উষ্ণতা লেগে আছে আমার হাতে ।। মাঈন উদ্দিন জাহেদ

 
শিশুদের জন্য আমার লেখালেখি কখন হয়ে ওঠে না। আমার মধ্যে একধরনের জ্যেঠামী ছোটবেলা থেকে কাজ করে। তাই শিশুতোষ লেখা আমি বারবার চেষ্টা করেও পাড়িনি। নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন সাহিত্য, সাহিত্য আড্ডা নিয়ে উন্মত্ত ছিলাম, তখন আমাদের সাহিত্য আড্ডার মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, মিজানুর রহমান শামীম, রমজান আলী মামুনসহ আরও অনেকের লেখাপাঠ উত্তর আলোচনায় প্রসঙ্গটি আসতো ছড়া লিখিনা কেনো? আমি বার বার বলতাম প্রকরণটি আমাকে টানে না। আমি আরও পরখ করে দেখলাম, ছড়া না হয় নাই লিখলাম, বাচ্চাদের জন্য গল্প কিংবা ছোট নিবন্ধতো লিখতে পাড়ি। না, তাও হয়ে ওঠে না। চেষ্টা যে করি নি তা নয়। কয়েকটা গল্প লিখেছিলাম। আবেগটা যখন কাটলো তখন দেখলাম, ওসব গল্পই হয়নি। কিছু গদ্য চর্চা ছাড়া। আর হলো না শিশু সাহিত্য চর্চা।
 
গেলো ১৯,২০,২১ সেপ্টেম্বর'১৯ চটগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি আর্ট গ্যালারী হলে বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি ' উদ্যোগে হয়ে গেলে তৃতীয় বারের মতো বইমেলা, সম্মিলন পদক প্রদান অনুষ্ঠান। ব্যাক্তিগত ব্যস্ততার জন্য প্রথম দুদিন যাওয়া হলো না। প্রথম দিন তিন লেখিকা ফেজবুক বন্ধুর ফটোসেশনের ছবি দেখে মন্তব্য করেছিলাম ' আহা, ছোটদের জন্য আমার কোনো বই নেই বলে, আজ এমন ফোটসেশন করতে পারলাম না।' ব্যাপারটি ছিলো শুধু মজা করার। নিয়ে কবি রেহেনা মাহমুদ মধুর প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিলো। ২১ তারিখ সমাপনী দিবসে বইমেলা অনুষ্ঠানে ব্যাক্তিগত কারনেই যাও। আমার যে শিশুসাহিত্যের প্রতি তেমন ঝোঁক নেই, চটগ্রামের সিনিয়র লেখকরা জানেন। শিশুতোষ লেখার জন্য যতটুকু মহৎ সারল্য দরকার, তার ছিটেফোঁটাও আমার স্বভাবে নেই। আমার নিত্যপাঠ সমালোচনা সাহিত্য নিরস জ্ঞানমুলক প্রবন্ধ। আর একান্ত ভালোবাসা কবিতার প্রতি। যা সচরাচর শিক্ষিত বাঙালির থাকেই। বিকালে শিল্পকলায় গেলে অনুজ কবি রেহেনা মাহমুদ বলেই বসে 'আজকে অনুষ্ঠান শেষে আপনার সাথে ফটোসেশন হবে। আজকে ছবি তুলেই ছাড়বো।' বড্ড গরম পড়ছিলো, হল থেকে বের হতেই ছড়া শিল্পী রমজান আলী মামুন সহ আরও কয়েক জনের সাথে দেখা। মঈন ফারুক আরও কয়েক জন। কুশলাদির পর মামুন ভাই বললেন,' সবাই শোনেন জাহেদ ভাই কিন্তু অনুষ্ঠানে এমনি আসেনি, ওনি ছড়া কিংবা শিশুসাহিত্যে চর্চা করেন না' একজন বললেন, 'ওনি হজ্ব করে এসেছেন, তাই? রমজান আলী মামুন বললেন, 'হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিচ্ছি: উনি এসেছেন ওনার বড় ভাই শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ এবার বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পদক পেয়েছেন, তাই ভাইয়ের অনুষ্ঠানে এসেছেন' আমি বিনয়ের সাথে জানালাম, 'ভাই আমি কেজো লেখক। হঠাৎ ভাব উদয় হলে লিখি, নয়তো আটটা পাঁচটার চাকুরে। আপনাদের মত পেশাদার লেখক হতে পারলাম কই? সারা জীবনে পাঁচটি বই হবে কিনা সন্দেহ!' নানা কথা হলো। তিনি জানালে তখন তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল থেকে এসেছেন। তার এক ভাইড়া ভাই হঠাৎ স্টোক করেছে। আজ মেলার শেষ দিন এবং তিনিও পদক প্রাপ্তদের একজন, তাই আসতেই হলো। মনটা তার খুব খারাপ, জানালেন। তার সাথে মেলায় ছবি তোলার ইচ্ছে ছিলো। বয়স হচ্ছে, স্মৃতি কাতর হয়ে যাচ্ছি। ফটোতোলার বাতিকটা বেড়েছে। কিন্তু বিধি বাম, ছোট ভাই ইমতিয়াজ তার ছবি তোলার জন্য আবদার করে এনড্রয়েট মোবাইল টা নিয়ে গেলো। অপেক্ষায় ছিলাম, মোবাইলাটা দিয়ে যাবে, সেলফি কিংবা গ্রুপ ছবি তুলবো, সাথে ছিলো . আজাদ বুলবুল শামসুদ্দীন শিশির স্যার। ইমতিয়াজের দেরি দেখে রমজান আলী মামুন ভাইয়ের হাতটা ছেড়ে দিলাম। এতক্ষণ হাতটা ধরায় ছিলো। এখনও মনে হয় উষ্ণতাটা লেগে আছে।
 
অনুষ্ঠান শুরু হওয়াতে তিনি মঞ্চে উঠেগেলেন।
 
প্রায় এগার জনের পদক প্রদান অনুষ্ঠান। দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। এক ফাঁকে চা খাওয়া আড্ডা দেয়ার জন্য বেড়িয়ে গেলাম। বন্ধু নিজামী এসেছিলো মীরসসরায় থেকে। তাকে কিছু সময় দিচ্ছি এমন সময় কাবেরী দিদির সাথে দেখা। সাংবাদিক ইমরান মাহফুজ কে নিয়ে তাদের ছবি তোলা নিয়ে মজা করছিলাম। আবার ছুটে আসলেন অনুজ কবি রেহেনা মাহমুদ। কালকের মন্তব্যে তিনি খোঁচা অনুভব করেছেন। আজ মধুর প্রতিশোধ নেবে। ঝুলে থাকা শিশুসাহিত্য উৎসবের ফ্যাস্টুনের সামনে দাড়িয়ে আমার সাথে ফটো তুলবেন। অগত্য কি আর করা আমি পাশে থাকা কবি পুলক রায় শিল্পী হাসনাত চৌধুরীকে ডাকলাম, মধুর প্রতিশোধের সঙ্গী হতে। কবি রেহেনা মাহমুদের শখ হয়েছে আমাকে শিশু সাহিlত্যিক হিসেবে লেখায় না হোক ছবি দিয়ে হলেও তকমা লাগাবেন। হায়, কে এড়ায় এমন রমণীয় সম্ভাষণ?
 
ফটোসেশন শেষে নানা প্রসঙ্গে আড্ডা জমে ছিলো জুয়েল ভাই, শিবলু শফি, হাসনাত, ইমরান, নিজামী, পুলক রায় দাদার সাথে। প্রজন্মের পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার কারণটা আলোচনার মূল প্রসঙ্গ ছিলো।
আড্ডার ঘোরে আমরা হল থেকে একটু দূরে চল আসছিলাম। মুক্তমঞ্চে কাছেই। দূর থেকে দেখলাম কয়েকজন একজন মানুষকে আলগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। মনে করেছিলাম এতো দীর্ঘ অনুষ্ঠান, কোনো বয়স্ক মানুষ হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমার আবাস শহরে থেকে দূরে, তাই চলে আসার তাড়া ছিলো। একটু পরেই চলে আসলাম শহর থেকে পঁচিশ মাইল দূরে, নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে কাফকো কলোনীতে। এর পর দিন আবার জীবনের নিত্য রুটিন, চাকরি ঘর সংসার পরিবার পরিজনের ফরমায়েশ, ফাঁকে সময়ে ক্ষণিক বিনোদন ফেজবুকিং। আবার মজা করা। কবি রেহেনা মাহমুদ শিল্পী হাসনাত চৌধুরীর আমার সাথে তোলা ছবি পোষ্ট। আমাদের ফান করে মন্তব্য। প্রতিমন্তব্য। মাঝ খানে দুইদিন। ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুর, হঠাৎ একটি সংবাদ টাইম লাইনে কালো কালো হয়ে আসতেই থাকে। প্রিয় ছড়াশিল্পী, শিশুসাহিত্যিক রমজান আলী মামুন আর নেই। একটির পর একটি পোস্ট। আসতেই থাকে। কালো কালো হয়ে আমার সমস্ত অনুভূতি অবস করে দিতে থাকে। মনে হচ্ছে এখনও তার হাতের উষ্ণতা লেগে আছে আমার হাতে...
 
.
ছড়াশিল্পী রমজান আলী মামুনের সাথে পরিচয় সেই মধ্য আশি দশক থেকে। নানা সাহিত্য আড্ডায় দেখা, লেখাপাঠ, পাঠ আলোচনায় অংশগ্রহণ। হালকা পাতলা গড়ন ছিলো তখন। নীরব সাহিত্য চর্চা। কখনো উচ্চ স্বরে হাসি দিতেও দেখিনি। বিনয়ী। সদা চঞ্চল, কর্মব্যস্ত, ছুটে চলা মানুষ। বয়সের পার্থক্যের কারণে সম্পর্ক হয়তো গভীর হয়নি। জানা হয়নি তার হৃদয় বেদনা কিংবা পরিবার পরিজনের পরিধি নিয়ে। কিন্তু কখন মনে হয়নি হঠাৎ করে মানুষটা চলে যাবেন। হ্যা, হঠাৎ করে তিনি মুটিয়ে গেলেন। আমার ভালো ঠেকেনি। এমন শরীর ছেড়ে দেয়া যে বয়সের লক্ষণ নয় সন্দেহ লাগলেও জিগেস করিনি সংকোচে। যদি তিনি মনে কিছু নেন! বিদায় বেলায় শুধু বলেছিলাম 'ভালো থাকবেন, দোয়া করবেন'
 
মামুন ভাই চেনা পরিধির বড় অসময়ে চলে গেলেন। হয়তো ঐটুকুই ছিলো মহাকলে তার জন্য বরাদ্দ। কিন্তু মনতো মায়া ছাড়ে না। জীবনটা বড় মায়ার হয়ে ওঠে কারো করো জন্যে। মামুন ভাই তেমন একজন। আপনি যেখানে থাকুন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিক, আপনার চারপাশ প্রশস্ত করে দিক। আলোকিত করে দিক।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.