কাতুরার
তাবুক হয়ে শোয়ায়েব নবীর
আল-
বেদ ১৯৯৭ সালের জুন মাসে তাবুক
ও হাইল সফর করি।
তাবুক ইবরাহীম আ-
এর স্ত্রী
কাতুরার ঘর। কাতুরার ছেলে
মাদায়েন। তার নামে পরিচিত
প্রাচীন মাদায়েন (Midian)-
এর অংশ তাবুক।
রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী তাবুক মহানবী সা-
এর নবম
হিজরীর বৃহত্তম সামরিক অভিযানের স্মৃতিধন্য। রোম সম্রাটের বাহিনী
বিনা যুদ্ধে হটে গেলে নবীজী
দুই সপ্তাহ থাকেন তাবুকে। হেজাজের উত্তর সীমান্তে বিস্তীর্ণ মাদায়েন এলাকায় মুসলমানদের বিপুল কূটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয়।
নযদের
প্রাচীন রাজধানী রিয়াদ থেকে দেড় হাজার
কিলোমিটার উত্তরে তাবুক এখন সীমান্তবর্তি সামরিক
শহর। সেখানে বহু বাংলাদেশির অভিবাস।
তাদের দাওয়াতে তাবুক সফরের পরিকল্পনা করি। রিয়াদ থেকে
তাবুকের সড়কপথ এখনো জটিল। যাত্রী-
বিরল। বাস চলাচল অনিয়মিত।
পথে পথে লম্বা বিরতি
দিয়ে বাস কখন গন্তব্যে
পৌছাবে ঠিক নেই। সড়ক
ভ্রমণের আনন্দ বিসর্জন দিয়ে তাই উড়াল
যাত্রায় তাবুক যাই।
কাজের
ফাঁকে ফাঁকে শহরের ঐতিহাসিক জায়গাগুলি ঘুরে দেখি। নবীজীর
সাথি ত্রিশ হাজার মুজাহিদের খিমা। কাছিমের পিঠের মতো ঢালু বিস্তীর্ণ
চত্বর। মধ্য-
চূড়া থেকে
চার দিকে চোখ রেখে
আদিগন্ত বহু দূর দেখি।
নবীজীর দূরদর্শি প্রতিরক্ষা কৌশলের স্মারক চত্বরের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তখনকার সময়কে ছোঁয়ার চেষ্টা করি।
চত্বরের
চার পাশের নিদর্শনগুলির মধ্যে আবদুল্লাহ জুলবিজাইনের কবর ও তার
নামে মসজিদ। মক্কা থেকে দুই টুকরা
কাপড় সম্বল করে মদীনায় আসেন
এতিম বালক আবদুল্লাহ। রাসূল
সা তাকে ডাকেন ‘
দুই
টুকরাওয়ালা’
বা ‘
জুলবিজাদাইন’!
গতানুগতিক
জীবন ছেড়ে নবীজীর মুক্তি-
আন্দোলনে শরীক হন আবদুল্লাহ
জুলবিজাদাইন। শাহাদাতের প্রবল তামান্না নিয়ে দু’
দিনের
জ্বরে ইনতেকাল করেন তাবুকে। তার
লাশ কবরে নামান আবূ
বকর ও উমর। বাতি
ধরেন বেলাল। নবীজী বলেন: ‘
সাবধানে নামাও। তোমরা জানো না এ
কার লাশ!’
আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ চীতকার
করেন: ‘
হায়,
এই লাশ
যদি আমি আবদুল্লাহর হতো!’
তাবুক
থেকে দু’
দিন পর
আল-
বেদ রওনা হই।
মাদায়েন ভূমির মধ্য দিয়ে সিরিয়া-
প্যালেস্টাইনের সীমানা ঘেঁষে দুইশ মাইল মরু-
গিরি-
উপত্যকা বেয়ে
আল-
বেদের পথ। হেজাজ ও
জেরুজালেমের মাঝে সিনাই উপত্যকা
হয়ে প্রাচীন বানিজ্য কারাভাঁর পথের ধারে আল-
বেদ। আকাবা উপ
সাগরের তীরে এখানে থামতো
হেজাজ-
সিরিয়ার প্রাচীন কারাভাঁ। জায়গাটি পরিণত হয় গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যকেন্দ্রে।
এ বানিজ্যিক বসতি ছিল শোয়ায়েব
আ-
এর দ্বীন প্রচারের
কেন্দ্র।
তাবুক
ও মদীনার মাঝপথে আল-
উলার কাছের
মাদায়েন এলাকায় ছিল সামুদ জাতির
নবী সালেহ আ-
এর কর্মস্থল।
সে এলাকা তার নামে পরিচিত
হয় মাদায়েন সালেহ নামে। আর সিনাইয়ের কাছে
আকাবা তীরবর্তী মাদায়েন এলাকা পরিচিত হয় পরবর্তি যমানার
আরব নবী শোয়ায়েব আ-
এর নামে। আকাবা
তীরে শোয়ায়েব আ-
এর সময়ের
ঘর-
বাড়ি নিয়ে এলাকার
নাম হয় ‘
মাগয়েরে শোয়ায়েব’
।
‘
মাগায়েরে
শোয়ায়েব’-
এর বানিজ্যকেন্দ্রের কাছে
দ্রুত বেড়ে উঠেছে পুরনো
নামের আধুনিক আল-
বেদ শহর।
নানা দেশের নানা ভাষী মানুষের
সাথে আল-
বেদ এখন
বহু বাংলাদেশির ঠিকানা। হাফিজ ও মুইন ভাইদের
মেহমানদারীতে সে আল-
বেদে
প্রবাসীদের সাথে আত্মার লেন-
দেন করি। তার
ফাঁকে পুরনো আল-
বেদ ঘুরে
দেখি।
শোয়ায়েব
নবীর সময়ে পাহাড়ের পাথর
খোদাই করে তৈরি ঘর-
বাড়ী ও পুরনো
কবর। শোয়ায়েব নবীর বাড়ির কাছে
সংরক্ষিত পুরনো কূয়া। মুসা আ যৌবনে
মাদায়েনে আসেন। তিনি শোয়ায়েব আ-
এর মেয়েদেরকে এ
কূয়া থেকে পানি তুলে
দেন। সে ঘটনার সূত্রে
শোয়ায়েব আ-
এর বাড়িতে
তিনি আট-
দশ বছর
কাটান। নবীজীর এক মেয়েকে বিয়ে
করেন। মাদায়েন থেকে মিসর ফেরার
পথে সিনাই উপত্যকায় তুর পাহাড়ে ঘটে
মুসা আ-
এর জীবনের
সবচে বড় ঘটনা। তিনি
নবুয়ত লাভ করেন।
মিসরে
ফিরাউনের সাথে নানা ঘটনার
জেরে বনী ইসরাইলের লোকদের
সাথে নিয়ে মুসা আ
সিনাই উপত্যকায় কাটান চল্লিশ বছর। সে সময়ের
কাহিনীর সাথেও আল-
বেদের সংযোগ
ঘটে। ‘
মাগায়েরে শোয়ায়েব’
থেকে প্রায় পঁচিশ
মাইল দূরে মুসা আ-
এর বারো ঝর্ণা
বা ইসনে আশারা আঈন।
এমনি বহু প্রাচীন নিদর্শন
নিয়ে এই পুরো এলাকা
এক বিশাল জাদুঘর।
প্রাচীন
কূয়ায় কাছে দাঁড়াই। মুসা
আ-
এর পানি তোলার
দৃশ্য কল্পনা করি। তখনকার তার
সংলাপ যেন কানে বাজে।
ইসনে আশারা আঈনের প্রাচীন ঝর্নামুখ দেখি। সেখানে চার-
পাঁচটি মুখ
থেকে ক্ষীণভাবে প্রবাহিত ঝিরঝির পানি। সে পানিতে ঠোঁট
ছোঁয়াই। সাগর থেকে এতো
কাছে বারো ঝর্ণার কুদরতি
মিঠা পানি!
আল-
বেদের ইথারে শুনি কারাভাঁর প্রাচীন
ঘন্টাধ্বনী। তেজারতের মুসাফিরদের বিচিত্র কলরব। আর দেখি লোক
ঠকানো ব্যবসায়ীদের পরিণামের নিশানা
মুসাফিরের
জীবন এক জায়গায় স্থায়ী
হয় না। আল-
বেদ-
এ দুই রাত
কাটিয়ে লোহিত সাগরের তীর বেয়ে তিহামা-
পথে সামনে চলি।
মেসোপটেমিয়ার ফোরাত তীরের ব্যাবিলনের ইবরাহীম নবী ফিলিস্তিনে হিজরত
করেন। সেখান থেকে স্ত্রী হাজেরা
ও ছেলে ইসমাইলকে নিয়ে
সিনাই ও আল-
বেদ
হয়ে এই তিহামা পথে
মক্কায় যান। হেজাজের বিরাণ
মক্কার সাথে জেরুজালেমের আত্মীয়তা
গড়েন। মক্কার আকর্ষণ তাকে বার বার
