"ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে জুঁই –শাখে
ফুল-খুকী ছোট রে।
খুকুমণি ওঠ রে!
রবিমামা
দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান
গায় গান
শোনো ঐ রামা হৈ !"
আমার মা এখনো এই ৭৪ বছর বয়সে গড়গড় করে এই 'প্রভাতী' কবিতা মুখস্থ বলে দিতে পারে। আমি তা অবাক হয়ে শুনি। মা বলে চলে, আগেকার কতো কবিতা-ছড়া আমাদের এখনো মুখস্থ। কী সুন্দর সব সব কবিতা। আর তোদের সব কবিতা এখন বুঝতে পারি না। ও তোরাই বুঝিস, তোরাই লিখিস। আমি তা শুনে একটু হেসে উঠি। মাও হাসে। আমি মাকে তারপর শুনিয়ে দিই-
"আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে-
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে! "
মা বলে, কী সুন্দর করে লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কী সুন্দর দেখতে। দেখলে ভক্তি জন্মায়। কতো গান, কবিতা, কতো কী!
আমি তখন ছেলেবেলায় ডুব দিই। সেই কবিতা প্রায় বলতাম। আমার তখন স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। মঞ্চে বলতে বলতে ভুলে যেতাম। তবু বলে যেতাম-
"দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবুসাব তারে
ঠেলে দিলে নীচে ফেলে
চোখ ফেটে এলো জল..."
আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় স্মৃতি হারিয়ে গেলে আর পুরস্কার পাওয়া যায় না। তাই তখন একটাও পুরস্কার কপালে জোটেনি। আর এখন ঘরে স্মারক-সম্মাননা রাখার জায়গা নেই!
কবিতা লিখবো আজও, এমন কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। পাড়ার এক দাদার সঙ্গে গ্রামের এক বড়ো পুস্করিণীর পাড়ে বিকেলে ঘাসের ওপর বসে থাকতাম দুজন। পুকুরে মাছের খেলা দেখতাম। আকাশে উড়ে যাওয়া কাক,বাদুড় ও বক দেখতাম। নানারকম গল্প -টল্প হতো। দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে আসতো। আমরা সেই অন্ধকারে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকতাম। তারপর বাড়ি ফিরে পাঠ্যবইতে ডুবে যেতাম।
মাধ্যমিক- জীবন শেষ হয়ে গেলো। ছুটির অবসরে এক কাকার মেয়ের বিয়েতে যাই। তখন আমি একাদশ শ্রেণি। যে বাড়িতে বোনের বিয়ে হয়েছে, সেই বাড়ির এক ষোড়শীর টানা টানা চোখের প্রেমে পড়ে গেলাম। বাড়ি ফিরে ভাবলাম, কবিতা লিখবো। ততোদিনে পাড়ার সেই দাদাও তার ঝুলি থেকে গোপন কবিতা বের করে বললো, দেখ আমিও কবিতা লিখছি। তোকে শোনাবো। একদিন শুনলাম। যে- গুলো প্রায় নজরুলের কবিতার ছন্দের অনুকরণে।
সেই ছেলেবেলা থেকে নজরুলের কবিতার প্রতি একটা টান অনুভব করি। মনে মনে গেয়েছি ফিরোজা বেগমের সেইসব নজরুলগীতি। কাজী সব্যসাচীর কন্ঠে সেই সব অসাধারণ আবৃত্তি। পাড়ার অনুষ্ঠান শুরু হলেই এই সব গান ও আবৃত্তি আগে বাজানো হতো। তারপর শুরু হতো অনুষ্ঠান। আজও তা হয়ে চলেছে।
দেখতে দেখতে জীবনের বাঁক বদল হলো। এক অজানা পথের সন্ধানে পাড়ি দিলাম বর্ধমান জেলার অন্ডাল শিল্পাঞ্চলে। প্রায় বছর দেড়েক সেখানে থেকে নিজেকে জানান দিলাম আমি কে,কী করতে পারি। অনেক বন্ধু হয়ে গলো। তাদের কেউ গায়ক, কেউ কবি-সম্পাদক, কেউ ডাক্তার, কেউ রেলের চাকরি করে, কেউ কলেজ পড়ুয়া, কেউ ব্যবসায়ী। কেউ রিকশাওশালা, কেউ চায়ের দোকানদার, ছাতু বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, কেউ রেলের গার্ড, কেউ আর পি এফ।
আড্ডা হতো বেশি এক ছবি বাঁধানোর দোকানে বসে। স্টেশনের অদূরে একটি কলোনির রাস্তার ধারে। তার প্রাচীরের পাশে অন্ডাল ইনস্টিটিউট সভাঘর। ছবি বাঁধানোর দোকান মানে একটি টিনের গুমটি। তার ঝাঁপের ওপর বসেই থাকতাম পা ঝুলিয়ে। আর দোকানের মালিক বিনয় ভকত ও তার ভাই ছবি বাঁধাতো। ব্যাগ তৈরি করতো। খুব নাম ডাক তার। বাড়ি বীরভূমের সাঁইথিয়ার দিকে। অন্ডালে মাকে নিয়ে তাদের ছোটো সংসার। বাংলা-হিন্দি, দুই ভাষাতেই তুখোড়। গান করতো দারুণ। সবই বাউল গান। সেখানে আসতো কবিবন্ধু নিখিল পানডে, দেবাশীষ ভট্টাচার্য সহ আরও অনেকে। পরে আমাদের আড্ডাসঙ্গী হলো তড়িৎ, বাপী, শম্ভু সহ একঝাঁক তরুণ। ভিড় করতো তরুণী দলও।
বিনয়দার দোকানে বসেই একদিন ঠিক করলাম, ওখানে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়বো। নাম দিলাম 'আলেখ্য'। তার আয়োজনে হলো একদিনের নজরুল সন্ধ্যা। ছবি আঁকা, নাচ, গান প্রতিযোগিতার পর হবে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। ভেনু হলো অন্ডাল ইনস্টিটিউট। চাঁদা কালেকশানে সব নেমে পড়লাম। যার কাছেই গেলাম, কেউ মুখ ফেরালেন না। আমি রাত জেগে কাজ করছি, আঁকছি নজরুলের বড়ো একটি পোর্টেট।
সেই অনুষ্ঠান দেখে স্থানীয় ক্লাবটি অবাক। আমাদের কোনো স্থায়ী বসবার ঘর নেই। একেবারে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এতো জন যুবক এতো বড়ো একটা অনুষ্ঠান করবে,এবং আমি বাইরে থেকে গিয়ে তাদের সংগঠিত করে এমন একটি অনুষ্ঠান করবো, সেই ক্লাবের হলো বেশ রাগ। তাই অনুষ্ঠান চলার সময় দু-একজন মঞ্চে এসে আমাকে আড়ালে ডেকে ধমক ও হুমকি দিয়ে গেলো। বলে গেলো, এইসব স্ফূর্তি হচ্ছে। পরে দেখে নেবো।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, ওরা যদি আমায় পরে মারধর করে! কেননা আমি বাইরের। ছোট পিসির বাড়িতে গেস্ট হয়ে আছি। নিজের জব জোগাড়ের সন্ধানে। আর ওরা এখানকার স্থানীয়। কিন্তু কিছুই হলো না। তবু একজন স্থানীয় যুবক একটু ঢেস দিয়ে গেলো বিনয়দার দোকানে। ধূর মসাই, কী আর করলেন। কিছু মেয়েছেলে নিয়ে নাচ-গান হলো। ও আমরা ঢের পারি।
সে চলে যেতে আমার হাসলাম। ভাবলাম, ওর দৌড় দেখা গেছে। মুখে বাতেলা। এমন নজরুল সন্ধ্যা ওরা ভাবতেই পারে না। এতো ভিড়। এতো মানুষের শুভেচ্ছা। বন্ধুরা আমায় আসস্থ করে বললো, কিছু ভেবো না। ওরা তোমার কেউ কিছু করতে পারবে না। তুলোধুনো করে দেবো।
সত্যি সত্যি কিছুই হলো না। রাতারাতি আমি খুব পপুলার হয়ে গেলাম। করুণাসিন্ধু বাবু আমায় তাঁর বাড়িতে ডেকে কিছু ছেলে-মেয়ে জোগাড় করে বললেন, আপনি এদের আঁকা শেখান। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে পরে। ভাববেন না। আমি আছি। -সে এক অন্য জীবন শুরু হলো। তারপর আমাকে স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা ধরলো। আমি তাদের নজরুলের পোর্টেট করে দিলাম। এক ক্লাবে রবীন্দ্রনাথ। নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে। ওরা কেউ কিছু দিলোই না। ভাবলাম, না দিক। তাতে কী। প্রাণের কবিদের তো এঁকে দিয়েছি...
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#স্মৃতিকথা
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#আশিস_মিশ্র
No comments