আমার মুক্তিযুদ্ধ_ইসহাক খান : পর্ব–১৫
ট্রেনিং এবং যুদ্ধ এসব যে কেবল কষ্ট দিয়েছে তা কিন্তু নয়। অনেক আনন্দ এবং মজাও দিয়েছে। তেমনি একটি মজার গল্প আপনাদের আজ শোনাবো। সেদিনের সেই মজার কাহিনী আজও মনে গেঁথে আছে। ট্রেনিংয়ে অনেক নিয়ম কানুন মানতে হয়। আমরা যারা ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ যুদ্ধে গিয়েছি তাদের এতো কিছু জানার কথা নয়। কিন্তু আমাদের ট্রেনিং হতো পুরো দস্তুর সামরিক কায়দায়। ট্রেনিংযের দুদিনের মাথায় আমাদের ওস্তাদ বললেন, ‘যাদের চুল বড় তাদের চুল ছেঁটে ফেলতে হবে।’ তিনি অবশ্য চুল বলেননি। তার ভাষায় বলেছিলেন ‘বাল’। আমাদের প্লাটুন কমান্ডার তারাভাই আমাদের বাংলায় বুঝিয়ে বললেন, ‘যাদের মাথায় লম্বা চুল আছে সেই লম্বা চুল খাটো করতে হবে। সেনাবাহিনীতে লম্বা চুল রাখা নিষেধ’। সেই লম্বা চুলের তালিকায় আমার বন্ধু আসগরও পড়ে গেল। ক্যাম্পের ভেতরে সেলুন আছে। সেখানে তাবুর ভেতর বাঁশের তৈরি মাচালে একসঙ্গে কয়েকজন বসে। আর সেনাবাহিনীর নাপিতরা একাধারে কাঁচি চালিয়ে চুল কাটতে থাকে। তাদের কাঁচি চালানো দেখলে শিউরে উঠতে হয়। কাঁচি দিয়ে চুল কাটছে না। যেন কাস্তে দিয়ে গ্যাসাং গ্যাসাং করে জমির ধান কাটছে। আমি নিজে সেলুনে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে ভয়ে বিস্ময়ে শিউড়ে উঠেছি।
সেদিন আমাদের ট্রেনিংয়ে হাঁটা প্রতিযোগিতা ছিল। অস্ত্র ট্রেনিংয়ের পর রাইফেলসহ আমাদের মাইল চারেক দূরে আরও একটি পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমাদের দৌড়ে দৌড়ে পাহাড়ে ওঠা নামা করানো হলো। ট্রেনিংটা খুব কষ্টকর ছিল। দুতিনবার ওঠার পর পা আর উঠতে চাচ্ছিল না। আমাদের সঙ্গে আমাদের ওস্তাদও ওঠা নামা করছিলেন। তাতে আমাদের সুবিধে হলো এই, উনি বয়স্ক মানুষ। আমাদের চেয়ে উনি বেশি হাঁপিয়ে গেলেন। কয়েকবার পাহাড়ে ওঠা নামার পর ছুটি মিললো। দম নিয়ে আবার শুরু হলো হাঁটা প্রতিযোগিতা। মূল ক্যাম্প থেকে যে চার মাইল হেঁটে অন্য পাহাড়ে গিয়েছিলাম, এবার সেখান থেকে হাঁটার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আমরা সবাই মোটামুটি কাছাকাছি অবস্থানে ছিলাম। আমরা অবাক হলাম, আমাদের কোম্পানি ইনচার্জ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি ক্যাপ্টেন [নাম ভুলে গেছি], মাখন মাখন চেহারার নরম নরম বাঙালি বাবুকে আমরা কেউ হারাতে পারলাম না। আস্তে আস্তে হাঁটা, চলনে বলনে বাবুয়ানা, অত্যন্ত মৃদু ভাষী ত্রিশোর্ধ্ব মানুষটি ভেতরে ভেতরে এতটা স্মার্ট আগে বোঝা যায়নি। বরং হেলাফেলার দৃষ্টিতে দেখেছি তাঁকে। কিন্তু কার্যত তিনি দেখিয়ে দিলেন, সৈনিকের জীবন কতটা দৃঢ়।
তাবুতে এসে আমি চমকে উঠলাম। অচেনা একজন আমার বিছানায় বিমর্ষ মুখে বসে আছে। কাছে গিয়ে খেয়াল করে দেখি আমার বন্ধু আসগর। আয়না হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছে। লাল রেক্সিনে মোড়ানো আয়নাটি আমার। ক্যাম্পের স্টোর থেকে কিনেছি। অভিনব আয়নাটি ভাঁজ করে পকেটে রাখা যায়।
