গলাকাটা লাশ_খলিল ইমতিয়াজ
ফজরের আজান হয়ে গেছে। আকাশে তেমন মেঘ নেই। ছেঁড়া-ফাঁড়া মেঘের ফাঁক গলিয়ে ভোরের আলো চক চক করছে।
সারারাত যে রকম বৃষ্টির প্রতাপ ছিল তার চিহ্ন ফুটে আছে আশেপাশে ডোবা খানাখন্দে। ঘোলাপানি টইটই করছে।
এরই মধ্যে চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব বলেছেন এ সময়ে চারদিকে বেহেশতের হাওয়া বয়।
লোকজন নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হচ্ছে।
সকালের আবহাওয়া বেশ গুমোট। কারণ এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও রাতে যে বাইরে কেউ থাকতে পারে এটা অনেকেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।
অথচ ঘটনা এখানেই। ভোর বেলা রফিক প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য রেলের ব্রিজের নিচে যায়। অন্যান্য দিনের মত নির্বিঘ্নে শুভকাজটা সারার জন্য প্রস্তুত হতেই আচমকা তার চোখে পড়ে ফ্যাকাশে কিছু একটার ওপর। গলাকাটা লাশ! ভয়ে সে চিৎকার করে ওঠে।
সারারাতের বৃষ্টিতে ভিজে রক্ত ধুয়ে মুছে লাশটা ফ্যাকাশে হয়ে ফুলে গেছে। মাথাটা কারা যেন কেটে নিয়ে গেছে।
হাওয়ার তোড়ে কথাটা এককান দু'কান করে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ ছুটে যায় রফিকের কাছে আদ্যোপান্ত শোনার জন্য। আবার কেউ কেউ ছোটে থানায়।
যেহেতু রফিকই প্রথম দেখেছে লাশটা তাই ভয় পেলেও সে বিরাট একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে।
ছোট বেলায় যখন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ঘটনা মনে পড়ে। রাতে ঘুমের ঘোরে কত আমেরিকা যে আবিষ্কার করেছে। কিন্তু সকাল হলেই টের পেত তার আবিষ্কৃত আমেরিকা হল চৌকি থেকে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে শুয়ে থাকা।
মসজিদের মুসল্লিরা বিভিন্নজন বিভিন্ন মন্তব্য করতে করতে লাশ দেখার জন্য যায়। মহিলাদের একটা অংশ সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে জটলা করে দেখছে এবং যারা আসতে পারেনি তাদেরকে সকৌতুকে বলার জন্য মনে মনে ঘটনাটা গুছিয়ে নেয়।
কেউবা আবার আহাজারি করতে থাকে- কার বুকের ধন গো....। না জানি তার বাবা-মার এখন কী অবস্থা!
সাংবাদিক এলো, ছবি তুললো, নানারকম প্রশ্ন করলো। রফিক মিয়াকে প্রশ্ন করলে সে সদম্ভে সব ঘটনা বললো। তার খুব খুশি খুশি লাগছে এই ভেবে যে, তার ছবি হয়তো পত্রিকায় ছাপবে। এমনও হতে পারে তাকে টেলিভিশনেও দেখাতে পারে।
খয়বর শেখ মসজিদের মোয়াজ্জিন। তিনি দোয়া দরূদ পড়তে পড়তে এলেন। লাশ দেখে তিনি আরেকবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করলেন। স্বগতভাবে তার মুখ দিয়ে বের হল- ছেলেটার বয়স বেশি হবে না। আল্লাহ-তালা আলিমুল গায়েব। কার মৃত্যু কোথায় তিনিই ভাল জানেন।
অনেকে বলাবলি করছে- এটা কি ছেলে নাকি মেয়ে? আজকাল তো মেয়েরাও ছেলেদের পোষাক পড়ে। শহরে দেখোনা!
বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য। গাঁয়ের মাতবর ইসহাক ব্যাপারী হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলেন। সদরের নেতাদের সাথে তার আবার উঠাবসা আছে।
গত বছর চেয়ারম্যানি ভোটে অল্প ভোটে হেরে গেছেন তিনি। লোকজন শ্রদ্ধায় নাকি সহানুভূতিতে জায়গা করে দিল বোঝা গেল না।
ব্যাপারী সাহেব এসেই খুব সূক্ষ্মভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাশ দেখলেন। কেউ একজন কানে কানে তাকে কী যেন বললো। তিনি লাশের ময়লা ভরা দামি কোর্তা নেড়ে চেড়ে বার বার দেখলেন।
হঠাৎ চমকে উঠেন লাশের ডান হাতের দিকে চেয়ে। তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল নেই লাশের হাতে। কারা যেন কেটে ফেলেছে। এই কথা শুনে উপস্থিত দর্শকেরা আরেকবার কেঁপে উঠল।
শহীদ ছেলেটা বয়সে তরুণ। বুকে ভয় ডর বলতে কিছু নেই। সে তাড়াতাড়ি করে লাশের গায়ের জামার বোতাম খুলে ফেলল। লোমশ বুকে অসংখ্য দাগ। সারা গা ফুলে গেছে। কাঁধের নিচে একটা কালো দাগ।
ব্যাপারী শহীদের দিকে দৃষ্টি দিতেই শহীদ বলে ফেলল- ব্যাপারী চাচা, আমার মনে হয় এ আমাদের আকু। ওর ঘাড়েও একটা কালো দাগ দেখেছি আমি।
ব্যাপারী সাহেব সব কিছু বুঝেছেন এমন একটা ভঙ্গিতে কঠিন সুরে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন - আমি সব বুঝেছি। আবারো আমাদের কে নির্বাচনে হারানোর জন্য কেউ আকুকে মেরেছে। ভাইসব, সামনের নির্বাচনে আমাদের জয় নিশ্চিত দেখে আমাদের প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আকু আমাদের একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিল। আমরা আকু হত্যার বিচার চাই।
সমস্বরে লোকজন সায় দিল।
এই সময়ে কেউ একজন ব্যাপারীর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল-চাচা, আকু মরে নাই। আমাদের আকু বেঁচে আছে, এ অন্য কেউ হবে। ব্যাপারী বিষয়টা বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে কিছু আর বলতে পারল না।
তবু গলায় জোর টেনে বলল- আকু না হলেও সে আমাদেরই কেউ। আমরা এর একটা বিহিত চাই।
যেহেতু নির্বাচনের আর বেশিদিন বাকি নাই। কদমগাছার মানুষ একটা গণ্ডগোলের আঁচ পেল।
পরদিন সকালবেলা চায়ের দোকানে তুমুল কথাবার্তা। নিহতের লাশ নিয়ে বেসামাল যুক্তি-তর্ক। একজন ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল- আরে পুলিশ তো লাশ নিয়ে গেছে। দেইখো তোমরা, দুইদিন পর সব গুজব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
আরেকজন টেবিল থাপড়ে বলল- আরে মিয়া তোমার দেখি মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে। যেনতেন দলের লোক মরে নাই। বিহিত না হয়ে যাবে কই। শোনো নাই ব্যাপারী সেদিন কি কইলো!
কদমগাছার দক্ষিণ বিলে আমন ক্ষেতের ভেতরে মানুষের বিচ্ছিন্ন মাথা পাওয়া গেছে। চোখ-মুখ বিকৃত, ফোলা। আজরাইল যেন জান কবচের সময় খুব কুদাকুদি করেছে।
কাটা মাথা দেখেছে মনার বাপ। রাতে জাল পেতেছিল আমন ক্ষতের আইলে। যদিও বুক ধুকপুক করছিল। কিন্তু মাছের নেশা বড় নেশা।
ছোটবেলা থেকেই মনার বাপের মাছ ধরার প্রতি প্রবল ঝোঁক। এমনকি মাছ মেরে মেরে নিজের পড়াশোনা করার ইচ্ছেটাকেও মেরে ফেলেছিল।
মনার বাপ প্রতিদিন সকালে জাল তুলতে যান। আজও সেরকম।
গতদিনের মরা লাশের বিষয়টা মনের ভেতর থাকলেও সেটা কিছু না। মাথায় গামছা বাঁধা। ঠোঁটের কোণে একটা জ্বলন্ত বিড়ির মোথা। জালের দশ-বারো হাতের মতো তুলে ধানের গাছের ভেতর। ওটা কী যেন গোল মানুষের মাথার মতো! মনার বাপ ভয়ে জমে যায়।
কালকের ঘটনাটা মনে করে তার ভয় আরেক দফা বেড়ে যায়। প্রথমে মুখ দিয়ে কথা বের হয়নি। ডান পা টা কাদায় ডুবে গেছে। দেহের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে একটা চিৎকার দিল।
গতদিনের মতো আজও শুধু কাটা মাথা দেখার জন্য লোকজন জড়ো হয়েছে। রহস্য মানুষের মনে কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়।
কৌতুহলকে মানুষ দাবিয়ে রাখতে পারেনা। কাটা মাথাটার মুখটাকে চেনা যায় না। ছেলেটার মন্দভাগ্য। রাত দুপুরে বেঘোরে মারা গেল। যেন তেনভাবে নয়, একেবারে মাথাটাকে দেহ থেকে আলাদা করে ফেলল। মাথা এক মুলুকে আর দেহ আরেক মুলুকে।
সাথে সাথে পুলিশ এলো। সাথে অল্পবয়স্ক গোছের ওসি সাহেব এলেন। ওসি সাহেব মনার বাপকে জেরা করলেন। মনার বাপ ভয়ে ভয়ে হলেও সত্য কথাটা বলে পুলিশের জেরা থেকে মুক্তি পেলেন।
ব্যাপারী সাহেব ওসি সাহেবকে বললেন- ওরা জানবে কী? ওরা তো আর মিছিল-মিটিংয়ে থাকে না। মার্কা নিয়া চিল্লাচিল্লি করেনা। আমি জানি কারা মারছে আকুকে।
চেয়ারম্যান ওসি সাহেবের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ঘন্টা খানেক পরে দলবল নিয়ে চলে যায়।
তারপর জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন- ভাইসব, আপনারা ঐ খুনি সিরাজ মাস্টারকে ভোট দেবেন না। সে একটা নিরীহ ছেলেকে বিনাদোষে খুন করেছে। এরা দেশ ও জাতির দুশমন। আপনারা এই অধমের কথা একটু মনে রাখবেন।
বামদিক থেকে একটা মিছিল এলো- আকু ভাইয়ের হত্যাকারীর বিচার চাই, বিচার চাই ।
ওসি সাহেব ব্যাপারীর প্রতি ঝুঁকে কানে কানে কী যেন বললেন। ব্যাপারী বুঝতে পারলেন।
আবেগ আপ্লুত হাসিতে তার মুখ মণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
পুলিশের দল ব্যাপারীর বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে চলে গেলেন। গ্রামে আরেকবার স্বস্তি ফিরে এলো।
পত্রিকায় লাশের ছবিসহ সংবাদ ছাপলো- 'কদমগাছায় গলাকাটা লাশ উদ্ধার'।
মামলা হয়েছে পাল্টাপাল্টি। দুই পক্ষই পুলিশের সমাদর করল নিখুঁতভাবে।
নানাকথার গুঞ্জনে চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠে আর কথার মাঝে মিশে যায়।
যতদিন যায় গুঞ্জনও কমে যায়। পুরনো কথা যেমন শুনতে বিরক্ত লাগে তেমনি বিতৃষ্ণা আর দৈনন্দিন ব্যস্ততার চাপে চাপা পড়ে যায় আকুমিয়ার খুনের রহস্য।
রফিক মিয়ার মনে দাগ কেটে থাকে ঘটনাটা। মুণ্ডুহীন লাশ শুধু তার চোখের সামনে ভাসে। অন্য সবাই ভুলে গেলেও রফিক ভুলতে পারেনা। ওর মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে-রাজনৈতিক মরার কী আর খোঁজ থাকে। তা আবার গরীব মানুষের পোলাপাইন হইলে তো কথাই নাই।
নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। আকু মিয়ার জায়গায় অন্য আরেকজন মিছিল করে। দিনের সূর্য প্রতিদিনের মতো সকালে ওঠে বিকেলে অস্ত যায়। শুধু পরিচিত জনের বুক চিড়ে বের হয় একটা পঁচা বাসি দীর্ঘশ্বাস।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments