শর্মী দে’র কবিতা

চরম নৈরাশ্যবাদী সময়কাল থেকে বলছি
 
আপনাদের মত আমরাও আশাবাদী হতে চাই
ওগো আশাবাদী যুগের সুবোধ কবিবর,
 
যে জীবন জেগেছিল
অন্ধকার তাড়ানিয়া সূর্যের মতন
সে জীবন কেন আজ মৃতপ্রায়?
আপনি বলছেন - তাদের ঘুম
সময় হলেই জেগে উঠবে।
 
সময় আর হবে কবে?
আমার বাস্তুভিটার সর্বস্ব লুট হলে
 তবেই কি ওরা জাগবে??
 
কবে আসবে সেই সময়ের হাঁক
ওগো কবি, কবে জাগবে?
কেন ওরা মুক্তি এনে দিয়েই ক্ষান্ত দেয়!!!
 
ওরা কি জানে না
এই ঘুমন্তরাতেই চুরি যায় আমাদের স্বপ্ন?
এই ঘুমন্তসময়েই আমাদের বাস্তভিটায়
 বসতি গড়ে উইপোকারা,
কোন এক অমাবস্যার রাতে
আমার আতুড়ঘরের মধ্যমণি খুঁটিটি
 খুলে নিয়ে পালায় কয়েকটি চামচিকা,
ঘুণে ধরে বাকি তিনটি খুঁটিতেও।
 
কিতাবের পাতায় জিহ্বা লেহন করে কয়েটি কুকুর,
আমার রাষ্ট্রের ন্যায়কুটির গুড়িয়ে দেয়
সেদিনকার মত শকুনেরা নয়
আজকের শেয়ালেরা।
 
ওরা কি জানে না
যতবার রক্তগঙ্গায় ভেসে মানুষ এনেছে মুক্তি,
ততবারই সেই রক্তে ভেজা উর্বর পলিতে জন্মেছে আগাছা,
পরিপুষ্ট পরগাছারা ঢেকে দিয়েছে সবুজ বৃক্ষ,
আমার, আমাদের,
মানুষের যত্নে লালিত শাশ্বত বৃক্ষ।
..................................................
 
ক্রান্তিকাল
 
মহাকাল প্রবেশ করছে কৃষ্ণগহ্বরে
ছায়াপথেরা সরে যাচ্ছে
আলোকবর্ষ থেকে আলোকবর্ষ দূরত্বে
মানবসন্তান আজ পোকামাকড়
পিষে মরছে জুতোর তলে।
 
নাকের সমান্তরালে দৃষ্টি রেখে
একবিংশ শতাব্দীর সভ্য নাগরিক আমরা
হেঁটে যাই নগরীর পথে,
ফিরেও তাকাই না কেউ
ক্রশবিদ্ধ যিশুর দিকে।
 
মনুষ্যকন্ঠের কোলাহলে কানপাতা দায়
অথচ বিবরে পৌঁছায় না কারও আর্তনাদ
শুনতে চাইছি না কেউ
দেখতে চাইছি না কেউ
অন্ধ প্রদেশ, বধির সময়,
স্থবির আকাশগঙ্গাও কুন্ডলীত
ছায়াপথ নিয়ে প্রবেশ করছে
কৃষ্ণগহ্বরে।
 
মহাকালের এই ক্রান্তিলগ্নেও
ঈশ্বরের বরপুত্ররা কেউ নেমে আসছে না
নেমে আসছে না কোন অলৌকিক খড়ক।
..................................................
 
