বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ১৮তম প্রবাহ

 
এজি­দ্ যে দি­বস হা­সা­নের মৃ­ত্যু­সং­বাদ পা­­লেন, মনের আন­ন্দে সেই দি­নই অকা­­রে ধন­ভা­ণ্ডার খু­লিয়া দিয়াছেন। দি­বা-রা­ত্রি আমোদ-আহ্লাদ। স্ব­দে­­জাত "মা­­ল্-আনব"-না­মক চি­ত্ত-উত্তে­জক মদ্য সর্ব­দাই পান করি­তে­ছেন। সু­খের সী­মা নাই। রা­­প্রা­সা­দে দি­বা­রা­ত্রি সন্তো­ষসূচক 'সা­দিয়ানা' বা­দ্য বা­জি­তে­ছে।পূর্বেই সং­বাদ আসিয়াছে মায়মু­নার সঙ্গে জায়েদা দা­মে­স্কে আসি­তে­ছেন। আজই আসি­বার সম্ভা­­না। চি­ন্তাও এজি­দের মনে রহিয়াছে। স্বা­মী­­ন্তা জায়েদা­কে দে­খি­তে এজি­দের বড়ই সাধ হইয়াছে। জায়েদা­কে অঙ্গী­কৃত অর্থ দান করি­বেন-এই প্র­তি­জ্ঞা­টিও প্র­তি­পা­লন করি­বেন। মায়মু­না­কে কী প্র­কা­রে পু­­স্কৃত করি­বেন, নব­­­­তি এজি­দ্ তা­হাও চি­ন্তা করি­তে­ছেন। পূর্বেই ঘো­­ণা করিয়া দিয়াছেন যে, "আমার পর­­­ত্রু­­ধ্যে এক­­­কে মারওয়ানই কৌ­শল করিয়া বধ করিয়াছে, দা­মে­স্কের ঘরে ঘরে সক­লে আমোদ-আহ্লা­দে প্র­বৃ­ত্ত হউক।অর্থের অন­টন হই­লে তজ্জ­ন্য রা­­ভা­ণ্ডার অবা­রি­তরূপে খো­লা রহিল। সপ্তা­­কাল রা­­কা­র্য বন্ধ;-দি­বা­রা­ত্রে কে­বল আন­ন্দ­স্রোত বহি­তে থা­কি­বে। যে ব্য­ক্তি হা­সা­নের মৃ­ত্যু­সং­বা­দে দু­­খিত হই­বে, কি­­বা শো­কা­শ্রু বি­নি­র্গত করি­বে, কি­­বা কোন প্র­কার শো­­চি­হ্ন অঙ্গে ধা­রণ করি­বে, তা­হার গর্দান মা­রা যা­­বে। যদি প্র­কাশ পায় যে, এই সপ্তা­­কা­­­ধ্যে কেহ কোন কা­­ণে দু­­খের সহিত এক বি­ন্দু চক্ষের জল ফে­লিয়াছে, তা­হার শরীর হই­তে সহ­স্রা­ধিক শো­ণি­­বি­ন্দু বহি­র্গত করা হই­বে।" অনে­কেই মহা­­র্ষে রা­জা­জ্ঞা প্র­তি­পা­লন করি­তে­ছে; কেহ কেহ প্রা­ণের ভয়ে আমো­দে মা­তিয়াছে।
