মাজার পূজা ও পীর পূজা_শাহিন আলম


মক্কার বুকে যখন ইসলামের বাণী প্রচারিত হয় তখন সে সমাজের লোকেরা এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন দেব দেবীর ইবাদত করতো। নিজেদের জীবনের আশা আকাংখা পূরনের জন্য তারা শরণাপন্ন হতো বিভিন্ন দেবতার মন্দিরে। দেবতাদের নামে মানত করতো। তাদের নামে পশু উৎসর্গ করতো। এসব দেবতার মধ্যে কিছু প্রসিদ্ধ দেবতা ছিলো যাদের কথা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ্য করেছেন।আল্লাহ বলেন-
"তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাত ওজ্জা সম্পর্কে? এবং তৃতীয় আর একটি মানাত সম্পর্কে? (সুরা নাজম আয়াত ১৯-২০)
সে সময়ে লাত, ওজ্জা, মানাত এরাই ছিলো প্রধান দেবতা। লোকেরা তাঁদেরকে স্রষ্টা হিসেবে মানতো বা আল্লাহর সমকক্ষ মনে করতো তা নয়। তারা স্রষ্টা হিসেবে এক আল্লাহকেই মানতো ব্যাপারে তাদের দ্বিমত ছিলোনা। তারা যেকোন কাজ আল্লাহর নাম দিয়েই শুরু করতো। আল্লাহ যে রিজিকদাতা, বৃষ্টিদাতা বিষয়ে তাদের বিশ্বাস ছিলো অটল। এখন প্রশ্ন জাগে তাহলে তারা এসব দেবতাদের পূজা কেন করতো? পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে -
"জেনে রেখো, একনিষ্ঠ এবাদত আল্লাহ তায়ালার জন্যই।যাঁরা তার বদলে অন্যদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহন করে তারা বলে,আমরা তো এদের ইবাদত ছাড়া অন্য কোন কারণে করিনা যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী করে দেয় কিন্তু তারা যে বিষয় নিয়ে মতভেদ করছে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সে বিষয়ের ফয়সালা করে দেবেন;অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এমন লোককে হেদায়েত করেননা যে মিথ্যাবাদী অকৃতজ্ঞ " (সুরা যুমার আয়াত )
কোরআনের ভাষায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় তারা দেবতাদের স্রষ্টা মনে করতোনা বরং আল্লাহর পর্যন্ত পৌঁছানোর একটি মাধ্যম মনে করতো। তারা মনে করতো এদের নামের অসীলায় আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ বেশি খুশি হবেন। তার অনুগ্রহ তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে। তাদের বিশ্বাস ছিলো এই দেবতারা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। শুধু মাত্র এই বিশ্বাসের আলোকে তারা মূর্তিপূজা করতো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো এই সমস্ত দেবতাদের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা।
এরপর রাসুল সা. যখন মক্কা বিজয় করেন তখন তিনি এই সমস্ত দেবতা মন্দির সমূলে ধ্বংস করেন। মক্কার বুকে মূর্তিপূজার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু শয়তান বসে থাকেনি। সে তার ওয়াদা মতো মানুষকে বিপথে পরিচালনার চেষ্টা অব্যাহত রাখে।সে মুসলিম সমাজের ভিতরে ভিন্নরুপী দেব দেবীর উদ্ভব করে এবং মানুষ যেন তাদেরকে অনুসরণ করে, তাদেরকে পূজা করে সে জন্যে কাজকে মানুষের চোখে, মানুষের মগজে শোভনীয় করে উপস্থাপন করে।
 মানুষ রুপী কিছু শয়তানের মাধ্যমে সে ইসলামী পরিভাষার ভুল ব্যাখ্যা এবং আকীদা বিকৃতি করে দলে দলে মানুষকে এই সব দেবতাদের দিকে আহবান করে। কাজের মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অনেকগুলো দলের সৃষ্টি করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সূফিবাদের নামে ঘরে ঘরে খেলাফত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।সমাজের ভিতরে পীর, আউলিয়া, দরবেশ খেতাবধারী কিছু লোক তৈরী করা। যারা ইসলামের ভিতরে থেকে ইসলামের পোষাক পরে ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এই ভন্ড সূফির দল কোরআন হাদিসের নির্দেশকে উপেক্ষা করে, নিজেদের মনগড়া কিছু ইবাদত সৃষ্টি করে, বিভিন্ন জাল হাদিস তৈরী করে, পবিত্র কোরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
রাসুল সা. এর আদর্শের পরিবর্তে বিভিন্ন বুযুর্গ ব্যক্তির জীবনাদর্শকে অনুসরণ করা শুরু করে। এই সূফিবাদের মোড়কে তারা রাষ্ট্রীয় খেলাফত ব্যবস্থাকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে খেলাফত ব্যবস্থা চালু করে এবং তাদের হাতে বায়াত গ্রহন করাকে ফরজ বলে প্রচার করে। এই সমস্ত খলিফাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারনা হলো যে, তারা নায়েবে রাসুল সা. আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তাদের হাতে হাত দিয়ে বায়াত গ্রহন না করলে রাসুলের দলে শামিল হওয়া যায় না।
পীর যেহেতু রাসুলের প্রতিনিধি তাই সে পরকালে রাসুল (সাঃ) এর সাথে আলোচনার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে মুরিদের ব্যাপারে সুপারিশ করবে। এই সুপারিশের ব্যাপারে মক্কার কাফের মোশরেকদের বিশ্বাস এবং মুসলিম সমাজে পীরের শিষ্যদের বিশ্বাস এক অভিন্ন। লাত মানাতের স্থান এখন পীর সাহেবেরা দখল করে বসেছে। সুপারিশের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন বলছে-
"() এমন কে আছে যে তার দরবারে বিনা অনুমতিতে সুপারিশ পেশ করবে। (সুরা বাকারা আয়াত ২৫৫)  () তুমি তাদের আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও,যখন কষ্টে তাদের প্রাণ কন্ঠাগত হবে, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে সেদিন যালেমদের কোন বন্ধু থাকবেনা। থাকবেনা এমন কোন সুপারিশকারী, যার সুপারিশ গ্রহন করা হবে। (সুরা মোমেন আয়াত ১৮)
মহান আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষনা করেছেন কেয়ামতের মাঠে কোন ব্যাক্তি তার অনুমতি ব্যতিরেকে সুপারিশ করতে পারবেনা। সেদিন মানুষ তার আপনজনদের থেকে দুরে পালিয়ে যাবে। সেদিন কোন নবী অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করার সাহস পাবেনা।সেখানে পীরের অবস্থান কোথায় সেটা ভেবে দেখা দরকার।
 বর্তমানে মুসলিম সমাজে প্রচলিত পূজার মধ্যে কবর পূজা অন্যতম। আমাদের দেশে অনেক মাজার আছে যেমন, হযরত শাহজালাল, শাহপরাণ, খানজাহান আলী, বায়েজীদ বোস্তামীর রহঃ এর মাজার। এই সমস্ত মাজারে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় জমায়।প্রতি বছর ঔরশের নামে বিরাট আয়োজন করা হয়। লোকেরা তাদের মাজারে বিভিন্ন রোগমুক্তির জন্য মানত করে।তাদের মাজারে সেজদা করে। বন্ধ্যা নারীরা সন্তান লাভের জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করে।
এই প্রসিদ্ধ মাজারগুলো ছাড়াও বিভিন্ন শহরে, রাস্তার মোড়ে, গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার মাজার রয়েছে এবং নিয়মিত সেখানে বিভিন্ন প্রকার ইবাদত চলছে।মানুষেরা মনে করে এই সমস্ত পীর আউলিয়ারা সবকিছু শোনেন। তারা হয়তো অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। তাই তারা বিভিন্ন মাজারে ভিড় করে এবং জীবিত পীরদের কথাকে ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। কোন মানুষের ভাগ্য গননার ক্ষমতা আছে কিনা, অদৃশ্যের কোন জ্ঞান আছে কিনা তা আমরা কোরআনের ভাষায় জানবো।পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে -
"গায়েবের চাবিগুলো সব তার হাতেই নিবদ্ধ রয়েছে; সেই (অদৃশ্য) খবর তো তিনি ছাড়া আর কারোই জানা নেই।জলে স্থলে যা কিছু আছে তা শুধু তিনিই জানেনএকটি পাতাও ঝরেনা যার (খবর) তিনি জানেনা। (সুরা আনয়াম আয়াত ৬৯)
