এক প্রজাপতির দিনে_অনিক সুমন
শেষমেশ ভয়টা দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। নতুবা শর্মিলাকে কাছে পাওয়ার কোনো বাধাঁ থাকেনা আমার। ভয়ে কেচোঁ হওয়াটা তার যৌক্তিক। আমার ব্যাপারটা তা নয়।দু'জনের বসত পাশাপাশি। সেটা কতটা লাভজনক তা নিয়ে এখন যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এক লোকালয়ে বসবাসের কারণে এক সময় আমাদের যোগাযোগটা যেমন সহজসাধ্য হয়েছে, এখন মাঝে যে ভয় নামক পাথরটা চেপে বসেছে, তার বড় কারন এই -এক লোকালয়, এক পাড়া, পরিচিতজনদের ভ্রুকুটি।বিষয়টি এমন নয় যে, চাইলেই আমরা সরে যেতে পারি, আশ্রয় নিতে পারি অন্য কোথাও কিংবা দুজনের এক জন ভাড়াটিয়ে হয়ে যেতে পারি। ব্যপারটা এত সহজ নয়। এর মাঝে, শর্মিলা বিবাহিত, দু' সন্তানের মা। তাহোক শর্মিলাকে আমার চাই। সে ও হয়তো তাই চায়। যতটা আমি, হয়তো তার চেয়ে ও বেশি।
বিছানায় শুয়ে আমার বেড়ালের মতন এপাশ ওপাশ -ভাবনার সাগরে যেনো কিনারা হচ্ছিল না। গতকাল এক পড়শীর বিয়েতে দু'জনে প্রচুর চেষ্টা করেছি একে অপরের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়ে। ব্যাপারটা যখন অনেকটা নির্লজ্জের মতো হয়ে পড়ছিল, নিজেই নিজেকে সামলে নেই। তার নাভীর অনেক নীচে করে পড়া সবুজ সিল্কের শাড়ির কারনে, নাভীমুখ অনাবশ্যক উন্মুক্ত হয়ে থাকে যেনো একটি চুম্বনের প্রত্যাশায়। তার স্বামী প্রবরের আশপাশে উপস্থিতি আছে জেনে ও, আমি যেনো একটা পাড় মদ্যপের মতো তার জবা ফুল সদৃশ গহব্বরের দিকে চেয়ে থাকি, অপলক। আগত অতিথিদের মাঝে, আমাদের দু'জনের দৃষ্টি বিনিময়, যেনো কোনো চাতক পাখির জোড়। শেষটায় এমন হবে, তা ভাবিনি। সবার নজর এড়িয়ে, চুপেচুপে ঢুকে পড়ি কমিউনিটি সেন্টারের যেদিকটায় মেয়েদের সাজঘর রয়েছে, তার মাঝে - তাকে একটু একাকী পাব এ আশায়। পূরন হতে বেশি দের হলো না। সে ড্রেসিং রুমে ঢুকতেই, আমি তার পিছু নিলাম। আমার বেলাল্লাপনায় সে কতকটা হতবাক। হতবাক আমিও কম কিছু নই। আমি তার নাভীকে চুম্বনে সিক্ত করে দিতে চাই। চাই যেনো, সে আজ সারারাত আমাকে নিয়েই ভাবে। প্রেমে মজলে, বীর হয় কুনোব্যঙ,কাপুরুষ হয় শেয়াল। আমার হয়েছে দ্বিতীয়টি।
এখন এ ভোরের আলোয় মাখামাখি হয়ে বিছানায় পড়ে আছি ভোদরের মতো, আর তার কথাই মনে আসছে বেয়াড়া বালকের মতো। তবে কি, এ ভয়ের কাতালমাছের মতো চোখ রাঙানী, আমরা পেরিয়ে আসতে পারবো না?
পরকীয়া প্রেমে আনন্দ ছাপিয়ে, যাতনা অধিকতর মনে হতে লাগলো। অথচ এমনটা হবার কথা ছিলো না। শর্মিলাকে দেখেই প্রেমে পড়েছি -ব্যাপারটা তা নয়।বিয়ের আগে তো সে আমাদেরই ভারাটে ছিলো। এক আধবার তার সাথে দেখা কিংবা টুকটাক কথাবার্তা হয়েছে। মনে পড়ে না, কখনো আমার এমনটা মনে হয়েছে যে, অনেক বছর পার হয়ে এলে, এ মেয়েটি আমাকে একদিন অর্হনিশ পোড়াবে। পেশায় একজন ডাকসাইটে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে ও এর কোনো নিবারক জানা নেই আমার।
সে ঝুলে রয়েছে আমার চোখের সামনেই, আমার কালো চশমার মতো, একেবারে নাকের ডগায়।
দুই বার আমি তাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে ছিলাম; সে প্রচন্ড রকমের বিতৃষ্ণা। প্রথমবার যখন তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। দ্বিতীয়বারের বিতৃষ্ণা ও যখন তার দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হওয়ার খবর আসে। সেটা ছিল, আমার প্রতি তার চূড়ান্তরকমের উপেক্ষা এবং তাচ্ছিল্য ;একধরনের উপহাস ছাড়া আর কিছু নয় -অন্তত আমার তো তাই মনে হয়ে ছিল।
গতবারে, পূজামন্ডপের পেছনে আমি তার মুখ চেপে ধরে, জোর করে তার ঠোঁটে আমার ঠোঁট চেপে ধরি। যতক্ষণ না, সে আমার চশমা কেড়ে নিয়ে, মন্ডপের পেছনে ঘাসের উপর ছুড়েঁ মারে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বাহুমুক্তি দেয়ার তিলমাত্র ইচ্ছে আমার হয় নি। তার সাজানো খোপাঁ এলোমেলো হয়ে যাওয়ার আনন্দ লুকোনো, আমার জন্য কষ্টকরই হচ্ছিল বটে।
'এই ভোরে, তুমি আমার সুন্দর দিনটা নষ্ট করলে, শোভন'। তার কপট বিরক্তি।
'বেশ করেছি। মাত্রই তো খোঁপা খুলেছি, এর বেশিকিছু তো নয়। ' আমি হাসি আর থামাতে পারছিলাম না।
শর্মিলা হঠাৎ আমার শার্টের কলার মুঠো করে চেপে ধরে। যেনো মাছের কানকো পরখ করছে, ঠিক সেই রকম সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,
'শোভন, তুমি বিয়ে করছ না কেন? '
'সে তোমাকে বিয়ে করব বলে - আমার তো কেবল তুমিই আছো। ' আমার হেয়াঁলি আর থামতে চায় না।
"বেশ তো, করো। থেমে কেন? " একটু থেমেই সে আবার যোগ করে,
'এতই যদি ভালোবাসা, তবে বললেই পারতে। আমি তোমার সামনেই ছিলাম, চুলে বিনুনি বেঁধে স্কুলে যেতাম - বিয়ের আগে ২২টি বসন্ত পার হয়ে গিয়েছিল। তুমি কি হাওয়া খেয়ে বেড়াতে? চোখে চশমা, সে কবেই পড়েছ -তবু্ও কি কিছু দেখতে না?'
শর্মিলা গাল ফুলিয়ে, বেশ যত্ন করে ফের খোঁপা বাঁধতে শুরু করে।
'এখন, আমার হয়েছে যত হ্যাপা।এক ঘর সাজাতে পারি না, তো দুই ঘর করো। '
তার কন্ঠের উষ্মা ঝড়ে পড়ে, যেনো মুক্তোর মতো.... ঝরঝর করে।
আমার কিছু বলার থাকে না, তার দিকে হলদে কপালে ছড়িয়ে পড়া কালো চুলের দিকে অপলক চেয়ে থাকা ছাড়া।অথবা নিজের ভুলের সমাধিতে মাথা কুটা যেনো একমাত্র উপায়।
'এতো ভোরে কোন বিবাহিতা নারীকে, পরপুরুষের সাথে দেখলে সবাই কি ভাববে বলোতো? ' শর্মিলা, শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নিতে নিতে বলে।
আমি শার্টের আস্তিন গুটিয়ে নিতে নিতে বলি, 'কি ভাববে?'
'না, তোমার ইচ্ছে হলো, আমাকে শরতের শুভ্র সকালে সাদা শাড়ী পরিহিত অবস্থায় শিউলি তলায় দেখবে- অমনি আমিও চলে এলাম, এ-তো ভোরে! ' একটু থেমেই সে অনেকটা স্বগতোক্তি করে, 'আমিও যে কেমন মেয়ে, নিজেকে বুঝি না '
'এবার বোঝ, কে কাকে কতটা ভালোবাসে। ' বলেই তাকে আমি বুকে টেনে নিই। ধন্যবাদ প্রাপ্য, শিউলি গাছটির ও।
আমার যতো পাপ আড়াল করতেই যেনো এটি ডালপালা বেশ ছড়িয়েছে। গতকাল ছিল মহা অষ্টমীর পূজা। কাজেই এতো ভোরে, কেউ জাগেনি। চারপাশ ছিল ভীষণ রকমের ফাঁকা। একটা নেড়িকুত্তা বালির ঢিবির উপর মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল কেবল আর আমাদের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছিল পিটপিট করে।
হয়তো আমাকে অন্যমনষ্ক দেখে, শর্মিলা নৈশব্দ ভাঙার জন্য বলে, 'এতো, কি ভাবছো? '
'ভাবছি, এই ধরো, কে বেশি সুন্দর? তুমি না মা' দূর্গা? '
সে নিশ্চিত লজ্জা পায়। কেন না আমি তাকে দ্রুত চোখ সরিয়ে, মাথা নীচু করতে দেখতে পাই।
'সত্যি করে বলতো শোভন, তুমি কি আদপেই বিয়ে করবে না ভেবেছ? এভাবে আর কদিন? '
শর্মিলা যাওয়ার প্রস্তুতি করছে।
আমি তার নাকে টোকা দিয়ে বললাম, 'এই তো বেশ চলছে, শমি - পেশা, নেশা... তারপর তোমার সাথে সংসার; নিষিদ্ধ, তা যতই হোক সমাজের চোখে। '
আজ ভোরবেলাতে বিছানার আড়মোড়া ভেঙে মনে হলো, এতকাল যা ভাবা হতো তা সঠিক তা নয়।এটা নিরুৎসাহিতার মোড়কে ঢাকা ভয় ব্যতিত আর কিছু নয়। বিষয়টা মনে হতেই মনে হলো, শর্মিলাকে খোলাসা করে জানানো উচিত, সে যেভাবেই হোক। গতকাল সন্ধ্যায় আমার মাতালের মতন মেয়েদের সাজঘরে ঢুকে পড়াটা বিবেচ্য নয়। কিন্তু ভয়ের এ ঘেরাটোপকে বোধহয় উপেক্ষা করে যাওয়ার সময় এসেছে।
আজ ছুটির দিন। বিছানা ছেড়ে যাওয়া ভিষণ কষ্টকর হয়ে পড়ে আমার জন্য। ইচ্ছে হয়, চাদর মুড়িয়ে আরও খানিক শুয়ে থাকি মরা কাকের মতো -পা দু'খানা উপরে তুলে। ব্যচেলর জীবনের পুরো ফায়দাটুকু নিতে উৎকীর্ণ হয়ে থাকি আমি। আর তো এই মুক্ত জীবনের মোহ কাটে না। এমনকি চুল দাড়ির রং কিছুটা কাঁচপাকা হলেও না। চোখের সামনেই বন্ধুদের সস্ত্রীক সন্তানাদি সমেত আনন্দ যাত্রাতে ও না।
এই যেমন, সেদিন ব্যাচমেটদের পূনর্মিলনীতে সবার কথার থুবরী আমার উপরে চলে এলো। কেউ এর সাথে বিয়ে দেয় তো, আরেকজন এর চাইতে ও ভালো প্রস্তাব নিয়ে আসে। সে পূনর্মিলনী আমার বিয়ের আসরে পরিণত হলো একপ্রকার। ক্যাম্পাসের রন্জনাকে আজো ভালোবাসি কিনা জানতে সবার উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি দেখে ভীষণ আশ্চর্য হলাম।
রঞ্জনাকে ভালোবাসতাম কিনা, আমি জানি না। কিন্তু তার ঠোঁট বাঁকিয়ে কথা বলাটা বেশ লাগতো। শেষ কবে তার কথা ভেবেছিলাম তাও আজ মনে পড়ে না। তার সন্তানের পিতার সাথেই কি তার শেষমেশ বিয়েটা হয়? এর উত্তর ও আমার অজানা। আমি জানতে চাইনি
সেদিনকার সে অনুষ্ঠানে ও।
কেউ একজন আমাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে যায়। টুকরো কাগজটা এখনো মানিব্যাগে রয়ে গেছে।
কিছু দিন পরে বোঝা গেল ব্যপারটার সুরাহা সেখানে হচ্ছে না।তার নতুন ঠিকানা, আমার ও তার মাঝের দুরত্ব আরো কমিয়ে দিল, আশ্চর্যজনক ভাবে। এখন আমার দোতলা বাড়ির ছাদে উঠলেই তার ঘরের খোলা জানালা দৃষ্টিতে পড়ে -মাঝে কেবল কিছু কাঁচাপাকা বেতের ঝোপের মতো টিন শেড ঘরের আড়াল, যার অনেকগুলোতে মরচে ধরেছে ভীষণ।
চিন্তার আশ্রমে প্রবেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়। তখন অব্দি পদব্রজে তেমন যাওয়া হয়নি। বরং সময় হয়নি বলা যায়। সময়টা এলো, চেম্বার পরিবর্তন কালে। ভাবলাম, বেশতো - কিছুদিন না হয় ঘরেই রোগী দেখা হবে। পসার যখন বেশ হয়েছে, ঠিকানা রোগীরা নিজে যেচেই খুঁজে নিক। ফলাফল, বিকেলে পার্কে যাওয়া হতো বেশ। খানিক মুটিয়ে গিয়েছিলাম তখন। পার্কে দৌড়ুতে বেশ লাগতো -কিছুটা একাকী, এই যা!
আমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললাম, 'তা পার্কে কখন আসা? আমার তো প্রায়, যাবার সময় হলো।'
তার আবারও খিলখিল হাসি।
'ডাক্তারবাবুকে আজ ঘাম না ঝরিয়ে ছাড়ছি না -কোনো মতেই না ।'
এমন অন্তরঙ্গতা, যেনো আমরা বহুকাল ধরে একে অপরের খুব চেনা!
আসলে ব্যপারটা তা নয়। বাসায় দু 'একবার টুকটাক আলাপচারিতা হয়েছে ঠিক। এর বেশি কিছু নয়। তার নামটা ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না, ভেবে নিজের বেশ সংকোচ হলো।
" আমি গোধূলি। গোধূলি বেলাতে বিচরণ। উর্মী হলে হয়তো, ভোরে বেড়ানো হতো। "
বলেই সলজ্জে চেয়ে থাকে, আমার দিকে।
ভাবলাম, এই সেরেছে! তবে কি মনের কথা, পড়ে ফেললো নাকি, সুন্দরী গোধূলি! বেশ নাম তো, গোধূলি! আগে শুনেছি বলে তো মনে হলো না। ডাক নাম হলেও হতে পারে।
গোধূলি, ফের চমকে দিল আমায়।
"ঠিক ধরেছেন, এটা আমার ডাক নাম। পুরো নাম- শুভশ্রী রায় গোধূলি। "
"আপনি তো বেশ মন পড়তে পারেন দেখছি! " আমি একটু সামলে নিয়ে বললাম। "বেশ ভালো গুন। আমাকে একটু শেখাবেন আশাকরি! "
"হৃদয়টা ও যদি পড়তে পারতাম, একটু..."
কথাটা সে অন্যমনস্কভাবে বললে ও আমার কানে আসে। কন্ঠের বিষন্নতা, নুয়ে পড়ে যেন পুঁইয়ের ডগার মতো। আমার নজর এড়ায়নি।
গোধূলি তড়িৎ সম্বিত ফিরে পেতেই, ' যাই, ডাক্তারবাবু! ' বলে দৌড়ুতে শুরু করে। আমি তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকি অনিমেষ। গোধূলিবেলার তির্যক আলোতে তার ছায়া আরো প্রলম্বিত হতে হতে তা আমাকেও ছাড়িয়ে যায়। এক সময় সে বিন্দু হয়ে, পার্কের আঁকাবাঁকা রাস্তায় হারিয়ে গেলে, বুঝতে পারি, পার্ক ছেড়ে যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে। আরো বুঝতে পারলাম, গোধুলিকে!
ইচ্ছে হলো চেঁচিয়ে বলি, 'গোধুলি! তোমার মন যে আমিও পড়তে পারছি বেশ! '
শুধু মনে হলো, সে কিছু লুকাল।
এর মাঝে একপ্রকার হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলে, আমি বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। অতীতে যে কাজটি সযতনে এড়িয়ে গেছি পরিবারের দেখভাল, তার পুরোটাই আমার কাঁধে বর্তাল এবং নানাবিধ চাপে গোধূলির বিষয়টা ও ভুলে গেলাম। গোধুলি, আর কখনো প্রভাতের প্রথম রশ্মি হয়ে উঠবে না - বিষয়টা মনে হলে কখনো কখনো যে কষ্ট হতো না তা নয়, তবে জীবন অনেকটা এরকমই। ট্রেনের যাত্রার মতো। কোনো স্টেশনে থামলো, কিছু যাত্রীর অবতরণ, নবাগত যাত্রীর সাথে পরিচয়। এক সময় ঢেঁকুর তুলে সে ও কোথাও নেমে পড়ে, অন্যকোথাও। সে ভুলে যায়, ভুলে যাই আমি ও। কারো সাথে শেষ অবধি গন্তব্যে পৌছানোটা, সৌভাগ্যের।
গোধূলি, আমার বিষয়ে ও তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলো। কিছুটা অবাক হলেও, উৎফুল্ল হই - কেন জানি না। তিনি বিষয়াদির ব্যপারে যত চতুরই হন, অহেতুক মিথ্যে বলার মানুষ নন।
এর কোনো এক অবসরে, শর্মিলা প্রথম সন্তানের মা হয়। বিষয়টি তার প্রতি বিরক্তির উদ্রেক করে। এটা অবশ্য তার অজানা নয়। দ্বিতীয় সন্তানের জননী হওয়ার সংবাদ এলে পরে, আমার মনে হলো, এর একটা সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। মনে হলো, আমাদের সম্পর্কটি মৃত নয় একেবারে - তার সেটা বোঝা উচিত।
সাঁঝের আলোতে একদিন তাকে সত্যি বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে বললাম, "শোন, আমি কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছি না কোথাও! '
উত্তরে তার সেই খিলখিল হাসি, যার জন্য মাঝে মাঝেই আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
" তুমি আমাকে হত্যা করবে, শোভন। চিঠিতে আমি তা লিখে যাবো। " বলেই সে উচ্চস্বরে হেসে উঠে।
"আমাকে ভয় দেখি ও না। " বলেই তাকে কোমরে জড়িয়ে আমি আরও কাছে টেনে আনি, চুম্বনে সিক্ত করবো বলে।
আজকাল ভাবি, ভয় কোনো ব্যাপার নয়। সে অনেক দেরি হয়েছে - আমি হয়তো কোনদিনই পাবো না নিজের মতো করে।
কখনো গলির মোড়ে, কখনো জানালায় তার খোঁপা খুলে ঢেউয়ের মতো চুল শুকানো, সপ্তাহে দু'একবার চেম্বারে তাকে চুপিচুপি চুমু খাওয়া, নিতম্বে হাত রেখে তাকে ভালোবাসার গান শুনানো, কিংবা পিঠের কালো তিলে নখ দিয়ে আঁচড় কাটা অথবা ধরা যাক, আমার কাঁচাপাকা ঝাউ বনের মতো দাড়িতে তার কোমল হাতের স্পর্শ -এ সব কিছুই রুটিনের মতো একঘেঁয়ে হয়ে গেছে।
শর্মিলার সাজঘরে আমার ভালোবাসা ঝাড়বাতির মতো জ্বলছে, জ্বলুক - অথবা আমি একটি নিছক উই পোকা, মোমের আলোতে জ্বলে যাওয়ার পূর্বে শুধু তড়পাচ্ছি! মনে হলো ভীষণ ঠকে যাচ্ছি। অথচ শর্মিলাকে ঠগ্ ভাবতে আমার বাঁধল।
সাদাপাকা চুলে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে আমি দরজায় রোদের কড়া নাড়া দেখতে পেলাম। দূরে কার্ণিশে কপোত-কপোতীদের বেলাল্লাপনা দেখতে দেখতে হাসিতে পেটে খিল ধরে গেল।
নারকেলগাছের ছায়া, জানালা দিয়ে কড়িডোর অব্দি পড়েছে। আমি খোলা জানালায় আনমনে চেয়ে রইলাম নিস্তব্ধতার মতো নীরবে। নিজের ছায়াটির সাথে ও খেলেছি কখনও বা।
দিনটিকে আজ অন্যরকম লাগছে - ভীষণ ভালো লাগছে।
No comments