আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৩৯

 

ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস

বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার


পঞ্চপ্রশতম রজনী।
আবার গল্প শুরু হলো :
মাসুরা বললো, আপনি উপযুক্ত কথাই বলেছেন, রাজকুমারী। বীর বীরের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লড়বো। আমি সেনা দলের প্রধান, আমিই প্রথমে লড়তে চাই।
ইরবিজা সতর্ক করে দেয়, কিন্তু তোমার পিছনে ধারা আছে তাদের সবাইকে জানিয়ে দাও আমার শর্তের কথা। মনে রেখো, তোমাদের কেউ যদি এই শর্ত ভঙ্গ করে আমি আমার মেহেমানকে রক্ষা করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করবো।
মাসুরা বলে, আপনার শর্তে আমরা রাজি, রাজকুমারী।
ইরবিজা একটু হাসলো, বললো, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত ছিলো, মাসুরা। এক নিরস্ত্ব যুবককে বন্দী করতে একশোজন-এর এক বাহিনী আনতে হয়েছে? ছিছি, কি লজ্জা।
ইরবিজা থামের পাশে গিয়ে সারকানকে তার প্রস্তাব জানালো। সারকান বললো, কিন্তু সুন্দরী, একজনের সঙ্গে লড়াই করা আমাদের রীতি বিরুদ্ধ। এক সাথে অন্তত জনাদশেক লডিয়ে না পেলে হাতের সুখ হয় না। যাইহোক, তুমি যখন প্রস্তাব দিয়েছে, তাই হবে।
এই বলে সে ঢাল তলোয়ার হাতে হারদুবের প্রধান সেনাপতির দিকে রুখে আসে। সারকানের প্রথম ঘা সে সামলে নিয়ে বসে পড়ে। মাথার উপর দিয়ে তলোয়ারখানা বেঁা করে ঘুরে আসে। এবার সারকান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।ক্ষিপ্রগতিতে আবার এক কোপ মারে। এবারে আর মাসুরা এড়াতে পারে না। ধড় আর মুণ্ডু আলাদা হয়ে যায়। প্রচণ্ড এক আর্তনাদ করে মাসুরার ধড়টা মেজের উপরে লুটিয়ে পড়ে।
ইরবিজা সারকানের এই বিক্রম দেখে মুগ্ধ হয়। লোক মুখে তার শৌর্য বীরত্বের অনেক গল্প গাথাই সে শুনেছিলো, মনে মনে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতো তাকে। কিন্তু আজ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে সে-শ্রদ্ধা সহস্বগুণ বেড়ে গেলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, কি তার স্পর্ধা, এই মানুষটাকে কাল সে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেছিলো? এবার ইরবিজা চিৎকার করে ওঠে, কই আর কে আছো, এগিয়ে এসো।
মাসুরার এক ভাই আসে। দৈত্যের মতো চেহারা। দাঁত কড়মড় করতে থাকে। একমুহূর্ত। সাঁই করে চালিয়ে দেয় তলোয়ার। কিন্তু সারকানের এক স্বা, ঘায়ে তার হাতের বঁটি হাতেই ধরা রইলো দ্বিখণ্ডিত তলোয়ার-এর টুকরো নিচে পড়ে গেলো। সারকানএক কোপেই শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু নিরস্তুকে আঘাত করা তার ধর্ম নয়। বললো, ওকে একখানা তলোয়ার দাও।
ইরবিজা অবাক হয়। দেওয়ালে টাঙানো একখানা তলোয়ার খুলে এনে মাসুরার ভাই-এর হাতে দেয়। কিন্তু তাক বুঝে একটা কোপ মারতে যায়। কিন্তু তার আগে সারকগনের তলোয়ার প্রচণ্ড বেগে গেঁথে যায়। তার তলপেটে।
এইভাবে একের পর এক আসে। আর সারকানের এক এক কোপে খতম হতে থাকে। এইভাবে জনা পঞ্চশ শেষ হয়ে গেলো। এবার আর কেউ শর্তের কথা মানলো না। সারকানকে খতম করতে এক সঙ্গে বাকী সবাই বাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সারকানের বিক্রমের কাছে ইহা তুচ্ছ। সব কচুকাটা করে শেষ করে দিলো।
বাঁদীরা বললো, না, মালকিন আর কেউ নাই। সব শেষে গুণে দেখা গেলো মোট আশীট লাশ। বাকী জনা কুড়ি আহত হয়ে চৌ-দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেছে।
সারকান তলোয়ারের রক্ত পুছে নামিয়ে রাখলো। ইরবিজা এসে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে সারকানের অধরে ছোট্ট একটি চুম্বন একে দেয়। তারপর ওর হাত ধরে ঘরের মাঝখানে এনে দাঁড় করায়। নিজের গায়ের শালখানা খুলে বাদীর হাতে দেয়। সারকান দেখে অবাক হয়, ইরবিজ, রাণ-সাজে সজিতা। কোমরে ঝোলানো তরবারীখানা দেখিয়ে বলে, একেবারে খাঁটি ভারতীয় ইস্পাতে তৈরি। তুমি যখন লড়াই করছে, আমি পাশের ঘরে গিয়ে নিজেকে তৈরি করে এলাম। যদি তোমার কোন সাহায্য দরকার হয়। তা তুমি তো একাই একশো। তোমার আবার সাহায্য দরকার হবে কিসে!
এরপর দুর্গ প্রাকারের দ্বার-রক্ষীদের ডেকে ইরবিজা কৈফিয়ৎ তলব করে, আমার হুকুম ছাড়া অন্য লোককে ঢুকতে দিয়েছিলে কেন?
দ্বার-রক্ষীরা জবাব দেয়, সম্রাটের প্রধান সেনাপতিকে বাধা দেবার সাহস পাবো কি করে? সম্রাট যেখানে নিজে তাদের পাঠিয়েছেন, আমরা কি করতে পারি? আপনি আমাদের মালকিন ঠিক; কিন্তু আপনার ওপরে তো তিনি।
ইরবিজা দ্বার-রক্ষীদের এই উদ্ধত জবাবে ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, কার ওপরে কে, আমি দেখাচ্ছি।
সারকানকে বললো, এই অবাধ্য প্রহরীদের কোনও প্রয়োজন নাই। ওদের তুমি খতম করো।
সারকগনের তলোয়ারের কোপে তারা ধরাশায়ী হয়।
ইরবিজা বলে, এবার তোমাকে আমার নিজের কথা শোনাবো। আমার নাম ইরবিজা সে তো তুমি শুনেছো। আমার বাবা সিসারিয়া সম্রাট হারদুব। আর যে ধূমসো বুড়িটা- হচ্ছে আমার বাবার পুরোনো বাঁদী। একসময় বাবার খুব অসুখ হয়েছিলো, সেই সময় ওর সেবাযত্নে বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই থেকে সে বাবার নেক-নজরে আসে। এই দুর্গের দেখাশুনার কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় তার উপর। কিন্তু আমার সঙ্গে তার কোন দিনও বনিবনাও ছিলো না। আজকের এই ঘটনা সে বাবার কাছে চতুগুণ করে লাগাবে, আমি জানি। বাবার মনটা বিষিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। হয়তো বলবে, আমি খ্ৰীষ্টান ধর্ম পরিত্যাগ করে মুসলমান হয়ে গেছি। এখন আমার একমাত্র রক্ষণ আমি যদি দেশের বাড়িতে চলে যাই। ব্যাপারে তোমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।
সারকান ভাবে, এই মেয়েটির দৌলতেই আজ সে এতটা বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। তার নিজের বিপদ জেনেও তাকে বাঁচাবার জন্যে এগিয়ে এসেছে। এখন তার কর্তব্য তাকে রক্ষা করা। সারকান বলে, আমার ধড়ে যতক্ষণ প্ৰাণ আছে, তোমার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না, ইরবিজা। কিন্তু তুমি কি তোমার বাবার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে চাও?
ইরবিজা বলে, এখন তা ছাড়া আর কোনও পথ নাই, সারকান। কারণ এর পরিণাম যা ঘটতে পারে, আমি অনুমান করতে পারি। আমার বাবাকে আমি জানি, তার ক্ৰোধ বড় মারাত্মক। সেখানে সন্তান-স্নেহ তুচ্ছ। তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে, আশা করি আমার অবস্থা বিবেচনা করে কথাটা তুমি শুনবে।
সারকগন বলে, কি কথা বলো, তোমার কথা না শোনার মতো স্পর্ধা আমার নাই, ইরবিজা।
তুমি আমার কথা শোনো, তোমার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বাগদাদে ফিরে যাও।
কিন্তু ইরবিজ, আমার বাবা উমর-আল-নুমান আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার বাবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কনসাঁতানতিনোপল-এর সম্রাট আফ্রিাদুন আমার বাবার সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। তোমার বাবা সম্রাট হারদুব তীর জাহাজ আক্রমণ করে সব লুঠপাঠ করে নিয়ে যান। সেই জাহাজে অনেক ধনরত্ন বোঝাই ছিলো। এবং তার মধ্যে ছিলো অলৌকিক দৈব-শক্তি সম্পন্ন তিনখানা পাথর।
ইরবিজা বাধা দিয়ে বলে, তাহলে আসল ব্যাপারটা খুলে বলি শোনো। তোমরা তো একতরফাই শুনেছো। এবার আমার কথা শুনলে, সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রতি বছর বড়দিনের সময় আমাদের-খ্ৰীষ্টানদের বিরাট উৎসব হয়। আমরা এই দুর্গে ফি বছর বছরের শেষ সাতটা দিন খুব জাঁকজমক করে আনন্দ উৎসব পালন করে থাকি। নানা দেশের সম্রাটদের নিমন্ত্রণ করা হয়। সপরিবারে তঁরা আসেন। খুব হৈ-হল্লা, আমোদ প্রমোদ করে তারা আবার দেশে ফিরে যান। একবার এই উৎসবে সম্রাট আফ্রিাদুন তার কন্যা সফিয়াকে উপহার স্বরূপ আমার বাবার হাতে সমর্পণ করে যান। তুমি নিশ্চয়ই জানো, সেই সফিয়া এখন তোমার বাবার অন্যতম রক্ষিতা হয়ে বাগদাদের প্রাসাদে রয়েছে। এবং সম্প্রতি সে একটি সন্তানের জননী হয়েছে।
আমার বাবার সঙ্গে তখন তোমার বাবার খুব সদ্ভাব ছিলো। তিনি সফিয়াসহ আর পাঁচটি সুন্দরী গ্ৰীক কুমারীকে উপহার হিসাবে পাঠিয়েছিলেন তোমার বাবার কাছে। সেই থেকে সে তোমার বাবার প্রাসাদেই আছে।
কিন্তু এদিকে বিপত্তি ঘটে। সম্রাট আফ্রিাদুন ভাবলেন, আমার বাবার্তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে তার কন্যাকে অন্যত্র চালান করে দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই দারুণ অপমান করে বাবাকে পত্র দিলেন তিনি। চিঠিখানার বয়ান মোটামুটি এই রকম :
বছর দুই আগে তোমার হাতে আমার কন্যা সফিয়াকে সমর্পণ করে এসেছিলাম। আমার আশা ছিলো, যথাযোগ্য রাজসিক মর্যাদায় সে তোমার কাছে থাকবে। কিন্তু সম্প্রতি খবর পেলাম, তুমি আমার উপহারের প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ করেছে। এখন সে তোমার কাছে নাই। এক স্লেচ্ছ যবন সুলতানের হারেমে সে এখন নগণ্য বাঁদী। আমি মনে করি, তোমার ঔদ্ধত্য। এবং আমাকে অপমান করার কৌশল মাত্র। আমার পত্র পাওয়া মাত্র আমার কন্যা সফিয়াকে সসম্মানে আমার রাজধানীতে ফেরৎ দিয়ে যাবে। নচেৎ সমুচিত শাস্তি পেতে হবে। আমার এই পত্রের জবাব যদি না দাও, তার পরিণাম আরও খারাপ হবে।
চিঠি পড়ার পর বাবা চিন্তিত হলেন। অহেতুক যুদ্ধ-বিগ্রহ তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু তাই বলে, হত-বীৰ্য, কাপুরুষ তিনি নন। বাবা দেখলেন, ক্ষেত্রে আফ্রিাদুনের সঙ্গে কলহ এড়ানো কঠিন। কারণ সফিয়াকে এখন ফেরৎ আনা সম্ভব নয়। সে সম্প্রতি উমর-আল-নুমানের সন্তানের জননী হয়েছে।
আমার বাবা বুঝলেন, ঝামেলা এড়ানো শক্ত। তবু শেষ চেষ্টা করলেন। আফ্রিাদুনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে চিঠি দিলেন। লিখলেন : সফিয়াকে তিনি ইচ্ছে করে সেখানে পাঠাননি। বাগদাদসুলতানকে উপহার পাঠানো হয়েছিলো, পাঁচটি সুন্দরী কুমারী কন্যা। তাদের মধ্যে সফিয়া ভুল করে চলে গেছে। এটা কোনও ইচ্ছাকৃত ব্যাপার নয়। তবুও তাকে ফেরৎ হয়তো আনা যেতো, কিন্তু এখন সে উমর-আল-নুমানের সস্তানের জননী হয়েছে, আর তা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আফ্রিাদুন যেন ব্যাপারটাকে অহেতুক জটিল না করে সহজ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেন।
কিন্তু এর ফলে আফ্রিাদুন শান্ত তো হলেনই না, বরং আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, কী, এত বড় স্পর্ধা, আমার মেয়ে মুসলমানের হারেমে তিনশো ষাটজনের একজন হয়ে পাশবিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। আমার বাবার উপর প্রতিশোধ নেবার পায়তারা ভাজতে লাগলেন। কিন্তু নামে সম্রাট হলে হবে কি, তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। না আছে ধনদৌলতের জোর, না আছে সেনা বল। অথচ ফুকো-আভিজাত্য আর দম্ভ আছে। ষোল আনা। যাদের ভেতরটা ফাঁপা, অথচ বড়ফট্টই বেশী তারা কিন্তু শয়তানের জাসু হয়। যত সব বন্দবুদ্ধির প্যাঁচ মাথায় ঘুরতে থাকে। আফ্রিাদুন ফন্দী করলেন, কীটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। তাই তিনি নানারকম উপহার উপটৌকনের ঘুষ পাঠালেন। আপনার বাবার কাছে। আর সেই সঙ্গে বলে পাঠালেন এক আষাঢ়ে গল্প, তার তিনখানা ধনদৌলতে ঠাসা জাহাজ নাকি আমার বাবা লুঠপাঠ করে নিয়ে গেছেন। এবং তার হাজার হাজার সৈন্যসামন্ত মেরে শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু আফ্রিাদুনের রাজত্বের হাল যাদের জানা আছে তারা একথা কি করে বিশ্বাস করবে। তার এমন কোনও ধনদৌলত নাই যা একটা জাহাজও বোঝাই হতে পারে। আর হাজার হাজার সৈন্য? সে তো তার স্বপ্ন লোকের কল্পনা। তার গোটা রাজ্যের সৈন্যসংখ্যা সাকুল্যে হাজারখানেক হবে কিনা সন্দেহ। তার মধ্যে হাজার সৈন্য যদি মারাই গিয়ে থাকে। তবে নিজের সুরক্ষা ঠিক রাখবে কি করে?
তোমার বাবা অত ঘোর প্যাচের মানুষ নন। তিনি আফ্রিাদুনের এই চাল বুঝতে পারেননি। ভেবেছেন, বিপদের সময় সাহায্য চাইলে এগিয়ে যাওয়াই বীরের ধর্ম। কিন্তু বীরত্ব আর রাজনীতি তো এক বস্তু নয়, সারকান। তোমার বাবা বিশ্ববিজেতা যোদ্ধা। রাজ্য জয় করতে গেলে বীরত্ব বিক্রমই প্রধান, কিন্তু রাজ্য পরিচালনা করতে গেলে রাজনীতিজ্ঞ হতে হবে।
আফ্রিদুন তোমার দশ হাজার সৈন্য এনে ফেলেছে তার কোজায়। এমন ফাঁদে তোমাকে তিনি ফেলবেন, তুমি আর বেরুতে পারবে না। জানো তো বুদ্ধির বলের কাছে দেহের বল তুচ্ছ। আবার সে বুদ্ধি যদি শয়তানের বুদ্ধি হয়। কি ভাবে কেমন করে তোমার সব সৈন্য তিনি রাতারাতি খতম করে দেবেন, তুমি টেরও পাবে না।
তুমি বলছিলে না? তিনটি দৈব শক্তিসম্পন্ন গ্বহরত্ন ছিলো সেই জাহাজে? আসলে গ্বহরত্ন তিনটি তার কন্যা সফিয়ার কাছেই ছিলো। গ্ৰীসে যাওয়ার পর সেগুলো সে আমার বাবার হাতে তুলে দেয়। সত্যিই, অবাক হতে হয়, পাথর তিনটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে। ধারণ করলে দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হতে পারে। বাবার অলক্ষ্যে আমি পাথরগুলো চুরি করে নিয়েছি। সময় মতো তোমাকে দেখাবো একদিন। সে যাকগে, তুমি আর এক মুহূর্ত দেরি করো না। ছাউনিতে ফিরে যাও। সৈন্যসামন্ত নিয়ে বাগদাদের পথে রওনা হয়ে পড়ে।
সারকান বলে, তুমি আমার চোখ খুলে দিলে, ইরবিজা। আমি আর কাল-বিলম্ব করতে চাই না। তোমার এই মূল্যবান উপদেশ না পেলে কী সর্বনাশই যে ঘটতো, ভাবতে শিউড়ে উঠছি। কিন্তু সুন্দরী, তোমাকে এখানে ফেলে রেখে কিছুতেই যাবো না আমি। আজ যা ঘটে গেছে তার পরিণতি বড়ই মারাত্মক। তোমাকে এখানে রেখে গেলে আর আস্ত রাখবে না তোমার বাবা। তুমিও আমার সঙ্গে চলো। আজই আমরা বাগদাদে রওনা হয়ে যাই।
ইরবিজা এক মুহূর্ত কি ভাবলো।ঠিক আছে, তুমি তোমার ছাউনি গোটাতে থাকে। লোকলস্কর রওনা করে দাও। আমি তিনদিনের মধ্যেই তোমার কাছে যাচ্ছি। তারপর দুজনে বাগদাদে রওনা হবে।
ইরবিজ, সারকানের বুকে মাথা রেখে কীদলো। সারকানের চোখেও জল আসে। বাদী ঘোড়া এনে দেয়। সারকানকে। বিদায় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিছু দূরে যেতেই সারকান দেখে, তিনজন ঘোড়সওয়ার তার দিকে ছুটে আসছে। শত্রুর আক্বমণ আশঙ্কায় সে তলোয়ার খুলে বাগিয়ে ধরে। কিন্তু না, কাছে আসতে দেখা গেলো, তার উজির দানদান আর দুই বিশ্বস্ত আমীর। যথারীতি আদব কায়দা দেখিয়ে তারা কাছে এসে দাঁড়ালো। উজির দানাদান বললে, কী ব্যাপার। আজ তিনদিন ধরে তোমার কোনও খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা তো দুশ্চিন্তায় ভেবে ভেবে সারা হচ্ছি। না জানি কী বিপদ হলো। সৈন্যদের মধ্যেও দারুণ আতঙ্ক। তারা বুঝতে পারছে না, তোমার কী হলো।
সারকান তখন আফ্রিাদুনের ষড়যন্ত্রের কাহিনী বললো। আফ্রিাদুন ফাদ পেতেছে। উদ্দেশ্য, তার সৈন্যবাহিনী সাবাড়ি করা। এই সময়ে ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে আসা ঠিক হয়নি। সারকান ঐটা বলে, আর দেরি নয়, এখুনি আমাদের ছাউনিতে পৌঁছতে হবে।
তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে তারা ছাউনিতে এসে পৌছয়। না, সব ঠিকই আছে। কোনও বিপদ আপদ ঘটেনি। সারকগনের হুকুমে তখুনি তাবু উঠানো হলো। উজির দানাদানকে বললে, আপনি এদের নিয়ে বাগদাদের পথে রওনা হয়ে পড়ুন। আমি এখানে আরও তিন দিন থাকবো। আমার সঙ্গে থাকবে শুধু একশোজন সেনাপতি। বাকী সব আপনি নিয়ে যান।
সৈন্যসামন্তরা খানাপিনা শেষ করে নিলো। ঘোড়া, উট, গাধা, খচ্চরদের দানাপানি খাওয়ানো হলো। তারপর মাত্র একশোজন সেনাপতি রেখে সমস্ত সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে দানদান রওনা হলো।
সারকান দাঁড়িয়ে দূরে পাহাড় শীর্ষে প্রত্যক্ষ করে শখানেক ঘোড়সওয়ার তার দিকেই ধাবমান। শত্রুশঙ্কায় সেও তার সেনাপতিদের সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলো। কাছে আসতে দেখা গেলো, সারকানের আশঙ্কা অমূলক নয়, সত্যিই একশো যোদ্ধার এক অশ্বারোহী বাহিনী। দূর থেকে হুঙ্কার ছাড়লো তারা, শোনো মুসলমানের ছেলেরা, শান্ত সুবোধ বালকের মতো তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে। না হলে, মেরী আর জোনের নাম বলছি, একেবারে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
সারকান অবাক বিস্ময়ে শোনে। ক্ৰোধে চোখ লাল হয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে। চোয়াল কঠিন হতে থাকে।-ওরে খ্ৰীষ্টানের বাচ্চা, কুকুর, তোদের এত বড় দুঃসাহস, আমারই এলাকায় এসে আমাকেই ধমকাচ্ছিস। ঘাড়ে কটা করে মাথা আছে রে? দাঁড়া এখুনি মজা টের পাইয়ে দিচ্ছি। এখনও ভালোয় ভালোয় বলছি ভালোয় ভালোয় মায়ের ছেলে মায়ের কাছে ফিরে যা। তা না হলে জন্মের সাধ মিটিয়ে দেব এখুনি।
তারপর সারকান তার সেনাপতিদের উদ্দেশ করে বলে, আল্লাহর নাম করে ঝাঁপিয়ে পড়ো। শয়তানগুলোকে সমুচিৎ শিক্ষা দিয়ে দাও।
নিমেষে দুই দলে প্রচণ্ড লড়াই বেঁধে গেলো। ঘোড়ার সঙ্গে ঘোড়ার, অসির সঙ্গে অসির, মানুষের সঙ্গে মানুষের আঘাত প্রত্যাঘাতে কেঁপে উঠলো সারা পাহাড় উপত্যকা। ধূলী বালীতে অন্ধকার হয়ে এলো চতুর্দিক। এইভাবে সন্ধ্যা নেমে আসে। অন্ধকার ছেয়ে যায়। হঠাৎ দেখা গেলো, হানাদাররা অন্তহিত হয়ে গেছে। সারকান শুনে খুশি হলো, তার দলের কেউই হতাহত হয়নি।
সারকান তার সেনাপতিদের উদ্দেশ করে বলে, বন্ধুগণ, আজ আমরা অতর্কিত আক্রান্ত হয়েছিলাম, যাক আল্লাহর দোয়ায় কারুরই তেমন কোন আঘাত লাগেনি। কিন্তু যারা এসেছিলো রাতের অন্ধকারে ফিরে গেলেও কাল সকালে যে আবার হানা দেবে না তার কোনও ভরসা নাই। সুতরাং সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। তাঁবুর বাইরে পালা করে পাহারায় থাকে। বাকী সবাই রাতের মতো ঘুমিয়ে শরীরকে চাঙ্গা করে নাও। কাল সকালে আরও বীরবিক্রমে লড়াই করতে হবে। নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা খুবই ভালো; কিন্তু তার চেয়ে আরও বেশি ভালো, শত্রুর শক্তি খাটো করে না দেখা। আমরা একশোজন, তারাও মাত্র একশোজনই ছিলো, তা সত্ত্বেও আমরা তাদের ঘায়েল করতে পারলাম না। সুতরাং মনে হচ্ছে, তারাও কিছু কম বাহাদুর নয়। যাই হোক, খানাপিনা সেরে রাতের মতো ঘুমিয়ে নাও।
এদিকে খ্ৰীষ্টান যোদ্ধারা তাদের সেনাপতিকে ঘিরে বলে, আজ তো আমরা কিছু করতে পারলাম না। মনে হচ্ছে অত সহজে ওদের কাবু করা যাবে না।
সেনাপতি বলে, ঠিক আছে, ঘাবড়াচ্ছে কেন? কাল সকালে আবার নতুন কায়দায় আক্রমণু চালাতে হবে। এখন আর নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নাই। ঘুমিয়ে পড়ো।
পরদিন সকালে সারকান সেনাপতিদের সঙ্গে নিয়ে সামনের পাহাড়ের পথে এগোতে থাকে।মনে হচ্ছে, বাছাধনরা কাহিল হয়ে পড়েছে! তা না হলে এতটা বেলা হয়ে গেলো কারো পাত্তা নাই কেন?
একজন বলে, জানের মায়া তো সকলেরই আছে, হুজুর। জেনে শুনে কে আর মাথা এগিয়ে দিতে আসে। জানে তো আজ গেলে কচু কাটা হতে হবে। কাল ওরা হঠাৎ এসে হানা মেরেছিলো, আজ তো আর তা হচ্ছে না। আমরা রীতিমতো তৈরি। আসুক না, মাথা রেখে যেতে হবে।
দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমরা বড্ডো বেশী উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। কে জানে, হয়তো ওদের অন্য কোনও প্যাঁচ আছে। তোমরা এক কাজ করো, এক এক করে এগিয়ে যাও। পাহাড়টার ওপারেই মনে হচ্ছে ওরা ডেরা গেড়েছে। একা পেয়ে হয়তো তেড়ে আসতে পারে। তখন তো আমরা পিছনেই আছি। এইভাবে ওদের ফাদে এনে ফেলতে হবে।
সারকানের নির্দেশ মতো একজন ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ের পথে উঠে যায়। চিৎকার করতে থাকে, কই হে কে আছো, নেকড়ের বাচ্চারা, বেরিয়ে এসো। তোমাদের যম হাজির।
মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো, একটা দডির ফাঁস এসে এটে গেলো তার গলায়। সারকান সেনাপতি দেখলো, অদূরে ঘোড়ার পিঠে এক বর্ম শিরস্ত্ৰাণ পরিহিত এক সুদৰ্শন যোদ্ধা। ফাসের দডিটা তার হাতের মুঠোয় ধরা। এক ঝটিকায় নিয়ে ফেলে দিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে গুহার দিকে নিয়ে চললো।
এদিকে সারকান চিন্তিত হলো। আর একজনকে হুকুম করলো, যাওদেখ, ওর কি হলো। তারও আসতে দেরি দেখে আরও একজন এগিয়ে যায়। এইভাবে সারাদিনে কুড়িজন সারকান সেনাপতি পাহাড়ের ওপারে গিয়ে আর ফিরে এলো না। সারকান অবাক হয়। কী ব্যাপার। তার সব দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। একটার পর একটা গেলো-আর ফিরলো না। দিন শেষ হয়ে এলো। এখনই রাত্রির কালো ছায়া নামবে। অবস্থায় আর এগোনো ঠিক হবে না মনে করে তাঁবুতে ফিরে আসে। ক্ৰোধে সারা শরীর জ্বলতে থাকে। মনে মনে ঠিক করে, কাল সকালে সে এর উপযুক্ত জবাব দেবে। আর অন্য কাউকে নয় নিজেই যাবে পাহাড়ের ওপারে। দেখবে কত বড় লডিয়েরা সেখানে আছে। সেনাপতিদের উদ্দেশ করে বলে, তোমরা আজকের মতো বিশ্রাম করো। ঘাবড়াবার কিছু নাই, কাল আমি নিজে লড়বো ওদের সবার সঙ্গে, দেখি কত বড় বীরপুরুষ তারা। কৈফিয়ৎ চাইবো, কেন তারা আমাদের এলাকার মধ্যে ঢুকেছে। যদি ভালোয় ভালোয় মিটিয়ে নিতে চায় ভালো, না হলে, লড়াই করার শখ ঘুচিয়ে দেব জন্মের মতো।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.