এই পথে টানে। ইবরাহীম
আ-
এর সেই প্রাচীন
তিহামা পথ বেয়ে আমাদের
নতুন গন্তব্য দুবা। আল-
বেদ ও
জেদ্দার মাঝপথে হেজাজ ও মিসরের আন্তর্জাতিক
পার-
ঘাটা দুবা।
স্টীয়ারিং-
এ হাত রেখে
গল্প বলেন শিশু বিশেষজ্ঞ
সরদার নূরুল ইসলাম। অনেক বছর তাবুকে
আছেন। এই পথে বহু
বার পাড়ি দিয়েছেন। তাকে
সাথে নিয়ে ইবরাহীম আ
ও ইসমাঈল আ-
এর অতীত
যমানায় ঘুরে বেড়াই।
মক্কা
থেকে শীতের বানিজ্যের পথ গেছে তায়েফ-
আছির-
জিদান-
নাজরান-
সানা হয়ে ইয়ামেনের
উপসাগরীয় এডেন বন্দরের দিকে।
আর গরমের মওসুমের বানিজ্য কারাভাঁ চলেছে মক্কা থেকে জেদ্দা-
রাবেগ-
মদীনা-
তায়মা-
তাবুক হয়ে মরু-
গিরি
পথে সিরিয়া অথবা মক্কা-
জেদ্দা-
রাবেগ-
ইয়াম্বু-
দুবার পথ ধরে লোহিত
সাগর ও পাহাড় ঘেরা
তিহামার পথ বেয়ে আল-
বেদ-
সিনাই পার
হয়ে জেরুজালেমের দিকে। সূরা কুরাইশে গরম
ও শীতের সেই বানিজ্য পথের
কথা আছে। আমরাও এখন
গরমের মওসুমে সেই গরমের পথের
যাত্রী হয়েছি।
সেই
প্রাচীন পথের ধারে লোহিত
তীরের পুরনো দুবা বন্দরে আমরা
তরী নোঙর করি। প্রবাসি
বাংলাদেশিদের রাতের মেহমানদারী আলো ঝলমল হয়ে
ওঠে। পর দিন দুবাকে
বিদায় জানাই।
মক্কা-
জেদ্দার তিহামা সড়কে না গিয়ে
গাড়ি চলে মরুভূমির বিচিত্র
পাহাড় ঘেরা নতুন সড়ক
বেয়ে। তাবুকে কিছু বকেয়া কাজ
সেরে নতুন পানিতে পাল
তুলতে চাই। কিন্তু তাবুকের
মেজবানরা আবার পথ আগলান।
নবীজীর দোয়ার বরকতে তাবুকের ঊষর মরু সবুজ
হয়েছে!
সে সবুজের ঘ্রাণ
নেয়া এখনো বাকী। কীভাবে
তাবুক ছাড়বেন?
তাবুক
শহর থেকে জর্দানের দিকে
পঞ্চাশ কি.
মি.
পাড়ি
দিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। সে খোলা
মাঠের চার দিকে সবুজ
কৃষি উদ্যান। ফিলিস্তিনী বংশের জর্দানী ব্যবস্থাপক ইয়াসির এক দল বাংলাদেশি
কর্মীকে নিয়ে তাবুক এগ্রিকালচারাল
ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সদর দরোজায় মেহমানকে
স্বাগত জানান। গোলাম রহমান গাইড হয়ে ‘
টাডকো’
কৃষি খামার ঘুরে দেখান।
আশি
কিলোমিটার দীর্ঘ ষাট কিলোমিটার প্রস্থ
খামারে অসংখ্য আলাদা ব্লক। বিভিন্ন বিচিত্র কেয়ারীর দুই ধারে পিচ,
এপ্রিকট,
ন্যাক্টারিন,
আপেল,
নাশপাতি,
প্লামস,
খোক,
আঙ্গুর,
আনার,
এলমন্ডস-
এর পাঁচ লাখের
বেশি সারিবদ্ধ গাছ।
দুশো
হেক্টর জমির একটি ব্লকে
লাল-
কালো-
সাদা নানা
জাতের আঙ্গুর। কোথাও অরচার্ড ও ভিনিয়ার্ড প্রকল্প।
সিড প্রসেসিং প্লান্ট। দুই হাজার হেক্টর
জমির আলু সৌদি আরবের
বিশ ভাগ চাহিদা মিটায়।
গম ও বার্লি ছাড়াও
বছরে নব্বই হাজার ম্যাট্রিক টন ঘাস জন্মে
খামারে। পরাগায়নের জন্য মৌমাছির চাষ
হয় বারো শ’
মৌচাকে।
সেখান থেকে উপজাত হিসাবে
বছরে চৌদ্দ টন মধুর যোগান
আসে।
চারদিকে
সবুজ-
সাদা-
কালো জয়তুন
গাছের সারির মাঝে গাছে গাছে
পাখিরা নানা সুরে গান
গেয়ে মুসাফিরকে স্বাগত জানায়। ‘
রবের কোন্ দান
তুমি অস্বীকার করবে!’
এক
রাত ‘
টাডকো’
র জান্নাতে কাটাই।
পরের রাতে তাবুকে ভিসা-
কফিল-
ইকামার গল্প
করি। শাহেরযাদীর কেচ্ছা ফুরায় না। তাবুকের কেচ্ছাখানি
অসম্পূর্ণ রেখে নতুন সফরে
চলি হাইলের পথে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments