ছিন্নডানার ফড়িং_শিল্পী নাজনীন : পর্ব-৪
কখন বাসে উঠে বসেছে নিজেও জানে না মিথিলা। ঘোর কাটে বাসের হেল্পারের বিরামহীন চিৎকারে। বিকট গলায় সে ডেকে চলে, ডেকেই চলে যাত্রীদের। যাত্রীরাও যেন ভীষণ অনিচ্ছুক এই যাত্রায়, ভীষণ অনিশ্চিত যেন গন্তব্য তাদের। যেন তারা নিজেরাই জানে না আদৌ গন্তব্য বলে কিছু আছে তাদের, নেহাৎ বাসের এই নাছোড়বান্দা লোকগুলো ছাড়ছে না তাই যাওয়া। খুব অনাগ্রহ নিয়ে উঠছে তারা বাসে, ছেড়ে দিচ্ছে অতঃপর বাসের লোকগুলোর মর্জির ওপর। বাসের হেল্পারগুলোও অত্যুৎসাহী, অফুরান প্রাণশক্তিতে যেন ভরপুর। বিস্ময় মানে মিথিলা। কী অদ্ভুত দ্রুততায় আর নিপুণতায় তারা একই কথা আউড়ে যায় বারবার। একটুও বিরক্ত না হয়ে, একটুও ছন্দপতন না ঘটিয়ে! অদ্ভুত!
বাস চলে ঢিমে তালে। সহসা ভারি কৌতুক বোধ করে মিথিলা। সে বসেছে সামনের সিটে, ঠিক দরজার পাশে। বাস কিছুক্ষণ পরপর থামছে, এক দু’জন যাত্রী তুলছে। বস্তুত অফিস ছুটি হতে এখনও অনেকটা দেরী, যাত্রী কম, তাই এত ঢিলেমি। বাস এক জায়গায় থামতেই, মিথিলা দেখে, ফুটপাতে দাঁড়ানো এক দম্পতি, লোকটা হুইল চেয়ারে বসা, পঙ্গু। পাশে ম্যাক্সি পরা, ওড়না মাথায় জড়ানো বউ, বাচ্চা কোলে দাঁড়ানো। বাস থামতেই এগিয়ে এল বউটা, কোনো যাত্রী না পেয়ে অগত্যা হেল্পারের কাছেই ভিক্ষা চেয়ে বসল সে। হেল্পার ছেলেটা, নিতান্তই অবহেলার ভঙ্গিতে দু’টাকার নোটটা গুঁজে দিল বউটার হাতে। নোটটা দিতে একটু কি বেশি সময় নিল সে? একটু কি হাসি ছলকে উঠল তার মুখে? কিংবা বউটার মুখে কি আগুন জ্বলল হঠাৎ? অথবা সবটাই মিথিলার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? কে জানে! ক্লান্তি বোধ করে সে।
হেল্পার ভাড়া চাইতেই একশ টাকার নোটটা এগিয়ে দেয় মিথিলা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে ছেলেটা। বলে, ভাংতি অইত না, ভাংতি ট্যাকা দ্যান!
গম্ভীর উত্তর দেয় মিথিলা, ভাংতি নাই।
টাকাটা নিয়ে চলে যায় লোকটা, ফিরে আসে অল্প পরেই। জিজ্ঞেস করল আবার, কই নামবেন?
বলে মিথিলা। গাড়ি ঐ পর্যন্ত যাবে না জানিয়ে, প্রাপ্য ভাড়া রেখে, বাকিটা মিথিলাকে ফেরত দিয়ে অন্যদিকে সরে যায় লোকটা।
একবার ইচ্ছে হয় নেমে যায়, আবার ভাবে, নাহ্, থাক! কী আর হবে! বরং গন্তব্যের কাছাকাছি নেমে অন্য কোনো বাসে উঠে পড়বে, কিংবা রিক্সা নিয়ে নেবে। অদ্ভুত এক আলস্য আর ক্লান্তি গ্রাস করে তাকে। পাশের যাত্রীদের টুকরো কথা, রাস্তায় চলমান গাড়ির গর্জন, কান ফাটানো হর্নের শব্দ, ঠিক পেছনের সিটে বসা যাত্রীর উত্তেজিত ফোনালাপ, তীব্র, ভীষণ তীব্র হয়ে কানে বাজে তার। ভোঁতা, বধির করে দিতে চায় তার শ্রবণেন্দ্রিয়কে! তীব্র ইচ্ছে করে খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠতে, চিৎকার করে বলতে—
দোহাই তোমাদের, এত শব্দ করো না! একটু থামো, একটু নীরব থাকো, চুপ থাকো একটু! দেখো কী চমৎকার শান্ত হয়ে যায় চারপাশ! অপার্থিব শান্তি নামবে তখন, দয়া করে একটু থামো, থামো তোমরা!
মনে মনে চিৎকার করলেও, মিথিলা বস্তুত বসে থাকে, চুপচাপ, অনড়। তার পাশের যাত্রীটি বুঝতেও পারে না, কী ভয়ানক আন্দোলন চলে তার মনের মধ্যে! কী ভীষণ যন্ত্রণায় সে ছটফট করে! মিথিলা ভাবে, যদি মানুষ সত্যিই অন্য মানুষের মনের কথা বুঝতে পারত, তবে কেমন হতো? ভালো হতো কি? নাহ্! মাথার মধ্যে চক্কর দেয় তার! চারপাশ দোদুল্যমান লাগে।
বাস থেকে নেমে পড়ে মিথিলা। তখনও পুরোপুরি বিকেল নামেনি। পড়ন্ত দুপুরের রৌদ্রের তেজ তখনও তীব্র। সে রোদ একটু একটু করে পুড়িয়ে দেয় পৃথিবীর নরম মাটি, গলিয়ে দেয় তার জমাট বরফ। আবার ফুটপাত ধরে হাঁটে মিথিলা, হাঁটতে হাঁটতে আবার থমকে দাঁড়ায়।
ফুটপাতে সস্তা, বাঁধানো কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবির পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছে একটি কমবয়সী ছেলে। একটি ছবিতে চোখ আটকে যায় তার। ফ্রেমে বন্দী খুব সুন্দর একটি দৃশ্য। সাদা-কালো ছবিটি মিথিলার চোখে যেন মায়াকাজল পরিয়ে দেয়, মনে স্বপ্ন ছড়ায়। কুলকুল বয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি নদী। একপাশে ছোট্ট, সুন্দর গ্রাম। নাম না জানা কতসব গাছ, হরেক রকম পাখি উড়ছে। মনে হয় বুঝি কান পাতলেই শোনা যাবে পাখিদের কূজন। একটি ছেলে, বাচ্চা একটি ছেলে, সে গাছে উঠেছে। উঁকি দিয়ে দেখতে চাইছে তার নাগালের বাইরের একটি পাখির বাসা। দেখতে চাইছে কী আছে সেখানে—ছানা, নাকি ডিম? কী আছে? জানার আগ্রহ জাগে মিথিলারও। কিন্তু ছবি তো উত্তর দেয় না কোনো কালেই! সে শুধু নিজেকে মেলে ধরে, তুলে ধরে। যেন বলে, এই-ই আমি, আমাকে তোমার মত করে কল্পনা করে নাও, ব্যাখ্যা করে নাও, সার্থক করে তোলো আমায়!
অনেকক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে মিথিলা। ছেলেটা আগপাশতলা খেয়াল করে মিথিলাকে। পরখ করে, উটকো লোক, নাকি সত্যিই খরিদ করবে তার ছবি। নিরাসক্ত গলায় প্রশ্ন করে অতঃপর—
লইবেন, আফা?
ছবি থেকে চোখ সরায় না মিথিলা। সেদিকে চোখ রেখেই সেও ছুড়ে দেয় পাল্টা প্রশ্ন, যেন বাতাসেই প্রশ্নটা ছোড়ে, কত দাম?
পঁচিশ শ।
কত? —নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রতি যেন ঠিক আস্থা পায় না মিথিলা। আবার তাই প্রশ্ন করে সে, ছেলেটির দিকে তাকিয়ে।
পঁচিশ শ।—পুনরুক্তি করে ছেলেটা। দ্রুত হিসাব করে মিথিলা। সব মিলিয়ে তার ব্যাগে আছে আট শ টাকার মত। ছবিটা কেনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবু, এভাবে চলে যেতেও খারাপ লাগে তার। লজ্জাও। সে তাই নির্জীব কণ্ঠে বলে—
কততে দিতে পারবে তুমি?
ছেলেটা বোকা নয়। সে ততক্ষণে বুঝেছে যে উটকো লোক মিথিলা। মিছিমিছি সময় নষ্ট করতে চায় না আর। অবহেলায় মুখ ঘুরিয়ে নিতে নিতে বলে—
এক শ ট্যাকা কম দিয়েন।
মিথিলা উত্তর না দিয়ে সামনে এগোয়। মনের মধ্যে অতৃপ্তি খোঁচা দেয়। ছবিটা কেনা হল না। আহা! এমন কত অতৃপ্তিই তো জমা হয় প্রতিদিন! সেখানে আরও একটু না হয় জমল নতুন করে। হোক না, ক্ষতি কী? যতদিন বাঁচবে সে, ততদিনে ঠিক কী পরিমাণ অতৃপ্তি জমা হবে বুকে? এক কাজ করলে কেমন হয়, প্রতিদিনের অপ্রাপ্তির, অতৃপ্তির তালিকা করল সে, আর তারপর, দিন, মাস বা বছর শেষে মিলিয়ে দেখল তা! ভাবতেই হেসে ফেলল মিথিলা নিজেই। তারপর রিক্সা ডেকে উঠে বসল। ততক্ষণে রোদ মরে এসেছে। একটু একটু রং ধরেছে আকাশে। বিকেলের মরা রোদে ধূসর হতে শুরু করেছে চরাচর। আশপাশের কোলাহল, শব্দ ছোঁয় না মিথিলাকে। এক নিঃসীম নির্জনতা টেনে নেয় তাকে, যার নেশায় সে বুঁদ হয়ে যায়, আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments