শী­ঘ্রই আমা­কে মদি­নায় লইয়া চল। অতি অল্প সময়ের জন্যও আর মু­সাল নগ­রে থা­কি­তে ইচ্ছা হই­তে­ছে না। যদি এই আঘা­তেই প্রাণ যায়, কী করিব, কোন উপায় নাই। কি­ন্তু মা­তা­­হের পবি­ত্র সমা­ধি­ক্ষে­ত্রে প্রা­­বিয়োগ হই­বে, তাঁহার পদ­প্রা­ন্তেই পড়িয়া থা­কিব, এই আমার ইচ্ছা। আর ভাই! সেই পবি­ত্র স্থা­নে প্রাণ বা­হির হই­লে সেই সময়ের নি­দা­রুণ মৃ­ত্যু­­ন্ত্র­ণা হই­তে রক্ষা পা­ইব। আজ­রা­­লের (যমদূতের) কঠিন ব্য­­হার হই­তে বাঁচি­তে পা­রিব।"
এই পর্য­ন্ত বলিয়া হা­সান পু­­রায় ক্ষী­­স্ব­রে কহি­তে লা­গি­লেন, "ভাই! অব­শ্যই আমার আশা-ভর­সা সক­লই শেষ হইয়াছে। পদে পদে ভ্রম, পদে পদে বি­­দ্, ঘরে-বা­হি­রে শত্রু-সক­লেই প্রাণ লই­তে উদ্যত!আমার শরীর অবশ হইয়া আসিল। কথা কহি­তে কষ্ট হই­তে­ছে। যত শী­ঘ্র হয়, আমা­কে মদি­নায় লইয়া চল।"
মু­সাল নগ­­বা­সী­রা অনে­কেই হা­সা­নের দু­­খে দু­­খিত হইয়া কহি­তে লা­গি­লেন, "মদি­নায় পা­ঠাইয়া দেওয়াই যু­ক্তি­­ঙ্গত।" ইব­নে আব্বাস হা­সা­­কে লইয়া মদি­নায় যা­ত্রা করি­লেন। যে­খা­নে যমদূতের দৌ­রা­ত্ম্য নাই, হি­­সা­বৃ­ত্তি­তে হি­­স্র লো­কের হি­­স্র জন্তুর প্র­বৃ­ত্তি নাই, খা­দ্য­খা­­কের বৈরী­ভাব নাই, নিয়মিত সময়ে হা­সান সেই মহা­­বি­ত্র 'রওজা মো­বা­­কে' আসিয়া উপ­স্থিত হই­লেন এবং সর্বা­ঙ্গে রওজা মো­বা­­কের ধু­লা মা­খিয়া ঈশ্ব­রের নি­কট আরো­গ্য প্রা­র্থ­না করি­লেন। ঈশ্ব­রা­নু­গ্র­হে বি­ষের যন্ত্র­ণা অনেক লা­ঘব হইল। কি­ন্তু আঘা­তের বে­­না-যা­­না তে­­নই রহিয়া গেল। ইহার অর্থ কে বু­ঝি­বে? সেই পরম কা­রু­ণিক পর­মে­শ্বর ভি­ন্ন আর কা­হা­রো বু­ঝি­বার সা­ধ্য নাই। ক্ষ­­স্থান দিন দিন বৃ­দ্ধি পা­­তে লা­গিল। জ্বা­লা-যন্ত্র­ণাও বাড়িতে লা­গিল।ইমাম হা­সান শে­ষে উত্থা­­­ক্তি রহিত হইয়া পড়িলেন। এক­দিন হো­সেন আসিয়া ভ্রা­তা­কে বলি­লেন, "ভ্রা­তঃ!এই 'মো­বা­­কে রওজায়' কোন প্র­কার বি­­দের সম্ভা­­না নাই। কি­ন্তু মা­নু­ষের শরীর অপ­বি­ত্র; বি­শেষ আপ­নার যে ব্যা­ধি, তা­হা­তে আরো সন্দেহ। পবি­ত্র স্থা­নে পবি­ত্র অব­স্থায় না থা­কি­তে পা­রি­লে স্থা­নের অব­মা­­না করা হয়।ক্ষ­­স্থান কে­মন ভয়ানক রূপ ধা­রণ করিয়াছে, বা­টী­তে চলুন, আম­রা সক­লেই আপ­নার সে­বা-শু­শ্রূষা করিব।জগ­তে জন­নীর স্নেহ নি­­স্বা­র্থ। সন্তা­নের সা­­ঘা­তিক পীড়ায় মায়ের অন্ত­রে যেরূপ বে­­না লা­গে, এমন আর কা­হা­রো লা­গে না। যদিও ভা­গ্য­দো­ষে সে স্নেহ-মম­তা হই­তে বঞ্চিত হইয়াছেন, তথা­পি আজ্ঞা­বহ কি­ঙ্কর বর্ত­মান আছে। সেই মা­তার গর্ভে আমিও জন্ম­গ্র­হণ করিয়াছি। আমার সা­ধ্য­মত আমি আপ­নার সে­বা করিব।"
ইমাম হা­সান আর বা­ক্য­ব্যয় করি­লেন না। হো­সেন এবং আবুল কা­সে­মের স্ক­ন্ধো­­রি হস্ত রা­খিয়া অতি কষ্টে বা­টী­তে আসিয়া পৌঁছি­লেন। হা­­নে­বা­নু, জয়নাব অথ­বা জায়েদা -এই তিন স্ত্রীর মধ্যে কোন স্ত্রীর ঘরেই গে­লেন না। প্রিয় ভ্রা­তা হো­সে­নের গৃ­হেই আবাস গ্র­হণ করি­লেন। সক­লেই তাঁহার সে­বা-শু­শ্রূষায় রত হইল
এক জায়েদার প্র­তি সন্দেহ করিয়া হা­সান যেন সক­লের প্র­তিই সন্দেহ করি­লেন। কি­ন্তু সেই আন্ত­রিক ভাব প্র­কা­শ্যে কা­হা­কেও কি­ছু বলি­লেন না। তবে ভা­­­তিক দে­খিয়া বা­হ্যিক ব্য­­হা­রে সক­লেই বু­ঝিয়াছি­লেন যে, পরি­­­­র্গের-বি­শে­­তঃ স্ত্রী­­ণের প্র­তি হা­সান মহা­বি­­ক্ত। হা­­নে­বা­নু জয়না­বের প্র­তি কে­বল এক­টু বি­­ক্তি­ভাব প্র­কাশ পা­ইত, কি­ন্তু জায়েদা­কে দে­খিয়া ভয় করি­তেন
হা­­নে­বা­নুর সে­বা-শু­শ্রূষায় ইমাম হা­সা­নের বি­­ক্তি­ভাব কে­হই দে­খি­তে পায় নাই। জয়নাব আসিয়া নি­­টে বসি­লে কি­ছু বলি­তেন না, কি­ন্তু জায়েদা­কে দে­খি­লেই চক্ষু বন্ধ করিয়া ফে­লি­তেন। দুই চা­রি­দি­নে সক­লেই জা­নি­লেন যে, ইমাম হা­সান বোধ হয় জায়েদা­কে দে­খি­তে ইচ্ছা করেন না। কা­রণ অনু­­ন্ধা­নেও ত্রু­টি হইল না। শে­ষে সা­ব্য­স্ত হইল যে, জায়েদার ঘরে গে­লেই বি­­দ্গ্র­স্ত হন, অস­হ্য বে­­নায় আক্রা­ন্ত হন। এই সকল কা­­ণেই বোধ হয়, জায়েদার প্র­তি কো­নরূপ সন্দেহ হইয়া থা­কি­বে। কেহ এই প্র­কার-কেহ অন্য প্র­কার-কেহ কেহ-বা না­না প্র­কার কথায় আন্দো­লন করি­তে লা­গি­লেন। কি­ন্তু কে­হই কি­ছু স্থির করি­তে পা­রি­লেন না।ইমাম হা­সা­নের ভা­­­তিক কি­ছু কি­ছু বু­ঝি­তে পা­রিয়া হো­সেন তাঁহার আহা­রীয় সা­­গ্রীর প্র­তি বি­শেষ লক্ষ্য রা­খি­তে লা­গি­লেন। ভ্রা­তার মনের ভাব পরী­ক্ষা করি­বার জন্য হা­­নে­বা­নুর সম্মু­খে বলি­লেন, "আপ­না­রা ইহার আহা­রীয় দ্র­ব্যা­দি বি­শেষ যত্নে রক্ষা করি­বেন।"
হা­­নে­বা­নু কহি­লেন, "আমি সা­হস করিয়া কি­ছু বলি­তে পা­রি না। তবে এই­মা­ত্র বলি­তে পা­রি যে, যা­হা হই­বার তা­হা হইয়া গিয়াছে। এক্ষ­ণে খা­দ্য­সা­­গ্রীর কোন দো­ষে আর পীড়া বৃ­দ্ধি হই­বে না। আমি বি­শেষ সত­র্ক হইয়াছি। আমি অগ্রে না খাইয়া ইহা­কে আর কি­ছুই খা­­তে দিই না। যত পীড়া-যত অপ­কার, সক­লই আমি মা­থায় করিয়া লইয়াছি। খো­দা এক্ষ­ণে আরো­গ্য করি­লেই সকল কথা বলিব।"
হা­­নে­বা­নুর প্র­তি দৃ­ষ্টি­পাত করিয়া দী­র্ঘ­নি­­শ্বাস পরি­ত্যা­গপূর্বক ইমাম হা­সান বলি­লেন, "অদৃ­ষ্টের লে­খা খণ্ডা­­তে কা­হা­রো সা­ধ্য নাই। তো­মার যা­হা­তে সন্দেহ দূর হয়, তু­মি সেই প্র­কা­রে আমার আহা­রীয় পা­নীয় সমুদয় দ্র­ব্য সা­­ধা­নে যত্নে রা­খিয়ো।"
হা­­নে­বা­নু পূর্ব হই­তেই সত­র্কিত ছি­লেন, স্বা­মীর কথায় এক­টু আভাস পাইয়া আরো যথা­সা­ধ্য সা­­ধান সত­র্ক হই­লেন। আহা­রীয় সা­­গ্রী বি­শেষ যত্নে রক্ষিত হই­তে লা­গিল। বি­শেষ পরী­ক্ষা করিয়া হা­­নে­বা­নু রো­গীর পথ্য ইত্যা­দি প্র­দান করি­তে লা­গি­লেন। জলের সু­রা­হীর উপর পরি­ষ্কার বস্ত্র আবৃত করিয়া একে­বা­রে শী­­মো­হর বন্ধ করি­লেন। অপর কেহ হা­সা­নের ব্যা­ধি­গৃ­হে আসি­তে না পা­রে, কৌ­­লে তা­হারও ব্য­­স্থা করি­লেন; প্র­কা­শ্যে কা­হা­কে বা­রণ করি­লেন না। হো­সেনও সত­র্ক রহি­লেন। হা­­নে­বা­নুও সদা­­র্ব­দা সা­­ধা­নে থা­কি­তে লা­গি­লেন
জায়েদা মা­ঝে মা­ঝে স্বা­মী­কে দে­খি­তে আসি­তেন, কি­ন্তু জয়না­­কে স্বা­মীর নি­­টে বসিয়া থা­কি­তে দে­খি­লে আর ঘরেই প্র­বেশ করি­তেন না। জয়না­বের প্র­তি দৃ­ষ্টি পড়িলেই জায়েদার মু­খের আকৃ­তি পরি­­র্তন হইত, বি­দ্বে­ষা­নল জ্ব­লিয়া উঠিত, সপ­ত্নী­হি­­সা বল­­তী হইত, সপ­ত্নী সৃ­ষ্টি­কা­রীর প্র­তি প্র­তি­হি­­সা-আগুন দ্বি­গু­­ভা­বে জ্ব­লিয়া উঠিত। স্বা­মী-স্নেহ, স্বা­মী-মম­তা অন্তর হই­তে একে­বা­রে সরিয়া যা­ইত। অধ­র্ম-আচ­­ণে প্র­বৃ­ত্তি জন্মিত। কো­মল হৃদয় পা­ষা­ণে পরি­ণত হইত। হা­সা­নের আকৃ­তি বি­ষবৎ লক্ষিত হইত। ইচ্ছা হইত যে, তখ­নি-সেই মুহূর্তেই হয় নি­জের প্রাণ নয় জয়না­বের, না হয় যি­নি ইহার মূল তাঁহার- রো­গীর রো­­­য্যা দে­খি­তে কা­হা­রো নি­ষেধ নাই। পীড়িত ব্য­ক্তির তত্ত্বা­­ধা­রণ সে­বা-শু­শ্রূষা করি­তে কি দে­খি­তে আসি­লে নি­বা­রণ করা শা­স্ত্র-বহি­র্ভূত। এক­দিন জায়েদার সহিত মায়মু­নাও হজ­রত হা­সা­­কে দে­খি­তে আসিল। শয্যার কি­ঞ্চিৎ ব্য­­ধা­নে জায়েদা, তৎপা­র্শ্বে মায়মু­না। তাঁহা­দের নি­­টে অপ­রা­পর সক­লে শয্যার প্রায় চতু­ষ্পা­র্শ্বে ঘে­রিয়া বসিয়া আছেন। মায়মু­না প্র­তি­বে­শি­নী; আরো সক­লেই জা­নিত যে, মায়মু­না ইমা­­দ্বয়ের বড়ই ভক্ত। বা­ল্য­কাল হই­তেই উভয়কে ভা­­বা­সে। ইমা­­দ্বয়ের জন্ম­দি­­সে মায়মু­না কতই আন­ন্দ প্র­কাশ করিয়াছিল। জা­ন্না­­বা­সি­নী জগ­জ্জ­­নী বি­বি ফা­তে­মাও মায়মু­না­কে ভা­­বা­সি­তেন; মায়মু­নাও তাঁহা­কে ভক্তির সহিত ভা­­বা­সিত। হা­সান-হো­সেনও মা­তার ভা­­বা­সা বলিয়া মায়মু­না­কে বি­শেষ ভক্তি করি­তেন। মায়মু­না একাল পর্য­ন্ত তাঁহা­দের সুখ-দু­­খের ভা­গি­নী বলিয়াই পরি­চি­তা আছে। মায়মু­নার মন যে কা­লকূট বি­ষম বি­ষে পরিপূর্ণ, তা­হা জায়েদা ভি­ন্ন আর কেহ জা­নি­তে পা­রেন নাই। হা­­নে­বা­নু যে মায়মু­না­কে দুই চক্ষে দে­খি­তে পা­রি­তেন না, সে­টি তাঁহার স্ব­ভাব। মায়মু­নাও হা­­নে­বা­নুর প্র­তি কথায় কাঁদিয়া মা­টি ভি­জা­ইত না, সে­টিও মায়মু­নার স্ব­ভাব। হা­­নে­বা­নু মুখ ফু­টিয়া কোন দিন মায়মু­না­কে কোন মন্দ কথা বলেন নাই, অথচ মায়মু­না তাঁহা­কে দে­খিয়া হাড়ে কাঁপিত
ইমাম হা­সা­নের পীড়িত অব­স্থা দে­খিয়া মায়মু­নার চক্ষে জল আসিল। সক­লেই বলি­তে লা­গিল, "আহা! কো­লে-কাঁধে করিয়া মা­নুষ করিয়াছে, আর কাঁদি­বে না?" মায়মু­নার চক্ষের জল গণ্ড বা­হিয়া পড়িতে লা­গিল। মায়মু­না গৃ­­­ধ্য­স্থিত সক­লের দি­কেই এক এক­বার তা­কাইয়া চক্ষের জল দে­খা­ইল। মায়মু­না শু­ধু চক্ষের জলই সক­­কে দে­খা­­তে­ছে তা­হা নহে; আরো উদ্দে­শ্য আছে। ঘরের মধ্যে যে­খা­নে যে­খা­নে যে জি­নিস যে যে পা­ত্রে রক্ষিত আছে, তা­হা সক­লই মনঃ­সং­যোগ করিয়া জলপূর্ণ-নয়নে বি­শে­ষরূপে দে­খি­তে লা­গিল
হা­সা­নের জল­পি­পা­সা হইয়াছে। সঙ্কে­তে হা­­নে­বা­নু­কে জল­পা­নে­চ্ছা জা­না­­লেন। তি­নি মহা­ব্য­স্তে 'আব্খো­রা' পরি­ষ্কার করিয়া সু­রা­হীর শীল ভগ্ন করি­বেন এবং সু­রা­হীর জলে আব্খো­রা পূর্ণ করিয়া হা­সা­নের সম্মু­খে ধরি­লেন। জল­পা­নে তৃ­প্তি­লাভ করিয়া হা­সান পু­­রায় শয্যা­শায়ী হই­লেন। হা­­নে­বা­নু আব্খো­রা যথা­স্থা­নে রা­খিয়া, পূর্ববৎ বস্ত্র দ্বা­রা মুখ বন্ধ শী­­মো­হর করিয়া সু­রা­হী­টিও যথা­স্থা­নে রা­খিয়া দি­লেন
যে যা­হা­কে দে­খি­তে ইচ্ছা করে না, সে তা­হার নামও শু­নি­তে ভা­­বা­সে না। জগ­তে এমন অনেক লোক আছে, যা­হা­রা স্ব­ভা­­তঃই এক-এক­­­কে দে­খি­তে ভা­­বা­সে না। অন্য পক্ষে-পরিচয় নাই, শত্রু­তা, মি­ত্র­তা নাই, আলাপ নাই, স্বা­র্থ নাই, কি­ছুই নাই, তথা­পি মু­­খা­নি দে­খি­তে ইচ্ছা করে। মনের সহিত ভা­­বা­সি­তেও ইচ্ছা করে। এমন মুখও জগ­তে অনেক আছে, পরিচয়ে পরি­চিত না হই­লেও সেই মু­­খা­নি যত­বার দে­খি­তে পাওয়া যায়, তত­বা­রই সু­­বোধ হয়
হা­­নে­বা­নু জলের সু­রা­হী যথা­স্থা­নে রা­খিয়া ঈষৎ বি­­ক্তির সহিত মায়মু­নার দি­কে চা­হিয়া চলিয়া গে­লেন। রো­গীর রো­­­য্যার পা­র্শ্বে সক­লেই নী­রব! সক­লের মু­খা­কৃ­তিই মলিন। মায়মু­নার মুখ ফু­টিল
"আহা! নরা­ধম জা­হা­ন্না­মী কে? আহা এমন সো­নার শরী­রে কে এমন নি­র্দয়রূপে আঘাত করিয়াছে। আহা! জা­ন্না­­বা­সি­নী বি­বি ফা­তে­মার হৃদয়ের ধন, নূরন­বীর চক্ষের পু­ত্ত­লি যে হা­সান সেই হা­সা­নের প্র­তি এতদূর নি­ষ্ঠুর অত্যা­চার করিয়াছে? সে পা­পীর পাপ-শরী­রে রক্ত-মা­­সের লে­­মা­ত্রও নাই। নি­শ্চয়ই সে হৃদয় দু­র্জয় পা­ষা­ণে গঠিত। হায় হায়! চাঁদমু­­খা­নি একে­বা­রে মলিন হইয়া গিয়াছে।" এইরূপ কাঁদিয়া কাঁদিয়া মায়মু­না আরো কি­ছু বলি­তে অগ্র­সর হই­তে­ছিল, হা­সা­নের বি­­ক্তি­ভাব কা­সে­মের নি­বা­­ণে সে চে­ষ্টা থা­মিয়া গেল;-চরে জল অল­ক্ষি­তে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়িয়া আপ­না­­­নিই আবার শু­ষ্ক হইল
রো­গীর পথ্য লইয়া জয়নাব সেই গৃ­­­ধ্যে প্র­বেশ করি­লেন। জায়েদা আড়নয়নে বি­­দৃ­ষ্টি­তে দে­খিয়াই উঠিয়া চলিয়া গে­লেন। মায়মু­নাও হা­­নে­বা­নুর আসি­বার সাড়া পাইয়া আস্তে আস্তে গৃহ ত্যাগ করিল

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.