ফৈড়লের নাও ।। মাঈন উদ্দিন
ভাদ্র মাসের দিকে পানিতে শ্যাওলা পরে, তখন পানি কিছুটা ঘোলা থাকে। সেই ঘোলা পানিতে মাছ ধরা একটা বাড়তি সুবিদা। গ্রামের নামটি জিরান তলি এ গাঁয়ের অনেকেই কৈবত্য! মাছ মারা ই তাদের একমাত্র পেশা। হাওড় পাড়ের জন-বসতি গুলো, জলের সাথে নিবির প্রেমে বেড়ে উঠে। তুরাব আলী ও তার একমাত্র ছেলে দুলাল সেই দলে, প্রতিদিন সকালে খেয়ে-দেয়ে বেড়িয়ে পরে। সারাদিন হাওড়ে মাছ ধরে, বৈকালের বাজারে সেই মাছ বিক্রি করে যা পায়। তা দিয়ে চাল-ডাল, নুন, তেল; কিনে একদম সন্ধায় বাড়ী ফেরে। মাছ যেদিন ভাল ধরা পরে, বাজারের আইটেমও ভাল হয়। সেদিন তুরাব আলী আনন্দচিত্তে বাড়ির পানে বৈঠা চালায়, আর মনের সুখে একটা গান ধরে…
দোষী আমার মন
শত দোষে হইলাম দোষী
আমি অভাজন “।।
কখনো কখনো খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। শুধুই যে খালি হাত, তা নয়। ফৈড়লরা মারধর করে, এমন কি অতি কষ্টে যোগাড় করা সহায় সম্বল জালগুলি কেড়ে নেয়! মাছ ধরার অপরাধে তাদের উপর চলে নির্মম অত্যাচার।
-তাদের জীবন জীবিকার গল্পটা হয়তো কারো মনে দাগ কাটেনা, কারণ তারা জেলে পাড়ার লোক! তাদের আবার গল্প কি ?
গ্রাম থেকে অনেক দুরে হাওড়। টাঙ্গুয়ার সুশীতল শান্ত জলরাশি, শীতল পাটির মত পরে থাকে। তুরাব আলি আর দুলাল বাপ-পুত দুজনে, কারেন্টের জাল টেনে টেনে কথা বলে…
:
: আব্বা তোমার কি এখানে ঠাঁই লইবো?
:
: কি কস তুই, ব্যাটা বেক্কলের ঘরের বেক্কল! এইডা টাঙ্গুয়ার হাওড়; এহন তো দুরের কতা চৈইত মাসেও ঠাঁই লইবো না।
বাবা ছেলেকে বুঝায় এটা বড় হাওড়, মানে সাগরের মত বড় কিছু।
দুলাল আবারও প্রশ্ন করে,
:
: যদি পানিতে পরে ডুবে যাই, তুলবা ক্যামনে?
এবার বাবা আর কিছুই বলতে পরে না, হা করে দুলালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হাতের জালটা পানিতে ছেড়ে দিয়ে, কাছে আইসা বসে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে
: বাজান আমার, এমুন কতা আর কইছ না। তরে ছাড়া আমার দুন্যাইডা আন্ধাইর!
:
: তাইলে আমারে আনো ক্যান?
:
: আর কয়ডা দিন বাজান, আর কয়ডা দিন; একটু সবুর কর। বিলে বান পইরা যাইবো, তখন আর চাইলেও আইতে পারুম না!
এরপর দূরে কিছু একটা লক্ষ্য করে দেখায়… ঐ দেখ পুত ফৈড়লের নাও!
এরা যদি আমারে একলা পায়, ধইরা মারবো জাল গুলি নিয়া যাইবো! তখন তো বাপধন না খায়া থাকতে অইবো।
-তুরাব আলি আবার জাল ফেলাতে মনযোগ দেয়।
দুলাল চুপটি করে বসে থাকে নাওয়ের ছৈয়ায়। মাঝে মাঝে উকি মেরে হাওড়ের শান্ত জলে নিজের ছবিটা দেখে, আবার হাত দিয়ে পানিতে ছুঁয়ে দেয়। তখন ছবিটা ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে মিলিয়ে যায়!
এটা একটা খেলা, হাওড়ে এলে দুলাল এই খেলাটা খেলে একা একা! এভাবে একলা থাকতে তার মোটেও ভাল লাগেনা। পাড়ার সব ছেলেদের মাঝে সে লিডার। সে না থাকলে ওদের খেলাই জমে না। পুরান ফুটবলটা লিক হয়ে গেছে, তবুও নিস্তার নাই! এইড্যার ভিতরে খড় ডুকায়া খেলে। সবাই মিলে বুদ্ধি করেছে ১০ টাকা করে চান্দা তুলবো? কিন্তু দুলাল’ই নাই! এগুলো মনে হলে খুব রাগ লাগে দুলালের।
তবুও রোজ রোজ বাবার সাথে মাছ ধরার জন্যে ছদ্মবেশে হাওড়ের পানিতে ভাসে!
এটা ইজারাদারের ডাক নেয়া বিল। ক্ষমতা আর টাকার বলে এই বিশাল হাওরটা দীর্ঘদিন যাবত তারা ভোগ দখল করছে। তাদের নিজস্ব পাহাড়াদার বাহীনি আছে, এদের কাছে সাধারণ জেলেদের কোন মূল্য নাই।
ফৈড়লদের অত্যাচারের ভয়ে তুরাব আলি ছেলেকে সাথে নিয়ে আসে হাওড়ে, গলুইয়ে চিপায় জালগুলো লুকায়ে প্রথমে বিল থেকে হিংড়া, শাপলা, ভেট্রা, কলমিশাঁক; এগুলো তুলে। ধরা পরলে যেন বলতে পারে আমরা জাইল্লা না। কখনো কখনো ফৈড়লের লোকেরা এসে চেক করে। তার আগেই তুরাব জালগুলো পুটলা করে বেধে পানিতে ছেড়ে দেয়, সেই পুটলার সাথে সুতা দিয়ে বাধা থাকে একটা পুড়ানো জুতা! জালগুলো নিয়ে পুড়ানো ছিঁড়া জুতা ভাসতে থাকে পানিতে। তারাও ভাসে একটু দুরে, দুলালের কাজ হলো সেই জুতাটা চিন্ রাখা। জাল খুঁজে না পেলেও তুরাব আলিকে ফৈড়লদের হাতে চড়-থাপ্পর খেতে হয়। ছোটছেলের দিকে করুনা করে বেশি মারধর করে না, আর বিলে না আসার হুমকি দিয়ে অল্পতেই ছেড়ে দেয়।
আজ তারা বোয়ালমারি বিলে এসেছে, ফৈড়লের নৌকা একটু আগে চক্কর দিয়া গেছে। ভাদ্দুর মাইস্যা রৈদের যে তেজ! ঘন্টা দুয়েকের মাঝে আর আসার কথা না। তাই তুরাব আলি জলদি করে জাল ফালাইতেছে! ঘন্টা তিনেকের মত গ্যাপ হলেই তাদের হয়ে যাবে।
আছরের পরে তারা সুযোগ বুঝে জাল তুলে নেয়। তখন জালে যা ধরা পরে, সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে। এই সময়ে সবাই বাজারে আসে মাছ তরকারি কিনতে, একটু ভাল দাম পাওয়া যায়। এখন তো মাছের কোন দামই নাই! সারাদিন খেটে ৭০/৮০! এদিয়ে আর সংসার চলে কই?
এই কথাটা মনে আসতেই দুলাল তার বাবাকে জিঞ্জাসা করে
: আব্বা তুমি না কইছো বিদেশ যাইবা?
:
: হ রে বাপ, দেখি কেউ যদি যায় তাদের সাথে চইল্যা যামু। এমন্যে চুরি কইরা মাছ মারতে আর ভাল লাগেনা। তাছাড়া মাছের যে দাম! সারা দিনে ৬০-৭০ ট্যাহা দিয়া কি সংসার চলে। তুরাব আলি ছেলেকে সংসারের দুর্দশার কথা শোনায়। কিন্তু দুলাল ভাবে অন্য কথা, স্বাধীনতার কথা। বাবা না থাকলে সে সারা দিন খেলতে পারবে, ঘুরতে পারবে,
মনের মাঝে একটু স্বস্থি স্বস্থি অনুভতি টের পায়।
: আচ্ছা তাইলে তারাতারি যাওগা, আর আইবার সময়ে আমার লাগি একটা ৪ নম্বর ডিয়ার বল আইন্নো?
এবার বাবা উল্টা কথা বলে!
:
: না রে বাজান যায়তাম তো কই ই, কিন্তু তরারে থইয়া যে বিদেশে মন টীহে না!
বাবার এই কথায় দুলালের আশাগুলো জলের নিচে ভেসে উঠা ছবির মতই সহসা মিলিয়ে যায়!
:
: আব্বা তুমি যে কোনসময় কি কও ঠিক নাই?
:
: বাজান’রে বড় অইলে বুজবে একটা সংসার চালানো কত কঠিন কাজ।
হঠাৎ তুরাব আলি দূরে লক্ষ করলো, একটা ফৈড়লের নাও তাদের দিকে তেরে আসছে!
ততক্ষণে জাল পাতা শেষ।
মাছ ধরা পরলে বিকালের দিকে সুযোগ বুঝে, জাল গুলি অতিদ্রুত তুলে নিয়ে চলে যাবে।
ফৈড়লরা আসতেছে দেখে তুরাব দুলালের দিকে একটা শাপলার আটি এগিয়ে দিয়ে বললো
: নে বাজান এটা বাঁছ। আর তুই ওদের সাথে কোন কথা কইবি না। এদের মুহের ভাষার ঠিক নাই, নোংরা ভাষা দিয়া মা বাপ তুইল্যা মাইষেরে গালি দেয়।
তুরাব আলি কলমিশাঁক গুলো এলোমেলো করে, আবার বাছঁতে লাগলো।
ফৈড়লের নাও তাদের নাওয়ের কাছে এসে থামলো, মাঝখান থেকে একজন তুরাব আলি বললো ঐ বাইঞ্চোৎ তরে না কহন কইয়া গেছি বিলের থেকে চইল্যা যাইতে, যাসন্যাই ক্যেরে?
:
: ভাইছাব আমার ঘরে কোন খাওন নাই, তাই কয়ডা হালপা, ভেট্রা তুলতে আইছি, পুলাডারে লইয়া একবেলা না খায়া আছি! ওর মায়ের অশুক।
বাবার অনুয় বিনোয় কথায় দুলালের শরীর জ্বলে।
-আল্লায় হাওর ভইরা পানি দিছে হেই পানিতে মাছ, যার মন চাই মাইরা খাইবো। এতো কৈফিয়তের কি ?
তোদের সমস্যা কি?
:
: ভাইছাব আমি মাছ মারি না।
: তুই কোন গেরামের?
:
: জিরান তলির।
গ্রামের নাম শুনে এরা অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। তারপর ওদের সর্দার বললো, কৈবত্যের বাচ্চা মাছ না মারলে এখানে গু**য়া মারা দিতে আইছস?
তুরাব আলিকে ওরা মারধোর করতে লাগলো। দুলাল এতক্ষন ফৈড়লের নাওয়ের দাড়ে শক্ত করে ধরে ছিল, বাবার উপরে নির্যাতন ঠেকাতে এবার সে ফৈড়লের নাওয়ে উঠে একটা রাম-দা টেনে নিল…
:
: হতভম্ব হয়ে দুলালের দিকে তাকালো সবাই। সর্দার ভাবছে, সর্বনাশ এই ছেলে তো ভারি পাজি! ওরে আজ শেষ করতেই হবে।
-কি করেছি আমরা হে?
-
-আমার আব্বা মাছ মারে এটা দুষ?
-
-হাওর কি তোদের বাপের একলার?
-
-আমাদের অধিকার নাই এখানে হে??
হাওড়ের আকাশ বাতাস কাপায়ে দিয়ে রাম-দা হাতে দাড়িয়ে আছে এক কিশোর, অন্য দিকে সর্দারের হাতে বন্দি তার বাবা।
একজন এগিয়ে এসে ধরতে চাইলো দুলালকে, এই মুহুর্তে নাওয়ে সেই অস্ত্রধারী বাকি অস্ত্রগুলো তার পায়ে নিচে। দুলালের মাথায় রক্ত চড়ে গেল, সজোরে কুপ চালাতে গিয়ে হোচট খেয়ে পরে গেল পানিতে! এবার সে প্রানপ্রণে চেষ্টা করছে নায়ে উঠার, বাবাকে হয়তো আর বাচানো যাবে না আজ।
ততক্ষণে সর্দারের গাদা বন্দুকে একটা বুলেট লোড করা হয়ে গেছে। সর্দার বললো ওরে উঠতে দে? কিন্তু দুলালের পক্ষে নায়ে উঠা আর সম্ভব হলো না। গাদা বন্দুকের নলিটা ওর মাথা বরাবর ঠেকানো হলো, তুরাব আলি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলো সর্দারের পা পর্যন্ত পৌঁছাতে।
-ডুউস করে একটা বিকট শব্দ হলো!
তুরাব আলির মূর্ছা গেল!
ততক্ষণে দুলালের প্রানহীন নিথর ছোট্র দেহটা হয়তো হাওড়ের তলদেশে পৌঁছে গেছে। আর তুরাব আলি ভাসছে হাওড়ের অথই জলে।
জিরান তলি গাঁয়ের কুড়ে ঘরে কুপি বাতি জ্বালায়া অপেক্ষা করছে তুরাব আলির বৌ। অথচ আর কখনই বাড়ি ফিরবে না তুরাব আলি!
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
#গল্প
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#সাহিত্য
#মাঈন_উদ্দিন
No comments