ফুটন্ত গোলাপ_কাসেম বিন আবুবাকার : পর্ব-৩

 

মাস খানেক পরের ঘটনা, সেদিন সকাল থেকে সারা আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। রহমান সাহেব অফিসে যাওয়ার সময় মেয়েকে আজ ভার্সিটি যেতে নিষেধ। করে গেলেন। কিন্তু লাইলী বাপের কথা শুনেনি। বেলা বারটার পর থেকে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হল। বেলা চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন বৃষ্টি থামল না তখন লাইলী ভিজে ভিজে গেটে এসে নিজের রিকশা দেখতে না পেয়ে অন্য একটা রিকশায় উঠে বসল। বৃষ্টির ঝাপটায় তার সব কাপড় ভিজে যাচ্ছে। রিকশা যখন ব্রিটিস কাউন্সিলের সামনে এসেছে তখন একটা জীপ পিছনের দিক থেকে সামনে এসে রাস্তা জাম করে দাঁড়াল। তারপর লাইলী কিছু বুঝে উঠার আগেই চারজন যুবক জীপ থেকে নেমে একজন রিকশাওয়ালার কলার ধরে বলল, চুপ করে থাকবি, নচেৎ ঘুসী মেরে তোর নাক-মুখের চেহারা পাল্টে দেব। আর একজন চারদিক লক্ষ্য রাখতে লাগল। বাকি দুজন লাইলীকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে এনে জিপে তোলার চেষ্টা করল
বেলা চারটেতেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে। সমানভাবে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। লাইলী প্রাণপণ শক্তিতে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল, আর চীৎকার করতে লাগল, কে আছ আমাকে বাঁচাও, ইয়া আল্লাহ তুমি সর্বজ্ঞ, তুমি আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি মেঘের গর্জনে তার গলার শব্দ বেশি দূর গেল না। সবাই মিলে তাকে গাড়িতে তুলে ফেলল। রিকশা থেকে আনার সময় লাইলীর বোরখা টান দিয়ে খুলে ফেলে দিয়েছে। বৃষ্টিতে জামা কাপড় ভিজে গিয়ে শীতে ভয়ে সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। কিন্তু চিৎকার বন্ধ করল না। দুজনে ওকে দুপাস থেকে ধরে রইল। আর একজন চীৎকার বন্ধ করার জন্যে মুখের ভিতর রুমাল ঢুকাবার চেষ্টা করতে লাগল
ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে। এমন সময় একটা প্রাইভেট কার পাশ থেকে যাওয়ার সময় মেয়েলী কণ্ঠে বাঁচাও শব্দ শুনতে পেয়ে গাড়ি ব্রেক করে পিছিয়ে আসতে লাগল। একটা গাড়িকে ব্যাক গীয়ারে পিছিয়ে আসতে দেখে জীপের ড্রাইভার জোরে গাড়ি ছেড়ে দিল
যে গাড়িটা লাইলীর বাঁচাও শব্দ শুনে পিছিয়ে আসছিল, তাতে সেলিম তার মাকে নিয়ে মেডিকেলে এক আত্মীয়কে দেখে বাড়ি ফিরছিল। সে মাকে বলল, মনে হয় গুন্ডারা একটা মেয়েকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাচ্ছে? মেয়েটাকে বাঁচান দরকার
সোহানা বেগম তাড়াতাড়ি বললেন, তুই একা কী ওদের সঙ্গে পারবি?
তুমি দেখ না মা, আমি কি করি বলে সেলিম গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তীরবেগে পলায়ন পর জীপের উদ্দেশ্যে ছুটল
জীপটা কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি। কিছুদূর গিয়ে ইঞ্জিন বিগড়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। ড্রাইভার নেমে গাড়ির হুড খুলে ইঞ্জিনের দোষ খুঁজতে লাগল
সেলিম ওদের গাড়ির সামনে গিয়ে বেক করে গাড়ি থামিয়ে তড়াক করে নেমে এল। ড্রাইভার একটা গাড়িকে ওদের সামনে থামতে দেখে ঘুরে দাঁড়াতেই সেলিম ছুটে এসে তার পাঁজরে জোড়া লাথি মারল। ড্রাইভার ডিগবাজী খেয়ে কয়েক হাত দুরে পড়ে গিয়ে মাথায় ইটের আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারাল
ড্রাইভারের অবস্থা দেখে লাইলীকে ছেড়ে দিয়ে বাকি তিনজন বেরিয়ে এসে একসঙ্গে তিন দিক থেকে আক্রমণ করল। সেলিম আগের থেকে তৈরী ছিল। ওরা বুঝে উঠবার আগেই একজনের কাছে ছুটে গিয়ে তার আক্রমণ ব্যর্থ করে কয়েকটা ক্যারাতের চাপ গর্দানে বসিয়ে দিল। লোকটা জ্ঞান হারাবার আগেই তার হাত দুটো ধরে বনবন করে ঘুরাতে লাগল। ফলে অন্য দুজন তার কাছে এগোতে পারল না। এক সময় সেলিম আহত ওভাটাকে একজনের গায়ে ফিকে দিল। তারপর অন্য জনকে ধরে খুব উত্তম মধ্যম দিয়ে বলল, আর কখন এমন জঘন্য কাজ করবে না? আজকের মত ছেড়ে দিলাম। দেখে তো মনে হচ্ছে, তোমরা ইউনির্ভাসিটির ছেলে। লজ্জা হওয়া উচিত তোমাদের। ওদিকে অন্য ছেলেটা ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়ে তার পায়ের হাড় মচকে গেছে। সে কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি মরি করে ছুটে পালাল। বাকি দুজন তাকে অনুস্বরণ করল। আর একজন অজ্ঞান অবস্থায় সেখানে পড়ে রইল
এতক্ষণ ছেলের কার্যকলাপ দেখে সোহানা বেগম শুধু অবাকই হলেন না, সঙ্গে সঙ্গে গর্বে তার বুকটাও ভরে উঠল। গাড়ি থেকে নেমে জীপের কাছে গিয়ে দরজা খুলে লাইলীকে দেখে চমকে উঠলেন। মেয়েটিকে মানবী বলে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কোনো মেয়ে যে এত রূপসী হতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতেন না
মাকে বৃষ্টির মধ্যে জীপের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেলিম বলল, মেয়েটাকে আমাদের গাড়িতে নিয়ে এস না মা, তুমি যে একদম ভিজে যাচ্ছ
সোহানা বেগম লাইলীর হাত ধরে বুঝতে পারলেন, অজ্ঞান হয়ে গেছে। বললেন, ওকে নামাব কি করে? ওরতো জ্ঞান নেই
সেলিম তাড়াতাড়ি মাকে সরিয়ে দিয়ে গাড়ির মধ্যে লাইলীকে দেখে একেবারে হয়ে গেল। তার গায়ে বোরখা নেই। এত কাছ থেকে বোরখা ছাড়া লাইলীকে এর আগে দেখেনি। যে এত সুন্দরী, সেলিম ভাবতেই পারছে না। সে একদৃষ্টে তার মানসীকে তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল
সোহানা বেগম মনে করলেন, ছেলেও মেয়েটার রূপ দেখে অবাক হয়ে গেছে
বললেন, তুই ওকে তুলে নিয়ে আয়
সেলিম দুহাতে পাজাকোলা করে নিয়ে এসে নিজেদের গাড়ির পিছনের সীটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল
সোহানা বেগম তাকে ধরে রেখে বললেন, চল, একে মেডিকেলে দিয়ে আসি
সেলিম বলল, না। মেয়েটি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে, এক্ষুণী জ্ঞান ফিরে আসবে। ওর জামা-কাপড় ছিঁড়ে গেছে। আমি একে চিনি মা, ভার্সিটিতে পড়ে। এখন আমাদের বাড়িতে বরং নিয়ে যাই, জ্ঞান ফিরলে ওদের বাড়িতে না হয় পৌঁছে দেব
সোহানা বেগম বললেন, বেশ তাই চল
সেলিম বাড়িতে এসে লাইলীকে মায়ের বিছানায় শুইয়ে ডাক্তারকে ফোন করে আসতে বলল। তারপর নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে ঘটনাটা জানিয়ে লোকেশনটা বলে দিল
ডাক্তার আসার আগেই লাইলীর জ্ঞান ফিরল। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দুর্ঘটনার কথা স্মরণ হতে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গেল
সোহানা বেগম বাধা দিয়ে বললেন, তুমি এখন নিরাপদে আছ, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে এনেছি। তুমি চুপ করে শুয়ে থাক। বাড়িতে এসে তিনি আয়াকে দিয়ে লাইলীর ভিজে জামা-কাপড় খুলে নিজের জামা কাপড় পরিয়ে দিয়েছেন
লাইলী চোখ বন্ধ করে ঘটনাটা চিন্তা করতে লাগল, গাড়ি খারাপ হয়ে যেতে দেখে ড্রাইভার যখন ইঞ্জিন সারাচ্ছিল তখন সে একটি গাড়িকে সামনে থামতে দেখে সাহায্যের আশায় বাঁচাও বাঁচাও বলে প্রাণপণে চীৎকার করে উঠেছিল। তারপর সেলিমকে ওদের সঙ্গে মারামারী করতে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপরের ঘটনা সে আর কিছুই জানে না। নিশ্চয় সেলিম গুন্ডাদের হাত থেকে উদ্ধার করে এনেছে। কিন্তু সেলিম একা ওদের চার জনের কাছ থেকে কিভাবে তাকে নিয়ে এল? এটা তা হলে ওদেরই বাড়ি। ভদ্র মহিলা নিশ্চয় ওর মা
লাইলীর চিন্তায় বাধা পড়ল। সেলিম মা বলে ডাক্তারসহ ঘরে ঢুকল। সে তাড়াতাড়ি দেওয়ালের দিকে মুখ করে গায়ের কম্বলটা টেনে মুখ পর্যন্ত ঢেকে দিল
ডাক্তার প্রবীণ ব্যক্তি। হাশেম সাহেবের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তার মৃত্যুর পরও বন্ধুপত্নী তার ছেলেদের সঙ্গে খুব ভালো সম্বন্ধ রেখেছেন। ঘরে আসার আগে সেলিম ডাক্তারকে সংক্ষেপে ঘটনাটা বলেছে। এতেই ডাক্তার অনেক কিছু বুঝে নিয়েছেন। লাইলীকে মুখে কম্বল ঢাকা দিতে দেখে বললেন, তোমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুব খুশি হয়েছি মা। তা এই বুড়ো ছেলেকে দেখে কেউ লজ্জা করে বুঝি? তারপর সেলিমের দিকে চেয়ে হেসে উঠে বললেন, ঠিক আছে, তোমার ডান হাতটা একটু এদিকে বাড়াও তো মা। লাইলী আস্তে আস্তে হাতটা বের করে ডাক্তারের দিকে বাড়াল। ডাক্তার নাড়ী পরীক্ষা করে বললেন, অল ক্লীয়ার, ঔষধ পত্র লাগবে না। একটু গরম দুধ খেতে দাও। তারপর ডাক্তার বিদায় নিয়ে সেলিমের সঙ্গে নিচে এসে গাড়িতে উঠার সময় বললেন, উইস ইওর গুড লাক মাই চাইল্ড। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং করে শব্দ হতে লাইলী সেদিকে চেয়ে দেখল, সাড়ে পাঁচটা। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল, আমি অযু করে আসরের নামায পড়ব
সোহানা বেগম ভার্সিটিতে পড়ুয়া মেয়ের মুখে নামাযের কথা শুনে একটু অবাক হলেন। তারপর রুবানীকে ডেকে আলমারী থেকে নামাযের মসাল্লাটা বার করে দিতে বললেন। বিয়ের পর তিনি যখন শুশুর বাড়িতে আসেন তখন তার মা এই মসল্লাটা দিয়ে বলেছিলেন, এটা দিলাম, তুমি তো নামায পড় না, যদি কখনও আল্লাহপাক তোমাকে হেদায়েৎ করেন তখন নামায পড়বে আর আমার জন্যে দোয়া করবে। এতদিন সেটা একবারের জন্যও ব্যবহার হয়নি। লাইলীর মুখে নামায পড়ার কথা শুনে মায়ের কথা মনে পড়ল। লাইলীর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের প্রতিচ্ছবি তার মুখ দেখতে পেলেন। বললেন, যাও মা, অযু। করে এস, যে এটাচ বাথ
লাইলী করে এসে দেখল একটা ষোল সতের বছরের সুন্দরী তরুণী মসালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত থেকে মসাল্লা নিয়ে বিছিয়ে নামায পড়তে লাগল
এদিকে সেলিম ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে ড্রইংরুমে বসে চিন্তা করতে লাগল, তার প্রেয়সীকে অবস্থায় পাবে তা কোনো দিন ভাবতেই পারেনি। সে যদি ঠিক সময়ে ঐরাস্তা দিয়ে না আসত, তা হলে ওর অবস্থা কি যে হত চিন্তা করে শিহরীত হল। সমাজের কথা চিন্তা করে সেলিমের খুব রাগ হল। ভদ ঘরের শিক্ষিত ছেলেরা যদি এরকম দুঃশ্চরিত্রের হয়, তা হলে দেশের অবনতি সুনিশ্চত। এর কি প্রতীকার নেই? নিজেকে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর বের করতে পারল না
সোহানা বেগম চেয়ারে বসে নামাযরত লাইলীকে দেখছিলেন। তাকে দেখে যেন তার তৃপ্তি মিটছিল না। রুবীনা একগ্লাস দুধ নিয়ে এসে টিপয়ের উপর রাখল। লাইলীর নামায পড়া শেষ হতে সোহানা বেগম বললেন, এই দুধটুকু খেয়ে নাও তো। মা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, চা বা কফি খাবে?
জ্বি না বলে লাইলী দুধের গ্লাসটা দুহাতে ধরে মুখের কাছে নিয়ে প্রথমে বিসমিল্লা, বলে এক ঢোক খেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলল। দ্বিতীয় বারও তাই করল এবং শেষ বারে সবটা খেয়ে নিয়ে আবার আলহামদুলিল্লাহ বলল
সোহানা বেগম এক দৃষ্টে তার দিকে চেয়েছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ল, তার মাও যখন কিছু পান করত ঠিক এভাবেই করত। কি জানি কেন লাইলীকে তার কার্যকলাপ দেখে তার মায়ের মতো মনে হতে লাগল। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি মা?”
লাইলী আরজুমান বানু, ডাক নাম লাইলী
বাহ, খুব সুন্দর নাম তো। যিনি তোমার নাম রেখেছেন তিনি ধন্য। তুমি কিসে পড়?
ইসলামিক হিষ্ট্রিতে অনার্স
ভেরী গুড। তোমার বাড়ি কোথায়?
্যাংকীন স্ট্রীটে
আব্বা কি করেন?
সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন
বেশ মা বেশ, সন্ধ্যে হয়ে আসছে আজ তুমি না হয় আমাদের এখানে থেকে যাও। এখনও ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। তোমাদের বাড়িতে কী ফোন আছে? লাইলীকে মাথা নাড়তে দেখে বললেন, তা হলে ঠিকানা দাও, ড্রাইভারকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিই
লাইলী আঁৎকে উঠে বলল, না না, আমি থাকতে পারব না। আম্বা-আম্মা ভীষণ চিন্তা করবেন। আপনি বরং ড্রাইভারকে বলুন, সে আমাকে পৌঁছে দিক
এমন সময় সেলিম ঘরে ঢুকে লাইলীর কথা শুনে বলল, ঠিক আছে মা, আমি হয় ওঁকে পৌঁছে দিয়ে আসি
সেলিমকে দেখে লাইলী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। মাথা নিচু করে বলল, দয়া একটু তাড়াতাড়ি করুন। ওদিকে বাড়িতে সবাই ভীষণ চিন্তা করছে। কথাগুলো বলার সময় তার গলার আওয়াজ কেঁপে গেল
সোহানা বেগম কিছু একটা যেন বুঝতে পারলেন। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে যাবে আর তুমিও সঙ্গে থাকবে
সেলিম বলল, তুমি বড় ভীতু মা, ড্রাইভার লাগবে না, আমি একাই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারব
সোহানা বেগম গম্ভীরস্বরে বললেন, যা বললাম তাই কর
মায়ের গম্ভীর স্বর শুনে সেলিম কোনো প্রতিবাদ না করে লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, চলুন তা হলে
লাইলী প্রথমে সেলিমের দিকে পরে সোহানা বেগমের দিকে চেয়ে বলল, আমার বোরখা কোথায়?
সোহানা বেগম অবাক হয়ে বললেন, তুমি বোরখা পর? আর ইউ ম্যারেড?
কথাটা শুনে লাইলীর সাদা ফর্সা মুখে শরীরের সমস্ত রক্ত উঠে এসে টকটকে লাল হয়ে গেল। কোনোরকমে না বলে লজ্জা পেয়ে মাথাটা এত নিচু করে নিল যে, চিবুকটা তার বুকে ঠেকে গেল। কয়েক সেকেন্ড কেউ কথা বলতে পারল না
সোহানা বেগম ওকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বললেন, হ্যারে সেলিম, কই গাড়িতে তো ওর গায়ে বোরখা ছিল না
সেলিম বলল, গুন্ডারা হয়তো ফেলে দিয়েছে। তারপর লাইলীকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলুন। রেডিওতে বলছিল, সন্ধ্যার পর আবহাওয়া আরও খারাপ হতে পারে
লাইলী রুবীনার দিকে চেয়ে বলল, আমাকে একটা চাদর দিতে পারেন?
রুবীনা মায়ের দিকে তাকালে সোহানা বেগম বললেন, আলমারী থেকে গরদের চাদরটা এনে দে
রুবীনা চাদর নিয়ে এলে লাইলী সেটা নিয়ে ভালো করে মাথাসহ সারা শরীর ঢেকে নিল। তারপর সোহানা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, আপনারা আমার জন্য যা করেছেন, সে ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। আল্লাহ পাকের দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানিয়ে ফরিয়াদ করছি, তিনি যেন আপনাদের মঙ্গল করেন
সোহানা বেগম এরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাদের সমাজে কেউ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে না। এত আন্তরিকতার সাথে কথাও বলে না। মেয়েটির চেহারা, আচার-ব্যবহার কথাবার্তা দেখে শুনে তার মনে হল এদের সবকিছু আলাদা হলেও কত সুন্দর মার্জিত। তিনি খুশি হয়ে লাইলীকে বুকে জড়িয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, আবার এস
লাইলী মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে রুবীনার হাত ধরে বলল, চলুন
সোহানা বেগমও তাদের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত এলেন
ড্রাইভারের পাশে সেলিম আগেই বসেছে। বড় রাস্তায় এসে সেলিম গাড়ি থামিয়ে পিছনের সীটে লাইলীর পাশে বসে ড্রাইভারকে যেতে বলল। কয়েক সেকেন্ড পর লাইলীর দিকে তাকিয়ে বলল, দয়া করে আপনার নামটা বলবেন?
লাইলীও তার দিকে তাকিয়ে নাম বলল
আমার নাম জানতে ইচ্ছে করছে না?
লাইলী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল
সেলিম নাম বলে বলল, দুএকটা প্রশ্ন করতে পারি?
লাইলী আস্তে করে বলল, করুন
আপনি কিসে পড়েন?
ইসলামিক হিষ্ট্ৰীতে অনার্সে
আবার কবে আপনার সঙ্গে দেখা হবে?
আমি প্রায় প্রতিদিন দুটো থেকে তিনটে পর্যন্ত লাইব্রেরীতে থাকি। ইচ্ছা করলে দেখা করতে পারেন। তারপর বলল, আপনাকে কি বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি যদি ঠিক সময় না এসে পড়তেন, তা হলে আমার যে কি হত, তা আল্লাহপাককে মালুম। কথা শেষ করে লাইলী আঁচলে চোখ মুছল
গাড়ির ভিতর অন্ধকার বলে সেলিম ওর চোখের পানি দেখতে পেল না, কিন্তু বুঝতে পারল কাঁদছে
লাইলী ভিজে গলায় আবার বলল, কি করে যে আপনার ঋণ শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না
সেলিম লাইলীর একটা হাত ধরে বলল, দেখুন, আমি শুধু একজন বিপন্নাকে সাহায্য করেছি। এটা করা প্রত্যেক মানুষের একান্ত কর্তব্য। সেলিম লাইলীর হাত ধরতে তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল
সেলিম বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, আমাকে ভুল বুঝে ভয় পাবেন না। তারপর তার দিকে ঝুঁকে পড়ে আস্তে আস্তে বলল, সেই এ্যাকসিডেন্টের দিন আপনাকে দেখে ভালবেসে ফেলেছি। তারপর পাগলের মত খুঁজেছি। ভাগ্যচক্রে ফাংসানের দিন স্বল্পক্ষণের জন্য পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। আজ দৈবদুর্ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে আপনার দেখা পেলাম। জানি না, আমার কথাগুলো পাগলের প্রলাপের মতো আপনার কাছে মনে হচ্ছে কি না। যাই মনে করুন না কেন, জেনে রাখুন, এই কথাগুলো আমার কাছে চন্দ্র সূর্যের মত সত্য। তারপর তার হাত ধরে আবার বলল, তুমি কী, সরি আপনি কী আমাকে খুব অভদ্র মনে করছেন?
লাইলী কেঁপে উঠে হাতটা টেনে নিতে গেল; কিন্তু সেলিম তার তুলতুলে নরম হাতটা ছাড়ল না। লাইলী জোর না খাটিয়ে বলল, না-না তা মনে করব কেন? আমাকে এত অকৃতজ্ঞ ভাবতে পারলেন কি করে? আপনার উপকারের কথা আমার অন্তরে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে
শুধু উপকারের কথাটাই মনে রাখবেন? উপকারীকে ভুলে যাবেন বুঝি?
আপনাদের সমাজে বুঝি সেই রকম রেওয়াজ আছে?
গাড়ি ততক্ষণে ্যাংকিন ষ্ট্রীটে এসে গেছে। ড্রইভার বলল, কোন দিকে যাব?
সেলিম লাইলীর হাত ছেড়ে দিল
লাইলী রাস্তা দেখিয়ে দিতে লাগল। একটু পরে গাড়ি তাদের বাড়ির গেটে এসে থামল। লাইলী গাড়ি থেকে নেমে সেলিমকে বলল, আসুন। তখন বৃষ্টি একদম থেমে গেছে। সেলিম নেমে এসে যখন লাইলীর পাশে দাঁড়াল তখন সে কলিং বেলে হাত রেখেছে
একটু পরে সাদেক দরজা খুলে ফুপু আম্মাকে একটা অচেনা লোকের সঙ্গে দেখে ভেবাচেখা খেয়ে অনেক কথা বলতে গিয়েও পারল না
লাইলী দরজা বন্ধ করে সাদেকের হাত ধরে সেলিমকে সঙ্গে করে আসতে লাগল
নিচের বারান্দায় হামিদা বানু রহিমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। একজন অচেনা যুবকের সঙ্গে লাইলীকে আসতে দেখে তারা পাশের রুমে ঢুকে পড়ল। এমন সময় মসজিদ থেকে মাগরীবের আযান ভেসে এল। লাইলী সেলিমকে ড্রইংরুমে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী নামায পড়বেন?