আসগরের চেহারা চেনা যাচ্ছিল না। এমন বাটি ছাট মেরেছে মাথার চান্দিতে কিছু চুল রেখে চারপাশের বাকি চুল ঝেরে বিদায় করে দিয়েছে। তাতেই আমার বন্ধুর ভীষণ মন খারাপ। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে বললাম, ‘মন খারাপ করে আছিস কেন? কিছু হয়েছে?’ ওর চোখজোড়া জলে টলমল করছে। মাথার দিকে ইঙ্গিত করে কান্না গলায় বললো, ‘এই চেহারা নিয়ে আমি বাইরে যাবো কিভাবে?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? ক’দিন গেলেই চুল আবার আগের ফর্মে চলে আসবে। এই নিয়ে তুই এতো মন খারাপ করছিস? লোকে শুনলে কি বলবে? এই ধরনের বাটিছাট কি শুধু তোকেই দিইয়েছে? যারা-যারা চুল কাটতে গেছে সবাইকে এমন বাটিছাট দিয়েছে। এটা ওদের সিস্টেম। চল, গোসল করে আসি। ভীষণ খিধে পেয়েছে।’
তারপরও বন্ধুর মুখ থেকে কালো মেঘ সরছে না। আমার এই বন্ধুটি ভীষণ ফ্যাসন দুরস্ত। ছোটবেলায় আমরা যখন জামা বালিশ ইস্ত্রি করে পরতাম তখন সে ধোপাবাড়ি থেকে কড়া ইস্ত্রি করা জামা পরতো। অনেকেই হয়তো বালিশ ইস্ত্রি কথাটার সঙ্গে পরিচিত নন। কাপড় ভাঁজ করে বালিশের নিচে রাখলে কাপড়ের কুঁচকানো ভাবটা কিছুটা দূর হয়ে যায়। ইহারই নাম বালিশ ইস্ত্রি। সিনেমার নায়ক নাদিম স্টাইলে চুল আঁচড়ানো, চকচকে পোশাক পরা নিয়ে বন্ধুমহলে তাকে সবাই সাহেব নামে ডাকতো। ছোটবেলা থেকে বন্ধু আসগর সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করতো। সেই বন্ধুর চুলে বাটিছাট। মন খারাপ হবারই কথা। তারউপর যাতা বাটিছাট। সাধারণ বাটি ছাট বললে কমই বলা হয়। মাথার চান্দিতে কয়েকগাছি চুল। চারপাশে ফকফকা। দেখে আমারই মায়া লাগছিল। আবার হাসিও পাচ্ছিল ভীষণ। হাসি চেক দিতে না পেরে আমি হা হা করে হেসে ফেললে বন্ধু আমার উপর ভীষণ ক্ষেপে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছিল না। রাগে দুঃখে কথা আসছিল না মুখে। আমি সরি বলে ওকে শান্ত করে তারপর ওকে নিয়ে ঝর্ণার দিকে যাই।
সেটা করতেও অনেক বেগ পেতে হয় আমাকে। বার বার বলছিল, ‘এই অবস্থায় বাইরে গেলে সবাই আমাকে দেখে হাসাহাসি করবে।’
আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘এখানে চেহারা পর্যবেক্ষণ করার টাইম নাই কারো। এখানে কেউ কোন নাটকে অভিনয় করতে আসেনি। এসেছে যুদ্ধ করতে। দুদিন পর তুইও এসব ভুলে যাবি।’
আমার কথাই ঠিক হলো। দুদিন পর বন্ধুর বাটিছাট নিয়ে তারও যেমন মাথা ব্যথা থাকলো না বাকিরাও কেউ কোন প্রশ্ন তুললো না। সত্যি কথা বলতে কি প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ কারো তখন ছিল না। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে দেশের ভাবনা, পরিবারের ভাবনা, যুদ্ধের ভাবনা। অন্য কোন ভাবনা মাথায় ঢুকবে কিভাবে?
