বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ।। মোঃ আলম শরীফ
সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের দর্পণ। মোতাহার হোসেন চৌধুরী সুন্দরভাবে বাঁচাকে সংস্কৃতি বলেছেন। আবুল ফজল আবার মনুষ্যত্ব তথা মানবধর্মের সাধনাকেই সংস্কৃতি বলেছেন। আরনান্ড ম্যাথিউ বলেছেন “পৃথিবী সম্বন্ধে যা উৎকৃষ্ট বলা বা চিন্তা করা হয়েছে তা জানাই হচ্ছে সংস্কৃতি। আবুল মনসুর আহমদ সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন “কালচার বা সংস্কৃতি মানুষের মন ও বিকাশের স্তরবোধক। তার মানে কোন সমাজ বা জাতির মনে কোন এক ব্যাপার একটা ষ্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার বিধি মোটামুটি সার্বজনীন চরিত্র কারেক্টার। আচরণ বা আখলাকের রূপ ধারণ করিলেই ঐ ব্যাপারে ঐ মানবগোষ্ঠির কালচার বলা হইয়া থাকে”। সংস্কৃতির সবচেয়ে সহজ সংজ্ঞা দিয়েছেন এইচ, জে, লাস্কি, তিনি বলেন ঃ “Culture is that what we are”.
আগ্রাসন শব্দটি সাম্প্রতিককালে বহুল উচ্চারিত। এ শব্দটি আক্রমণ, জবরদখল প্রভৃতির সমার্থক। এ কারণে শব্দটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব খুব বেশী। সাধারণতঃ কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা গ্রাস করার উদ্যোগ আগ্রাসন রূপে বিবেচিত হয়। আগ্রাসন সংঘটিত হতে পারে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে, ক্ষিপ্রগতিতে। কিংবা তা সম্পন্ন হতে পারে ধীর চালে বড়শিতে মাছ আটকানোর কৌশলে।
আধুনিক যুগে যুদ্ধের মাধ্যমে কোন দেশকে প্রত্যক্ষভাবে পদানত করা সহজ নয়। আগ্রাসী শক্তিগুলি এখন কৌশলে তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়। এই প্রক্রিয়ায়, একটি দেশকে ভৌগোলিকভাবে গ্রাস করার আগে সেখানে একটি উপযুক্ত পরিবেশ পর্যায়ক্রমে তৈরি করা হয়। নানা কৌশলে টার্গেট রাষ্ট্রটির জনগণের স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যসমূহ এবং তাদের স্বাতন্ত্রচেতনা বিলুপ্ত বা ভোঁতা করে তাদের শক্তি, সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিংড়ে নেয়া হয়। এভাবে সংশ্লিষ্ট জাতির রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরাজয়ের সোপান রচিত হয়ে গেলে এক সময় সে দেশটি আগ্রাসী শক্তির অধীনতা কবুল করে নিতে বাধ্য হয়।
একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র বিনাস, ধর্মীয় চেতনার বিলোপ সাধন, ঐতিহ্যচেতনায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি, টার্গেট রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে গুপ্তচরবৃত্তি, সাবোটাজ বা নাশকতামূলক তৎপরতা পরিচালনা, সে দেশের ভিতর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃতাত্বিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠির মধ্যে সংঘাত জীইয়ে রাখা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নাশ, অর্থনেতিক বাজার দখল, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দান ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ, কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ, টার্গেট রাষ্ট্রটির ভিতর সংঘবদ্ধ পঞ্চম বাহিনী লালন, ছাত্র রাজনীতিবিদ সামরিক বেসামরিক আমলা ও বুদ্ধিজীবিদের মগজ ধোলাই ও মগজক্রয়, তথ্য সন্ত্রাস ও তথ্য প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি উপায়ে দীর্ঘমেয়াদী আগ্রাসন কার্যকর করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদী আগ্রাসন প্রক্রিয়ায় কোন দেশের সংস্কৃতি হয় আগ্রাসী রাষ্ট্রের প্রধান টার্গেট। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্য হলো টার্গেটকৃত জাতিকে আত্ম পরিচয়বিস্মৃত, স্বাতন্ত্রচেতনারহিত, শিকড়-বিচ্ছিন্ন এমন একদল মানুষে পরিণত করা, যারা আগ্রাসী শক্তির গোলামীকে হাঁটু পেতে মেনে নেবে। রাজনৈতিক গোলামী বা ভৌগোলিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করা সম্ভব; কিন্তু মানসিকভাবে গোলাম হয়ে পড়া একটি নতজানু জাতিকে উদ্ধার করা সাধ্যাতীত হয়ে দাঁড়ায়। ভিন্ন দিক থেকেও বিষয়টি দেখা যায়।