না ফেরা ট্রেন
 
সকলে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে
কারও চোখে জ্বলজ্বলে নিয়ন আলো,
হাত ভর্তি মুঠো মুঠো উত্তেজনা,
 
কেউ জানলার ধারে বসে দেখছে
কৃত্তিকার রূপ,
সাতটা পাঁচটা জীবনের ক্লান্তি কাটিয়ে
কেউ ঘুমোচ্ছে বেঘোরে
কতশত বছর ঘুমায়নি কেউ!
কাও লাগেজে অপেক্ষমান উচ্ছাস,
কারও হাতে মুষ্টিবদ্ধ আবদার।
 
অন্ধকার হয়ে আসছে চরাচর
সমস্ত ট্রেন ছেড়ে গেছে প্লাটফর্ম
হুইসেলের শব্দে পৌঁছে গেছে গন্তব্যে।
 
শেষ চিঠি হাতে গন্তব্যহীন
 আমিই শুধু বসে থাকি একা,
চোখে মৃত আগ্নেয়গিরি নিয়ে দেখি
কংক্রিটের স্তম্ভ আর রাতের টিনকে
 কত রঙে সাজাতে পারে
 ফাগুনের জ্যোৎস্না,
দেখতে থাকি জ্যোৎস্নার আলোয়
 পুড়া প্রতীক্ষার রং।
 
শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তোমার,
একজীবনের সমস্ত অভিযোগের উত্তরপত্র হাতে।
..................................................
 
গন্তব্য
 
নেশাধরা চোখে তাকিয়ে থাকি
ঝাপসা কাঁচের বাইরে আবছা আলোয়,
দ্রুতগামী যান গন্তব্যে পৌঁছুতে
ছুটছে মরিয়া
অসংখ্য সমগোত্রীয়কে পেছনে ফেলে,
এক একটি গল্প তৈরির
সমূহ সম্ভাবনা স্থগিত রেখে,
এপিডাপ লিখার সময়কে করছে
আরও দীর্ঘতর।
দূরে সারবাঁধা নিয়ন আলো আর
অতন্ত্র প্রহরী বটবৃক্ষগুলো
ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অনিমেষ দেখে যায়
এই ক্রম - অতিক্রমের পাল্লা দেওয়ার খেলা।
 
ছুটছে, ছুটছে, ছুটছে
গন্তব্যে
তারাগুলো, চাঁদটা, এই রাত
এই খোলস তার ভেতরে সমস্ত ঘুমন্ত মানুষ
ফিরছে, যে যার গন্তব্যে।
 
গন্তব্য কি আছে তাদের?
 
ঘরছাড়াদের ফেরাবে না ঘর
দরজায় করাঘাত করে ফিরবে,
গন্তব্যের খুঁজে মাথা ঠুকে মরবে
সমস্ত বিশ্ব চরাচর।
 
গন্তব্যহীন চোখে তাই দেখি
ঝাপসা কাঁচের বাইরে
আবছা আলোয় তুই, স্পর্শের বাইরে,
অথচ আমি স্পর্শকাতর।
তবুও বাড়ি ফেরা হলো না আমার।
..................................................
 
জুয়া
 
আয় জীবন আমার
জুয়া খেলি আর একবার
বহুদিনের সাজানো সংসার তোর
ভেঙ্গে দিই রুটিনমাফিক এপাড়-ওপাড়
সাহেব-বিবি-গোলামেদের ধ্বংসস্তুপের
ওপর বানাই নতুন তাসের ঘর।
 
আয়,
ছুটে যাই মন্বন্তর থেকে মন্বন্তরে,
সদ্যজাত শিশুর চিৎকার এড়িয়ে
মাতৃছায়া, পিতৃআজ্ঞা ফেলে
ছুটে যাই নেবুচাঁদের উদ্যানে,
হাম্বুরাবি সংহিতাকে অস্বীকার করে
ঝুলে থাকি শূন্যে।
কিংবা
যাত্রাপালার মঞ্চ থেকে পালিয়ে এসে
মধ্যরাতে ফিরে যাই রঙ্গালয়ে।
সর্বনাশের নেশা যারে পায়
তারে কে দেখায় ডাকাতিয়ার মোহনার ভয়।
ভাসছি-ডুবছি যে জোয়ারে
সেও তো যাচ্ছে গাঙ্গ থেকে গাঙ্গে
কে সে জানে কোন গাঙ্গে তার শেষ ঠিকানা!
..................................................
 
মধ্যবিত্তের পানসী
 
তীরে ভীড়ার আগেই ডুবার বার্তা
বহন করে আমাদের তরীগুলো,
কোনরকম অশনী সংকেত ছাড়াই আসে বজ্রপাত,
একটা তীব্র আলোর তাপে ঝলসে যায়
দিনে দিনে বড়হতে থাকা আমাদের স্বপ্নগুলো।
মধ্যবিত্তের স্বপ্নের বোঝা আর বহন করতে পারে না
সে ছোট তরী,
টুকরো টুকরো হয়ে ছিড়ে ছিড়ে পড়তে থাকে
একটা একটা করে।
 
অথচ ছোট্ট একটা স্বপ্ন,
স্বতন্ত্র একটা পরিচয়,
একটা নিজের পরিচয়,
একটা নিজের ঠিকানা চাই
যে ঠিকানায় আসবে আমাদের সমস্ত
পাঠানো, না পাঠানো চিঠি।
কথা ছিল একটি সতন্ত্র পরিচয়ের জন্য আমরা
হেঁটে যাব ছায়াপথ থেকে ছায়াপথে,
শত শত আলোকবর্ষ দূরে
 
কথা ছিল
একটি পরিচয়পত্রের জন্য আমরা আবেদন করতে থাকব
সাত আসমান, সপ্তশৃঙ্গ এমনকি
সাত সাগর আর তের নদীর কাছেও।
আমরা ভুলে গেছি
ভুলে গেছি।
আমরা ভুলে যাই
 কথা দিয়ে কথা না রাখারই
আভিধানিক নাম বেইমানি,
আমরা ভুলে যাই যার নুন খাই তার
পাকা ধানে আগুন দেওয়াকেই বাংলা ভাষায়
বলে নিমকহারামি।
 
একটি গল্পকে অসমাপ্ত রেখে আমরা তার
 নামকরণ করেছি "অপূর্ণ স্বপ্ন।"
অতপর অনাগত ভবিষ্যতের উপর
 চাপিয়ে দিব সেই স্বপ্নের বোঝা,
উত্তরসূরী থেকে থেকে উত্তরসূরীর চোখে
 শুধু স্বপ্নই দেখে যাব আমরা,
নিজের ঔরসজাতের স্বপ্নভঙ্গের হাহাকারে অনুভব করব
আমার জন্মদাত্রীর কান্না।
..................................................
 
পড়শী
 
সাতপুরুষের পড়শী আমাদের
সুখে দুঃখে, বিপদে আপদে, পূজোয় পার্বনে
বাড়ির কাপড়, বাড়ির মাছের বাটিতে কুশল বিনিময়।
 
দু"বাড়ির মাঝে সীমানা প্রাচীর বসল বাবা হার মানলেন,
পরশির সীমানা প্রাচীর জুড়ে রক্ষী,
আমাদের দ্বারে কোন রক্ষী নেই,
আপন রক্ষীতে বাবার বড্ড ভয়,
রক্ষী নাকি বড় বিশ্বাসঘাতক হয়।
আমাদের কুড়ের ঘরের চারপাশে
একটি বাবলা কাঁটার ডালও পুতে নি বাবা।
পড়শীর  সীমানা প্রাচীর অভ্যন্তরে
পালোয়ান কুস্তি লড়ছে, মালিতে চাষ করছে বাগান,
 উঠোন জুড়ে খেলছে শিশু, চরকা কাটছে বুড়ি।
সুসজ্জিত বাগানের পানির চাহিদা নিশ্চয়তায়
আমাদের যৌথমালিকানার দীঘির  মাঝখানটায়
যেদিন বসল সুবিশাল যন্ত্র,
বাবা হার মানলেন।
 
আমাদের শাপলাঘাট মরুভূমি হলো
বাবা হার মানলেন,
স্নানের জল নেই, বাবা হার মানলেন,
তৃষ্ণার জল নেই, বাবা হার মানলেন,
আমরা আকাশ পানে চাইলাম,
আকাশ হার মানল।
সাত দিনের বর্ষণে পানি উঠে এলো উঠোন অব্দি,
 জলের রাস্তা বন্ধ,
জল উঠে এলো কুড়েঘরে,
 জল উঠে এলো বইয়ের তাকে, পড়ার টেবিলে,
জল উঠে এল মায়ের বুকে, রান্নার উনুনে, মাছের বাটিতে,
পান্তার থালায়, হিজল কাঠের পালঙ্কে।
 
" আমার দেশের মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা"
বলে আমি মাথা ঠেকাতে চাইলাম মাটিতে,
অথই জলের নিচে মাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,
ভেসে যাচ্ছে পলি, মায়ের চুল, বাবার নিঃশ্বাস।
..................................................
 