সু­­জ্জিত প্র­­রী­বে­ষ্টিত হইয়া মায়মু­নার সহিত জায়েদা দা­মে­স্ক নগ­রে উপ­স্থিত হই­লেন।জায়েদার আগ­মন সং­বাদ প্রা­প্ত হইয়া মনে মনে কি অনু­ধ্যা­নপূর্বক এজি­দ্ বলি­লেন, "আজি আমার শরীর কি­ছু অসু­স্থ। জায়েদা এবং মায়মু­না­কে বি­শেষ অভ্য­র্থ­নার সহিত আমার উদ্যা­­স্থ প্র­মো­­­­নে স্থান দান কর।যথা­যো­গ্য আদ­রে তা­হা­দি­­কে গ্র­হণ কর। কোন বিষয়ে যেন অম­র্যা­দা কি­­বা কোন ত্রু­টি না হয়। আগা­মী­­ল্য প্র­থম প্র­কা­শ্য দর­বা­রে তা­হা­দের সহিত আমার দে­খা হই­বে। পরে অন্য কথা।"
এইরূপ উপ­দেশ দিয়া রা­জা এজি­দ্ তদ­র্থ উপ­যু­ক্ত লোক নি­যু­ক্ত করি­লেন। এজি­দের আজ্ঞা­ক্র­মে, তাঁহার উপ­দে­­­তে সমুদয় কা­র্য সু­­ম্প­ন্ন হইল। জায়েদা মায়মু­না যথা­যো­গ্য সমা­­রে প্র­মো­­­­নে স্থান পা­­লেন। পরি­চা­রক, পরি­চা­রি­কা, রক্ষক, প্র­­রী সক­লই নিয়োজিত হইল। দে­খি­তে দে­খি­তে সূর্য­দেব অস্তা­­লে গমন করি­লেন। নি­শা যে কী জি­নিস, আর ইহার ক্ষ­­তা যে কী, তা­হা বোধ হয় আজ পর্য­ন্ত অনে­কেই বু­ঝি­তে পা­রেন নাই। সম­স্ত দিন চি­­দু­­খে কা­টাইয়া, কু­­কি­নী নি­শার আগ­­নে নি­দ্রায় অভিভূত হই­লে সে দু­­খের কথা কা­হার মনে থা­কে? নি­শ্চয়ই সূর্য উদয় হই­লে প্রা­­বিয়োগ হই­বে, কথা জা­নিয়াও যদি রা­ত্রে নি­দ্রা­ভিভূত হয়, তা­হা হই­লে প্র­ভা­তের ভা­বী ঘট­নার কথা কি সেই দণ্ডা­জ্ঞা­প্রা­প্ত অভা­গার মনে পড়ে? দি­­সে সন্তান-বিয়োগ হইয়াছে, কু­­কি­নী আসিয়া চতু­র্দিক অন্ধ­কার করিল, ক্র­মে জগৎ নি­স্ত­ব্ধ করিল, অজ্ঞা­­সা­রে নি­দ্রা­কে আহ্বান করিল, সন্তা­নের বিয়োগ­­নিত দু­ঃখ কি তখন সন্তা­­বিয়োগীর মনে থা­কে?-জায়েদা প্র­মো­­­­নে পরি­চা­রি­কা­বে­ষ্টি­তা হইয়া সু­­স্ব­চ্ছ­ন্দে স্ব­র্ণ­পা­­ঙ্কে কো­মল শয্যায় শুইয়া আছেন। কত কী ভা­বি­তে­ছেন, তা­হার তর­ঙ্গ অনেক। প্র­­­তঃ দশ সহ­স্র স্ব­র্ণ­মু­দ্রা, তা­­পর রা­­রা­ণী। এই প্র­থম নি­শা­তেই সু­­সো­পা­নে আরো­হণ করিয়াছেন? প্র­ভাত হই­লেই রা­­­­বা­রে নীত হই­বেন, সু­খের প্রা­ঙ্গ­ণে পদা­র্পণ করি­বেন, তৎপরেই গৃ­­প্র­বেশ! পর­মায়ুর শেষ পর্য­ন্ত সুখ-নি­কে­­নে বাস করি­বেন। মায়মু­না রা­­রা­ণী হই­বে না, শু­ধু কে­বল স্ব­র্ণ­মু­দ্রা­প্রা­প্ত হই­বে মা­ত্র!
জায়েদার শয্যার পা­র্শ্বেই নি­ন্ম­তর আর এক­টি শয্যায় মায়মু­না শয়ন করিয়া আছে। তা­হার মনে কী কোন চি­ন্তা নাই?-আশা নাই?-আছে। মারওয়ানের স্বী­কৃত অর্থ মদি­নায় বসিয়াই পা­­তে পা­রিত, এতদূর পর্য­ন্ত আসি­বার কা­রণ কি­ছু বে­শির প্র­ত্যা­শা। উভয়েই আপন আপন চি­ন্তায় চি­ন্তিত, উভয়েই নী­রব। নি­শার কা­র্য নি­শা ভু­লে নাই। ক্র­মে ক্র­মে উভয়েই নি­দ্রার কো­লে অচে­তন। এক­বার এই সময়ে এজি­দের শয়নগৃ­­টি দে­খিয়া আসা আব­শ্যক। আজ এজি­দের মনের ভাব কিরূপ?-এত আশা এবং এত সু­­কা­­নার মধ্যে আবার কি­সের পীড়া? এজি­দ্ আজ মনের মত মন­তো­ষি­ণী সু­রা­পান করিয়া বসিয়া আছেন, এখ­নো শয়ন করেন নাই।সম্মু­খে পা­­পা­ত্র, পেয়ালা এবং মদি­রাপূর্ণ সু­রা­হী ধরা রহিয়াছে। রজ­­প্র­দী­পে সু­­ন্ধি-তৈলে আলো জ্ব­লি­তে­ছে। জন­প্রা­ণী­মা­ত্র সে গৃ­হে নাই। গৃ­হের দ্বা­রে, কি­ঞ্চিৎ দূরে নি­ষ্কো­ষিত অসি­­স্তে প্র­­রী সত­র্কি­­ভা­বে প্র­­রি­তা করি­তে­ছে। মদ্য­পা­নে অজ্ঞা­­তা জন্মে, সা­ধ্যা­তীত ব্য­­হার করি­লে মা­­­প্র­কৃ­তি বি­কৃ­তি­প্রা­প্ত হয়। মা­নুষ তখন পশু হই­তেও নীচ হইয়া পড়ে। কি­ন্তু সা­ধ্য-সম­তার অতীত না হই­লে বোধ হয় অতি জঘ­ন্য হৃদয়ে অনেক উৎকৃ­ষ্ট ভাবও আসিয়া উপ­স্থিত হয়। এজি­দ্ আজ একা একা অনেক কথা বলি­তে­ছেন। বোধ হয়, সু­রা­দে­বীর প্র­সা­দে তাঁহার পূর্ব­কৃত কা­র্য একে একে স্ম­­­­থে উপ­স্থিত হইয়াছে। প্র­থম জয়না­­কে দর্শন,-তা­হার পর পি­তার নি­কট মনো­গত ভাব প্র­কাশ,-তা­হার পর মা­বিয়ার রোষ,-পরে আশ্বাস প্রা­প্তি,-আব­দুল জা­ব্বা­রের নি­­ন্ত্রণ কল্পি­তা ভগ্নীর বি­বাহ-প্র­স্তাব,-অর্থ লা­­সায় আব­দুল জা­ব্বা­রের জয়নাব পরি­ত্যাগ, বি­বাহ জন্য কা­সেদ প্রে­রণ,-বি­­­­নো­­থে কা­সে­দের প্র­ত্যা­­মন,-পীড়িত পি­তার উপ­দেশ, প্র­­মে কা­সে­দের শর­নি­ক্ষে­পে প্রা­­সং­হার, মো­স্লে­­কে কৌ­­লে কা­রা­­দ্ধ করা,-পি­তার মৃ­ত্যু, নি­­­রা­ধে মো­স্লে­মের প্রা­­­ণ্ড, হা­সা­নের সহিত যু­দ্ধ­ঘো­­ণা, যু­দ্ধে পরাজয়ের পর নূতন মন্ত্র­ণা,-মায়মু­না এবং জায়েদার সহায়ে হা­সা­নের প্রা­­বি­নাশ, মারওয়ানের প্র­ভু­­ক্তি,-জায়েদা এবং মায়মু­নার দা­মে­স্কে আগ­মন, প্র­মো­­­­নে স্থা­­নি­র্দেশ। এজি­দ্ ক্র­মে ক্র­মে এই সকল বিষয় আলো­­না করি­লেন। সু­রা­প্র­ভা­বে মনের কপ­­তা দূর হইয়াছে; হি­­সা, দ্বেষ, শত্রু­তা সময়ে অন্তর হই­তে অনেক পরি­মা­ণে বিদূরিত হইয়াছে। আজ এজি­দের চক্ষের জল পড়িল; কেন পড়িল, কে বলি­বে? পা­ষা­ণময় অন্তর আজ কেন কাঁদিল? কে জা­নি­বে? কী আশ্চ­র্য! যদি সু­রার প্র­ভা­বে এখন এজি­দের চি­­­লু­ষিত পা­পময় কু­টিল অন্ত­রে সর­­ভা­বে পবি­ত্র­তা আসিয়া থা­কে, তবে সু­রা! তো­মা­কে শত শত বার নম­স্কার! শত শত বার ধন্য­বাদ! জগ­তে যদি কি­ছু মূল্য­বান বস্তু থা­কে, সেই মূল্য­বান বস্তু তবে তু­মি! হে সু­রে­শ্ব­রী! পু­­র্বার আমি ভক্তি­ভা­বে তো­মা­কে শত শত ধন্য­বাদ প্র­দান করি!! এজি­দ্ আর এক পা­ত্র পান করি­লেন। কোন কথা কহি­লেন না।ক্ষ­­কাল নি­স্ত­ব্ধ­ভা­বে থা­কিয়া শয্যায় শয়ন করি­লেন।
প্র­মো­­­­নে জায়েদা মায়মু­না নি­দ্রি­তা। রা­­প্রা­সা­দে এজি­দ্ নি­দ্রিত; মদি­নায় হা­সা­নের অন্তঃ­পু­রে হা­­নে­বা­নু নি­দ্রি­তা; জয়নাবও বোধ হয় নি­দ্রি­তা। এই কয়টি লো­কের মনো­ভাব পৃ­থক পৃ­­করূপে পর্যা­লো­­না করি­লে ঈশ্ব­রের অপার মহি­মার এক­টি অপ­রি­সীম দৃ­ষ্টা­ন্ত­প্রা­প্ত হওয়া যায়। যদি ইহা­রা সক­লেই নি­দ্রি­তা­­স্থায় আপন আপন মনো­মত ভা­বের ফলা­নু­যায়ী স্ব­প্নে মা­তিয়া থা­কেন, তবে কে কি দে­খি­তে­ছেন? বোধ হয় জয়নাব আলু­লায়িত কে­শে, মলিন বস­নে, উপা­ধা­নশূন্য মৃ­ত্তি­কা­­য্যায় শয়ন করিয়া-হা­সা­নের জী­বি­­কা­লের কা­র্য­­লা­পে অর্থাৎ বি­বা­হের পর­­র্তী ঘট­না­­লী,-যা­হা তাঁহার অন্ত­রে চি­­নি­হিত রহিয়াছে, তা­হা­রই কোন-না-কোন অংশ লইয়া স্ব­প্নে ব্য­তি­ব্য­স্ত রহিয়াছেন। হা­­নে­বা­নুও স্ব­প্ন­যো­গে স্বা­মীর জ্যো­তি­র্ময় পবি­ত্র দে­হের পবি­ত্র কা­ন্তি দে­খিয়া কতই আন­ন্দ অনু­ভব করি­তে­ছেন। স্ব­র্গের অপ­রি­সীম সু­­ভো­গে লা­লায়িতা হইয়া ইহ­জী­বন ত্যা­গে স্বা­মী­­­প্রা­ন্তে থা­কি­তে যেন ঈশ্ব­রের নি­কট কতই আরা­­না করি­তে­ছেন। জায়েদা বোধ হয়, এক-এক­বার ভী­ষণ মূর্তি স্ব­প্নে দে­খিয়া নি­দা­রুণ আত­ঙ্কে জড়সড় হই­তে­ছেন, ফুঁকা­রিয়া কাঁদি­তে পা­রি­তে­ছেন না, পলা­­বার উপ­যু­ক্ত স্থানও খুঁজিয়া পা­­তে­ছেন না। স্ব­প্ন­কু­­কে ত্র­স্ত­­দে যা­­বারও শক্তি নাই, মনে মনে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কতই মি­­তি করি­তে­ছেন। আবার সে সক­লই যেন কো­থায় মি­শিয়া গেল। জায়েদা যেন রা­­রা­ণী, শত শত দা­সী-সে­বি­তা, এজি­দের পা­­রা­ণী, সর্বময়ী গৃ­হি­ণী। আবার যেন তা­হাও কো­থায় মি­শিয়া গেল! জায়েদা যেন স্বা­মীর বন্দি­নী। প্রা­­বি­না­শি­নী বলিয়া অপ­রা­ধি­নী;-ধর্মা­­নে এজি­দ্ যেন বি­চা­­­তি। মায়মু­না টা­কার ভার আর বহি­তে সহি­তে পা­রি­তে­ছে না। এত টা­কা লইয়া কী করি­বে? কো­থায় রা­খি­বে? আবার যেন টা­কা কে কাড়িয়া লইল! মায়মু­না কাঁদি­তে­ছে। টা­কা অপ­হা­রক বলি­তে­ছে, "নে-পা­পীয়সী। এই নে! তোর পা­পপূর্ণ টা­কা লইয়া আমি কি করিব?" এই বলিয়া টা­কা নি­ক্ষেপ করিয়া মায়মু­নার শি­রে যেন আঘাত করি­তে লা­গিল!মায়মু­না কাঁদিয়া অস্থির। তা­হার কা­ন্নার রবে জায়েদার নি­দ্রা­­ঙ্গ হইল। এজি­দের বি­চার হই­তেও তি­নি নি­ষ্কৃ­তি পা­­লেন।
যে গৃ­হে জায়েদা মায়মু­না, সেই শয়নগৃ­হে আর আর সক­লে নি­দ্রিত, কে­বল তা­হা­রা দুই জনেই জা­গিয়া আছেন। উভয়ে পর­স্পর অনেক কথা কহি­তে লা­গি­লেন।
এজি­দ্ সু­রা­প্র­ভা­বে ঘোর নি­দ্রা­ভিভূত। অনেক দি­নের পর পি­তা­কে আজ বোধ হয় স্ব­প্নে দে­খিয়াই বলি­লেন, "আমা­কে রক্ষা করুন। আমি আর কখ­নোই হা­সা­নের অনি­ষ্ট করিব না।" মা­­­তার অনেক লা­ঘব হইয়াছে; কি­ন্তু পি­পা­সার ক্র­­শঃই বৃ­দ্ধি। শয়নকে সু­শী­তল জলপূর্ণ স্ব­র্ণ­সু­রা­হী ছিল, জল পান করিয়া পি­পা­সা নি­বৃ­ত্তি করি­লেন। শু­­তা­রার উদয় দে­খিয়া আর ঘু­মা­­লেন না;-প্রা­তঃ­ক্রিয়াদি সমা­পন করিয়া রা­­­রি­চ্ছদ ধা­রণ করি­লেন। এদি­কে জগৎলো­চন-রবি­দেব সহ­স্র কর বি­স্তার করিয়া আসি­তে­ছেন;-কা­হার সা­ধ্য, তাঁহার সম্মু­খে দাঁড়ায়! শু­­তা­রার অন্ত­র্ধান, ঊষার আগ­মন প্র­স্থান; দে­খি­তে দে­খি­তে সূর্য­দে­বের অধি­ষ্ঠান।এজি­দের প্র­কা­শ্য দর­বার দে­খি­বার আশায়ই যেন লো­হি­­­র্ণ ধা­রণ করিয়া পূর্বা­কা­­­তি হা­সি­তে হা­সি­তে পূর্বা­কা­শে দে­খা দি­লেন-হা­সি­তে হা­সি­তে দা­মে­স্ক নগ­রী­কে জা­­রিত করি­লেন। স্বা­মী­­ন্তা জায়েদা­কে এজি­দ্ পু­­স্কৃত করি­বেন, সা­হা­য্য­কা­রি­ণী মায়মু­না­কেও অর্থ­দান করি­বেন, জায়েদা­কেও মারওয়ানের স্বী­কৃত স্ব­র্ণ­মু­দ্রা দান করিয়া প্র­তি­জ্ঞা রা করি­বেন, অধি­­ন্তু জায়েদা­কে পা­­রা­ণীরূপে গ্র­হণ করি­বারও ইচ্ছা আছে; সূর্য­দেব প্র­তি ঘরে ঘরে স্ব­কীয় কি­রণ বি­কি­­ণের সহিত কথা­গু­লি ঘো­­ণা করিয়া দি­লেন। রা­­মু­কুট শি­রে ধা­রণ করিয়া মহা­রাজ এজি­দ্ খা­স্ দর­বা­রে বার দি­লেন। প্র­­রি­গণ সশ­স্ত্রে শ্রে­ণী­­দ্ধ হইয়া দণ্ডায়মান হইল। অমা­ত্য­গণ এবং পূর্বাহূত নগ­­স্থ প্র­ধান প্র­ধান মা­­নীয় মহোদয়গণ স্ব-স্ব স্থান পূর্ণ করিয়া দর­বা­রের শো­ভা সম্ব­র্ধন করি­লেন। জায়েদা মায়মু­না পূর্ব-আদেশ অনু­সা­রে পূর্বেই দর­বা­রে নীত হইয়াছি­লেন। শা­হী­­ক্তের বা­­পা­র্শ্বে দু­­টি স্ত্রী­লোক। জায়েদা রজ­তা­­নে আসী­না, মায়মু­না কা­ষ্ঠা­­নে উপ­বি­ষ্টা। জায়েদার প্র­তি অনে­কে­রই দৃ­ষ্টি পড়িতে­ছে। যাঁহা­রা জায়েদার কৃ­­কা­র্য বিষয়ে সবি­শেষ পরি­জ্ঞাত, অথচ ইমাম হা­সা­নের প্রিয়পা­ত্র ছি­লেন।তাঁহা­রা জায়েদার সা­­­কে ধন্য­বাদ দিয়া তা­হার ঘর্মা­ক্ত ললাট, বি­স্ফা­রিত লো­চন আয়ত ভ্রূযু­­লের প্র­তি ঘন­ঘন সস্পৃহ দৃ­ষ্টি­পাত করি­তে­ছেন।
এজি­দ্ বলি­তে লা­গি­লেন, "আপ­না­রা সক­লেই অব­গত আছেন যে, হা­সান আমার চি­­­ত্রু ছিল, না­না­প্র­কা­রে আমার মনে কষ্ট দিয়াছে। আমি কৌ­শল করিয়া এই সি­­হা­সন রক্ষা করিয়াছি; সেই চি­­­ত্রু হা­সান কোন বিষয়েই আমার অপে­ক্ষা শ্রে­ষ্ঠ ছিল না, তথাচ তা­হার বং­­গৌ­রব এত প্র­বল ছিল যে, না­না­প্র­কার অয­থা কটূক্তি দ্বা­রা সর্ব­দাই আমার মনে ব্য­থা দিয়াছে। আমি সে­দি­কে লক্ষ্য করি নাই। রা­জ্য বি­স্তা­রই আমার কর্ত­ব্য কা­র্য। বি­শেষ মদি­না­রা­জ্যের শা­­­ভার নি­­­হায়, নি­র্ধন ভি­খা­রির হস্তে থা­কা অনু­চিত বি­বে­­না করিয়া প্র­­­তঃ কা­সে­দের দ্বা­রা তাঁহা­দি­­কে আমার বশ্য­তা স্বী­কার করি­বার আদেশ করা হইয়াছিল। সে কথা তাঁহা­রা অব­হে­লা করিয়া কা­সে­দ্কে বি­শেষ তি­­স্কা­রের সহিত দা­মে­স্ক সি­­হা­­নের অব­মা­­না করিয়া, আমার লি­খিত পত্র শত খণ্ডিত করিয়া উত্ত­­স্বরূপ সেই কা­সে­দের হস্তে পু­নঃ­প্রে­রণ করিয়াছিল। সেই কা­­ণেই আমি যু­দ্ধ ঘো­­ণা করি। প্রিয় মন্ত্রী মারওয়ান­কে সেই যু­দ্ধে "সি­পা­­সা­লার" (প্র­ধান সৈন্যা­ধ্য­ক্ষ) পদে বরণ করিয়া বহু­সং­খ্যক সৈন্য­সহ হা­সা­­কে বাঁধিয়া আনি­তে মদি­নায় প্রে­রণ করি। আমার সৈন্য­­ণের মধ্যে অনে­কেই বি­শ্বা­­ঘা­­­তা করিয়া হা­সা­নের পক্ষে মি­লিত হয় এবং দা­মে­স্কের অব­শি­ষ্ট সৈন্য­দি­­কে আক্র­মণ করিয়া যু­দ্ধে পরা­স্ত করে। কি করি, চি­­­ত্রু দমন না করি­লেও নহে, এদি­কে সৈন্য­দি­­কের চক্রে বা­ধ্য হইয়া হা­সা­নের প্রাণ কৌ­­লে গ্র­হণ করাই যু­ক্তি­সি­দ্ধ বি­বে­­না হয়। এই যে কা­ষ্ঠা­­নো­­রি উপ­বি­ষ্টা বি­বি মায়মু­না­কে দে­খি­তে­ছেন, ইহার কল্যা­ণে-আর এই রজ­তা­­নে উপ­বি­ষ্টা বি­বি জায়েদার সা­হা­য্যে আমার চি­­­ত্রু বি­­ষ্ট হইয়াছে।বি­বি জায়েদা আমার জন্য বি­স্তর পরি­শ্রম স্বী­কার করিয়াছেন। কয়েক­বার স্ব­­স্তে আপন স্বা­মী হা­সা­­কে বি­­পান করাইয়াছি­লেন, শে­ষে হী­­কচূর্ণ জলে মি­শাইয়া পান করা­­লেন। তা­হা­তেই চি­­­ত্রু, আমার চি­­­ত্রু ইহ­জগৎ পরি­ত্যাগ করিয়াছে। আমি এই মহোদয়ার কৃ­পা­তেই শত্রু­বি­হীন হইয়াছি। এই গু­­­তী রম­ণীর অনু­গ্র­হেই আমি প্রা­ণে বাঁচিয়াছি, এই সদাশয়া লল­নার কৌ­­লেই আজ আমার মন কি­ঞ্চিৎ শা­ন্তি­লাভ করিয়াছে। বহু চে­ষ্টা বহু পরি­শ্র­মের ফল এই মহা­­তী যু­­তীর দ্বা­রাই সু­­ক্ব হইয়া ফলিয়াছে। আর এই বি­বি মায়মু­না, ইহার সহিত এই কথা ছিল যে, যে কৌ­­লে, যে কু­­কেই হউক, হা­সা­­কে প্রা­ণে মা­রি­তে পা­রি­লে ইনি সহ­স্র স্ব­র্ণ­মু­দ্রা পা­রি­তো­ষিক প্রা­প্ত হই­বেন।"
ইঙ্গি­­মা­ত্র কো­ষা­ধ্য সহ­স্র স্ব­র্ণ­মু­দ্রা পরিপূর্ণ থলিয়া আনিয়া বি­বি মায়মু­নার সম্মু­খে রা­খিয়া দিয়া, সস­ম্ভ্র­মে পূর্ব­স্থা­নে পূর্ববৎ কর­জোড়ে দণ্ডায়মান রহিল।
এজি­দ্ পু­­র্বার বলি­তে লা­গি­লেন, "রজ­তা­­­­রি­শো­ভি­তা এই বি­বি জায়েদার সহিত এই অঙ্গী­কার করিয়াছি­লাম যে, আপ­নার প্রিয়তম পতির প্রাণ যদি আপ­নি বি­নাশ করি­তে পা­রেন, তবে সহ­স্র স্ব­র্ণ­মু­দ্রা, মূল্য­বা­ন্ বস্ত্র মণিময় অল­ঙ্কার দান করিয়া রা­­সি­­হা­­নে বসা­ইব।"
সঙ্কে­­মা­ত্র কো­ষা­ধ্য সহ­স্র স্ব­র্ণ­মু­দ্রাপূরিত কয়েক­টি রে­­­­স্ত্রের থলিয়া, রত্নময় অল­ঙ্কার এবং কা­রু­কা­র্য­­চিত বি­চি­ত্র বসন জায়েদার সম্মু­খে রা­খিয়া দিল।
কিয়ৎক্ষণ চি­ন্তা করিয়া এজি­দ্ আবার বলি­লেন, "যদি ইচ্ছা হয়, তবে বি­বি জায়েদা এই সি­­হা­­নে আমার বাম পা­র্শ্বে আসিয়া বসুন।-বি­বি জায়েদা! আপ­নি আপ­নার অঙ্গী­কার পরিপূর্ণ করিয়াছেন, এখন আমিও আমার অঙ্গী­কার পরিপূর্ণ করি।"
জায়েদা মনে মনে ভা­বি­লেন, বস্ত্র, অল­ঙ্কার মো­হর, সক­লই তো পাইয়াছি; এক রা­­রা­ণী হওয়াই বা­কি ছিল, রা­জা যখন নি­জেই তাঁহার বা­­পা­র্শ্বে বসি­তে আদেশ করি­তে­ছেন, তখন সে আশাও পূর্ণ হইল। বি­বাহ না হয় পরেই হই­বে। রা­­রা­ণী করিয়া আর আমা­কে পরি­ত্যাগ করি­তে পা­রি­বেন না। এই ভা­বিয়া বু­দ্ধি­­তী জায়েদা সন্তু­ষ্ট হৃদয়ে রজ­তা­সন পরি­ত্যা­গপূর্বক রা­­সি­­হা­­নে এজি­দের বা­­পা­র্শ্বে গিয়া উপ­বে­শন করি­লেন।
এজি­দ্ বলি­লেন, "আমার প্র­তি­জ্ঞা পূর্ণ হইল। এক্ষ­ণে আমার কয়েক­টা কথা আছে, আপ­না­রা সক­লেই মনো­যো­গপূর্বক শ্র­বণ করুন।"-এই কথা বলিয়াই এজি­দ্ সি­­হা­সন ছাড়িয়া একে­বা­রে নি­চে না­মি­লেন। জায়েদা আর তখন কি বলিয়া সি­­হা­­নে বসিয়া থা­কি­বেন, সল­জ্জ­ভা­বে অতি ত্র­স্তে তি­নিও সি­­হা­সন পরি­ত্যাগ করিয়া সভা­স্থ­লে এজি­দের পা­র্শ্ব­দে­শে দাঁড়াই­লেন।
এজি­দের বা­ক্য­স্রোত বন্ধ হইল। স্ত­ম্ভিত হইয়া দাঁড়াই­লেন। জায়েদার সি­­হা­সন পরি­ত্যাগ দে­খিয়া,-ক্ষ­­কাল নী­­বে থা­কিয়া, পু­­রায় বলি­তে আর­ম্ভ করি­লেন, "আমার শত্রু­কে এই বি­বি জায়েদা বি­নাশ করিয়াছেন, আমি ইহার নি­কট আজী­বন কৃ­­জ্ঞ­তা­­ণে আব­দ্ধ থা­কি­লাম। কি­ন্তু সা­মা­ন্য অর্থ­লো­ভে এমন প্রিয়তম নি­র্দে­াষ পতির প্রাণ যে রা­ক্ষ­সী বি­নাশ করিয়াছে, তা­হা­কে কি বলিয়া কো­ন্ বি­শ্বা­সে আমার জী­­নের চি­­­ঙ্গি­নী সহ­­র্মি­ণী পদে বরণ করিয়া লইব? আমার প্র­লো­­নে ভু­লিয়া যে পি­শা­চী এক স্বা­মীর প্রাণ বি­নাশ করিল, অন্য কা­হা­রো প্র­লো­­নে ভু­লিয়া সেই পি­শা­চী আমার প্রাণও তো অনায়াসে বি­নাশ করি­তে পা­রে! যে স্ত্রী স্বা­মী­ঘা­তি­নী,-স্ব­­স্তে স্বা­মীর প্রাণ বধ করি­তে যে এক বার নয়, দুই বার নয়, কয়েক বার বিষ দিয়া শেষ বা­রে কৃ­­কা­র্য হইল, আমি দণ্ড­ধর রা­জা, তা­হার সমু­চিত শা­স্তি বি­ধান করা কী আমার কর্ত­ব্য নহে? ইহার ভার আমি আর কা­হা­রো হস্তে দিব না; পা­পীয়সীর শা­স্তি, আমি গত­রা­ত্রে আমার শয়নম­ন্দি­রে বসিয়া যা­হা সা­ব্য­স্ত করিয়াছি, তা­হাই পা­লন করিব।" এই কথা বলিয়াই কটি­­ন্ধ­সং­যু­ক্ত দো­লায়মান অসি­কোষ হই­তে সু­তী­ক্ষ্ণ তর­বা­রী রো­­­রে নি­ষ্কো­ষিত করিয়া জায়েদার দি­কে ফি­রিয়া বলি­লেন, "পা­পীয়সী! স্ত্রী হইয়া স্বা­মী­­ধের প্র­তি­ফল ভোগ কর! প্রিয় পতির প্রা­­­­ণের প্র­তি­ফল!" এই বলিয়া কথার সঙ্গে সঙ্গেই এজি­দ্ স্ব­­স্তে এক আঘা­তে পা­পি­নী জায়েদা­কে দ্বি­­ণ্ডিত করিয়া ফে­লি­লেন। শো­ণি­তের ধা­রা ছু­টিল। এজি­দের অসি জায়েদার রক্তে রঞ্জিত হইল! কী আশ্চ­র্য!
অসি হস্তে গম্ভী­­স্ব­রে এজি­দ্ পু­­রায় বলি­তে লা­গি­লেন, " কু­­কি­নী মায়মু­নার শা­স্তি আমি স্ব­­স্তে বি­ধান করিব না! আমার আজ্ঞায় উহার অর্ধ­­রীর মৃ­ত্তি­কায় প্রো­থিত করিয়া, প্র­স্ত­­নি­ক্ষে­পে মস্তক চূর্ণ করিয়া ফেল।" আজ্ঞা­মা­ত্র প্র­­রি­গণ মায়মু­নার হস্ত ধরিয়া দর­বা­রের বা­হি­রে টা­নিয়া লইয়া গেল। মা­টি­তে অর্ধ­দেহ পুঁতিয়া প্র­স্ত­­নি­ক্ষে­পে মস্তক চূর্ণ করিল। স্ব­প্ন আজ মায়মু­নার ভা­গ্যে সত্য সত্য ফলিয়া গেল। সভা­স্থ সক­লেই "যে­মন কর্ম তে­­নি ফল!" বলি­তে বলি­তে সভা­­ঙ্গের বা­দ্যের সহিত সভাভূমি হই­তে বহি­র্গত হই­লেন।এজি­দ্ হা­সান-বধ শেষ করিয়া হো­সেন-বধে প্র­বৃ­ত্ত হই­লেন! আম­রাও এই উপ­যু­ক্ত অব­­রে দা­মে­স্ক নগর পরি­ত্যাগ করিয়া মদি­নার অভি­মু­খে যা­ত্রা করি­লাম।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.