সেলিম লাইলীর মুখের দিকে শুধু চেয়ে রইল, কোনো কথা বলতে পারল না
লাইলী বুঝতে পেরে বলল, ঠিক আছে, আপনি একটু বসুন। আমি নামায পড়ে দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। তারপর সেলিমকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল
যে রুমটায় সেলিমকে বসান হয়েছে, সেটা ভাড়াটিয়াদের ড্রইংরুম হলেও তারা নিজেদের রুমের মতো ব্যবহার করে। সিঁড়ির মুখে মা ভাবির সঙ্গে লাইলীর দেখা হল। ভাবি বলল, কি ব্যাপার? এদিকে আমরা সকলে তোমার জন্যে চিন্তায় অস্থির। তোমার ভাইয়া খালুজান ঘণ্টা খানেক আগে তোমাকে খুঁজতে গেছেন। তোমার বোরখা কোথায়? কার জামা কাপড় পরে এসেছ?
সব তোমাদের বলব, তার আগে সবাই নামায পড়ে নিই এস। নামায শেষে লাইলী সংক্ষেপে সব ঘটনা বলার সময় কেঁদে ফেলল
হামিদা বানু বললেন, আর তোমার লেখাপড়া করার দরকার নেই। কাল থেকে ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ
লাইলী সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, সে যা হয় হবে, এখন মেহমানকে তো কিছু আপ্যায়ন করান উচিত
রহিমা বলল, ঘরে তো সবকিছু আছে; কিন্তু পরিবেশন করাবে কে?
তুমিই করাও বলে লাইলীর হাত ধরে নিজের ঘরে এসে ফ্রীজ থেকে কয়েকটা মিষ্টি কয়েক পীস কেক একটা প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে বলল, যাও সখি, তোমার উদ্ধার কর্তাকে আপাতত এই দিয়েই আপ্যায়ন করাও
লাইলী গায়ে মাথায় ভালো করে চাদরটা জড়িয়ে নাস্তার প্রেট পানির গ্লাস নিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে সেগুলো টেবিলের উপর রেখে বলল, অনেকক্ষণ বসিয়ে আপনাকে কষ্ট দিলাম, সে জন্য মাফ চাইছি
সেলিম কোনো কথা না বলে বোবা দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল
বেশ কিছুক্ষণ সেলিমকে তার দিকে নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে লাইলী লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে মাথাটা নিচু করে নিল
এদিকে রহিমা চা নিয়ে এসে পর্দার ফাঁক দিয়ে ওদের অবস্থা দেখে অনেক কিছু বুঝে নিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ওদেরকে বাস্তবে ফিরতে দেখল না তখন বলল, লাইলী চা নিয়ে যাও
লাইলী ভাবির গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সেলিমের দিকে তাকাতে আবার চোখাচোখি হয়ে গেল। লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, কই নিন, নাস্তা খেয়ে নিন। আমি ততক্ষণে চা নিয়ে আসি বলে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে সে ভাবিকে চায়ের কাপ কেতলী হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল
রহিমা দুষ্টমীভরা হাসি দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, এতক্ষণ ধরে বুঝি কেউ কাউকে দেখে? এই নাও কাপ, আমি চা গরম করে আনি। অল্প চা কি আর এতক্ষণ গরম থাকে?
লাইলী কাপ কেতলী তার হাত থেকে নিয়ে আমি গরম করে আনছি বলে রান্না ঘরের উদ্দশ্যে চলে গেল। চা গরম করে একটু পরে ফিরে এসে দেখল, সেলিম নাস্তার পেটের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। বলল, আপনি এখনও কিছু মুখে দেন নি?
সেলিম এতক্ষণ যেন বাস্তবে ছিল না। লাইলীর গলার শব্দ পেয়ে নড়ে চড়ে বসে বলল, আপনি কী যেন বলছিলেন?
বলছিলাম, এখনও নাস্তা খাননি কেন? একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে সেলিম বলল, আপনি মনে হয় আমার সঙ্গে খাবেন না
লাইলী বলল, কিছু প্রশ্নের উত্তর অনেক সময় দেওয়া যায় না। সেলিমকে চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াতে দেখে বলল, সে কি? আপনি যে কিছুই খেলেন না?
সেলিম বলল, এবার আমিও আপনার ভাষার বলি, খেতে পারলেও অনেক সময় বেশি খাওয়া যায় না
তার কথা শুনে লাইলী ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, ঐসব কথা শুনব না, আপনাকে সব খেতে হবে
সেলিম তার হাসিমাখা মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আপনাকে দেখলে আমার ভুখ পিয়াস থাকে না। অভুক্ত অবস্থায় কী কিছু খাওয়া যায়? আপনিই বলুন?
উত্তরটাও এখন দিতে পারলাম না, দুঃখিত। যদি কোনোদিন সময় আসে তখন বলব। তারপর চায়ের কাপটা তার হাতে দিয়ে বলল, একটা কথা বলব, রাখবেন?
বলুন, রাখবার হলে নিশ্চয় রাখব
আম্বা ভাইয়া বাড়িতে নেই, যদি অনুগ্রহ করে সামনের ছুটির দিনে সকালের দিকে আসেন, তা হলে ওঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম
আসবার চেষ্টা করব, কিন্তু ভুলে গেলে মাফ করে দিতে হবে। ছুটির দিন আসতে এখনও পাঁচদিন বাকি। তবে, আপনি যদি ভার্সিটিতে আগের দিন মনে করিয়ে দেন, তা হলে পাকা কথা বলতে পারি। আপনার বাবা আর ভাইয়া বুঝি আপনাকে খুঁজতে গেছেন?
জ্বি
এখন তা হলে আসি? আপনার মা কী আমার সামনে আসবেন না?
একটু বসুন, এক্ষুণি আসছি বলে লাইলী চলে গেল। অল্পক্ষণ পরে একটা কাগজে সোহানা বেগমের জামা-কাপড় মুড়ে এনে টেবিল রেখে বলল, দয়া করে এটা নিয়ে যাবেন
এতে কি আছে
আমি আপনাদের বাড়ি থেকে যেগুলো পরে এসেছিলাম
আপনার মা বুঝি আসবেন না? লাইলী কিছু বলার আগে হামিদা বানু দরজার বাইরে থেকে বলে উঠলেন, আল্লাহপাকের দরবারে আপনার জন্য দোয়া করছি বাবা, তিনি যেন আপনাকে সহিসালামতে রাখেন, সব সময় সৎপথে চালিত করেন, সুখী করেন। আপনি আমার মেয়েকে গুন্ডাদের হাত থেকে রক্ষা করে তার জান ইজ্জৎ বাঁচিয়েছেন। সে জন্য আপনার কাছে আমরা চিরকাল ঋণী থাকব। একদিন এসে ওর আর ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। আমরা আরও খুশি হব। আজকের আবহাওয়া খারাপ তাই বেশিক্ষণ আপনাকে আটকে রাখতে চাই না। আর একদিন আসবেন, বলে চুপ করে গেলেন
সেলিম বলল, আপনার কথা রাখার চেষ্টা করব। তারপর লাইলীর দিকে তাকিয়ে বলল, আসি
লাইলী অনুচ্চস্বরে সালাম দিয়ে বলল, আল্লাহ হাফেজ
নিজের অজান্তে জীবনের এই প্রথম সেলিমের মুখ দিয়ে বেরল আল্লাহ হাফেজ
লাইলী গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কাপড়ের প্যাকেটটা যে টেবিলের উপর রয়ে গেল, বিদায় মুহূর্তে সেদিকে কারুর খেয়াল রইল না। সেলিম গাড়িতে উঠতে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল
গাড়ি বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হতে লাইলী গেট বন্ধ করে ফিরে এল
তাকে দেখতে পেয়ে রহিমা ঘর থেকে ডাক দিল, একটু শুনে যাও মিস লাইলী আরজুমান বানু
রহিমা যখন তার সঙ্গে রসিকতা করার ইচ্ছা করে তখন তাকে তার পুরা নাম ধরে ডাকে। তাই নামে ডাকতেই শুনেই লাইলী ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারল। সেও কম যায় না, জবাব দিল, পরে, এখন বাথরুমে যাব বলে তাড়াতাড়ী করে উপরে উঠে গেল
রাত্রি দশটায় নিরাশ হয়ে রহমান সাহেব জলিল সাহেব ফিরে এসে সবকিছু শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করে সবাই দুরাকাত শোকরানার নামায আদায় করলেন

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.