বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র মহাকবি আলাওল_সৈয়দ নাজমুল আহসান

 
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি ছিলেন কবি আলাওল। যিনি মহাকবি আলাওল নামেই সাহিত্য গবেষকদের কাছে আজো শ্রদ্ধেয়। মধ্যযুগে মুসলিম বাঙালি সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চাকে অনুপ্রানিত গতিশীল করতে তথা মুসলিম ঐতিহ্যে মিশেলে নবধারা সৃষ্টিতে যে জন কবি-সাহিত্যিক অগ্রনী মিকা পালন করেছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন মহাকবি আলাওল। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের এক অনন্য প্রতিভা। মহাকবি আলাওল ছিলেন বহুভাষাবিদ। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরবী, ফার্সী,সংস্কৃত,হিন্দি,মৈথিলা,ব্রজবুলি, বার্মিজ মাঘী ভাষায তার দক্ষতা ছিল। কাব্যচর্চার পাশাপাশি তাসাউফ বা আধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম হিন্দুধর্মশাস্ত্রীয় জ্ঞান, কামশাস্ত্র, যোগশাস্ত্র, প্রাকৃতপৈঙ্গল, যুদ্ধবিদ্যা, নৌচালনায়ও পারদর্শী ছিলেন। ছিলেন খ্যতিমান সংগীতজ্ঞ। বৈচিত্রময় জীবনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আলাওলের সৃষ্ট কাব্যসমূহ পাঠকের হৃদয়কে আলোড়িত করতে পেরেছিল। সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা আলাওল সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়ে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শ্রেষ্টতম সাহিত্য ব্যক্তিত্বের আসন অলংকৃত করে মধ্যমনি হয়েছিলেন।
 
হাজার বছরেরও বেশি সময়ের পুরনো আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য। গবেষকরা ৬৫০ খ্রী. থেকে ১২০০ খ্রী. পর্যন্ত সময়কালের সাহিত্যচর্চাকে প্রাচীন যুগ আর ১২০১ খ্রী. থেকে ১৮০০ খ্রী. পর্যন্ত সময়ের বাংলা সাহিত্যচর্চাকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসাবে ধরে থাকেন। বাংলা সাহিত্যেও মধ্যযুগের ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রী. সময়কে কেউ কেউ আবার অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন। যা অনেকাংশেই উদ্দেশ্যমূলক বলে প্রতীয়মান হয়। কারন সময়েই খনার বচন, শূণ্য পূরান, কলিমা জালাল, সেক শুভদয়া ইত্যদিও মতো  জনপ্রিয় সাহিত্যও সৃষ্টি হয়েছিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাংগালী মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরা তৎকালীন প্রচলিত ধারার বাইরে রোমান্টিক প্রণয়কাব্যধারা প্রবর্তণ করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দেব-দেবী, রাধা, কৃষে প্রেমসম্বলিত প্রণয়,ভক্তি,মহাত্মের সাম্প্রদায়িকতায় পরিপুষ্ট পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর। সেখানে  মানব-মানবীর কোন কথা ছিল না। মধ্যযুগের  মুসলিম বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরাই  প্রথম মানুষকে বাংলা সাহিত্যে তুলে ধরে সাবজেক্টে পরিনত করে নবধারার সাহিত্য সৃষ্টি করেন। এক্ষেত্রে কবি কোরেশী মাগন ঠাকুর, দৌলত কাজী মহাকবি আলাওল অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। মূল ’-খন্ডের বাইরে আরাকানের  রোসাঙ্গ রাজসভায় নিবেদিত থেকেও  বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম সাহিত্য গবেষকদের কাছে আজো বিস্ময়কর। যদিও বর্তমানে মায়ামারের আরাকান রাজ্যের বাস্তবতা ভিন্ন তবুও স্বীকার করতেই হবে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য বিকাশে-বিবর্তনে তৎকালীন আরাকানের রোসাঙ্গরাজদের পৃষ্ঠপোষকতা অনন্য মিকা রেখেছিল। মধ্যযুগে বাংলার মূল ’-খন্ডের কবি কবি মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্রের পাশাপাশি আলাওলও শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। বহুভাষাবিদ-বহুগুনে গুনান্বিত কবি আলাওলের রচনাসমগ্রের ভাব-ভাষা-কাব্যিক রুচিবোধ তথা শব্দচয়ণ পাঠককে বিশেষভাবে মুগ্ধ করতো। মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা ছিলেন আলাওল। জনপ্রিয়তায় ছিলেন শীর্ষে। সাহিত্য গবেষকদের আখ্যায়িত মহাকবি আলাওলকে অনেকে পন্ডিত কবি এবং মধ্যযুগের রবীন্দ্রনাথ রুপেও আখ্যায়িত করে থাকেন।
 
মহাকবি আলাওলের রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে  প্রথম শ্রেষ্ঠতর কাব্যপদ্মাবতী এটি মূলত হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর এর কাব্যগ্রন্থপদুমাবৎ-এর বঙ্গানুবাদ। প্রায় তিন বছরের সাহিত্য সাধনায় সৃষ্টি রোমান্টিকধর্মী প্রণয়কাব্য পদ্মাবতী  ভাষার সৌকর্য মুগ্ধ করেছিল পাঠক সমাজকে। কবি আলাওল পদ্মাবতী দ্বিতীয় পর্বেও বিয়োগান্তক পরিণতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে মিলনাত্মক পরিসমাপ্তি টেনেছিলেন। পদ্মাবতীতে আলাওলের অলংকার শাস্ত্র, ছন্দ- কাব্যতাত্ত্বিক জ্ঞানের সার্থক প্রয়োগে বিমোহিত ছিল পাঠককল।সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামানছিল আলাওলের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এটিও ছিল প্রেমমূলক অনুবাদ কাব্য। বিখ্যাত কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য সতীময়না লোচন্দ্রানী কাব্য গ্রন্থটি সমাপ্ত করে আলাওল তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। পারস্য কবি নিজামীর সপ্তপয়কর কাব্যের ভাবানুবাদ ছাড়াও আলাওলের সার্থক অনুবাদ গ্রন্থ ছিলসেকান্দরনামাতোহফা
 