একটি জাতিকে যুদ্ধেও মাধ্যমে পরাস্ত করা গেলেও তার সংস্কৃতিকে গ্রাস করা ছাড়া সেই জাতিকে স্থায়ীভাবে পদানত রাখা যায়না। আগ্রাসী শক্তির কাছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের গুরুত্ব তাই সমধিক। একইভাবে, দুর্বল জাতিগুলির জন্যও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রাখার প্রশ্নটি তাদের অস্তিত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্য। ‘দেশ হিসাবে আমরা ছোট, কিন্তু জাতি হিসাবে অনেক বড়’ এই প্রত্যয় যখন কোন জাতির অন্তর ভেদ করে উচ্চারিত হয়, তার মাধ্যমে প্রকারান্তরে সে জাতির স্বকীয় সংস্কৃৃতির শ্রেষ্ঠত্বের মহিমাই ঘোষণা করা হয়।
ফরাক্কা বাঁধের সাহায্যে ভারত একদিকে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় মানুষকে শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা কেেছ, অন্য দিকে ভারতের সৃষ্ট সাংস্কৃতিক ফারাক্কা আমাদের জাতির আত্মাকে শোষণ করছে। ভারতীয় বই, পত্র-পত্রিকা বানের পানির মতো এদেশের বাজারে ঢুকে পড়ছে। ভারত এদেশের সাংস্কৃতিক বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। ভারতীয় বইপত্রে বাংলাদেশের বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা শুধু নয়, টেক্সট বই এমনকি শিশু পাঠের জন্যও এখন ভারতীয় বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। নিজেদের দেশের স্কুলে ভারতীয় বই পাঠ করে আমাদের দেশের শিশুরা বিজাতীয় সংস্কৃতির তালিম নিচ্ছে। এ সংস্কৃতি শুধু বিজাতীয় নয়, এ সংস্কৃতি আমাদের বৈরি প্রতিপক্ষ, এ বইতে কুকুরের নাম ‘সুলতান’। ভারতীয় বই পত্রের প্রচন্ড দাপটে বাংলা দেশের প্রকাশনা শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের শিশু কিশোর তরুন যুবক, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের, ছাত্র ছাত্রীর ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ও বই পুস্তকের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতির গরল পাশ করেছে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের দেশজ ও আদর্শিক স্বকীয়তাও এর ফলে নষ্ট হচ্ছে। আমাদেও দেশের এক শ্রেণীর শিক্ষক ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকদের তৈরি করা বিকৃত ইতিহাস থেকে সবক গ্রহণ করে নিজেদের মগজ যেভাবে গড়ে তুলেছেন, সেভাবেই তাদের হাতে গড়ে উঠছে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ভাষা সাহিত্য কিংবা সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ব সম্পর্কেও একই কথা।
ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়াও আমাদের দেশে চলছে পশ্চিমা সংস্কৃতির দাপট। পশ্চিমা জগৎ বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে ইসলামী চেতনা দুর্বল করার জন্য ভোগবাদ, বস্তুবাদ, যৌনতা, উলঙ্গপনা বেহায়াপনার সয়লাব সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর পুঁজিবাদী পশ্চিমা জগৎ মুসলিম দুনিয়াকে তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের টার্গেট বানিয়েছে। ইসলাম এখন তাদের সামনে প্রধান এবং একমাত্র চ্যালেঞ্জ। ক্ষয়িষ্ণু পাশ্চাত্য সভ্যতা ইতিমধ্যে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেছে। পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধান অস্ত্র হলো সেবার নামে, এনজিওর ছদ্মাবরণে এদেশের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ধ্বংস করা ও ধর্মান্তর করার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের স্থায়ী এজেন্ট সৃষ্টি এবং তথ্য প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্বের সুবাদে তথ্য সন্ত্রাস।
এদেশের জনগণের দারিদ্র ও বেকারত্বের সুযোগে এনজিওরা এদেশের সংস্কৃতিতে তাদের আগ্রাসী থাবা বিস্তার করেছে। এই এনজিওগুলির কার্যক্রম দু‘টি ধারায় বিভক্ত। একদল হচ্ছে মিশনারী। এরা প্রত্যক্ষভাবে খ্রীষ্টান মিশনারী তৎপরতার সাথে যুক্ত। আরেক পশ্চিমা এনজিও, তাদের সামগ্রিক কর্মকান্ডে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামকে এবং এদেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবার ব্যবস্থাকে প্রতিপক্ষরূপে দাড় করিয়েছে।
১৯৪৮ সলে এদেশে ইউরোপীয় বনিকদের আগমনধারা সূচনা করেছিলেন ভাস্কো ডা গামা। ক্রসেডের পটভূমিতে প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে তারা মুসলিম ভারতে প্রবেশ করেছিল এক হাতে বাইবেল ও অন্যহাতে তরবারী নিয়ে। আঠারো শতকের শেষের ইউরোপের নব্য প্রটেস্টাইন্ট বাদী ইভেঞ্জেলিক মুভমেন্টের পর খ্রীষ্টানদের সংগঠিত মিশনারী তৎপরতার সূচনা হয়। ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট ১৭৯২ সালে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কোম্পানী সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। এর দু’বছর পর বর্তমানে বাংলাদেশ এলাকায় ব্যাপিটাল মিশনারী সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৩ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক সনদেও মাধ্যমে এদেশের শিক্ষব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের কে পৃষ্ঠপোষকতা দানের কর্মসূচী গ্রহণ করে। খ্রীষ্টান মিশনারীরা চার্লস গ্রান্ট এর র্ফমূলা অনুযায়ী খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে নানা জায়গায় ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী নেয়। এ সময়ই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে খ্রীষ্টান পাদ্রীরা ব্রাহ্মণ সংস্কৃত পন্ডিতদের যোগসাজসে বাংলা ভাষার ওপর করাত চালাতে শুরু করে। বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি এবং অন্যান্য ভাষায় খ্রীষ্ঠধর্মের মাহাত্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বইপত্র সাময়িকী ও সংবাদ পত্র প্রকাশ হতে থাকে। প্রথম দিকে খ্রীষ্টান মিশনারী তৎপরতা হিন্দু অধ্যষিত কলকাতা ও এর পাশ্ববর্তী জেলাগুলিতে কেন্দ্রীভুত ছিল। মুসলমান অধ্যুষিত উত্তর ও পূর্ববঙ্গে তখনো তাদের ক্রিয়াকলাপ খুব বেশী বিস্তৃত হয়নি। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এরপর মুসলমানদেরকে তাদের টার্গেট বানায়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার মফস্বল এলাকায়, বিশেষত নদীয়া, যশোর, খুলনা ও মালদহে খ্রীষ্টান মিশনারী তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। খ্রীষ্টান মিশনারীরা রীতিমতো দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং নানারূপ নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয়ে ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত হয়। তারা নিজেদের মিশন কেন্দ্রের সাথে সাথে দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল, অনাথাশ্রম, সেবাশ্রম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে। স্থানীয় জনগণের বোধগম্য ভাষায় তারা অসংখ্য পুস্তক পুস্তিকা ও পত্র পত্রিকা প্রকাশ করে বিনামূল্যে সর্বত্র ছড়াতে থাকে। এসব প্রচারপত্র ইসলামের বিরুদ্ধে অশালীন কুৎসা ও নিন্দায় পূর্ণ ছিল।
আমাদের দেশে এখন যেমন, সেসময় তেমনি ইসলাম, ইসলামের নবী ও আল কোরআনের বিরুদ্ধে খ্রীষ্ঠান মিশনারীরা ব্যাপকভাবে অপপ্রচার চালায়। মিশনারীদের পাশাপাশি একদল ইউরোপীয় পন্ডিত ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা মূলক বহু বইপত্র লেখেন। এদের মধ্যে ম্যুর, সেল, ¯েপ্রঞ্জার, জুয়েমার প্রভৃতি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৪ সালে বর্তমানে বাংলাদেশ এলাকায় ব্যাপিটাল মিশনারী সোসাইটির কাজ শুরুর পর ১৮০১ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত একশ বছরে আরো একটি মিশনারী প্রতিষ্ঠান এখানে তাদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। এরপর বস্তুতঃ কুড়ি শতক থেকেই এখানে খ্রীষ্টান মিশনারীদের আগমন ধারা ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠে। ১৯০১ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে দু’টি এবং ১৯২১ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে আরো দু’টি খ্রীষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। এরপর ১৯৪১ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত মাত্র দশবছরে সংযুক্ত হয় আরো দু’টি মিশনারী সংস্থা। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে পাকিস্তান আমলের বাংলাদেশ ভূখন্ডে আরো ছয়টি খ্রীষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করে। ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এক দশকে নতুন মিশনারী প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয় নয়টি। সবশেষে বাংলাদেশ আমলে এখানে খ্রীষ্টান মিশনারী তৎপরতার ক্ষেত্রে প্রবল জোয়ারের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ খ্রীষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠানের যাত্রাশুরুর দুইশ বছর ইতোমধ্যে পূর্তি হয়েছে। এই দুইশ বছরের মধ্যে শেষ পঁচিশ বছর তাদের সাফল্যের স্বর্ণযুগ। মিশনারীদের তৎপরতা এখন দেশের উপজাতীয় ও দরিদ্র জনপদে শুধু সীমাবদ্ধ নয়। জাতীয় জীনের সর্বক্ষেত্রে এখন তাদের প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। খ্রীষ্টান মিশনারীরা তাদের প্রচার কৌশলে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে। ঈসায়ী মুসলমান নামের আড়ালে ‘আহমদ আলী’ ‘মোহাম্মদ আলী’ নাম ধারণ করে তারা সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করছে।
বাংলাদেশে খ্রীষ্টান মিশনারীদের ধর্র্মান্তর করণ প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই বিপদজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
এনজিওর ছদ্মবরণে বাংলাদেশে খ্রীষ্টান মিশনারী তৎপরতা বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের থাবা বিস্তারের একটি অত্যন্ত কার্যকর কৌশল। সুদানে এখন থেকে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে খ্রীষ্টান মিশনারীরা প্রবেশ করেছিল সেবার নামে, এনজিওর ছদ্মাবরণে। এই মুসলিম দেশকে দু’ভাগে ভাগ করে দক্ষিণ সুদানকে খ্রীষ্টান সুদানে পরিণত করার জন্য তারা এখন একটি বিরাট বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে তুলেছে জন গ্যারাং এর নেতৃত্বে। প্রথমতঃ তারা দক্ষিণ সুদানের স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলেছে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতা। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অজুহাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সুদানে খ্রীষ্টানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকান মুসলিম নেতা আহমদ দীদাত মুসলিম বিশ্বকে সজাগ করে দিয়ে বলেছেন, “খ্রীষ্টান মিশনারী ও এনজিওরা ব্যাপক সংখ্যক লোককে খ্রীষ্টান বানিয়েছে। এখন তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন করছে।”
আধুনিক বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার রূপে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রক এখন পাশ্চাত্য দুনিয়া। তথ্য প্রযুক্তিও তাদের করায়ত্ব। বিশ্বেও প্রধান প্রধান সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমগুলি পশ্চিমা ও গণমাধ্যমের সাহায্যে পাশ্চাত্য সভ্যতা বিশ্বব্যাপি প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের তথ্য সাম্রাজ্য। এই তথ্য সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি স¤পর্কে ধারণা লাভের জন্য বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বার্তাসংস্থাগুলির উৎসভূমির দিকে প্রথমেই নযর ফিরানো যেতে পারে। পৃথিবীর সবচে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সংস্থা এসোসিয়েট প্রেস বা এপির সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল বা ইউপি আই একটি মার্কিনী বার্তা সংস্থা। রয়টারের ঠিকানা ব্রিটেন এবং এএফপির সদর দফতর ফ্রান্সে। বিশ্বের সংবাদ প্রবাহের সিংহভাগই এই চারটি বার্তা সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এপি প্রতিদিন সারা বিশ্বে এক কোটি সত্তর লাখ শব্দের খবর সরবরাহ করে। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল প্রতিদিন নব্বইটি দেশের ৭ হাজার গ্রাহকের কাজে এককোটি চল্লিশ লাখ শব্দের খবর পাঠায়। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টারের নিজস্ব প্রতিনিধি রয়েছে ৬৯টি দেশে এবং তারা ১৩৮টি দেশে খবর প্রেরণ করে থাকে। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপির নেটওয়ার্ক পৃথিবীর ১২৯টি দেশে বিস্তৃত। এই চারটি বার্তা সংস্থা তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কোটি শব্দ সম্বলিত খবর দুনিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় সরবরাহ করছে। তথ্য প্রবাহের উপর পাশ্চাত্য দেশসমূহের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণের ফলে তারা বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে দুনিয়ার মানুষকে নিজ স্বার্থে প্রভাবিত করার সুযোগ পাচ্ছে। সংবাদ সংস্থা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে প্রকাশিত কয়েকটি প্রধান সংবাদপত্র ও সাময়িকী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলির রেডিও ও টেলিভিশন বিশ্বের সার্বিক রেডিও ওয়েভলেংথের শতকরা ৯০ ভাগ এবং বার্তা সংস্থাগুলি বিশ্বের মোট তথ্য প্রবাহের শতকরা ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসকল বার্তা সংস্থা, সংবাদপত্র ও রেডিও টিভি নেটওয়ার্কেও একচেটিয়া মালিক হচ্ছে পশ্চিমা ধনিক ও শিল্পপতি শ্রেণী যাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ইহুদী। একটি তথ্যে জানা যায় যে, প্রায় দেড় হাজার মার্কিন সাংবাদিক সি আই এর অধীনে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত রয়েছে। বিশ্বে অত্যধিক প্রভাব বিস্তারকারী আন্তর্জাতিক গণ মাধ্যমরূপে বিবিসির কথা ধরা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিভাগের একটি সম্প্রসারিত উয়িংরূপে বিবিসি অবিস্মরণীয় প্রচার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। তারপর থেকে এই প্রতিষ্ঠারটির কার্যক্রম ও এর কার্যকারিতা দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি ঘটার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপি টিভি সম্প্রচার বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে টেলিভিশনের একাধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে তথ্য ও তথ্যচিত্র সংগ্রহ করে পৃথিবীর সর্বত্র তা ছড়িয়ে দেয়ার যে কৌশল পৃথিবীর কয়েকটি উন্নত দেশ আয়ত্ত করেছে, তার ফলে পাশ্চাত্য জগৎ দুনিয়ার বুকে তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও তথ্য সন্ত্রাস পরিচালনার ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্ব লাভ করেছে। স্যাটেলাইট যোগাযোগের মাধ্যমে যে ‘ডিশ এন্টেনা’ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার ওপর একাধিপত্য চলছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার। ফলে উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের মধ্যে তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে যে বিরাট গ্যাপ আগে থেকে বিরাজ করছিল তা রাতারাতি সীমাহীন ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুন্নত দেশগুলির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এখন এই যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারিত থাবার নীচে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। দরীদ্র দেশগুলি পাশ্চাত্যেও তথ্য সাম্রাজ্যবাদী, তথ্য সন্ত্রাস ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হবার পটভূমিতে তথ্য সরবরাহে ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে ইউনেস্কোর অধীনে ম্যাকব্রাইড কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তথ্য প্রবাহের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা, উপগ্রহের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা, সংবাদ বিনিময় ব্যবস্থার জন্য অর্থ তহবিল গঠন, উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য পাশ্চাত্য বার্তা সরবারাহের মূল্য হ্রাস, প্রযুক্তি আমদানীর সুযোগ সৃষ্টি, তৃতীয় বিশ্বের জন্য একটি স্বাধীন সংস্থা প্রতিষ্ঠা এই কমিশনের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়া এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং শেষ পর্যায়ে আমেরিকা ও ব্রিটেন ইউনেস্কোতে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ম্যাকব্রাইড কমিশনের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ওআইসি দেশগুলিও পাশ্চাত্য তথ্য আগ্রাসনের মুকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক স্টেটস ব্রডকাস্টিং অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থাভাবের অজুহাতে এই উদ্যোগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হবার পটভূমিতে পাশ্চাত্য জগৎ এখন সারা দুনিয়ায় তাদের তথ্য সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে সারা বিশ্বকে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে টেনে নিচ্ছে।
মুসলিম স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধি, তাদের কর্মকান্ডকে বিকৃত ও অসত্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। মৌলবাদী, সাম্পদায়িক, সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, কট্টরপন্থী, রক্ষণশীল প্রভৃতি শব্দগুলি তারা মুসলিম বিশ্বের প্রকৃত নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে প্রয়োগ করে এবং তাদের দেখাদেখি সেগুলি তাদের এজেন্ট এবং অন্যরা ব্যবহার করে থাকে।
পশ্চিমা ইলেক্ট্রিক প্রচার মাধ্যমগুলির বিনোদন কর্মসূচী উন্নয়নশীল বিশ্ব, বিশেষত মুসলিম দেশগুলির ঐতিহ্যগত, লোকজ ও ইসলামী সংস্কৃতির মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। এসকল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের দ্বারা সকলকে টিভির সামনে বসিয়ে রেখে এরা নিজ দেশের আদর্শ, সাংস্কৃতিক ধারণা ও পররাষ্ট্রনীতি মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য সূক্ষ্মভাবে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বিবিসি ও সিএনএন এই পদ্ধতিতেই প্রচার-প্রচারণা চালায়। এভাবে তারা অতি সহজে রাতকে দিন এবং দিনকে রাতরূপে প্রচার করছে।
বাংলাদেশের যে নাগরিক গীত সিনেমায় সাহিত্যে ভারতীয় , রাজনৈতিক চিন্তায় ভিনদেশী, পোষাকে মার্কিন, বিদ্যায় ইউরোপীয় তারপরেও তিনি বাংলাদেশী থাকবেন সে আশা এক দূরাশা।
তাই মন মগজ দখল করা আগ্রাসী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়ে যাবে বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল। তাদেও মেধা দেহ শ্রম দিয়ে গড়ে যাবে তিতুমিরের বাঁেশর কেল্লা আর ঈসাখাঁর সোনারগাঁ।
আমরা জানি,বাংলাদেশ খুবই গরীব দেশ। এদেশের পাঁচভাগের এক ভাগ মাত্র লোক রোজগার করে, আর বাদবাকী লোককে ঐ এক ভাগের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। আমরা যদি ইউরোপ ও আমেরিকার মত উগ্র ব্যক্তি সমাজকে সমাজ দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে চাই, তবে আমাদের সমাজ জীবন দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে, গড়ে উঠবে না। পাশ্চাত্যের উগ্র ব্যাক্তিসতন্ত্রবাদকে আমরা আমাদের দেশে স্বাগত জানাতে পারিনা। যদিও তার প্রভাব এসে পড়েছে। আমরা গরীব দেশ, তবু এখানে সন্তান মাতাপিতার যে ভালবাসা পেয়ে থাকে, তার মূল্য কম নয়। বিপদে ভাইয়ের কাছ থেকে সাহায্য পায় বোন, বোনের কাছ থেকে সাহায্য পায় ভাই। আমাদের এই সংস্কৃতিকে ছোট করে দেখবার কোন কারণ নেই বরং এই সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের উপরেই নির্ভর করবে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#সংস্কৃতি
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#মোঃ_আলম_শরীফ
No comments