পূর্বজন্মের ঐশ্বর্য্য
 
আমি কি হারিয়ে ভিখিরী হলাম
পথে নামলাম ঝুলি হাতে,
আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না আমার কিছুই,
কোন ভূমিকম্পে চূরমার রত্নোদধি,
 ধূলোয় মিশল নালন্দা,
কোন্ শ্মশানে পুড়ছে প্রজ্ঞাপারমিতা,
আত্মবাদী দর্শনটা ডুবল কোন ঘাটে!
 
বন্দরে পড়ছে না নোঙ্গর,
নিখোঁজ টানেলের আলো,
সোনালি আঁশ ধূসর হচ্ছে,
শূন্য জাহাজ ফিরে যাচ্ছে।
 
বানিজ্য হবে কি করে, এই ঘরে?
শ্যামল মাঠ নেই কোথাও, কোন হৈমন্তী চাষী নেই,
 ময়না কথা কয় না, কোকিল ডাকে না।
পূর্বজন্মের ঐশ্বর্য - উর্বরতার গল্প বলে কাটবে
আর কত বন্ধ্যা জীবন!
..................................................
 
ডাকাতিয়া ছলনা
(উৎসর্গঃ পুষ্প)
 
সখি আমার মন উচাটন,
বাতাসের হু হু যেন কার দীর্ঘশ্বাস,
বৃষ্টি ফোঁটা যেন পথিক চোখের জল।
 
কড়িকাঠ গুনছি একটা, দুইটা তিনটা,
বইয়ের ভাজে জমাট উদাসীনতা,
আনন্দ হচ্ছে খুব আমার
সখি, কষ্ট হচ্ছে খুব।
 
কাজে তো মন নেই সখি,
দৃষ্টি জুড়ে রংধনু,
শিউলিতলায় ছড়িয়ে কার দুঃখ,
পাহাড়ের কেমন হৃদকম্পন।
সখি, সখি, শুন
দূর শৈলশিখর হতে ভেসে আসা কার মিনতি।
 
- পোড়ামুখী
ভ্রম ভ্রম এইসব মিছে ভ্রম,
ছুটবি যত ডাকের পিছু,  যাবে তত দূরে।
অমরাবতীর ঐশ্বর্য্য ছেড়ে এবার এসে নামলি পথে,
শূন্য হাতে, ভিক্ষা পাত্রে মাঙ্গবি প্রেম,
যে পাত্র ফুটো রেখেছে দ্বাপরযুগের শ্যাম।
..................................................
 
অতৃপ্তি
 
আদিম এই অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে আমি
কোন সিংহদুয়ারে দাঁড়িয়ে মাঙ্গব অমৃত।
আমি তো বুঝি না কি সে চায়
হাতের মুঠোয় চায় কার কনিষ্ঠা,
কোন সরোবর খুঁজে তারে এনে দিই,
সাতটি মেটে রং পদ্ম।
 
সূর্য দেখলেই সে আঁধার হাতড়ায়
আঁধারে বসে তপস্যা করে
একটি কনে দেখা আলোর অপরাহ্ণের।
 
তেরশত ক্রোশ পেরিয়ে এলাম,
পেরিয়ে এলাম কত মন্বন্তর,
আর কতজন্মের তপস্যায়,
দেখা পাই সেই কল্পবৃক্ষের,
যে দিতে পারে পূর্বজন্মের স্মৃতির
অভিশাপ হতে মুক্তি।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.