করোনাকালীন করচা_সাবরিনা চৌধুরী

বেশকিছু দিন যাবত সবাই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে থাকতে গৃহাস্থলী কার্মিক হয়ে উঠছি। বেশ ভালো, কিন্তু এই কার্মিকদের কেউ দেখছে না।কেবল সবাই ডাক্তার, নার্স,পুলিশ আর সাংবাদিকদের দেখছে। অবশ্য এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমরা পুরো মানবজাতি বিশেষ মানুষগুলোর কাছে আন্তরিকতভাবে কৃতজ্ঞ।
তবে এরা ছাড়াও আরো কিছু মানুষ আছে, যাদের দায়িত্ব বা সাহায্যগুলো আমাদের চোখের আলো ফাঁকি দিয়ে আড়ালে চলে যাচ্ছে। এরা হয়তোবা কখনো সংবাদের শিরোনাম হবে না,,পত্রিকার পাতাতে উঠবে না,,কিংবা ঘরোয়া আলোচনার বিষয়বস্তু হবে না, তবুও এদের কাজগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
চলেন তাহলে কিছু নিরব পর্যবেক্ষণ করে আসি....
 
দৃশ্যপট :
মনে করেন আজ দুটো দিন যাবত বাসায় বিদ্যুৎ নেই,ঘরের চুলাও বন্ধ।কারণ মটর ছাড়া যাচ্ছে না, পানি নেই।রান্নার পাশাপাশি শৌচালয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পরছে। এই গরমে বাচ্চাদের ঘরে বন্দী রাখা কঠিন, শরীরে ঘামাচি ফুসে উঠছে। ফ্রিজের খাবার সব পচতে শুরু করেছে।মোমবাতি গলিয়ে দু রাত চলাতে বুঝেছি,,ইলেক্ট্রিসিটি শতাব্দীর কতো বড় আশীর্বাদ। এখন হারিকেন নেই যে ওকে নিয়ে কেরোসিন খুজবো।
এভাবে আর কতোদিন....!
শুনেছি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আর চালু রাখা সম্ভব হবে না।গরমে ছটফট করে মানুষ রাস্তায় বেড়িয়ে পরছে। কী করবেন…!
এই ৩৪/৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা নিয়ে বিদ্যুৎ ছাড়া কিভাবে ঘরবন্দী থাকা যায়!
তাই মানুষগুলো দিনের আলোতে কিছুটা লুকিয়ে থাকলেও রাতে চুপচাপ বের হয়ে আসছে।
ভাবতে পারেন কীয়েক্টাবস্থা....!
 
দৃশ্যপট :
চারদিকে খাবারের হাহাকার। কিন্তু কৃষকের ফসল আর সবজিগুলো বাগানেই শুকাতে শুরু করেছে। কারণ সময়মতো ট্রান্সপ্রোটেশনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। দুর্দিনের এতো কষ্টের ফসল সঠিক জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না।কৃষকরাই বা বাঁচবে কী করে!
তাদের মনে ফসল ফলাবার অনেক স্বপ্ন আছে কিন্তু গতরে যে শক্তি নেই, সেতো আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এদিকে ড্রাইভার ভাইয়েরাও বের হতে চাচ্ছেন না ঘর থেকে। তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে নিরাপদে থাকতে চাচ্ছেন।
 
দৃশ্যপট :
বেশিরভাগ অফিস আদালত বন্ধ থাকলেও রেলওয়ে বেশ কিছু কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ছুটি নেই। মালবাহী ট্রেনগুলো বয়ে চলেছে পুরো জাতির বেঁচে থাকার রসদ নিয়ে। মালবাহী ট্রেনের চালক হোক আর ট্রাকের চালক হোক তদের জীবনতো আর মূল্যহীন নয়।
 
দৃশ্যপট :
ফার্মেসিতে যারা আছে তারা সকাল ৮টায় খুলছে আর রাত দুটো,তিনটে দিকে সাটার লাগাচ্ছে। ডাক্তার বা নার্সের চেয়ে কী এসব মানুষগুলোর অবদান কম লাগছে! একটু ভাবেন কি পরিমাণ ঝু্ঁকি নিয়ে তারা রোগী বা রোগীর আত্মীয় স্বজনদের সান্নিধ্যে আসছেন,ঔষধ দিচ্ছেন।
 
দৃশ্যপট :
মুদি দোকানী বা শাক-সব্জি বিক্রেতা আপনাদের প্রোয়োজনীয় জিনিষপত্রের থলে ভরে দেবার জন্যে বসে আছেন। তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, মূল্য নেই!
 
দৃশ্যপট :
বরকত সাহেব ইন্টারনেটের সেবা দিচ্ছেন। তার সাথেও আছে একদল স্বেচ্ছাসেবক।কারণ মুহুর্তে যাকে বেতন দিয়েও ডিউটি করিয়ে নিচ্ছেন তার অবশ্যই স্বেচ্ছাসেবার মানষিকতা থাকতে হবে। তা নাহলে তাকে দিয়ে এখন বহির্জগতের কাজ করাতে পারবেন না।
কারণ টাকার চেয়ে যে জীবনের মূল্য অনেক বেশি এটি জানতে খুব বেশি পড়াশোনার দরকার হয় না। একজন পেপারওয়ালা ভাই দুর্দিনে সেকাজটা হাসিমুখে করে যাচ্ছেন।
ভাবা হয়েছে এসব সার্ভিসে থাকা মানুষদের কথা।
একটা ঘন্টা ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকেন না, মনে হবে পৃথবীর সব যোগাযোগ থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছেন।
 
দৃশ্যপট :
এরপর আসেন গ্যাস ফিল্ডের দিকে। কি কি সম্ভব হবে গ্যাস ছাড়া অনুমান করেন।
রান্না তো বন্ধ হবেই, বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হবে।
জ্বলবে না আর বাতি আপনার প্রিয়কুঞ্জে।
 
দৃশ্যপট :
সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা আপনার ময়লা আবর্জনা তুলে নিয়ে আপনাকে দিচ্ছে গৃহাস্থলির নির্মলতা।তারা এখনো রাস্তায় আছে বলেই আপনি আমি ঘরে পরিচ্ছন্নভাবে কোয়ারেন্টাইন পালন করতে পারছি।
 
দৃশ্যপট :
এরা যদিও সবার আগে আসা উচিৎ ছিলো তবুও পরেই দিলাম।কারণ আগে তো টিকে থাকা তারপর পড়াশোনা, শিক্ষা। অনেক শিক্ষক স্কুল বন্ধের পরেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন নি। তারা অনলাইনে তাদের পাঠদান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। খুদে, চালবাজ মস্তিষ্কগুলোকে সক্রিয় রাখার ভারটা যে তাদের হাতেই।
 
দৃশ্যপট : ১০
আর সর্বশেষে আমাদের মতো যারা স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে নিজের সাথে যুদ্ধে নেমেছেন তাদের ধন্যবাদ।এরা অবশ্যই মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে শুদ্ধতম কাজটি করছেন।
যাক অনেক্ষন যাবত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছেন এবার একটু ভিন্ন কথা শোনেন।
এই কোয়ারেন্টাইনে আপনাকে কি কি করা একদম ভোলা যাবে না তার তালিকা দিয়ে দিলাম ...
. এসময় হাসব্যান্ডের সাথে, গৃহযুদ্ধ করতে ভুলবেন না।
. বাচ্চাদের কান মলে, বুকে টেনে নিতে ভুলবেন না।
. শ্বশুর-শ্বাশুড়ির ভালো কথা শুনে বা বকা খেয়ে, মন খারাপ করতে ভুলবেন না।
. ভাই-বোন,বা দেবর-ননদের সাথে, কষ্টি-মিষ্টি ঝগড়া করতে ভুলবেন না।
. প্রতিবেশির খোজ নেবার পাশাপাশি তাদের ঝগড়াতে কান পাততে ভুলবেন না।
. দিনের বেলায় না হোক, রাতের বেলায় একলা-একা জোছনা মাখতে ভুলবেন না।
. সকালের কঠিন রোদে কিছুক্ষন শরীর জ্বালাতে ভুলবেন না।
. লাইক, কমেন্ট না দিয়ে সুইট ডিজিটাল হিংসা করতে ভুলবেন না।
. সমস্যা যতোই হোক,উল্টা-পাল্টা খাবার বানাতে ভুলবেন না।
১০. দাড়িয়ে থেকে কঠিন চেহারা নিয়ে,সেগুলো খাওয়াতে ভুলবেন না।
১১. ঘরে থাকতে থাকতে যতোই ছোচামি ভাব জাগুক, হাত না ধুয়ে খেতে ভুলবেন না।
১২. যেহেতু পুরো রুটিন এলোমেলো,কিছু কিছু ব্যতিক্রমী সাহায্যের হাত,বাড়িয়ে দিতে ভুলবেন না।
১৩. হুটহাট যত্রতত্র ঘুমিয়ে পরতে ভুলবেন না।
১৪. মাকে, ফোনে খবর নিতে ভুলবেন না।
১৫. পৃথিবীতে থাকলেও মাঝেমধ্যে চাঁদে যেতে ভুলবেন না।
১৬. চিৎকার - চেচামেচি করতে ভুলবেন না।
১৭. নিরবে প্রার্থনায় বা ইবাদতে কাঁদতে ভুলবেন না।
১৮. দুঃশ্চিন্তায় ঘুম না আসলেও, স্বপ্ন দেখতে ভুলবেন না।
পৃথিবী একদিন হাসবেই...
আর আমার প্রলাপ পড়ে ভাবতে, হাসতে ভুলবেন না।
 
১১/০৪/২০২০
নারায়ণগঞ্জ

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.