 
 
মহাকবি আলাওল জন্মেছিলেন ১৫৯৭ খ্রী. (সম্ভবত) তৎকালীন গৌড়ের(বাংলার) ফতেহাবাদে বা বৃহত্তর ফরিদপুরে যা বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার জালালপুর(আলাওলপুর) অঞ্চল। দুর্গশহর জালালপুরে রাজা মজলিশ কুতুবের একজন মন্ত্রী ছিলেন আলাওলের পিতা। বিশ বছর বয়সে আলাওল একদিন তার পিতার সাথে ভাটি অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে আরাকানের মগ আর হার্মাদ ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের হাতে বন্দী হয়ে আরাকানের রোসাঙ্গরাজের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সেখানে প্রথমে তাকে ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ দেয়া হয়েছিল পরে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন সর্দার। সেখান থেকে আলাওলকে সরিয়ে সৈনিকের চাকুরী দেয়া হয়েছিল। আর এখানে থাকাবস্থায় আলাওলের সাহিত্য সংগীতের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রোসাঙ্গরাজের প্রধানমন্ত্রী কবি কোরেশী মাগন ঠাকুর আলাওলকে রাজকবি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেনন। আলাওল তাঁর নিজের পরিচয় ব্যক্ত করতে গিযে পদ্মাবতী কাব্যে আত্মকথনে  এসব উল্লেখ করেছেন নি¤œরুপে
 
মুলুক ফতেহাবাদ গৌড়েতে প্রধান।
তথায় জালালপুর পূণ্যবস্তু স্থান।।
ঊহগুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলামা।
কতেক কহিমু সেই দেশের মহিমা।।
মজলিশ কুতুব তাহাতে অধিপতি।
মুই হীন দীন তান অমাত সন্ততি।।
 
---------
 
কার্যহেতু পন্থক্রমে আছে কর্ম লেখা।
দুষ্ট হার্মাদেও সঙ্গে হই গেল দেখা।।
ঊহু যুদ্ধ করিয়া শহীদ হৈল বাপ।
রণক্ষতে রোসাঙ্গে আইলুঁ মহাপাপ।।
 
আরাকানে কবি মাগন ঠাকুরের পরম সাহচার্য পেয়ে আলাওল শুধু কাব্যচর্চাই নয় সংগীত, অস্ত্রবিদ্যা, যোগশাস্ত্র ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি  সব বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। আলাওলের অনুবাদকৃত কাব্যসমূহ শুধু অনুবাদই নয়  সাহিত্যের গুন বিচারে সার্থক সফল ভাবানুবাদ। এছাড়াও তাঁর রচনাসমূহে সময় বাস্তবতার ছবি পরিষ্ফ সেসাথে বাংলা সাহিত্যে পরিবর্তন-বিবর্তনও লক্ষ্যনীয়। বর্তমান পাঠকদের অনেকেরই হয়তো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পাঠে তেমন আগ্রহ নেই। কারন সত্যিকার অর্থে তখনকার রচনাসমূহ আধুনিক যুগের সাহিত্যধারার মতো এতোটা সাবলিল হয়ে উঠেনি। প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যের সাথে তুলনামূলক বিচারে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সাবলিলতার গতি যে বাড়ছিল তা সাহিত্য গবেষকরা মহাকবি আলাওলের অমর সৃষ্টির রসাস্বাদনের মাধ্যমে অনুভব করতে পারছেন। তাই নিরপেক্ষ বিচারে সাহিত্য গবেষকরা বাংলা সাহিত্যেও মধ্যযুগে মহাকবি আলাওলকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত দ্ধিধান্বিত নন। কবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের কিছু অংশ-
 
প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস/ত্রিভবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে বশ/যার হুদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর/মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর। এমনি অন্য কাব্যে রাসুল(.) এর বন্দনায় পাই- মহা জ্যোতিময় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত/জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মুহাম্মদ। আরেকটি কাব্যে- আহাদ আছিল এক/মিম হন্তে পরতেক/যে মিমেত জগৎ মোহন।। কবি আলাওল এভাবেই পাঠককলকে সহজ-সাবলিল গতিতে সাহিত্যের রসাস্বাদন করিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রচলিত ধারা ভেংগে  বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মানবীয় কাব্যধারার সফল কবি আলাওলের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল তিনি আরাকান রাজ্যে বসবাস করেও মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য সাধনা কওে গিয়েছেন। বহুভাষাবিদ আলাওল  অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ না করে মাতৃভাষা বাংলায় কাব্যচর্চা করে বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ-কর্তব্যবোধের  যে উদহারন সৃষ্টি করেছিলেন যা আজো বিস্ময়কর। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রবাহমানধারা সৃষ্টির পূর্বসূরী মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য বিকাশে  আলাওল সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন তারি স্বীকৃতি স্বরূপ আজো বাংলা সাহিত্যকাশে মহাকবি আলাওলের নামটি উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধারসাথে। যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবেন মহাকবি আলাওল এবং তাঁর কালজয়ী কাব্যগ্রন্থসমূয়। সেসাথে নবীন-প্রবীন বাংলা সাহিত্যসেবীদের অনুপ্রেরণা যোগাবে উজ্জীবীত করবে মা-মাটি -মাতৃভাষার প্রতি তাঁর নির্ভেজাল ভালোবাসা।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.