স্পষ্ট হয়ে গেলো, অদৃশ্যের খবর কোন মানুষের জানা নেই এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ার ভুক্ত। তাই যারা মনে করে পীর সাহেব মুরিদের মনের অবস্থা জানেন তারা স্পষ্ট শেরেকে লিপ্ত আছে।তাদের এই ভ্রান্ত ধারনা পথভ্রষ্ট হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যারা রোগ মুক্তির জন্য বিভিন্ন স্থানে মানত করে তাদের জানা প্রয়োজন রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ।কোন মানুষের ব্যাপারে কোন ক্ষমতা নেই। হযরত ইব্রাহিম আঃ এই কথায় তার জাতিকে বলেছিলেন। ইব্রাহিম আঃ বলেছিলেন-
"বিশ্ব পালনকর্তা ব্যতীত তারা সবাই আমার শত্রু। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অতপর তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। যিনি আমাকে আহার এবং পানীয় দান করেন। যখন আমি রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন। (সুরা শোয়ারা আয়াত ৭৭-৮০)
শারীরিক অসুস্থতা সহ যেকোন বালা মুসিবত থেকে রক্ষার জন্য একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।অন্য কারও দরবারে যাওয়া জায়েজ নয়।মহান আল্লাহ বলেন-
"এবং আল্লাহ তোমাকে বিপদ আপদ দিলে তিনি ব্যতীত তা মোচনকারী কেউ নেই এবং আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই। (সুরা ইউনূস আয়াত ১০৭)
মুসলিম সমাজের কিছু মানুষ সন্তান লাভের জন্য পীর ফকিরদের শরণাপন্ন হয়।কেউ কেউ আবার পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তান লাভের জন্যেও তদবির নিয়ে থাকে।এবং মানত পূরনের জন্য পীরের মাজারে বা বাৎসরিক ঔরশে গরু খাসি বা নগদ টাকা দিতে দেখা যায়।মানুষের এই সব ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাসের মূলৎপাটন করে আল্লাহ বলেন-
"আকাশ মন্ডলী যমীনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহ তায়ালার জন্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন; যাকে চান তাকে কন্যা সন্তান দান করেন আবার যাকে চান তাকে পুত্র সন্তান দান করেন। যাকে চান তাকে পুত্র কন্যা (উভয়ই) দান করেন। যাকে চান তাকে তিনি বন্ধ্যা করে দেন। নিঃসন্দেহে তিনি বেশী জানেন। ক্ষমতাও তিনি বেশী রাখেন। (সুরা আশ শূরা আয়াত ৪৯-৫০)
আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে আল্লাহ সন্তান দান করে থাকেন। ব্যাপারে কোন মানুষের কোন ক্ষমতা নেই।মানুষের কোন ক্ষমতা আছে যদি কেউ এই বিশ্বাস করে তবে সে ব্যক্তি শেরেকে লিপ্ত হয়ে যায়। ছাড়াও আমাদের সমাজের মানুষেরা সংসারের সুখ শান্তি ব্যবসায়িক উন্নতি সহ যে কোন কাজে সফলতার জন্য এই সব পীরদের আস্তানায় ধর্না দেয়। আইয়্যামে জাহিলিয়াত যুগের কাফেরদের বৈশিষ্ট্যের সাথে এদের বৈশিষ্ট্যের কোন পার্থক্য নেই। তারা লাত মানাত ইত্যাদি দেব দেবীর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতো আর এরা বিভিন্ন পীর ফকিরের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়। রাসূলের যুগের মানুষেরা যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করার পরও শুধু মূর্তিকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে পূজা করার অপরাধে মুশরিক হয়ে থাকে তাহলে বর্তমান যুগে যারা পীরদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম হিসেবে গ্রহন করে, পীরের দরবারে মানত করে, পীর সাহেব মুরিদের মনের অবস্থা জানে, কেয়ামতের মাঠে পীর সুপারিশ করতে পারবে এই ধারনা পোষন করে তারাও মুশরিক তাতে কোনই সন্দেহ নেই।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.