দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে ।। অমিয়েত্রা সুমাইয়া

এক.
বাইরে টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া বেপরোয়া হয়ে ঢুকছে। এলোমেলো চুল গুলো উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে বারবার। বৃষ্টির তালে তালে হাতের আঙুল নাচছে। কাচ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে নিশাত। চোখে মুখে তৃপ্তি বিরাজ করছে তার। এর মাঝেও কাঁপা কাঁপা চোখে অদূরের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে সে। আবছা হলেও ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। এক ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে এদিকেই দেখছে সে। মৃদু হাওয়ায় উড়তে থাকা নিশাতের চুলের দিকে চোখ তার।
চমকে ওঠে নিশাত। এই চোখ তো তার চেনা!
কত স্মৃতি এই চোখ ঘিরে।
আবারো অবাক হয় নিশাত। ছেলেটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। উধাও হয়ে গেলো যেন।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেখে ঠান্ডা হয়ে গেছে কফি।
নিচে নামিয়ে রাখে কাপটা।
চোখের জল আজ আর বাঁধ মানছে না তার। দুচোখ বেয়ে উপচে পড়ছে।
 
"টুপ! টুপ!!"
কয়েক ফোঁটা পানি কফির কাপে পড়লো তার। এই সামান্য শব্দ চমকে দিলো নিশাতকে।
 
সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে। চারিদিকে আবছায়া অন্ধকার বিরাজ করছে। এই আবছায়া আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় সেই শরীর টা।
সেই চোখ, সেই চিরচেনা হাসি, সেই স্নিগ্ধ মায়া কাড়া মুখটা।
 
নিশাতের মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে সে।
 
"নিশাত, খাবার দিয়েছি খেতে আয়"
মায়ের গলায় ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে নিশাত। ধীর পায়ে নিচে নেমে যায় সে।
 
বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, সেই আলোয় দেখা যায় আবছায়া সেই ছেলেটা এখনো চেয়ে আছে নিশাতের জানালায়।
 
শান্তা বেগম মেয়ের দিকে চাইলেন। খাচ্ছে না কিছুই। শুধু আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছে খাবারটা। মেয়েটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকে। হয়তো রাতেও ঘুমায় না। সারাদিন চুপচাপ থাকে, আর জানালা দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অথচ তিন বছর আগেও এই মেয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সারাদিন মা এটা করো, মা ওটা করো, মা এই দেখো দেখো!!
চোখ ভিজে আসে শান্তার। তার মেয়ের সাথেই এমনটা হওয়ার ছিলো??
 
-কি হলো খাচ্ছিস না কেনো নিশু?
-এই তো খাচ্ছি মা।।
-আচ্ছা এখন তো তীর্থের কলেজ ছুটি আছে, চল না আমরা কোথাও ঘুরতে যায়, আমাদের গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারি, যাবি? তোর বাবা বলছিলো এখন নাকি গ্রামের বাড়িতে বর্ষায় কদম ফুল ফোটে। আমাদের বাড়িতেই নাকি তিনটা গাছ আছে। যাবি?
-না মা, আমার কোথাও যেতে ভালো লাগছে না। তোমরা চাইলে যেতে পারো। কিন্তু আমি যেতে পারবো না।
 
ইমদাদ সাহেব খাবার ঘরে ঢুকলেন। দেখে মনে হয় অতিরিক্ত বয়সের কারণে শরীর ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু তা না, তাকে দেখে যতটা বয়সী মনে হয় ততটা বয়স তার নয় অতিরিক্ত চিন্তার ভারে নুইয়ে পড়েছেন তিনি।
 
-কি কথা হচ্ছে মা-মেয়ের মধ্যে? আমি কি জানতে পারি? হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে ইমদাদ সাহেব।
-হ্যা, আসলে আমি নিশু কে বলছিলাম যে এই বর্ষায় গ্রামের বাড়ি ঘুরে আসার জন্য।
-তাই নাকি, তাহলে তো ভালোই হয়। গ্রামের পরিবেশ দেখা হবে আর শরীরটা একটু বিশ্রাম পাবে। কি বলিস নিশু? চলনা একবার ঘুরে আসি।
 
-আমি পারবোনা বাবা, তোমরা যাও। আর আমাকে জোর করবে না।
দৃঢ়তা ফুটে ওঠে নিশাতের গলায়।
 
শান্তা আর ইমদাদ সাহেব একে অপরের দিকে চোখাচোখি করে। দুজনের চোখেই ভয়ের ভাব স্পষ্ট।
 
-আচ্ছা সেই তীর্থটা কোথায়? কলেজ ছুটি এখন কিসের কাজে বাইরে গেছে সে? লাট সাহেবের কি এখনো বাড়ি ফেরার সময় হয়নি?
 
-বাবা, তীর্থকে সবসময় বকবে না, এই বয়সে বন্ধুদের সাথে একটু বাইরে থাকতেই পারে। এর জন্য বকাবকির কোনো প্রয়োজন নেই।
শান্ত মুখে কথা গুলো বলে উঠে গেল নিশাত।
 
ইমদাদ সাহেব আর শান্তা দুজনের মুখই থমথম করছে। ইমদাদ সাহেব ছেলে মেয়েদের শাসন করা ছেড়ে দিয়েছেন। তার মেয়ের এই অবস্থায় তার শাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মেয়েটাকে এত চাপ না দিলেই পারতেন তিনি।
 
দুই.
নিজের ছোট বাক্সটা বের করে সামনে নিয়ে আছে নিশাত। কত পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।
ডালাটা খুলতে যেয়েও বন্ধ করে দিলো সে। যে নেই তার স্মৃতি বের করে তাকে মনে করার কোনো মানে হয়না।
 
"নিশা!"
কানের কাছে উষ্ণ বাতাসে চমকে ওঠে নিশাত। কেউ যেন তাকে সেই পুরোনো নাম ধরে ডাকলো। ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পায়না নিশাত। হৃৎপিণ্ডটা এখনো লাফালাফি করছে। যেন বাইরে চলে আসবে।
কন্ঠটা যে সেই অতি পরিচিত মানুষের। চোখের সামনে আঁধার ঘনিয়ে আসে তার। অজ্ঞান হওয়ার আগে ছেলেটাকে একঝলক দেখতে পায় সে। যেন তাকে ডাকছে,
নিশা!
 
তীর্থ এখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে সে। বন্ধু রা অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছে। দোকানে এখনো কিছু খদ্দের আছে। চায়ের কাপের সাথে চামচের টুং টুং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
বাড়ি এখন অসহ্য লাগে তার। বাড়ি নয় যেন মৃত্যুপুরী একটা। আপু নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছে। অথচ সেদিন তীর্থ আর নিশাতের ঝগড়ায় মুখোরিত ছিলো পরিবেশ। বাবা মা আপু সবাই কত খুশি ছিল। এখন তো আপুকে ডাকলেও আপু উত্তর দেয় না। সারাদিন ভেবে যায়। বাবাকে এখন তার সহ্য হয়না। বাবার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ পরিবারের এই অবস্থা। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে একটা চুইংগাম নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। আপু সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এখন কিছুই বলে না।
 
তীর্থ ঘরে ঢুকেই বাবাকে দেখতে পেলো। যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। তাকে দেখেই চড়াও হয়ে উঠলো ইমদাদ সাহেব তার চিৎকারে শান্তা বেগম আর নিশাত দুজনেই বের হয়ে আসলো। কিছুক্ষণ কথাকাটাকাটির পর হঠাৎ করেই ইমদাদ সাহেব চড় বসিয়ে দেয় তীর্থের গালে। শীতল দৃষ্টিতে বাবাকে একনজর দেখে একছুটে ঘরে চলে যায় তীর্থ।
 
নিশাত ঘরে চলে গেলে নিজের কাজে অনুশোচনা বোধ করে ইমদাদ সাহেব। শাসন করতে গিয়ে কোনো ভুল করেনি তো আবার। ভেঙে আসতে চাইছে শরীর টা। শান্তা বেগম এবার ক্ষুব্ধ তার প্রতি। অথচ ছেলে মেয়ে দুটোকে প্রানের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তিনি।
 
জ্ঞান ফেরার পর বাবার চিৎকারে নিচে যায় নিশাত।বাবার কাজ আবার তার মনটাকে বিচলিত করে তোলে।
ঘুম আসছে নিশাতের। বহুদিন পর। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে।
 
ছেলেটা এগিয়ে আসছে নিশাতের দিকে। কাছে, আরো কাছে! কানের কাছে মুখ এনে বলে -তীর্থের কাছে যাও নিশা!
 
ঘুম ভেঙ্গে যায় নিশাতের কানের কাছটা এখনো গরম হয়ে গেল আছে। মনে পড়ল কথা টা। এক ছুটে বারান্দা পেরিয়ে তীর্থের ঘরের সামনে চলে যায় সে। দরজা বন্ধ।
-তীর্থ, এই তীর্থ। দরজাটা খোল।
-কি বলবা আপু? বাইরে থেকেই বলো। আমি দরজা খুলতে পারবো না‌‌
-তুই দরজা খোল, আমি বলছি দরজা টা খুলতে।
 
দরজাটা একটু ফাক হয়ে আসে। ভিতরটা অন্ধকার। হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করে নিশাত।
বিছানার উপর অনেক গুলো ঔষধ এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখে ঘুমের ওষুধ।
ঘুরে দাঁড়িয়ে তীর্থের গালে চড় বসিয়ে দেয় সে। তারপর তাকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে থাকে সে। তীর্থ এখন তার আপুকে শান্তনা দিচ্ছে। তাকে এখন বড় ভাই মনে হচ্ছে।
 
তিন.
-নিশাত, নিচে আয়, দেখ কে এসেছে!
ধীর পায়ে নিচে নেমে এসে সোফার দিকে চোখ যায়।
রাগে তার রক্ত ফুটে ওঠে। স্বামী নামের পশুটা বসে আছে।
 
-কেমন আছ নিশা?
-খবরদার এই নামে ডাকবে না তুমি আমায়, আর তুমি এখানে কেন এসেছো ? বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।
-আমি ডাকবো না তো কে ডাকবে এই নামে তোমাকে? তোমার প্রয়াত প্রেমিক?
-মুখ সামলে কথা বলো আবির। তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই , ডিভোর্স লেটারটি তুমি তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে। আর কখনো তোমার মুখ আমাকে দেখাবে না। এখন বেরিয়ে যাও।
 
রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেলো আবির।
নিজেকে আবার খুব ক্লান্ত লাগে নিশাতের।
নিজের ঘরে এগিয়ে যায়।
 
বারান্দার শেষে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। হাসিমুখে। ছেলেটার চারপাশ জুড়ে অন্ধকার। কিন্তু তাকে কি স্পষ্টই না দেখা যাচ্ছে। স্নিগ্ধ আলো তার শরীর ঘিরে। দু হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নিশাতের দিকে। এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে নিশাত। ছেলেটাকে ছোঁয়ার আগেই অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। অতল গভীরে তলিয়ে যেতে লাগলো সে।
 
চার.
"নিশাত, ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে , তাড়াতাড়ি চল। নাহলে স্যার আজ ক্লাসে ঢুকতে দেবে না। "
-সীমা, কিছু হবে না, চলনা এককাপ কফি খেয়ে আসি ক্যান্টিন থেকে।
-কিন্তু ক্লাস??
-কিছু হবেনা, চলতো।
নিশাত আর সীমা ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যায়।
দুজনে একটি টেবিলে বসে পড়ে। কফি নিশাতের খুব প্রিয়। প্রতিদিন ক্লাসের আগে এক কাপ কফি না খেলে তার চলে না।
কফি অর্ডার দিয়ে বসে বসে গল্প করছিলো তারা।
 
-চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা!
-তোমার চুল গুলো ঠিক বনলতা সেনের মতো। অন্ধকার বিদিশার নিশা।
একটা ছেলে তাদের টেবিলে বসে এসব কথা বলে দেখে হচকচিয়ে যায় নিশাত। তাতে আবার জীবনানন্দের কবিতা। ছেলেটির সাহস আছে বলতে হবে। নয়তো যেকোনো ছেলেই তার সামনে কথা বলতে ভয় পায়।
-কে আপনি? বলে ওঠে নিশাত। -আমি রিফাত হাসান। এখন আমার পরিচয় আমি তোমার চুলের নেশায় দেবদাস।
আসি।
 
যেমনি হুট করে ছেলেটা এসেছিল তেমনি হুট করে চলে যায়।
এরপর কিছুদিন ধরে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয় নিশাতের, কেমন যেন পাগল একটা।
-তোমার নাম কি বনলতা সেন?
-এক্সিউজ মী‌‌ আমি কোনো বনলতা সেন না। আমি নিশাত।
-নিশাত?? না মানাচ্ছে না, তুমি অন্ধকার বিদিশার নিশা,
নিশা!! হ্যাঁ তুমি নিশা আজ থেকে তুমি আমার নিশা বনলতা সেন।
 
আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হতে শুরু করে তাদের মধ্যে। পরিচয় পর্ব শেষে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
রিফাত কয়েকবার নিশাতের বাড়ি এসেছে। শান্তা বেগমের সাথে আড্ডা দিয়েছে।
 
রিফাতের একজন বন্ধুর মধ্যে আবির অন্যতম। দীর্ঘ দিন ধরে নিশাত কে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারেনা। নিশাত যেমন মেয়ে হাত পা ভেঙ্গে দিতে পারে। একসময় সে জানতে পারে নিশাত তার বাবার বন্ধুর মেয়ে। বাবাকে রাজি করিয়ে নিশাতের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয়।
 
এক বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় রিফাত আর নিশা কফি খাচ্ছিলো। হঠাৎ রিফাত জোর করে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
 
বাড়ি এসে দেখে ঘর ভর্তি লোকজন। নিজের ঘরে যাওয়ার পর মা আসে। বলে শাড়ি পরে নিতে। আজ ওর বিয়ে।
কোনোভাবেই নিতে পারেনা এটা সে। ইমদাদ সাহেব তার ঘরে আসে, বলে,
"মা, আজ আমার সম্মান তোর হাতে, নিজের বন্ধু কে দেওয়া কথা আমি ফিরাতে পারবো না।
আজ হয় তুই আমার সম্মান রাখবি নয়তো আমার জীবন শেষ হওয়ার জন্য তুই দায়ি থাকবি"
কথা গুলো বলে চলে যায় ইমদাদ সাহেব।
নিশাতের চোখে পানি বাঁধ মানছে না।
শান্তা বেগম কে শুধু বললো, "রিফাত খুব কষ্ট পাবে মা"
 
নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে রিফাতের নম্বর ডায়াল করতে যায় সে। তার আগেই দেখে স্ক্রিনে রিফাতের নাম ভাসছে। ওপাশ থেকে বলে ওঠে," আজ তো আমার নিশার বিয়ে তাহলে চোখে পানি কেনো? আমার নিশা সকলকে কাঁদাবে, নিজে কাঁদবে না। আর সুবোধ মেয়ের মতো বিয়ে করে নাও। পরে একবার দাওয়াত দিয়ে বিরিয়ানি খাইয়ে দিও। শুভ বিবাহ" কিছু বলে ওঠার আগেই কল কেটে যায়। নিশাত রিডায়াল করতে গিয়ে দেখে অপর পাশের ফোন বন্ধ। বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিশাতের।
 
বিয়ে হয়ে যায় নিশাতের। বিয়ের পর আবির তার সাথে কথা বলতে তার বারান্দায় আসে।
"এভাবে হুট করে বিয়ে করার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তবে আপনাকে আমি এখন নিবো না। আপনার পড়াশোনা শেষ করুন। আর সময় নিন।"
নিশাতের কাছে থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ফিরে যায় আবির। আবির চলে যাওয়ার পর নিশাত দেখে একগুচ্ছ ধোঁয়া তার দিকে এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ধোঁয়াটা রিফাতের রূপ নেয়। দু হাত বাড়িয়ে ডেকে ওঠে,
-নিশা।
সেদিন প্রথম অজ্ঞান হয়ে যায় নিশাত। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই রিফাতের ধোঁয়াশা শরীর টা ভেসে আসে তার সামনে।
 
নিশাতের বিয়ের পর হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে রিফাত। আবিরকে নিয়ে হাসপাতালে দেখতে যায় তাকে।
তাকে দেখে রিফাত বলে ওঠে" তুমি তো দেখি আরো সুন্দরী হয়েছো নিশা। আবির, তোর বৌকে সামলে রাখিস, কেউ যেন তুলে না নিয়ে যায়।"
নিজের রসিকতায় হেসে ওঠে রিফাত।
এই কথা শুনে বেরিয়ে আসে নিশাত।
কিছু দূর যাওয়ার পর সেই ধোঁয়াশা শরীর টা তার কাছে আসে, -একটা বার আমার হাতটা ধরবে নিশা?
 
ছুটে গিয়ে রিফাতের কেবিনে যায় সে। দু হাত ধরে কান্না করে সে। রিফাত মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তার।
 
কিছু দিন পর কলেজ থেকে পিকনিকে যায় তারা, সেখানে পাহাড় থেকে পড়ে মারা যায় রিফাত। তারপর থেকেই সেইধোঁয়াশা শরীর টা অবয়ব ধারন করে। রিফাতের অবয়ব। যে ছাদ থেকে তাকিয়ে থাকে নিশাতের দিকে। কখনো দু হাত বাড়িয়ে দেয়, কখনো কানের কাছে ডেকে ওঠে।
নিশা!
 
