মুসলিম রেঁনেসার কবি ফররুখ আহমদ কেন আজ উপেক্ষিত_ড. মাহফুজ পারভেজ

 
কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে লিখতে গেলে বিশেষ কিছু কথা আগেভাগে স্পষ্ট ও পরিষ্কার হয়ে নেওয়া উচিত। তাঁকে আমরা প্রধানত মুসলিম রেঁনেসার কবি হিসেবেই জানি। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের সমৃদ্ধ সোনালি ইতিহাস-ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই মূলত: সফলভাবে নিরন্তর কাব্যচর্চা করেছেন। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আজকে ফররুখ আহমদ এতটাই উপেক্ষিত ও অবহেলিত যে- আমাদের কাব্যসাহিত্যে তাঁর মতো অবিসংবাদিত মহৎ এক জীবন্ত কিংবদন্তী কবি আছেন যা নতুন প্রজন্মের স্মরণে বলতে গেলে আসেই না। তাঁর মতো এত বড় মাপের কবি বর্তমানে অনালোচিত ও উপেক্ষিত- এটা ভাবতেই বিস্ময়বোধ হয়। তিনি শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কবিতা লিখেছেন বলেই কি তাঁর অপরাধ? যার জন্য তাঁকে আজ মাসুল দিতে হচ্ছে? সেজন্যই কি তাঁর প্রতি কোনো কোনো সময় সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা হয়? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে মধুসূদন, বঙ্কিম কিংবা রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানদের জন্য লেখেন নি? তবে তারাও কি সাম্প্রদায়িকতার মতো একই দোষে দুষ্ট নন? ফররুখ আহমদের প্রতি একতরফা এমন অভিযোগ তোলাটা সত্যিই চরম অবিচার ও বৈষম্য হয়ে যায়। তাছাড়া ফররুখ আহমদ কোনোদিনও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে কটাক্ষ করে কিংবা উদ্দেশ্য করে কোনো কটুক্তি করেন নি। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে বেশি কবিতা লিখেছেন বলেই তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা হয়। যার ফলে তিনি আজ আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তারকারী বাম ঘরানার কবি-সাহিত্যিকশ্রেণীর দ্বারা চরম উপেক্ষার শিকার। অপরদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারক ও সামন্তবাদী জমিদার-কবি রবীন্দ্রনাথকে খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ ও জনগণের কবি বলে দাবি করে তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন বাড়াবাড়ি ও নর্তকুদনের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া আমাদের বাংলা সাহিত্যে কবি ফররুখ আহমদ মুসলমানদের অবদান সমৃদ্ধ করেছেন। মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথরা মুসলিম বাংলা সাহিত্যে অন্তত দয়া করেও কোনো ছিঁটেফোটা কিছু দিয়েছেন কিনা আমার ঘোর সন্দেহ আছে। তাঁদের সাহিত্যচর্চাকালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের বেশ আকাল ছিল। অবশ্য মীর মশারফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শাহাদাৎ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলাম এ গুটিকয়েক সাহিত্যিকরা তখন মুসলিম বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রেখেছেন। উল্লেখ্য যে, হিন্দুদের শ্যামা সঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া ‘নজরুলের কাব্যনায়ক শিবÑ হিন্দু পুরাণের একটি চরিত্র। যিনি একই সঙ্গে ধ্বংস ও পুনর্নির্মাণের প্রতিভূ।’ কাজী নজরুল ইসলাম কেবল মুসলিম সাহিত্যেই নয়; হিন্দুসাহিত্যেও স্মরণীয় প্রভূত অবদান রেখেছেন। পক্ষান্তরে কোনো হিন্দু সাহিত্যিক আমাদের মুসলিম বাংলা সাহিত্যে কোনো অবদান রেখে ন্যূনতম উদারতা দেখাতে পেরেছেন কি? জানি এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া বড্ড কঠিন। যাই হোক আশা করি নির্ভেজাল ও আদর্শবাদী কবি ফররুখ আহমদকে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতার ঠুনকো অপবাদ দিতে আর কারো সাহস হবে না।
তিনি তাঁর স্ব-ধর্ম ও স্ব-জাতির আদর্শকে ধারণ ও লালন করতে চেয়েছেন মাত্র। ইসলাম  এবং তাওহীদের বিশ্বাসকে তাঁর কাব্যধারায় প্রাণবন্ত করতে চেয়েছিলেন। মুসলমানকে তার নিজের সমৃদ্ধ ইতিহাস বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে সচেতন করতে সচেষ্ট ছিলেন। মানবতার প্রকৃত স্বরূপ তিনি ইসলামেই খুঁজে পেয়েছিলেন। ঈমান ও বিশ্বাসের গানের সুর তিনি ইসলামেই সন্ধান করেছেন। সেখানে তিনি কখনোই বিভ্রান্ত হননি। বরং মানবাত্মার মুক্তির পথ ক্রমশ তাঁর কাছে উন্মুক্ত দিগন্তের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। সেদিকেই তিনি তাঁর স্বজাতিকে আজীবন আহ্বান জানিয়ে এসেছেন। যার দরুন কখনো তাঁকে আমরা তাঁর আদর্শ থেকে কিঞ্চিৎ বিচ্যুত হতে শুনিনি।
আরেকটি আলোচ্য বিষয় হলোÑ জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে’র মতো প্রবল প্রতিভাধর ও দিকপাল কবিরা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের তুলনায় সে সময়ে ফররুখ আহমদ আদর্শগত দিক থেকে ব্যতিক্রম ও ভিন্নধারার কবি ছিলেন। যা তাঁকে অন্যান্য মহৎ কবিদের চেয়েও সেই সময়ের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে প্রতিপন্ন করে। এখন কথা হচ্ছে, কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন? আল মাহমুদের একটি বক্তব্য উত্থাপন করলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তিনি বলেছেন, “সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষার প্রথম শ্লোগানমুখর কবিতা লিখতে শুরু করলেন, যেটা বিষ্ণু দে’রা পারলেন না মার্কসিস্ট হওয়া সত্ত্বেও। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসে সে সময় ‘লাল ইশতেহার’ ছূঁড়ে দিলেন বাংলা কাব্যে। আর তারই অপজিট কাজ করলেন ফররুখ আহমদ, তাঁর কবিতাকে একদম ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন ‘সাত সাগরের মাঝি’তে যেখানে সিন্দাবাদ, হাতেম তাঈ, ধর্মীয় অনুসঙ্গ ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি প্রীতি ইত্যাদি বিরাজমান। একই সময়ে দুই কবি দুই ধারার দুই নিশান উড়িয়ে দিলেন।” অর্থাৎ ‘একই সময়ে দুই ধারার দুই নিশান উড়িয়ে’ দেওয়ার সাফল্যের জন্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ফররুখ আহমদও একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ কবি। 
সাম্প্রতিককালের বামধারার এবং সেক্যুলার ও প্রগতিপন্থী একশ্রেণীর কবিকুল ফররুখ আহমদকে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবেন। এর কারণ একটাই- ধর্ম তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সেজন্যই তাদের কাছে তিনি প্রগতিশীল বা আধুনিক না হয়ে প্রতিক্রিয়াশীলই রয়ে গেলেন। ফলে ফররুখ আহমদ তথাকথিত প্রগতিবাদী(?) কবিকুলের কাছে অনালোচনাযোগ্য হওয়ার কারণে আজ বিদ্যমান কাব্যসাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে নিতান্তই অবহেলার শিকার। নতুন প্রজন্ম ফররুখ আহমদের জীবনাদর্শ ও সৃষ্টিশীল কর্মচেতনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছে না। সুকৌশলে তাদের কাছ থেকে তাঁকে জেনেশুনেই দূরে সরিয়ে রাখার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ এদেশের কোনো একটি কু-চক্রী মহল চায় না নতুন প্রজন্ম ইসলামী ভাবাদর্শে তাদের দেশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে জানুক। তারা একচেটিয়াভাবে রবীন্দ্রব্যবসার মাধ্যমে ধর্মহীন ও সেক্যুলারি সাহিত্য-সংস্কৃতির বাজার কায়েম করতে চায়। কোনোভাবেই তারা দেশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটতে দিতে নারাজ।
তিরিশের দশকের শেষভাগে কাব্যচর্চা শুরু করা এবং চল্লিশের দশকে এসে ফররুখ আহমদের কবিত্বশক্তি ও কাব্যশৈলী পরিণত পর্যায়ে উপনীত হয়। এই চল্লিশের দশকেই তাঁর কবিপ্রতিভার চমৎকার ও  বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্ফূরণ ঘটে। তাঁর সময়কার অন্যান্য প্রতিভাধর ও শক্তিমান কবিদের মধ্যে তিনি স্বকীয় ও স্বতন্ত্রধারার একজন কবি হিসেবে বিশিষ্টতা অর্জন করেন। তিনি ইসলাম ও মুসলিমদের সুবর্ণ ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তাঁর কাব্যক্ষেত্রের প্রায় সর্বত্র লালন ও ধারণ করেছেন। কবিতায় স্ব-ধর্মীয় চেতনাকে সমুন্নত করাই ছিল তাঁর অধিক খেয়াল। কিন্তু তাঁর সময়ের অন্যান্য খ্যাতিমান কবিরা তো ধর্মমুখী কিংবা ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হননি। এমনকি তখনকার কবিরা মার্কসবাদের কট্টর সমর্থক অথবা কমিউনিজমের ধারক হতেই বেশি পছন্দ করতেন। অথচ ফররুখ আহমদ কেন তাঁদের সাথে তাল মিলিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি? এছাড়াও প্রশ্ন ওঠে- তাঁর মধ্যে স্বজাত্যবোধ অর্থাৎ মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামী চৈতন্যে জারিত হওয়ার কারণ বা সূত্র কী ছিল? এ প্রশ্নগুলোর সহজ উত্তর হলো, “আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, গোলাম কুদ্দুস, সিকান্দার আবু জাফরÑ এঁদের প্রাথমিক ভিত্তি, ভূমি ও মঞ্জরি ছিল একই : এঁরা সবাই নির্জিতের পক্ষে কলম ধরেছিলেন, এঁরা সবাই জনসাধারণের কবি। তিরিশের কবিদের অতিব্যক্তিকতা ফাটিয়ে চল্লিশের কবিরা যে-অব্যক্তিকতা নিয়ে এসেছিলেনÑ সুকান্ত ভট্টাচার্য, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, দিনেশ দাস প্রমুখÑ আমাদের চল্লিশের এই কবিরা তাঁদেরই সহযাত্রিক। ফররুখও। কিন্তু ১৯৩৭ সালে তাঁর (ফররুখ) কবি হিসেবে আবির্ভাব। ১৯৪৩-৪৪ সালেই তিনি দেখলেন নির্জিত ও নির্যাতিতদের মধ্যেও একটি দল বিশেষভাবে নিপীড়িত এবং জাগরণউন্মুখ। এঁরা বাঙালি মুসলমান। প্রথম প্রকাশের বছর ছয়েক পর ফররুখ কথা বলেছেন তাঁর কালের কণ্ঠস্বরেই, সপ্তম বছরেই তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর নিজস্ব কবিব্যক্তিত্ব (সূত্র: বাংলা সাহিত্যে মুসলমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ)”। অর্থাৎ সেসময়ে তিনি লক্ষ করেছেন যে, সমগ্র নির্জিত জনতার মাঝে তাঁর স্ব-জাতি মুসলমানরাও রয়েছে। তাছাড়া তখন মুসলিমদের সাহিত্য বা কাব্যচর্চা অত্যন্ত অপ্রতুল ও ক্ষীণ ছিল। হয়ত এমতাবস্থায় তিনি নিজ চোখের সামনে স্বজাতির এমন করুণ দুর্দিন ও দুর্গতি দেখে সহ্য করতে না পেরে দু:সাহসিক ও বৈপ্লবিক ইসলামী চেতনায় ঝলসে ওঠেছিলেন। যা তাঁকে শেষপর্যন্ত স্বীয় আদর্শে অটল রেখে কাব্যসাধনার সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে-তথাকথিত প্রগতিবাদী কবিকুল ফররুখ আহমদকে উপেক্ষা করে থাকে, তাদের অধিকাংশই এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরই অংশ বটে। অথচ ফররুখ আহমদ তাঁর লেখনীশক্তিকে এমন এক সময়ে জাগ্রত করেছিলেন- যেসময়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের অহরহ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মুসলমানরা পদে পদে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছিল। তখন তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, এ অবস্থায় তাঁর স্বগোষ্ঠী যদি জেগে না ওঠে তাহলে তাদের সমূহ ভবিষ্যত অচিরেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তাই তিনি নিপীড়িত ও অবহেলিত মুসলমানদের পক্ষে এবং তাদের ব্যথিত ও জর্জরিত হৃদয়ে অধিকারের আন্দোলন জাগাতে চেয়েছিলেন। নিজ জাতির সোনালি ইতিহাসের বীরত্ব ও বিজয়গাথা তাঁর কবিতার মাধ্যমে নতুন বৈপ্লবিক উদ্দীপনার নিনাদ-ঝঙ্কারে অধিকার হারা মুসলমানদের শুনিয়েছেন। যাতে করে ঘুমন্ত জাতির মধ্যে কিঞ্চিৎ অধিকারসচেতনতা ও জাগরণ ঘটে। সেজন্যই তো তিনি মুসলিম রেঁনেসার কবি হিসেবে খ্যাত। আর আজকে সেই নির্যাতিত ও বঞ্চিত মুসলমানদের উত্তরসূরীদের কাছে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদী কবি হিসেবে বিবেচিত এবং উপেক্ষিত!!
এবার আমি একটি বিতর্কের আলোচনা করবো তা হলো- ফররুখ আহমদকে শুধু বাঙালি মুসলমানদের কবি বলবো নাকি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতির কবি বলে অভিহিত করবো? এ বিতর্কের অবসান করা জটিল হলেও আমি অন্তত কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবো যে, ফররুখ আহমদ কেবল মুসলিম রেঁনেসার কবি। অর্থাৎ তিনি নির্যাতিত ও বঞ্চিত বাঙালি মুসলমানের পুনর্জাগরণের কবি। দেশবিভাগের পর একটি স্বাধীন জাতিসত্তা ও আদর্শের উত্থানের চেতনায় বিভাসিত হন কবি। যে স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র মুসলমানদেরকে শাশ্বত কল্যাণের পথে বিকশিত ও পরিচালিত করবে। স্বাধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে মুসলমান। এই বাসনায় তিনি তাঁর ‘সিরাজুম মুনীরা’ কাব্যগ্রন্থে ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে জাতির সামনে উপস্থাপন করে বলেন, ‘চলেছে সে দূরে ভৃত্যের সাথে মরুপথে/আগুন খেলেছে আকাশে সূর্য প্রলয়কর/সেই তাপে সারা গায়ে আতসের শিখা জ্বলে/আনন্দে টানে উটের রশি, উটে চাকর/শুকনো খোর্মা খেজুরে তৃপ্ত সে খলিফাতুল মুসলেমীন/সত্য ন্যায়ের মাঝে এনেছিলে সব মানুষের মুক্ত দিন’। অর্থাৎ খলিফাতুল মুসলেমীন ওমর ফারুক রা. যেভাবে সু-সাম্যের শাসনব্যবস্থা দেখিয়ে গেছেন ঠিক সেই রকম শাসনব্যবস্থা কবি দেখতে চেয়েছিলেন নব গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে। কিন্তু কবির বড়ই দুর্ভাগ্য, তাঁর স্বপ্ন শেষাবধি পূরণ হলো না। কারণ তিনি অচিরেই দেখলেন যে- পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নিরীহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কী অবর্ণনীয় ও বীভৎস জুলুম-শোষণ চালাচ্ছে। পাকিস্তানী শাসকরা দেশকে অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল। এ অবস্থায় বিষণœ মনে তিনি লিখলেন, ‘প্রতি মুহূর্তে শ্বাপদ তুলিছে ফণা/হানি পরাজয়ী বিষাক্ত যন্ত্রণা/ক্রূর হীনতার পিছল পথে সে/বিষাইছে জাতিরে।’ অনেকে হয়ত বলেন, ফররুখ আহমদ পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তানের  প্রতিষ্ঠালগ্নে স্বাভাবিকভাবে তখনকার সকলেই পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। বোধ করি শেখ মুজিবও তা-ই ছিলেন। কিন্তু যখন পাকিস্তানী শাসকদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পৈশাচিক ও দানবিক চেহারা বেরিয়ে পড়ে তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ জুলুমবাজ শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা শুরু করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে পাকিস্তানী দানব শাসকরা চাপিয়ে দিতে চাইলে ১৯৫২ সালে বাঙালি তার অস্তিত্ব রক্ষার্থে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন শুরু করে। সেসময় কবি ফররুখ আহমদ পাকিস্তানী শাসকদের এহেন অন্যায় আচরণের বিরোধিতা করে প্রচুর লেখালেখি করেন। এক জায়গায় তিনি লেখেন, “এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তাই হয় তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে” (সওগাত আশ্বিন, ১৩৫৪) সূত্র: তাঁর স্বপ্নরাজ্যে তিনি একা, সৈয়দ আবুল মকসুদ। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি পাকিস্তানী অত্যাচারী ও শোষণকারী শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দেননি। যদিও চাইলে তিনি দিতে পারতেন। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদ তো চির মানবতার কবি। তাহলে তাঁর পক্ষে এ অন্যায় সমর্থন দেওয়া কি সম্ভব? পরবর্তীতে পাকিস্তানী ফ্যাসিবাদী শাসকদের অব্যাহত জুলুম নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকারের দাবিতে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা-আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রয়োজন দেখা দেয় ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নতুন স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের। সুতরাং নি:সন্দেহে কবি ফররুখ আহমদকে নির্যাতিত ও বঞ্চিত বাঙালি মুসলমানদের কবি বলা চলে। তবে তাঁকে সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতির কবি বলা যাবে না। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর (পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ) কাছে তিনি অপ্রয়োজনীয়। কেননা তারা ফররুখের কবিতায় তাদের মূল খোরাক পাবে না। যেমনটা তারা কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে পেতো। তাই ফররুখ আহমদ মুসলিম জাতিসত্তার ঐতিহ্যধারী কবি। মুসলমান বাঙালিরা তাঁর ইসলামী ঐতিহ্যবাহী কবিতাসমগ্র ও গজল শুনে নিজেদের মূল শিকড়ের সাথে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে। প্রকারান্তরে বাঙালি সাহিত্যে মুসলমানদের কতটুকু অবদান রয়েছে- তা-ও তারা অনুমান করতে পারবে। আর কেউ যদি এমন প্রশ্ন করে যে- কবি ফররুখ আহমদের আত্মপরিচয় কী? এবং তিনি কি শুধুই মুসলমান? বাঙালি নন? তাদের এ প্রশ্নগুলোর জবাবে আমি বলবো, তিনি যদি বাঙালি না হয়ে শুধুই মুসলমান হতেন তাহলে বাংলা ভাষায় কেন কাব্যচর্চা করলেন? কেনইবা বায়ান্ন’র ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিলেন? মোদ্দাকথা হলো- তিনি একজন মুসলমান বাঙালি কবি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া বাঙালি চেতনার সাথে মুসলমান হওয়াটা কিংবা মুসলিম সংস্কৃতিচর্চা ও ঐতিহ্য লালন করাটা কোনো দোষের বা পরস্পরবিরোধী নয়। 
কবি ফররুখ আহমদ যখন কাব্যচর্চা করছিলেন, তখন চারিদিকে মানবতার নিদারুণ হাহাকার চলছিল। “১৯৪৩-৪৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল কীরকম? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। ১৯৪৩-৪৪ সালে কোলকাতায় জাপানি বোমা পড়েছে। ভয়াবহ মন্বন্তরে পঞ্চাশ লক্ষ লোক মারা গেছে ১৯৪৩ সালে (১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষ নামে চিহ্নিত)। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু। ১৯৪২ সালে নজরুলের নিস্তব্ধতা।” (সূত্র: বাংলা সাহিত্যে মুসলমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ)। এ থেকে বোঝা যায় ফররুখ আহমদের কাব্যচর্চাকালে তাঁর সময়কার পারিপার্শ্বিক ও বৈশ্বিক অবস্থা কতটা বি:ধ্বস্ত ছিল। তখন মানবতা প্রায় নির্জীব নির্বাক। তখন তিনি মানবতার সপক্ষে উচ্চারণ করেন, ‘যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়/কালো পিচ ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়/সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর/সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃত্যুর খবর/জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরণীর পর/ক্ষুধিত অসাড় তবু বত্রিশ নাড়ির তাপে পড়ে আছে/নিসাড় নিথর, পাশ দিয়ে চলে যায় সজ্জিত পিশাচ, নারী নর/পাথরের ঘর।’ অথবা ‘মজলুমানের রক্তে এখনো পৃথ্বি লাল/কোথায় ওড়াবো শান্তিপ্রতীক আল হেলাল?/ঘোরে বুভুক্ষু জনগণ পথে পাংশু মুখে/দ্বার থেকে দ্বারে ফেরে তার দাবী ক্লান্ত বুকে/চির পলাতক শিকার সে হোক দৃপ্ত আজ/মানবতা হোক নির্যাতনের মাথার তাজ।’ 
আজকে সারা বিশ্বে পুঁজিবাদের নগ্নাধিপত্য চুষে খাচ্ছে নিরানব্বই শতাংশ জনগণের রক্ত। সেই পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর অবাধ স্বাধীনতা শোষণ-লুণ্ঠন আর নির্মম দারিদ্র্যের জালে বন্দি করেছে সেই জনগোষ্ঠীকে। পুঁজিবাদী সভ্যতার এই শোষণপ্রক্রিয়াকে অনেক আগেই তিনি তাঁর চৈতন্যের সবটুকু দিয়ে অনুভব করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে সেইসব বৈষম্যবাদী শোষকশ্রেণীর প্রতি ঘৃণার দাবানল জ্বলে ওঠে। তিনি এ নিষ্ঠুর ও অসাম্য সভ্যতার ধ্বংস কামনা করে বলেন, ‘হে জড়সভ্যতা/মৃত সভ্যতার দাস স্ফীতমেদ শোষকসমাজ/মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ/তারপর আসিলে সময়/বিশ্বময়/তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি/নিয়ে যাবো জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি/আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও/ধ্বংস হও, তুমি ধ্বংস হও’ (লাশ, সাত সাগরের মাঝি)। 
তাঁর কবিতায় আমরা ঐতিহ্যপ্রবণতা লক্ষ করি। তাঁর কবিতা পড়লেই বোঝা যায় তিনি কতটা ঐতিহ্যসন্ধানী। এ প্রসঙ্গে কবি ও গবেষক হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ বইয়ে বলেন, “তাঁর (ফররুখ) প্রবণতা সম্পূর্ণই আরব-ইরান সংস্কৃতিকেন্দ্রিক এবং মুসলিম হিসেবে এক্ষেত্রে তিনি সচেতনভাবেই একাত্মতা অনুভব করেছেন : ‘মোরা মুসলিম দরিয়ার মাঝি মওতের নাহি ভয়!’ দেশ এবং কাল উভয় দিক থেকে দূরায়ত ঐতিহ্যের প্রেরণায় উজ্জীবনের মূলসূত্রটাও এইখানেই। ... ... ফররুখ আহমদ মুসলিম পুনর্জাগরণের আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর কাব্যে ঐতিহ্য ও আদর্শের পারম্পর্য কী তা সহজেই বোধগম্য এবং কোন্ প্রেক্ষিতে এই সমন্বিত উদ্বোধন তা-ও সহজেই অনুমেয়।” মহাকবি মাইকেল মধুসূদনও তাঁর মহাকাব্যের জন্য হিন্দুগ্রন্থ রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ ও অন্যান্য পুঁথিগ্রন্থ থেকে প্রচুর উপমা সংগ্রহ করেছেন। তাঁর মেঘনাদবধ ও তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে আমরা ঐতিহ্যপ্রবণতা দেখি। কবি ফররুখ মুসলিম ও ইসলামী ঐতিহ্যের সুবিশাল ঋদ্ধ ভাণ্ডার থেকে প্রচুর উপমার রসদ নিয়ে তাঁর কাব্যে উৎপ্রেক্ষার অসাধারণ অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছেন। যা যেকোনো কবিতাপ্রেমীকেই রোমাঞ্চিত ও চমকিত করবে। পুঁথির কাহিনী ধারণ করে তিনি আধুনিক ভাষার ছন্দে ও উপমায় অভূতপূর্ব রূপক ও কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেনÑ ‘ঘন সন্দল কাফুরের বনে ঘোরে এ দিল বেহুঁশ/হাতির দাঁতের সাঁজোয়া পরেছে শিলা দৃঢ় আবলুস/পিপুল বনের ঝাঁঝালো হাওয়ায় চোখে যেন ঘুম নামে/নামে নির্ভীক সিন্ধু ঈগল দরিয়ার হাম্মামে’ (সিন্দাবাদ)। অথবা ‘দূর বন্দরে দৃপ্ত সূর্য, আমাদের গতিমান/জাহাজের পাল ¯্রােতের নেশায় ভরা/যেথা দিগন্তে সবজা হেরেমে ভাসে পরীদের গান/নেকাব দোলায়ে আদিম বনানী জাগছে মৃত্যুপরা/দরিয়া-মরুর মরীচিকা পানে মাতাল দু:সাহসী/ছুটছে অল্প তাজী’ (বারো দরিয়ায়)। কখনো আবার আরব্য উপন্যাসের নাবিক সিন্দাবাদ তাঁর মানসরাজ্যে বিচিত্র কল্পনানুভূতি তৈরি করে। নীল দরিয়ার অথৈ জলে অসীমের হাতছানি তাঁর মনকে আলোড়িত করে। তিনি সকল মখমল আরাম-আয়েশ ছেড়ে এবং খাকের মমতা চূর্ণ করে নতুন পানিতে সফর করতে চান। তাই তিনি বলেন, ‘ভেঙে ফেল আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ/দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাধ/ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ/নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ’ (সিন্দাবাদ)। তবে তিনি নিরুদ্দেশে নতুন সফর করতে চাননি। অনন্য এক অনাবিল আদর্শের গন্তব্যে তিনি তাঁর মনমাঝিকে নিয়ে যেতে চান। তিনি জানেন, এ সফর কতটা ভয়ঙ্কর ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ‘হেরার রাজতোরণ’ তাঁকে চিরকালীন অমৃত সত্য ও সৌন্দর্যের পথে ডাকছেÑ ‘যদিও শ্বাপদ তোলে বিষাক্ত ফণা/যদিও এখানে অসহ্য হলো হীনতার যন্ত্রণা/তবু বহুদূরে ডাক দিলো আজ হেরার শিখরচূড়া/হেরার কপাট খোলো আজ বন্ধুরা’ (এই সংগ্রাম, সিরাজুম মুনীরা) এবং ‘আমাকে জাগাও যেখানে সেনানী, মানে না বাঁধন রবি/আমাকে জাগাও যেখানে দীপ্ত সে মদীনাতুন্নবী/বিশ্বকরুণ, মুক্তিপদ্মÑ বেদনা লাল/বহিছে চিত্তে সুরভিত শাশ্বত আল হেলাল।’
কবি যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবলোকন করছিলেন, তখন পুরো বিশ্ব দিশাহীন এক অস্থির সময় অতিবাহিত করছিল। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর খবর। রাস্তায় রাস্তায় মড়কের উৎকট পূঁতিগন্ধ। জুলুমবাজ পিশাচের নগ্ন আদিম বর্বর উল্লাসে আর নির্যাতিতের আর্তনাদে কেঁপে উঠছিল আকাশ বাতাস। সেসময় অনেকেই জীবনবোধের তাগিদে নতুন নতুন জীবনদর্শনের সন্ধান শুরু করে। এই কঠিন ক্রান্তিকালে কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ মার্কসবাদ আবার কেউবা কমিউনিজমের ওপর ভর করতে লাগল। কবি ফররুখ আহমদ সবক্ষেত্রে ঢুঁ মারলেও অতিসত্বর বুঝতে পারেন যে- না, এসবগুলোতে অপূর্ণতা রয়েছে। এগুলো মানবজাতির কল্যাণ সাধনে পরিপূর্ণ সবল নয়। অতপর তিনি আত্ম-অনুসন্ধানের প্রেরণা খুঁজে পান ইসলামের মধ্যেই। তিনি ভাবেন, ইসলামই হচ্ছে সার্বজনীন জীবনব্যবস্থা। যাতে নিহিত আছে ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের শাশ্বত পরম মুক্তি ও শান্তি। রাসূল পাক (স.) এর জীবনদর্শনে তিনি আত্মমগ্ন হন। মুসলমানদের দুরবস্থা নিরসনের জন্য তখনকার অন্যান্য জীবনদর্শনের চেয়ে ইসলামকেই তাঁর অধিক উপযুক্ত বলে মনে হয়। ইসলামের অতীত থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজেছেন বলে তিনি অতীতমুখী নন। অতীতের পুনরুজ্জীবন নয়; বরং এ কথা বলা যায়, তিনি ভবিষ্যত বিনির্মাণের রূপরেখা খুঁজে পেয়েছেন ইসলামের অতীত থেকেই। যা তাঁকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখায়। তাই তিনি বলেন, ‘আজকে উমরপন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন/পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ/ঊষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা/দিক-দিগন্তে তাদের খুঁজে ফিরিছে সর্বহারা।’
আজকের ইসলামবিরোধীরা কতই না আস্ফালন করছে। কিন্তু তারা কি ফেরাঊন, নমরুদ, সামুদের করুণ পরিণতির ইতিহাস জানে না? ইতিহাস সাক্ষী যে, তাদেরকে তো ভয়াবহ পরিণাম বরণ করে নিতে হয়েছিল। সুতরাং ইসলাম ও ধর্মবিদ্বেষীদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে  ইতিহাসসচেতন কবি বলেন, ‘অনেক সভ্যতা জানি মিশেছে ধূলির নীচে, অনেক সামুদ/কত ফেরাঊন, কত জালিম পিশাচ নমরুদ/মিশে গেল ধূলিতলে/নতুন যাত্রীর দল দেখা দিল দুর্গম উপলে/উড়ায়ে নিশান/ সাথে করে নিয়ে এল জীবনের অশ্রান্ত তুফান।’ 
কাজী নজরুল ইসলামের পর কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের সুনিপুণ ও সার্থক প্রয়োগ করেছেন ফররুখ আহমদ। এক কথায় বলা যায়, কাজী নজরুলের সেই কাজকে আধুনিকতায় পরিণত করে পরিপূর্ণ মাত্রা দেন তিনি। দুটি উদাহরণ দেয়া যাক্Ñ ১. ‘আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি/দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়েছে তাদের সেতারা শশী।’ ২. ‘ডাকে বাগদাদী খেজুর শাখায় শুকা রাতের চাঁদ/মাহাগির বুঝি দজলার বুকে ফেলে জোছনার জাল।’ এ থেকে বোঝা যায়- কবিতায় তাঁর আরবি-ফারসি শব্দের যথার্থ প্রয়োগ ঘটেছে।
বস্তুত তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কথা হলো- তিনি বাস্তবে যা বিশ্বাস করতেন তা-ই তাঁর কবিতায় অসামান্য পারদর্শিতায় ফুটে ওঠেছে। কবিতায় তিনি যে-বিশ্বাস ও আদর্শ লালন করতেন তা বাস্তবিক ক্ষেত্রেও তাঁর জীবনে আমরা বিদ্যমান দেখি। তিনি কখনোই তাঁর আদর্শ পরিপন্থীদের সঙ্গে আপস করেননি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে ক্ষণে ক্ষণে বিপর্যস্ত হয়েছেন। তবুও লোভে পড়ে ব্যক্তিস্বার্থের জন্য তিনি অন্যায়, মিথ্যা ও ভণ্ড-চাটুকারদের সাথে মোলাকাত করেননি। সাধারণত যাঁরা ইসলাম, আদর্শ, সততা ও সাধুতার কথা বলেন- তা তাঁদের প্রায়োগিক জীবনে আমরা প্রায়সময়ই অনুপস্থিত দেখি। কিন্তু ফররুখ আহমদ এক্ষেত্রে একদমই ব্যতিক্রমী। তিনি সারাজীবন যে বিশ্বাস ও আদর্শের কথা বলেছেন, সেটার ওপরই তাঁর জীবন পরিচালিত হয়েছে। তিনি বিভ্রান্ত চিন্তার অলিগলি বেড়িয়ে হন্যে হতে চাননি। চিন্তার সুস্থিরতার মধ্যে থেকেই তিনি জীবনকে সুনির্দিষ্ট ও সম্ভাবনাময় লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। মুসলমানদেরকে বারবার সচেতন করেছেন। ঈমানের কথা বলে তাদেরকে ইসলামী চেতনায় বলিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছেন। এমন একজন মহৎ মুসলিম বাঙালি কবি আজ আমাদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে উপেক্ষিত থাকার বিষয়টি বড়ই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.