মনসুর আজিজের ছড়া-কবিতা: পড়তে পড়তে ফিরে দেখা_প্রবীর বিকাশ সরকার

 
মনসুর আজিজ সমকালীন সাহিত্য জগতে সুপরিচিত একটি নাম। কবিতার জমিনে তার বিচরণ আমার মতো অজস্র পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।  লেখালেখির শুরু ১৯৮৭ সালে হলেও ১৯৯২ সালে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। এক দশকের মাথায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অতলান্ত নীলচোখ’ জন্মলাভ করে ২০০২ সালে। অগ্রগতি একটু দ্রুতই হয়েছে বলা যায়। তারপর ২০০৭ সালে ‘অনন্ত আকাশের জ্যোর্তিময় নক্ষত্র’; ২০০৯ সালে ‘মনুষ্যত্বের ল্যাম্পপোস্ট’, ২০১০ সালে ‘শব্দের বেনারসি’ ২০১২ সালে জোড়াপাখি ফুলের রুমাল ও ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ জল ও জোয়ারের কাব্য। কিশোর কাব্য ও ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে ২০০৭ সালে ‘নীল গালিচার স্বপ্ন’, ২০০৮ সালে ‘হৃদয়পুরের রাজা’, ২০০৯ সালে যথাক্রমে  ‘দুর্দিনের ছড়া’ এবং ‘মেঘের খোঁপায় পালক ভরে’ ২০১১ সালে ‘নতুন ভোরে হীরের কুচি’ ও ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে সবুজপাতা আঁকতে জানি। তাছাড়া কিশোর গল্প ও উপন্যাসও তার রয়েছে। শুধু তাই নয়, একাধিক চীনা কবিতা তার হাতে অনূদিত হয়ে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। বিকশিত হয়েছে চীনা কবিতার সম্ভাবনার চারা।
 
বড়দের জন্য কবিতা লেখায় তিনি যেমন সিদ্ধহস্ত ঠিক তেমনি শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য রয়েছে তার একটি কাব্যিক মন। এ পর্যন্ত তার একাধিক গ্রন্থাদি পাঠ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেগুলো নিয়ে একট সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে উপস্থাপন করছি।
 
দুই.
প্রথম যে গ্রন্থটি নিয়ে লিখছি তার নাম ‘দুর্দিনের ছড়া’, নামেই বোঝা যাচ্ছে সমাজসচেতন ছড়ার একটি সংকলন। শিশুতোষ ছড়ার বাইতে বলা যায় এটিই তার একমাত্র ছড়াগ্রন্থ। এতে ৪২টি ছড়া গ্রন্থভূক্ত হয়েছে। ছড়াগুলো বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর। অসাধারণ অকুতোভয় সাহসী ছড়া রয়েছে একাধিক। যেমন একটি ছড়া তুলে দিচ্ছি:
 
টোকাই নাপিত মেথর মুচি
ভাতের সাথে পাথরকুচি
নিত্য খায় আজ দেশে
বিশ টাকাতে পোলা বেঁচে
ঘোরে পাগল বেশে।
 
মাছুম শিশুর লাজ লুটে নেয়
তখতে বসে ফিক হাসে
চেলা চামুন্ডারা খুশি
আনন্দে দশ দিক ভাসে।
(দুর্দিনের ছড়া)
 
কিংবা
পড়ছি আমি
বখাটেদের খপ্পরে
হাতটা ধরে খপ করে
চারটা পকেট সার্চ করে
চতুর্দিকে মার্চ করে
তারপরেতেÑ
বুকের মাঝে চকচকাচক চাক্কু
কলার চেপে লিডার বলেÑ
আর কি আছে কাক্কু?
 
একটা বখা ঘড়িটা নেয়
গলা থেকে দড়িটা নেয়
হাতের দামি ছড়িটা নেয়
পকেট থেকে কড়িটা নেয়
হাইপেসারের বড়িটা নেয়
তারপরেতেÑ
টাইটা দিয়ে পিছমোড়া বান, ধাক্কা
টহল পুলিশ এসে দেখে
চতুর্দিকই ফাক্কা।
বখাটেদের খপ্পরে
 
তার আরেকটি ছড়ায় তিনপুরুষকে গেঁথেছেন অসম্ভব দকষতায়।
 
দাদার ছিলো কানি কানি
বাবার ছিলো বিঘা
বস্তিঘরের ভাড়া কতো
ওস্তাদেরে জিগা।
 
দাদার ছিলো জমিদারি
বাবার বসতভিটা
আমার মাথার নিচে এখন
ফুটপাতের এক ইটা।
 
দাদার ছিলো পাইক পেয়াদা
বাবার ছিলো চাকর
সবাই আমায় হুকুম করে
আলগা পাতির চা কর।
 
দাদা খেতো নিজের ফসল
বাবা খেতো কিনে
আমি এখন হাত পেতে খাই
সপ্তাহ সাত দিনে।
 
দাদার ছিলো কাশ্মিরি শাল
বাবার ছিলো চাদর
ক্লান্ত আমার দেহে এখন
ছেঁড়া কাঁথার আদর।
(দাদা বাবা আমি)
এমনি আরও অনেক ছড়া আছে এই গ্রন্থে পড়তে গিয়ে বেশ নড়েচড়ে বসতে হয়। এই যে নাড়া দেয়া এতেই কবি স্বার্থক হয়েছেন বলে বিশ্বাস করতে দ্বিধান্বিত হওয়ার কথা নয়।
 
 
তিন.
প্রথম কিশোরকাব্যগ্রন্থটির নাম ‘নীল গালিচার স্বপ্ন’ এতে রয়েছে ছোটবড় মিলিয়ে ২৮টি কবিতা। এই গ্রন্থে কবি বেশ কিছু কবিতা স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে লিখেছেন। বেশ কয়েকটি কবিতাই সুখপাঠ্য বিষয়বৈচিত্র্য ও চিত্রকল্পের বুননের কারণে। একটি কবিতার অংশ তুলে দিই:
বৃষ্টির গান
বৃষ্টিরে তুই কোন সুদূরের মেয়ে
মেঘের ঘোমটা ফেলে এলি নেমে
কদম কেয়ার বনে থেমে থেমে
আকাশ থেকে নামলিরে তুই কোন দড়িটা বেয়ে।
 
দ্বিতীয় কিশোরকাব্যগ্রন্থটির নাম ‘হৃদয়পুরের রাজা’। নামটিতে যেমন চমক আছে তেমনি কবিতাগুলোতেও। একটি শিশুর জন্মের আগে মায়ের যে স্বপ্ন-কল্পনা, শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তার প্রথম পাঠ ইত্যাদি অনেকটা কথোপকথনের মাধ্যমে ওঠে এসেছে হৃদয়পুরের রাজা’য়।  ২৫টি কবিতার সমাহার এই গ্রন্থটি। গ্রন্থের নামে যে কবিতাটি আছে তার কয়েকটি ছত্র এরকম:
হৃদয়পুরের রাজা
আমার হৃদয় জুড়ে ছিল দেখার স্বপ্নসাধ
আজকে কোলে চাঁদ উঠেছে ভাঙলো খুশির বাঁধ
কানে কানে বলব কথা আমার সোনার সাথে
মোরগডাকা ভোরবেলা কি সন্ধ্যা সকাল রাতে।
 
পিটপিটাপিট চোখে বলিস কথা আমার চোখে
হাতটা গালে ঘুমাস যখন ভাবুক বলি তোকে
ঝলমলে রোদ গায়ে মাখিস সূর্য ওঠে যখন
তোর হাসিরই শব্দ শুনে সূর্য হাসে তখন।
 
অনেকগুলো কবিতাই বেশ ভাবনার উদ্রেক করে। তেমনি একটি কবিতা ‘খোকার বায়না’ অনন্য-অনবদ্য।
 
তৃতীয় শিশু-কিশোর ছড়াকাব্যগ্রন্থটি হচ্ছে: ‘মেঘের খোঁপায় পালক ভরে’। এতে রয়েছে মোট ২৭টি ছড়া। একটি ছড়া দারুণ নস্টালজিক:  মেঘের খোপায় পালক ভরে
চিড়ল চিড়ল গাছের ডালে
তুলতুলেতুল পাখির গালে
আহার যোগায় মা
কদিন পরে ডানায় চড়ে
মেঘের খোপায় পালক ভরে
নীল আকাশে যা।
 
আরও আছে যেমন:
 
কাশফুল
কাশফুলে কি দুর্বাঘাসের দাদা
মাথার উপর চুলগুলো তার ফক ফকা ফক সাদা
কাশফুলে কি নানুর মাথার চুল
নাকি তারা হাঁসের ছানা পাখনারা তুলতুল
কাশফুলেরা মেঘের ভেলা হতে
গুলতি খেয়ে ছিটকে পড়ে পথে
হয় তো ওরা পরীর ছোটো মেয়ে
পথ ভোলাতে মায়ের পথে আজো আছে চেয়ে
কাশফুলেরা শিমুল তুলোর বোন
করগুনে তাই ফাগুন মাসের দিনগুলোকে গোন
কিংবা ওরা হিমালয়ের মিহি বরফদানা
আদ্যিকালের দৈত্যগুলো দিয়েছিল হানা
তাই তো ওরা যাযাবরের মতো
বাংলা মায়ের পথে ঘাটে ফুটছে অবিরত।
 
আরও একটি কবিতার আংশিক তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না :
বরষার বিষ্টি
দিনভর ঝরঝর ঝরছে বৃষ্টি
কাদা মাখা পথ ঘাট হলো অনাসৃষ্টি
কামিনীর গন্ধ
লাগে না তো মন্দ
দোয়েলের শিসটা যে লাগে কতো মিষ্টি
পাতা ঝরা দিনটাতে ঝরে কতো বিষ্টি।
চতুর্থ কিশোরকাব্যগ্রন্থ ‘নতুন ভোরে হীরের কুচি’এতে ২৮টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। এর ‘আজ খুলে দাও বন্ধ মনের দ্বার’ একটি অসাধারণ কবিতা! এখানে তুলে দিলাম:
ছোট্ট পাখিটি কখনো যদি দোলা দেয় মনে দোলা
নতুন পালকে উড়বার নেশা বাতাসের বুক খোলা
বোশেখি বাতাসে নতুন শাখায় শিস দিতে সাধ জাগে
হামাগুড়ি দেয় ছোট্ট শিশুটি উপরে তাকিয়ে আগে।
 
কাগজের নাও ভাসায় কিশোর বোশেখি নতুন জোয়ারে
পাখনা ছড়ায় হাঁসের ছানারা জড়ো নয় আজ খোঁয়াড়ে
কিশোরীর কানে ঘাসফুল গেঁথে বকুলের মালা পরে
নকশি আঁকানো কলসীটা আনে নতুন পানিতে ভরে।
 
রূপালি মাছের ঘাই দেেেখ জাগে জেলেদের মনে আশা
ধানের ছড়ায় কৃষকের হাসি বুকভরা ভালোবাাসা
মেঘের ভেলায় ঈগলের ডানা দোল খায় মিঠে রোদে
স্বপ্নের বিভা আলোকিত হয় জীবনের নানা বোধে।
 
নববর্ষ আজ খুলে দিক যতো বন্ধ মনের দ্বার
অজেয়কে জয় করতেই হবে নয় জীবনের হার।
আশ্চর্যজনকভাবে এই কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই ভালো এবং ক্ষুদে পাঠক-পাঠিকাদের ভালো লাগবেই এই কারণে যে, গ্রামবাংলার চিরকালীন অনন্য রূপটি আঁকা হয়েছে। ভোরবেলাকার সূর্যরশ্মি হীরের দ্যুতির মতোই প্রতিটি কবিতায় ঝিলিক দিচ্ছে।
 
 পঞ্চম শিশুকিশোরকাব্যগ্রন্থটি সম্প্রতি প্রকাশিত। নামটি খুব কাব্যিক ‘সবুজ পাতা আঁকতে জানি’ এতে রয়েছে বিচিত্র স্বাদের ২৮টি কবিতা। বলতে দ্বিধা নেই সবগুলো কবিতা ভালোলাগার মতো। আবহমান বাংলা ও বাঙালি জীবনপ্রকৃতির ছবি চমৎকারভাবে এঁকেছেন মনসুর আজিজ। ‘লাল সবুজের নাম’ কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে কী দারুণভাবেই না উসকে দেয়:
 
স¦াধীনতা রুয়ে দেই সবুজের বুকে
পথ চলি বনে বনে ফুল ঘ্রাণ শুকে
লাল সবুজের মাঝে আমার এই দেশ
ফুল ফসলের ডালা আহা সুনিবেশ।
 
স¦াধীনতা হয়ে যায় কিশোরের ঘুড়ি
মুক্ত আকাশ জুড়ে তার ওড়াউড়ি
হৃদয়টা হয়ে যায় সুনীল আকাশ
তার দিকে এই মন নিত্য তাকাস।
 
স¦াধীনতা হয়ে যায় নীড়হারা পাখিদের বাসা
স¦াধীনতা হয়ে যায় বোটা জুড়ে আম ডাঁসা ডাঁসা।
 
স¦াধীনতা বন্ধন হাতে হাত রাখা
তাপ দেহে বাও দেয়া তালেরই পাখা।
 
চার.
কবি মনসুর আজিজ নিঃসন্দেহে একজন শক্তিশালী কবি। কবিতায় ঘুরে ফিরে বাংলাদেশ, বাংলার ঐতিহ্য, বাঙালি সংস্কৃতি এবং চিরকালের গ্রাম্যপ্রকৃতিকে কলমের তুলিতে এঁকেছেন। সব বয়সী পাঠকই তার সহজবোধ্য কবিতা পাঠ করে আনন্দ লাভ করবে বলে এই আলোচকের একান্ত বিশ্বাস। বয়স্ক পাঠকসমাজ হারিয়ে যাওয়া সময়কে ফিরে দেখার সুযোগ পাবেন।
সৃজনশীলতায় টইটুম্বুর, খুব পরিশ্রমী কবি মনসুর আজিজ। ছন্দের হাত তার অত্যন্ত সাবলীল, আঙ্গিক গঠনে সুপটু। চিত্রকল্প নির্মাণে যেমন সিদ্ধহস্ত চিন্তার বৈচিত্র্যময়তা তার বৃত্তায়িত বা সীমিত। কিন্তু কবির বুকের ভেতরে রয়েছে উষ্ণ, স্বপ্নসরস এক স্বাদেশিকবোধ যা পাঠককে সংক্রামিত করে। বর্তমান সময়ে ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে রেখেই কিশোর কবিতা রচনায় যুগের পরিবর্তন ও রুচিশীলতাকে প্রাধান্য দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আশা করি কবি মনসুর আজিজের ভবিষ্যৎ কবিতা বা ছড়া আরও গতিময়তা, নতুন বিষয় বৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হবে। আমরা সেই আশায় রইলাম।
 
জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.