-নিশা, নিশা, এই নিশা ওঠ। এখানে এভাবে পড়ে আছিস কেনো? মায়ের ডাকে চোখ খুলে ওঠে নিশাত। তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে।
 
পাঁচ.
রিফাত মারা যাওয়ার পর আবির যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রচুর অত্যাচার নির্যাতন করতো কয়েকবার হাত ভেঙে দিয়েছে। পা ভেঙ্গে দিয়েছে। নিশাতের বাড়িতে অবশ্য সে বলেছে যে বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে। অন্তত তার বাবার এই ধারনা।
শেষ বার মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। সেখান থেকে সোজা বাড়িতে চলে এসেছে সে। তারপর মাঝে মাঝেই রিফাতের ধোঁয়াশা শরীর টা দেখতে পায় সে। কখনো বারান্দায়, কখনো ছাদে, কখনো ঘরে। যেন কিছু অজানা রহস্য জানাতে চায় তাকে।
 
নিশাত, নিচে আয়।
 
বাবার ডাকে নিচে আসে সে
আবির, আবার এসেছো তুমি?
-কেনো? আমার আসাতে এত কি ক্ষতি হয়েছে তোমার। আর বেশি কথা বললে এবার আর হাত পা ভাঙবো না, মেরে ফেলব তোমাকে।।
হিসহিসিয়ে কথা গুলো বলে আবির।
 
-বুঝলি নিশাত, তোর শাশুড়ি অসুস্থ, তাই তোকে নিয়ে যেতে এসেছে আবির, উনি নাকি তোকে দেখতে চেয়েছে।
ইমদাদ সাহেব এর কথায় সামলে ওঠে আবির।
-ইয়ে মানে হ্যাঁ নিশাত, মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে।
 
বিশ্বাস না হলে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয় নিশাত।
-আমি কাপড় পাল্টে আসছি।।
 
নিশাতের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিফাত, দু হাত বাড়িয়ে। নিশাত ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে তাকে। হঠাৎ করেই সাদাকালো রঙিন কিছু ছবি ভেসে আসতে লাগলো তার চোখের সামনে। এটাতো সেদিনের, পিকনিকের দিন!!
অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে নিশাত।
 
আবির আর রিফাত জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিশাত কে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। দুজনে গল্প করতে করতে পাহাড়ের শেষ মাথায় চলে গেছিলো। রিফাত ফিরে আসতে চাইলো , কিন্তু আবির তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। না, পড়েনি রিফাত। দুহাতে মাটি আঁকড়ে ধরে ছিল সে। আবির হঠাৎ করেই বড় একটা পাথর নিয়ে ছুড়ে মারে রিফাতের মুখে। নিশাত চিৎকার করে উঠল। কেউ তা শুনতে পেল না। থেঁতলে যাওয়া মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে অতলে পড়ে যেতে লাগলো রিফাত।
 
 
গাড়িতে বসে আছে আবির আর নিশাত। নিশাত এর মুখ থমথমে হয়ে আছে। হঠাৎই জিজ্ঞেস করে ওঠে," তুমি রিফাতকে পাহাড় থেকে ফেলে দিলে কেন? "
"কি বলছ তুমি, আমি কেনো ফেলে দিতে যাবো? রিফাত আমার বন্ধু। তো নিজেই পা ফসকে পড়ে গেছে। তাছাড়া আমি তো তখন ছিলাম না ওর কাছে।"
"আমি সব দেখেছি আবির"
"তুমি দেখেছ? অসম্ভব সেখানে আমি ছাড়া দূর দূরান্তে কেউ ছিল না। নাকি রিফাত নিজে তোমাকে দেখিয়েছে?"
চমকে ওঠে নিশাত।
"হাহা হা হা, নিশাত তুমি খুব বোকা একটা মেয়ে। আমার সাথে এসে খুব ভুল কাজ করেছ। বিয়ের পর যখন তোমাকে দেখতাম তখন তোমার পাশে আমি রিফাত এর ধোঁয়াটে শরীর দেখতে পেতাম। তখন থেকেই আমার মাথায় খুন চেপে ওঠে। তাইতো কলেজে টাকা দিয়ে তোমাদের সবাইকে পাহাড়ে নিয়ে গেছিলাম। ওখানেই হত্যা করি আমি রিফাত কে। আর তারপর ওর শরীর তোমার পিছু ছাড়েনি। তোমাকে মেরে বুঝিয়েছি ওকে আমার ক্ষমতা কত। এখন তোমার পালা। তোমাকেও সেই পাহাড় থেকে ফেলবো আমি। "
 
নিশাত কে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আবির। কিন্তু সে খেয়াল করেনি রিফাতের শরীর নিশাতকে ধরে আছে। হঠাৎ করেই পা পিছলে পড়ে যায় আবির, অতলে ডুবে যাচ্ছে সে। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে একবার উপরে তাকিয়ে দেখে নিশাতের অচেতন দেহটা দু হাতে আগলে আছে রিফাত।।
 
সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে, চারিদিকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে নিশাতের শরীর। এর মাঝেই সেই ছেলেটা কানে কানে বলে ওঠে, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, নিশা।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.