বুক ও জল ।। রহিমা আক্তার মৌ

 
দিন চারেক আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেছি গল্প লিখে কোটি টাকা জেতার অফার। পত্রিকার পেইজ উল্টাতে উল্টাতে ভাবছি, এই ৪৩ বছর বয়সে একশ টাকাও পাইনি, আর কোটি টাকা হাহাহা,,,,,, এরপরের দিন থেকে ফেইসবুকের অন্তত শখানেক বন্ধুর টাইমলাইনে দেখলাম বিজ্ঞাপনটি। দেখি আর হাসি, শখানেকের মাঝে প্রায় পঞ্চাশ জন ইনবক্সে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে। উনারা ভাবছে আমার চোখেই পড়েনি বিজ্ঞাপনটি। আসলে পুরো দোষ উনাদের না, শখানেক পোস্টের কোন পোস্টেই আমি লাইক বা কমেন্ট করিনি। তাই সবার এমন ধারণা। ইনবক্সে বিজ্ঞাপনের পাতাটা দিয়ে কেউ কেউ দুইচার লাইন লিখে দিয়েছেন-

আপু চেষ্টা করো”,

আপু এবার কাজ হবেই”,

প্রতিযোগিতায় আপনাকে চায়”,
আপনাকে ছাড়া এই প্রতিযোগিতার কোনমানেই নেই
আহা! মন ভরে যায়, নিজেই নিজেকে বলি-
মৌমিতা তুই নিজেই নিজের কদর বুঝিসনা, তোর পাশের কেউ বুঝেনা, অন্যরা ঠিক বুঝে। জানিস তো বাত্তির নিচে সব সময় অন্ধকারই থাকে
ইদানীং ইনবক্সের জবাবে লাইকের চিহ্নটা দিতে পারিনা। দিলেই কেউ কেউ বলে-
আঙুল দেখান কেন?
ভাষাটা যায়না আমার সাথে, তাই লাইক চিহ্ন না দিয়ে চুপ থাকি। নে বাপু তোমরা শান্তিতে থাকো। শুধু এই বিষয়ে না অনেক বিষয়েই চুপ থাকতে হয়, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে-
আপু / মৌ/ মিতা কেমন আছেন/ আছো?
যদি বলি ভালো নেই, শুরু হয় হাজার প্রশ্ন-
কেন ভালো নেই? শরীর খারাপ নাকি মন খারাপ? বাসায় কিছু হইছে? কেউ বকেছে?
তাই সোজা জবাব দিই-

ভালো আছি
সব শান্তি আমিও শান্তি। জানি অধিক ভালোবাসায় কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, কিন্তু হেঙলামো আছে অনেকের। নিজের মা বোন বউ মেয়ের খোঁজ রাখে না ফেইসবুক বন্ধু ভালো নেই শুনলেই হাপিত্তিস করে
দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, কল আসে অপরিচিত নাম্বার থেকে
-হ্যালো মৌমতা বলছেন
-জ্বি, আপনি?
-
-আমি আরাফাত রাসেল, ‘গল্প লিখে কোটি টাকা জেতারবিজ্ঞাপন আমিই দিয়েছি
-আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। ভালো কাজ আপনার
-আপনি কি বিজ্ঞাপনটা দেখেছেন? না মানে দুয়েক লোক পোস্ট দিলো, আপনি কোন লাইক কমেন্ট করেননি বলে ভেবেছি হয়তো নজরে পড়েনি
-পত্রিকায় দেখেছি, ফেবুতে দেখেছি, অনেকে ইনবক্সে দিয়েছে, দেখেছি। কেন জানি ইচ্ছে হয়নি কিছু বলার বা লেখার
-যাক আমি বিশেষ ভাবে অনুরোধ করছি আপনাকে একটা গল্প লিখতে। গল্পের বিষয় থাকবেবুক
-জানি
-তাহলে লিখে ফেলুন, একটা কথা মনে রাখবেন, গল্পে দুটো গান থাকতে হবে নতুন গান। যে গল্প সেরা হবে সে গল্প দিয়ে টেলিফিল্ম তৈরি করবো
-তাও জানি, চেষ্টা করবো
-আরেকটা কথা, আপনারবুক বিছানাগল্পটি অসাধারণ হয়েছে, পুরানো গল্প বলেই নিতে পারছিনা। নতুন দরকার। ওকে ভালো থাকুন, লেগে যান কাজে
-আপনিও ভালো থাকুন
মোবাইলের কথা শেষ করে নাম্বারটা সেভ করি, চোখের ঘুম কোথায় হারায়। গল্পের বিষয় অন্য কিছু হলে ভাবতে পারতাম, কিন্তুবুকআররোমান্টিকশব্দদুটি আমায় এগুতে দেয় না।বুকশব্দের সাথে জড়িয়ে আছে আমার হাজার কষ্ট, সে কষ্টগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে রোমান্স নিয়ে গল্প, আমায় দিয়ে কখনোই হবে না। ভাবতে ভাবতেই বুকটা টনটন করে, ব্যাথা অনুভব করি। মোবাইলে ভেজে উঠলো-
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা-
রাসেল রায়হানের কল আসলেই এইগানটা বেজে উঠে। ইচ্ছে করেই ধরিনি। বুকের ব্যাথাটা নতুন নয়, কিন্তু কাউকে বলতেও পারিনা। রায়হান ভাববে ঘুমিয়ে আছি তাই কল ধরিনি। ওর জন্যে মায়া হয় খুব, পরিবারের কথা ভেবে নিজের নীতিকে বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতির দায়ে আজ সে ফেরারি। একটু সুযোগ পেলেই কল দেয় আমায়। রায়হানের ভাবনা দুরে সরিয়ে
গুনগুন করে উঠি-
ইচ্ছে করে বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকিরে
বুকটা আমার হারিয়ে গেছে সর্বনাশা ঝড়ে,
হাজার বুকের মাঝে আমি খুঁজি শুধু তারে
বুকের ভেতর তার জন্যে ছটপট শুধু করে।
গুনগুন করা শেষ, নিজেই হাসি নিজেকে নিয়ে। বুক নিয়ে যার কোন আনন্দের স্মৃতি নেই সে কিনা লিখবে বুক নিয়ে রোমান্টিক গল্প আর গান
বেদনার সবটুকু আমাকে দিয়ে সুখ নিয়ে তুমি চলে যাও, গান হলেও যত সহজে এটা অপূর্বকে বলেছি, তত সহজে মেনে নিতে পারিনি, আজো পারছিনা। আমার কাছে বুক মানে ভালোবাসা, বুক মানে বিশ্বাস, বুক মানে হারিয়ে যাওয়া, বুক মানে নিজেকে উৎসর্গ করা। বুক মানে গভীর রাতের গোপন কথা, বুক মানে অস্তজলে হাবুডুবু খাওয়া। বুক মানে সমুদ্রের কিনারে বসে ঢেউ দেখা, বুক মানে স্তবরাতের কাঁপন, বুক মানে জোয়ার ভাটার আষাঢ় শ্রাবণ
এমন একটি বুক পেয়েছিলাম মাত্র তিনদিনের জন্যে। তিনদিন পর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওকে বিদায় দিয়েছি। বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছি, দিয়েছি বুক থেকেও। আজো সে নতুন ঘাটের খোঁজ পায়নি, পায়নি বলে পেছনেও টেনে ধরিনি। ওর পরিবারের সাথে আমাদের পুরানো কলহ, সেটাই আমাদের তিনদিনের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে যেতে দেয়নি। প্রাপ্ত বয়সি দুজন বিয়ে করে তিনদিনের জন্যে শহর ছাড়া। ওর মায়ের কথায় মুক্তি দিয়ে দিলাম। একটা দাবী ওর উপর, যদি কখনো দেখা করতে ডাকি যেনো এসে দেখা দিয়ে যায়
গত ছয় বছরে একবার আসতে বলিনি, কথা হয়েছে মাত্র মিনিট কয়েক। অনেক কেঁদেছি কিন্তু কখনো বুক ভিজতে দিই নি। চোখের জল দেখতে যতটা কষ্টের তার চেয়ে কয়েকগুন ধ্বংসের। এইতো কয়েকদিন আগের কথা, পরপর কয়েকদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান্না করেছি জল ফেলেছি গ্রিলে। সপ্তাহ না ঘুরতেই গ্রিলে মরিচা ধরেছে। এই জন্যেই কখনো দাঁড়িয়ে কাঁদি না, এমনকি বসেও। দাঁড়িয়ে আর বসে কাঁদলে বুক ভিজে যায় চোখের নোনা জলে ভাসিয়ে দেয় বছরের পর বছর ধরে জমিয়ে রাখা আবেগকে
শুয়ে শুয়ে কাঁদলে জল বেয়ে পড়ে বালিশে, কান্নার ব্যাপারে মোটেও কিছু নষ্ট করতে চাইনা বলে একটা সুতির দোপাট্টা সাথে রাখি। তাই দিয়েই ইচ্ছেমত মুছিয়ে দিই চোখের জল। সময় করে শহরের বহুতল ভবনের কৃত্রিম ঝর্ণার পানিতে ধুয়ে ফেলি। অপূর্বের দেয়া স্মৃতি গুলো এখনো সেই তিনদিনের মতো তাজাই আছে। কষ্টগুলো এতোই শক্তিশালী এই তিনদিনের স্মৃতিগুলো এন্টিবায়োটিকের কাজ করতে পারে না। বারবার আমায় তছনছ করে ডানাকাটা পাখির মতো ফেলে রাখে খাটের কোনায়। ভাবনাটা শক্ত অবস্থানে না যেতেই অবুঝ মোবাইলটা বেজে উঠে। হাতে নিয়ে দেখি আরাফাত রাসেল এর কল-
-
-হ্যালো আমার আপনাকে বিরক্ত করতে কল করলাম
-ঠিক আছে বলুন
-গল্পটা রোমান্টিক হতে হবে
-জ্বি এটাও আমি জানি
-আচ্ছা আমি কি আপনাকে মিতা বলে ডাকতে পারি? আসলে মৌ বলতে পারতাম, কিন্তু মৌ যে আমার ঘরেই
-আপনার ইচ্ছে
-নিশ্চই গল্প নিয়ে কিছু ভেবেছেন
-ভেবেছি কিনা জানিনা, তবে চার লাইনের গান বানিয়েছি
-কিছু মনে না করলে শুনাতে পারেন
আরাফাত রাসেলকে চার লাইনের গানটি শুনিয়ে দিলাম, উনি তো মহাখুশি
-মিতা আপনাকে দিয়েই হবে, আমি নিশ্চিত আপনিই পারবেন
-কিন্তু আমার যে রোমান্টিক গল্প আসবেনা, বিরহের হয়ে যাবে
-কেনো আপনার তিনদিনের স্মৃতি কি সব মুছে গেছে
-আপনি জানলেন কি করে?
-
-তাহলে যা জানি ঠিকই জানি
কথা না বাড়িয়ে মোবাইল রেখে দিই। আরাফাত রাসেল আসলে কে? সে কি আমার চেনার ভেতরের অচেনা কেউ। অপূর্বের সাথে কাটানো তিনদিনের কথা তো অন্য কেউ জানেনা। তিনদিনের শেষ মুহূর্তে অপূর্বকে বলেছিলাম
-বুকের মাঝে এমন একটা ক্ষত করে দাও যা প্রতিনিয়তো আমায় এই দিনগুলোকে মনে করিয়ে দিবে
অপূর্ব আলতো করে বসিয়ে দেয় ভালবাসার পরশ, বেঁচে আছি আজো তা নিয়েই। হয়তো এজন্যেই বুকটা ভিজাতে চাইনা চোখের জল দিয়ে
কিন্তু আরাফাত রাসেল উনি কে হতে পারে, তবে কি অপূর্বের ছায়া। তাই মনে করে লিখতে বসিবুক জলগল্পটি। যে বুকে জল পড়েনি কখনো সে বুকেই আজ জলের ঢেউ
প্রতিযোগিতায় গল্পটি টিকে নি, কারণ বুকের গভীরের কোন রোমান্টিকতা ছিলো না গল্পে। যা পড়ে শুনে দেখে আরাফাত রাসেল তার টেলিফিল্ম এর কাটতি বাড়াবেন। পুরানো ডায়রির ভাজে আজো পড়ে আছে আমারবুক জলএর পাণ্ডুলিপি। যার পাঠক কম, কাটতি কম, রোমান্টিকতাও কম। তবুও বুক ভিজিয়ে দিই না চোখের জলে
সাহিত্যিক কলামিস্ট প্রাবন্ধিক

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

#গল্প
#ছোটগল্প
#সাহিত্য
#বাংলাসাহিত্য
#মোলাকাত
#সাহিত্য_ম্যাগাজিন
#ওয়েব_ম্যাগাজিন
#Molakat
#ShortStory
#Story
#Literature
#Bengali_Literature
#রহিমা_আক্তার_মৌ

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.