ঈদুল ফিতর: চলমান প্রথা বনাম সংস্কৃতির গোড়ার কথা ।। রিদওয়ান বিন ওয়ালী উল্লাহ

 
মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অবকাঠামোগতভাবে সে সর্ব শ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে-(আত্-তীন:৪)। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ মানুষের জ্ঞান। মানুষ স্রষ্টা কর্তৃক কল্যাণ-অকল্যাণে পার্থক্য সৃষ্টিতে সক্ষম হওয়া তাকে জগতের সৃষ্টিকুলের মাঝে শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন করেছে। পৃথিবীর সব আয়োজন তাকে ঘিরেই। স্রষ্টাই আল-কোরআন নামক সর্বশেষ, সর্বাধুনিক ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থার সূরা আল-হাজ্জ:৬৫, লুকমান:২০, আন্-নাহল:১৪, আয্-যুখরুফ:১২-১৩ এবং সূরা আল-জাসিয়া’র:১২-১৩ নং সহ বিভিন্ন আয়াতে এই ঘোষণা দিয়েছেন। সূরা লুকমানের ২০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে। আর তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামত ব্যাপক করে দিয়েছেন; মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করে জ্ঞান, হিদায়াত ও আলো দানকারী কিতাব ছাড়া।  
স্রষ্টারই হিকমাত যে, মানুষ পরিশ্রমের পরে ফলাফল আশা করে। আল্লাহ তায়ালাও অনর্থক ও নিস্ফল কাজ পছন্দ করেন না। পার্থিব জগতে মানুষ কোনো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলে তার ফলাফল তৎক্ষণাৎ পায় না। তথাপি যারা পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো করেছে তারা আত্মবিশ্বাসের বলে পরীক্ষা শেষেই চাঙ্গা মেজাজে থাকে। ঈদ সে রকমই একটি ব্যাপার। পূর্ণ একমাস রমজান পালনের পর ঈদের দিন আনন্দ তাদের জন্যই মানায় যারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সিয়াম সাধনা করতে পেরেছে। সিয়ামের প্রতিদান যদিও আখেরাতে আল্লাহ নিজেই দেবেন তবুও আত্মবিশ্বাসের বলে প্রভুর প্রতিশ্রুতির স্মরণে এই দিন সাচ্চা ঈমানদারগণ আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আল্লাহ তায়ালা তাই শিখিয়েছেন যে, ‘বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম-(সূরা ইউনুস:৫৮)। প্রভুকে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে আর কোন্ আনন্দ উত্তম হতে পারে! বান্দার জন্য এর চেয়ে খুশির আর কী হতে পারে যে, আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে রাসূল স. বলেন, মহান আল্লাহ বলেন, রোযা আমার জন্য এর প্রতিদান আমিই দেবো-(বুখারী-মুসলিম)।
 আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূল স. বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানসহ সাওয়াবের আশায় রমযানের সাওম পালন করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেওয়া হবে (বুখরী-মুসলিম)। আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত আরেকটি হাদীসে রাসূল স. বলেন, রমযান মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দুয়ারগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানগুলোকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় (বুখরী-মুসলিম)। সাহল ইবনে সা’দ রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল স. বলেন, জান্নাতের মধ্যে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন কেবলমাত্র রোযাদার লোকেরাই প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না (বুখরী-মুসলিম)। আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত আরেকটি হাদীসে রাসূল স. ইরশাদ করেন, রোযাদার ব্যক্তি দু'টি আনন্দ লাভ করবে। একটি আনন্দ হল ইফতারের মুহূর্তে আর অপরটি হবে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা থেকে বর্ণিত ‘রাসুলুল্লাহ সা বলেন, রোযা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আমার রব! আমি তাঁকে দিনের বেলা পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত রেখেছি। তাঁর সম্পর্কে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাঁকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাঁর সম্পর্কে আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন এদের সুপারিশ কবুল করা হবে।’
তাছাড়া একটু ভালো খাবারের আয়োজন তো সবাই করতে পারে। কিন্তু সেটা মুমীনের আনন্দ হতে পারে না। তার আনন্দ তো প্রভুর সন্তুষ্টিতে নিহিত।
ঈদ নিছক কোনো আনন্দানুষ্ঠান নয়। এটা ইসলামের নিদর্শনাবলীর অন্যতম। হযরত আনাস রা.  থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহেলী যুগে মদীনা বাসীরা দুটো দিবসে খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ স. মদীনায় আগমন করলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ রাববুল আ‘লামীন এ দু’দিনের পরিবর্তে তোমাদের জন্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হল-ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (আবু দাউদ, কিতাবুস সালাত, আল্লামা আলবনী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যুগে যুগে সকল জাতির নির্দিষ্ট কিছু ঈদ বা আনন্দের দিন ছিল এবং আছে। যার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। রয়েছে ঈদ উদ্যাপনের নির্দিষ্ট কৃষ্টি-কালচার। মুসলিমরা সবার থেকে ভিন্ন। তাদের ঈদ একান্তই আল্লাহ-রাসূল’র নির্দেশনায় উদ্যাপিত হয়। ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান হওয়ায় মুসলমানদের আনন্দের ক্ষণগুলিও পরিমার্জিত। মানব প্রকৃতি বিরুদ্ধ সংস্কৃতি মুক্ত। তা যে বুঝে সে কখনো অমুসলিম থাকতে পারে না।  
নবুয়তী যুগের পরিসমাপ্তির পর যত দিন গড়াচ্ছে তত শয়তান মানব মনে স্থান করে নেয়ার সুযোগ বেশি খুঁজছে। ফলে মানব কল্যাণে পরিপূর্ণ ঈদ অনুষ্ঠানে ইসলাম অনুসরণের দাবিদারদেরকেও দেখা যায় ভিন্ন সংস্কৃতি চর্চায় ডুবে থাকতে। তাই বলে হাদীসের কথা ভুল নয়। মুহাদ্দিসগণের মতে, ‘নাফসে আম্মারাহ’র অধিকারীরাই এ কাজ করতে পারে। পবিত্র ঈদ উদযাপনের মৌলিক সংস্কৃতি আর চলমান প্রথার মাঝে কতটুকু ব্যবধান ভেবে দেখা যাক।
 
ঈদের সংখ্যা গণনা:
ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। তাই এর অনুসারীরা শালীনতা বজায় রেখে মনভরে আনন্দ-উল্লাসের সুযোগ পায়। মুসলমানদের দু’টি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও আযহা। তবে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হাদীসে জুমা’র দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলা হয়েছে। তিনি বলেন আমি রাসুল স. কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় জুমা’র দিন ঈদের দিন (আহমাদ ও ইবনে খুযায়মাহ)। এ ছাড়া বাকী সব ঈদই ইসলামী সংস্কৃতি বহির্ভূত। যেমন- ঈদুর রবী’ Spring Festival, ঈদুল Valentine’s Day, New Year’s Day, ঈদুল জ্বালা Evacuation Day, ঈদুস্ সাওরাহ Evacuation Day, ঈদুস্ শাজারাহ Arbor Day, Festival of Sham el- Nessim, ঈদুল জুলুস, ঈদুল মীলাদ Christmas Day, ঈদুল উম্ম Mother’s Day, ঈদুল আব্ব Father’s Day, Workers’ Day, Flooding of the Nile, Teachers’ Day, ঈদ-ই-মীলাদুন্নবী, Flag Day, Hygiene Day, Birth Day, Family Day  ইত্যাদি।
 
ঈদের রাত্রি জাগরণ:
রাত্রি জেগে আল্লাহর ইবাদাত করা ইসলামে বিধিত। বরং আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাতে সালাতে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম (আল-মুয্যাম্মিল:২-৩)।’ তবে শরীয়ত কোনো রাত সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলা সত্ত্বেও ঐ রাতকে নির্দিষ্ট করে উদ্যাপন করা বিদয়‘াত হবে। কারণ, আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসুল স. বলেন, ‘কেউ এমন কিছু নতুন আবিষ্কার করলো যা আমাদের দ্বীনে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত (বুখারী-মুসলিম)।’ তাই অভ্যাসগতভাবে রাত না জেগে এই রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদাত করলে তা বিদয়াত তথা ইসলাম প্রত্যাখ্যাত সংস্কৃতি হবে। কারণ, রাসুল স. ঈদের রাত জাগার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেন নি (যাদুল মায়’াদ)। এ রাত জাগরণ সম্পর্কিত বর্ণিত একটি হাদীস হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও আজহার রাত্রিদ্বয় আল্লাহর ইবাদাতের মাধ্যমে জাগরিত থাকবে, তার অন্তর সে দিন মরবে না যে দিন অন্তর সমূহ মৃত্যু বরণ করবে।’ প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আলবানী’র মতে, এই হাদীসটি ও এ সংক্রান্ত বর্ণিত অন্যান্য হাদীসগুলো হয় অত্যন্ত দূর্বল নচেৎ বানোয়াট। তবে সে ব্যক্তির জন্য এই দু’রাত্রি জাগরণ বেদয়াত হবে না, যে সাধারণতঃ রাত জেগে ইবাদাত করে এবং এ রাতকে বিশেষ কোন রাত মনে না করে একা একা ইবাদাত করে। 
 
যাকাতুল ফিত্র ও দুঃস্থ অধিকার:
ইসলামে সম্মানের মানদণ্ড তাকওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অদিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন (আল-হুজুরাত:১৩)।’ এখানে ধনী-গরীবে কোনো ভেদাভেদ নেই। ইসলামই একমাত্র ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখতে সদা তৎপর। তাইতো ধনী-গরীবের সীমানা পেরিয়ে  ভ্রাতৃত্বের সৌধের উপর চিরন্তন ভালোবাসার মিনার গড়তে স্বাধীন-গোলাম, নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের উপর যাকাতুল ফিত্র ফরজ করা হয়েছে (বুখারী-মুসলিম)। তা আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে ঈদের চাঁদ দেখা থেকে বা ঈদের দিন ফজরের সময় থেকে ঈদের সালাতের পূর্ব পর্যন্ত (বুখারী-মুসলিম)। ‘ফিতরা আদায় করা ছাড়া সাওম আল্লাহর কাছে পৌঁছে না’ হাদীসটিকে আল্লামা আলবানী দূর্বল বলেছেন। তবে ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ঈদের সালাতের আগের আদায়কৃত যাকাত ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে নচেৎ হবে সাদাকাহ, ফিতরা আদায় হবে না।
সুতরাং গরীবের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে শুধু নিজের উদরপূর্তি আর অনর্থক কাজে অর্থ ব্যয় ইসলাম বহির্ভূত সংস্কৃতি। অন্যদিকে নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী ও গরীবদের জন্য পরিকল্পিত ব্যয়ই হচ্ছে ঈদ সংস্কৃতি।
 
তাকবীর বনাম গান-বাজনা-পার্টির আয়োজন:
মুসলমানরা হেদায়াত ও নেয়ামত (যেমন সূরা বাক্বারা: ১৮৫) পাওয়ার শুকরিয়া স্বরূপ ঈদের রাতের সূর্যাস্তের সময় থেকে ঈদের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত বাড়িতে, মসজিদে কিংবা বাজারে উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করে। তবে নারীরা পাঠ করবে গোপনে। কী চমৎকার সংস্কৃতি যে, তারা বলে- ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ।’ আফসোস তাদের জন্য যারা এই চমৎকার সংস্কৃতি বাদ দিয়ে ঈদের রাত থেকেই অশ্লীল নাচ-গান, সিনেমা, হোটেলে কিংবা পার্কে নারী-পুরুষের সমন্বিত পার্টির আয়োজন করে মদ-গাঁজার আসর বসিয়ে, আতশবাজি করে ভিনদেশী সংস্কৃতিতে ডুবে থাকে। গ্রাম গঞ্জেও জুয়ার আসর বসতে দেখা যায়। দেখা যায় নগ্নতা, বেহায়াপনা, বেপরোয়া যৌন ব্যবসায় লিপ্ত থাকতে। যার সাথে ঈদ সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই।
 
বিনোদন বনাম অশ্লীলতা:
রাসূল স. বলেন, তোমার দেহের প্রতি তোমার কর্তব্য রয়েছে (বুখারী)। ইসলামে বিনোদন ততক্ষণ বিধিত যতক্ষণ তা মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল থাকে। এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীসের একটি হচ্ছে- আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল স. ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দু’টি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর রা. ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসূল স. তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ [সহীহ বুখারি : ৯৫২]
হাদীসের আলোকে বলা যায়, জ্ঞান ও চরিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না এ রকম সকল শালীন সংগীত, খেলাধুলা ঈদের দিনে বৈধ। যেমন-দফ (এক দিকে খোলো ঢোল) বাজিয়ে গান গাওয়া, বর্শা, চামড়ার তৈরী ঢাল দিয়ে খেলা ও ‘যাপ্ন’ নামক খেলার কথা সহীহ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। অথচ তথাকথিত আধুনিকতার ধ্বজাধারীরা ঈদকে উপলক্ষ্য করে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ঈদ সংস্কৃতি বিবর্জিত অশ্লীল নাটক, সিনেমা, অর্ধ উলঙ্গ কিংবা নগ্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, পত্রিকায় অভিনয় শিল্পীদের নগ্ন ছবি ছাপায় এমনকি ইসলামী আক্বীদা পরিপন্থী গল্প-কবিতা-প্রবন্ধের সমন্বয়ে সাময়িকী প্রকাশ করে। ফলে ধ্বংসের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে আমাদের যুব সমাজ। আমরা মনে করি তার বিপরীতে ইসলামের সোনালী অতীতকে উপজীব্য করে তৈরী হতে পারে রুচিশীল নাটক, সিনেমা, অশ্লীলতা বিবর্জিত বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান। মুসলিম বিজ্ঞানী ও বীরদের জীবনী, যুগে যুগে মুসলিম বিজয়াভিযানের সোনালি ইতিহাস নিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে বিভিন্ন সাময়িকী। পত্রিকায় ছাপানো যেতে পারে ইসলামের ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলীর আকর্ষণীয় সব ছবি। মিসরের ইতিহাসে প্রথম জনগণের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আপনি কিভাবে মিডিয়ার চাহিদা মিটাবেন? উত্তরে বলেছিলেন, ‘ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা ‘শহীদ হাসান আল বান্না’ নিজেই তো ৬ টি নাটক তৈরী করে গেছেন। তাছাড়া মিসরে ব্রাদারহুড কর্তৃক পর্দা মেনে সম্পূর্ণ নারীদের দ্বারা চ্যানেল খোলার নজির তো আমাদের সামনেই আছে। তাই আসুন অপসংস্কৃতি ছেড়ে মূলের দিকে ফিরে যাই। মোবাইল অপারেটরগুলোও অশ্লীল ও যৌন উত্তেজক গান আর রিংটোনের পরিবর্তে শালীন ও ইসলামী গানের প্রচলন করতে পারে। অনর্থক রাত জাগিয়ে সময়, স্বাস্থ্য, চরিত্র ও অর্থ নষ্ট করার মত ন্যাক্কারজনক কাজ থেকে বিরত রাখা ও থাকার আহবান থাকলো তাদের প্রতি।
 
সাজসজ্জা:
পরিপাটি পোশাকেই মানুষকে স্মার্ট লাগে। ইতিহাস বলে এই সভ্যতা ইসলামই মানবজাতিকে শিখিয়েছে। তাই অপব্যয় মুক্ত পরিমার্জিত সাজসজ্জা ইসলামের শিক্ষা। জাবের রা. বলেন, নবী করীম স. এর একটি চমৎকার জুব্বা ছিল, যা তিনি দু’ঈদ ও জুমা’র দিনে পরিধান করতেন (সহীহ ইবনে খুজায়সাহ:১৭৬৫)। অন্য দিকে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল স. ওমর রা.কে রেশমী কাপড়ের জামা ক্রয়ে নিষেধ করেছেন (বুখারী:৪৯৮)।
সুন্দর পোশাক পরিধান কিংবা সুগন্ধি ব্যবহারে ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে। তবে অযথা ব্যয়বহুল পোশাক আর যৌন উত্তেজনাপূর্ণ সেন্ট ব্যবহার কখনো ভ্রাততৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়তা করে না। বরং বাড়ে ধনী-গরীবের তফাৎ আর সামাজিক উকৃঙ্খলতা । নারীদেকে সাজসজ্জার অনুমতি দেয়া হয়েছে তবে পর্দার ভিতরে থেকে। অথচ আজ-কাল নগ্ন কিংবা ছেলেদের পোশাক পরে মেয়েরা যেভাবে মার্কেটে, রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে তাতে অপচয় তো হয় ই সাথে গরীবের হক নষ্ট হয়, সমাজে ইভটিজিংয়ের মাত্রা বেড়ে যায়। এমনকি যৌন উত্তেজনায় সুকৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
 
ঘর থেকে ঈদগাহে:
ঈদুল ফিতরে কিছু খেয়ে আর ঈদুল আজহাতে নামাজের আগে না খেয়ে বের হওয়া সুন্নত। ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ও মিনকা’ বলে রাসূল স. ও সাহবীরা শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন বলে হাদীসে উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়া বর্তমানে প্রচলিত ‘ঈদুকুম সায়ীদ’, ‘ঈদ মোবারাক’ বলাতে সমস্যা নেই। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, নবী করীম স. ঈদের দিন আসা-যাওয়া ভিন্্ন পথে করতেন (বুখারী:৯৮৬)। ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূল স. ঈদগাহে যাওয়া-আসা হেঁটে করতেন (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী, আলবানী এটিকে সহীহ বলেছেন)।
এখন তো ঈদগাহে ভিন্নপথে আসা-যাওয়ার হিকমত নিয়ে আমরা চিন্তাই করিনা। হেঁটে যাওয়া তো গরীবের কাজ, বিত্তশালীরা কেন করবে? এই হল সমাজের চিত্র। অথচ অশান্তির দাবানলে ছারখার হওয়া ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমাজ থেকে মুক্ত হয়ে একটি শান্তির সমাজ গড়ার প্রেসক্রিপশন যে এই ছোট্র ক’টি দাওয়ায় নিহিত সেটা ভাবার সময় কি আমাদের আছে?
 
ঈদগাহ ও নারী:
বেলেল্লাপনায় বিশ্বাসী তথাকথিত নারীবাদীরা বলে ইসলাম নারীকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। অথচ বুখারীর সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, নারীদের ঈদগাহে আসা ও ভিন্নভাবে ঈদের নামাজ আদায় করা সুন্নত। হায়েজা মহিলারা নামাজ আদায় করবে না। ঈদগাহে আসতে পারবে (দেখুন; বুখারী:১/৯৩, মুসলিম: ৮৯০, বুখরী: ১/৮৪)। 
 
ঈদগাহ ও সামাজিক ঐক্য:
মক্কাবাসী ব্যতীত এবং ওজর না থাকলে খোলামাঠে ঈদগাহ বানানো সুন্নাত (যাদুল মায়া‘দ)। উদ্দেশ্য ইসলামের নিদর্শন উজ্জীবিত করণ আর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গঠনে মহাসমাবেশ ঘটানো। অথচ ইচ্ছেমতো ছোটছোট মসজিদ বানিয়ে সেখানে জুমা’ আর ঈদগাহের আয়োজন করা মামুলী ব্যাপার সেখানে জুমা’ আর ঈদগাহের আয়োজন করা মামুলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। এতে সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট হয়।
 
কবর যেয়ারত:
মহিলাদের জন্য কবর যেয়ারত সর্বদা হারাম। পুরুষদের জন্য সুন্নাত। তবে রাসূল স.’র কবর ব্যতিরেকে (তাও সেটা মসজিদে নববীতে সফর বৈধ হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট) যেয়ারতের জন্য কোথাও সফর করা যাবে না। এবং ঈদের দিনকে যিয়ারতের জন্য কল্যাণকর বলে নির্দিষ্ট করা বিদয়াত। কারণ, তা কষ্ট বাড়িয়ে দেবে অথচ ঈদের উদ্দেশ্য আনন্দ দান।
 
ঈদ-রাজনীতি-জনস্বার্থ:
ঈদ আসলেই আমাদের সমাজে জনপ্রতিনিধিদের লোকদেখানো মানবপ্রেমের হিড়িক পড়ে যায়। অথচ ভোট ভিক্ষার পর তাদের না দেখতে দেখতে এলাকার জনগণ তাদের নাম পর্যন্ত ভুলার উপক্রম হয়ে পড়ে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন দলের ব্যানারে ঈদ পূণর্মিলনী কিংবা সামান্য পোশাক বিতরণ করে মানবতার প্রতি দরদ প্রদর্শনের মহড়া পরিলক্ষিত হলেও এদের উদ্দেশ্য হীন স্বার্থোদ্ধার। সারা বছর জনসাধারণের রিলিফ, মুক্তিযুদ্ধ ভাতা কিংবা বিধবা ভাতা খেয়ে পেট মোটা করলেও ঈদের সময়ও এদের হুঁশ ফেরেনা। ঈদের পোশাক বিতরণ কিংবা ঈদ পূণর্মিলনী অনুষ্ঠান করতেও সেই জনগণের পকেটের টাকাতেই এদের ভরসা। বছরে দু’টি ঈদ এসে বিশ্ব মানবতার মাঝে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের যে ডাক দিয়ে যায়, তা তাদের কানে পৌঁছে না। অথচ ইসলামের সোনালী অতীত এর সম্পূর্ণ বিপরীত। রাত জেগে জনগণের খোঁজখবর নেওয়ার ইতিহাস তো মুসলমানদেরই।
আসুন অতীতের সকল গ্লানিকে পেছনে ফেলে জেগে উঠি আরেক বার। মস্তক অবনত করি মহান প্রভুর কদমে। নিজেকে উৎসর্গ করি রাসূলের অনুসরণে। জ্বলে উঠি ঐশী শক্তিতে। সকল অপসংস্কৃতিকে রুখে দিয়ে চর্চা করি আল্লাহ-রাসূলের শেখানো ঈদ সংস্কৃতি। সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সৌধের উপর গড়ে তুলি একটি মানবিক সমাজ। প্রতিষ্ঠা করি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অধিকার। ফিরিয়ে আনি সেই সোনালী অতীত। যেখানে বাঘ-ছাগল তৃষ্ণা মেটাবে একই কূপে। তবু চোখ রাঙ্গাবে না কেউ কারো প্রতি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। সমস্বরে বলি ‘তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না ও মিনকা’।
 
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক
ridwanullah88@gmail.com

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

#সংস্কৃতি
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#রিদওয়ান_বিন_ওয়ালী_উল্লাহ
#ঈদুল_ফিতর

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.