হাইডি_জোহান্না স্পাইরি : সৃজনানুবাদ_রেজা কারিম : পর্ব-৪

 
হাইডি রোজই পিটার ও ছাগলগুলোর সাথে আল্ম পর্বতে যেতো। এভাবে অনেক দিন অতিবাহিত হলো। হাইডিও ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। তার গায়ের রং আর সুন্দর হলো ও তার শক্তিও বৃদ্ধি পেলো।
 
শীত আসছিল। দিনগুলো ঠান্ডা হতে শুরু করেছিল। বাতাসও বইতে লাগলো। যখন খুব বেশি বাতাস বইতো তখন দাদা হাইডিকে ঘরের ভেতরে যত্নে আগলে রাখতো। পিটারের সাথে না যেতে পেরে তারা খারাপ লাগতো। কিন্তু ঘরের মাঝেও তার আনন্দে সময় কাটতো।
 
দাদার কাজের সময় সে তার দাদার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে তিনি কাঠের জিনিস বানাতেন। এবং প্রায়ই ঘরের এটা ওটা তিনি মেরামত করতেন। দুধ থেকে পনির বানানোর বিষয়টিও হাইডি অবাক হয়ে দেখে। কিন্তু পুরনো ফির গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার ভালো লাগে। সেখানে দাঁড়িয়েই সে বাতাসের গর্জন শোনে।
 
এক রাতে অনেক তুষার পড়েছিল। সকালে সবকিছুই ছিল সাদা ও সুন্দর। কিন্তু তারপরও তারা দরজা খুলতে পারেনি। প্রায় এক সপ্তাহ তাদের ঘরের ভেতরে থাকতে হয়েছিল।
 
রবিবারে পিটার তাদের দেখতে এসেছিল। তারা আগুনের পাশে বসেছিল। শুকনো গোশত খেতে খেতে তারা খোশগল্প করেছিল।
 
“তোমার স্কুল কেমন লাগছে?” দাদা জিজ্ঞেস করলেন।
 
“মোটেও ভালো না। আমি পড়তে শিখিনি। আমি কখনই শিখবনা।” বললো পিটার।
 
হাইডি স্কুল নিয়ে অনেক কিছু জানতে চেয়েছিল। পিটারকে সে অনেক প্রশ্ন করেছিল। পিটারের জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া অনেক কঠিন ছিল। অবশেষে সে বললো “আমার দাদী তোমার সাথে দেখা করতে চান। কোনো এক বিকালে তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে।”
 
হাইডিও খুব করে চেয়েছিল পিটারের দাদীর সাথে দেখা করতে। দুই দিন পরে পিটার তুষার শক্ত হয়েছিল। তারা বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। দাদা তার স্লেজগাড়ি বের করলেন। তিনি স্লেজগাড়িতে বসে হাইডিকে তার বাহুতে জড়িয়ে নিলেন। তারপর পর্বতের নিচের দিতে গোট পিটারের বাড়িতে পৌঁছেন।
 
“চলে এসো সন্ধ্যার আগে আগেই।” একথা বলেই তিনি উপরের দিকে উঠতে শুরু করলেন।
 
হাইডি দরজা খুলে ভেতরে গেলো। এটা তার দাদার বাড়ির মতো বড় এক রুমের বাড়ি নয়। এ বাড়িতে তিনটি রুম আছে। সবগুলোই ছোট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভেতরের সবকিছুই পুরনো ও জীর্ণশীর্ণ।
 
দ্বিতীয় রুমে একজন মহিলা বসে বসে একটি কোট মেরামত করছিলেন। এই কোটটি পিটারের। হাইডি এটা ভালো করেই চিনে। এক কোনে একজন বৃদ্ধ মহিলা বসে সেলাই করছিল। হাইডি তার কাছে গেল এবং তার হাত জড়িয়ে ধরলো।
 
“দাদী আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।” বৃদ্ধ মহিলা তার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিলেন।
 
“তুমিই কি সেই শিশু যে নাকি আল্ম অপার সাথে থাকে? তুমিই কি হাইডি?”
 
“হাঁ, আমি স্লেজে চড়ে আমার দাদার সাথেই এসেছি।” বললো হাইডি।
 
“কি! আল্ম অপা নিজে তোমাকে নিয়ে এসেছে? ব্রিজিট্টা, তুমি শুনেছো?” তিনি পিটারের মাকে বললেন।
তারা উভয়েই অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন।
“মেয়েটি দেখতে কেমন?” বৃদ্ধ মহিলা প্রশ্ন করলেন।
“অত্যন্ত সুশ্রী। ঠিক এডেলহাইডের মতন। কিন্তু চোখগুলো তার বাবার চোখের মতই বাদামি। ব্রিজিট্টা তার শাশুড়িতে বললেন।
 
হাইডি আগ্রহ নিয়ে ঘরের চারপাশ দেখছিল।
“দাদিমা দেখ, জানালাটি ভাঙা। এটি দেয়ালের সাথে বাড়ি খাচ্ছে।”
 
“আমি দেখতে পাই না কিন্তু শুনতে পাই।” বললেন দাদিমা। “কত রকমের শব্দ এই ঘরে হয় তখন বাতাস আসে। আমি রাতে জেগে যাই আর ভয় পাই যে ঘরটি আমাদের উপর ভেঙে পড়বে। আর আমরা সবাই মারা পড়বো।”
 
“কিন্তু তুমি কি জানালাটি দেখতে পাও না? হাইডি জিজ্ঞেস করলো।
“নারে দাদুভাই আমি কিছুই দেখতে পাই না। কিছুই না।”
 
“ঘরে অন্ধকার তবে তুমি যদি শুভ্র তুষারে বের হও, সেখানে আলো পাবে। আসো ও দেখ।” বললো হাইডি।
“নারে কেউ আমার চোখে আলো এনে দিতে পারবে না।”
“যখন সুর্য অস্ত যায় তখন পর্বতগুলোতে মনে হয় যেন আগুন লাগে, তাও কি তুমি দেখতে পারো না?” মন খারাপের সাথে বললো হাইডি।
 
“না দাদুভাই , আমি আর কখনোই পর্বতগুলোকে আগের মতো দেখতে পাবো না।” বললেন দাদীমা।
 
ব্যাপারটি হাইডির জন্য কষ্টদায়ক ছিল। সে হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করলো। সে অনেকক্ষন ধরে কাঁদে। তারা কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারলো না।
অবশেষে দাদীমা বললেন “এসো আর আমার সাথে কথা বলো। হাইডি , আমি তোমাকে দেখে না তবে তোমার কথাগুলো শুনতে আমার ভালো লাগে। আমাকে বলো তুমি ও আল্ম অপা বাড়িতে কী কী করো। তোমার দাদাকে একসময় আমি ভালোই চিনতাম।”
 
অবশেষে হাইডি কান্না থামালো। সে তার দাদার সাথে বাড়িতে কী কী করেছিল সব বললো। দাদীমা ও ব্রিজিট্টা সেসব শুনে খুবই অবাক হলো।
“তিনি তার নাতনির প্রতি খুবই দয়ালু।” বললেন তারা।
হাইডি পিটারের ফেরার পর তার সাথে কথা বললো।
“তোমার স্কুলে কেমন কাটলো?” দাদিমা জিজ্ঞেস করলেন। “তোমার পড়ার অবস্থা কী?”  “ঐ একই। আগের মতো।”
“ওহ পিটার! তোমার বয়স এখন প্রায় বারো। আমি ভেবেছিলাম তুমি পড়তে শিখবে।”
এই বলে তিনি হাইডির দিকে ফিরলেন।
 
“ঐ যে উপরে বইটি দেখতে পাচ্ছো? এর মধ্যে অনেকগুলো সুন্দর গান রয়েছে। আমি এগুলো এখন আর মনে করতে পারিনা। আমি চাই পিটার এগুলো আমাকে পড়ে শোনাক। কিন্তু সে পড়তে শিখতে পারে না। পড়ালেখা নাকি তার কাছে খুব কঠিন মনে হয়।”
 
হঠাৎ হাইডি লাফিয়ে ওঠে। “অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে।”
 
বাইরে দাদা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি হাইডিকে কোল নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগলেন।
সন্ধ্যায় হাইডি দাদাকে গোট পিটারের বাড়ি সম্পর্কে সবকিছু বললো।
“সবকিছুই ভাঙা। বাতাস এলে ঘরটি নড়ে ও শব্দ করে। দাদিমা ভয়ে থাকেন যে কখন ঘরটা তাদের উপর ভেঙে পড়ে। দাদা, তুমি তো ঘরটি ঠিক করে দিতে পারো। পারবে না? আগামিকাল ঠিক করে দাও না।”
 
দাদা এক মিনিট চুপ থাকলেন। তিনি হাইডির দিকে তাকালেন ও বললেন “হুম, আগামিকাল ঠিক করে দিবো।”
 
পরদিন তারা উভয়েই পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলো। হাইডি ঘরের ভেতরে গেলো আর দাদা বাইরে অবস্থান নিলো। হাইডি যখন দাদিমার সাথে কথা বলছিল দাদা তখন জানালা ও ছাদটা ঠিক করছিল। দাদিমা তাকে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু দাদা ভেতরে গেলেন না।
 
“না, আমি জানি তোমরা আমার সম্পর্কে কী বলো?” আল্ম অপা বললেন।
শীতের প্রতিটি শীতের দিনে দাদিমাকে হাইডি দেখতে যেতো। মাঝে মাঝে দাদাও যেতেন ও ঘরটিকে ঠিকঠাক করে দিতেন। আর এরপর থেকে রাতে আর কোনো শব্দ হতো না।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.