দুপুরের পর ফেটিক খাটতে গিয়ে দেখি আমাদের ভূতপূর্ব কমান্ডার তৌহিদ ভাইয়ের মাথায় বাটিছাট। তাকেও আমি চুলে স্টাইল করে সিঁথি করতে দেখেছি। তার চুলের স্টাইলটা ভিন্ন। সামনে চুল ছোট কিন্তু পেছনে ঝুটি। বাবরি ছাট। বরাবরই তিনি একটু ভাবে থাকতেন। তার বাটিছাট এমন বিটকেলে দেখাচ্ছিল আমি না হেসে পারলাম না। মুখ ঘুরিয়ে একা-একাই হাসলাম কিছুক্ষণ।
উচ্চতর ট্রেনিংয়ে আমাদের থাকা খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। একদিন পর পর আমাদের জন্য লেডিস খাসি [বকরি] বরাদ্দ ছিল। খাদ্য তালিকায় মাছ ছিল না। মাছের পরিবর্তে ছিল পাঁচ মিশালি তরকারি দিয়ে রান্না সুস্বাদু লাবড়া। সকালে প্রমাণ সাইজের পরোটা আর সবজি। সঙ্গে এক মগ চা। সমস্যা হচ্ছিল আমার মতো ধূমপায়ীদের। ক্যাম্পের স্টোরে শুধু এক ব্রান্ডের সিগারেট পাওয়া যেত। উইলস কিংস। দাম বেশি। খেয়ে মজা পেতাম না। বাধ্য হয়ে খেতাম। দুদিনের মাথায় জানতে পারি ঝর্ণার ওপার পাহাড়িদের একটি গ্রাম আছে। সেখানে দোকান আছে আর সেই দোকানে সব ধরণের বিড়ি সিগারেট পাওয়া যায়। ঝর্ণায় উরু অবধি পানি। কাপড় বাঁচিয়ে যাওয়া যায়। গিয়ে আমি হতবাক। প্রচণ্ড ভিড়। ক্যাম্পের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা যেন চলে এসেছে। আমি এবং আসগর খানিকটা হেঁটে গ্রামটা দেখলাম। অন্য আর দশটা পাহাড়ি গ্রামের মতো ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর নয়। বেশ ঘিঞ্জি। গায়ে গায়ে বাড়িঘর। সবগুলো বাড়ির সামনে ছোটখাটো দোকান। মোটামুটি সবই পাওয়া যায়। বেশি পাওয়া যায় কলা। ছোটছোট পাহাড়ি কলা। দেখতেও সুন্দর। খেতেও মজা। দামেও সস্তা। আমরা ঘুরে টুরে একটি কম ভিড়ের দোকানে এসে দাঁড়ালাম। সবগুলো দোকানে সেলস গার্ল। বোধকরি ভিড়টা সম্ভবত এই কারণে। মেয়েগুলো দেখতে সুশ্রী। সে তুলনায় পুরুষগুলো খ্যাত টাইপের। বেঢপ ধরণের। আমরা যে দোকানের সামনে দাঁড়ালাম সেই দোকানের বিক্রেতা মেয়েটি আমাদের দেখে এমন মিষ্টি হাসি হাসলো বুকে কাঁপন ধরানো সেই হাসি আমরা উপেক্ষা করতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে ইশারায় সিগারেটের কথা বলতে মিষ্টি চেহারার মেয়েটি কয়েকরকম সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাদের সামনে রাখলো। আমরা চার প্যাকেট চারমিনার সিগারেট কিনে আরও খানিকক্ষণ খুচরা প্যাঁচাল পেরে বেরিয়ে এলাম। একটা কথা আগেই আমাদের সতর্ক করা হয়েছিল, আমরা যেন বাঁকা চোখে মেয়েদের দিকে না তাকাই। এই ব্যাপারটা ওরা খুব খারাপ ভাবে নেয়। ওদের সবার কোমরে চামড়ার বেল্টে ছুরি থাকে। উলত-পাল্টা কিছু করলে ঘ্যাচাং করে গলায় ছুরির পোঁচ দিতে ওদের নাকি একটু হাত কাঁপে না।
আমি ভেবে পেলাম না ছোট একটি গ্রামে এতো দোকান কেন? এতো খরিদ্দার ওরা কোথায় পায়? পরে মনে হলো, এখানে ক্যাম্প হওয়ার কারণে হয়তো অস্থায়ী ভাবে দোকানগুলো গড়ে উঠেছে।
জামার বুক পকেটে সিগারেটের দুটো প্যাকেট রেখে কাপড় বাঁচিয়ে ঝর্ণা পার হচ্ছিলাম। হঠাৎ পাথরের সঙ্গে থাক্কা খেয়ে পা পিছলে পানিতে পড়ে গেলাম। ঝর্ণার প্রবল স্রোত আমাকে খানিকটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। পরে একটি পাথর ধরে আমি আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হলাম। ভেজা কাপড়ে উঠে হাঁটতে হাঁটতে আসগরের কাছে এলে ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা দুজনই হতভম্ব। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘ব্যথা পেয়েছিস? কেটে টেটে যায়নিতো?’
বললাম, ‘না। ব্যথা তেমন পাইনি। তবে ভয় পেয়েছিলাম।’ আমার এ কথার পর আমরা দুজনই জোরে হেসে উঠলাম এবং হাসতে থাকলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেটের প্যাকেট দুটো নেই। ঝর্ণার প্রবল স্রোতে সিগারেটের প্যাকেট দুটো কোন ফাঁকে ভেসে গেছে একটু টের পাইনি। তখনই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। দুর্মূল্যের বাজারে দু’প্যাকেট সিগারেট হারানো মানে যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র হারিয়ে ফেলার মতো ভয়ংকর ব্যাপার। আসগর ওর থেকে এক প্যাকেট সিগারেট আমাকে দিলেও সিগারেট হারানোর ব্যথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments