সোনার দেশ বাংলাদেশ_মোহাম্মদ আবদুল মান্নান : রক্তে রাঙা নীল-পর্ব-৩
রক্তে রাঙা নীল
নীলচাষী সাদেক মোল্লা ও ক্যানি-রেনীদের কেচ্ছা
নীল বানরে সোনার বাংলা
কোন এক পল্লী কবি এভাবেই শুরু করেছেন আমাদের নীল শিল্পের কথা। নীল বানর ইংরেজ। তারা কুঠি গড়ে নানা জায়গায়। জোর করে নীল চাষ করায় চাষীদের। চাষীরা বাধ্য হয়ে ধানের জমিতে নীল ফলায়। ভাতের অভাবে না খেয়ে মরে। সোনার বাংলা ছারখার হয় ইংরেজ কুঠিয়ালদের অত্যাচারে।
ইংরেজরা আমাদের দেশ দখল করে ১৭৫৭ সালে। তারপর তারা শত শত নীল কুঠি গড়ে তোলে এ দেশে। প্রতিটি কুঠির সাথে জড়িয়ে ছিল মানুষের দুঃখ আর কান্নার অসংখ্য কাহিনী। বড় করুণ সে কাহিনী। এমনি এক নীলকুঠি ছিল কুষ্টিয়া জেলার কালিদহে।
সে কুঠি সম্পর্কে বলে গেছেন আরেকজন পল্লী কবি ঃ
শুন কুঠিয়ালের সমাচার
কালিদয়ে কুঠি যার
ক্যানি সাহেব কাইজ্যার করলে শুরু ।।
সে আউশের ক্ষেতে বোনে নীল
গব রায়তের হইল মুশকিল।
নীল চাষের দুঃখ নিয়ে এমনি কত ছড়া, কবিতা আর গান লেখা হয়েছে এদেশে। নীলের কথা মানেই চাষীদের দুঃখের কাহিনী। লোভী ইংরেজদের জুলুম-অত্যাচারের বৃত্তান্ত।
একদিকে ইংরেজ কুঠিয়াল। অন্যদিকে নিরিহ গরীব চাষী। ইংরেজরা বেশী মুনাফার লোভে অধিক জমিতে নীল দাদন করে। চাষীরা বাধ্য হয়ে তাদের ধানের ক্ষেতে নীল বোনে।
চাষীদের ঘরে চাল নেই। পকেটে পয়সা নেই। তাই তারা উপোস করে। তারা নীলের দাম পায় না। প্রতিবাদ করলে নেমে আসে জুলুম-নিপীড়ন। নীলের এ করুণ চিত্রই ভাসে আমাদের চোখে।
নীলের অন্য রকম কাহিনী
নীলের কাহিনী সব সময় দুঃখের ছিল না। এককালে নীল ছিল আমাদের সবচে’ দামি ফসল। মূল্যবান শিল্প-সম্পদ। গুরুত্বপূর্ণ রফতানী পণ্য। নীল ছিল আমদের অহংকার। নীলের সে গৌরবের কথাই আগে বলি।
এক সময় নীল ছিল কেবল বুনো গাছ। নীলের প্রথম আবাস ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকা আর আরবের বন-জঙ্গল। আমাদের উপমহাদেশের সাথে এর সম্পর্ক ছিল সবচে’ নিবিড়।
বুনো নীল গাছকে চাষের আওতায় আনা হয়। শুরু হয় কৃষি জমিতে নীলচাষ। চাষাবাদের মাধ্যমে নীলকে রং-এর কাজে লাগানো শুরু হয়। তাও অনেক অনেক দিন আগে।
প্রচুর নীল উৎপন্ন হতো এই উপমহাদেশে। নীলের ব্যবহারও আমাদের অঞ্চলেই সবচে’ বেশী ছিল। আমাদের দেশে তৈরী হতো পৃথিবীর সেরা কাপড়। সে কাপড় রফতানী করা হতো বিদেশে। এছাড়া প্রচুর নীলও রফতানী হতো এদেশ থেকে।
ইন্ডিয়া থেকে ইন্ডিগো
বুনো নীল গাছের জাতিগত নাম ‘ই-ণ্ডিগো কো-ইরুলিয়া’। ই-ণ্ডিয়া থেকেই ই-ণ্ডিগো। ভারতীয় উপমহাদেশের পণ্য হিসাবে নীলের জাতিগত নাম ‘ই-ণ্ডিগো ফেরা’। বাংলাদেশ ও ভারতে উৎপাদিত সবচে’ ভালো জাতের নীলকে ল্যাটিন ভাষায় বলা হতো ‘ই-ণ্ডিগো টিনটোরিয়া’। অন্যেরা যে নামেই ডাকুক, নীল আমাদের দেশে ‘নীল’ নামেই পরিচিত। ফারসী ভাষায় এর নাম ‘তুখমে নীল’। আরবীতে বলা হতো ‘আবুন নীল’।
মিসরের পিরামিডে নীলে রাঙা মসলিন
মিসরের পিড়ামিডে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো ফেরাউনের মমি। তাতে আমাদের দেশের মসলিন পাওয়া গেছে। সে মসলিন আমাদেরই নীল দিয়ে রং করা।
ছয় শতকের একজন পত্নি ছিলেন বরাহ মিহির। তার লেখা বই ‘ভারত সংহিতা’য় আছে নীল উৎপাদনের কথা। প্রাচীন যুগে আমাদের নীল রফতানী হতো গ্রীস ও রোমে। মধ্যযুগে নীলের বড় ক্রেতা ছিল ফ্রান্স, ইংল্যা-, জার্মানী।
তেরো শতকের মার্কোপোলোর ভ্রমণ কাহিনী থেকেও জানা যায় আমাদের নীলের কথা। ১২২৮ সালে আমাদের এ এলাকা থেকে ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরে নীল যেতো বাগদাদ হয়ে। ষোল শতকে ইউরোপে নীলের চাহিদা বাড়তে থাকে। সম্রাট আকবরের সময় নীল ছিল এদেশের সবচে’ দামি কৃষিপণ্য। আবুল ফযল লিখেছেন, গমের তুলনায় তখন নীলের আনুপাতিক দাম ছিল আড়াই গুণেরও বেশী।
নীল চাষে লাভ বেশী। তাই নীলের জমির খাজনাও বেশী। ইংরেজরা আমাদের দেশ দখল করে ১৭৫৭ সালে। ১৭৮৮ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের এক বিবরণীতে বলা হয়, ইউরোপের যত নীল দরকার, বাংলাদেশ একাই তার বিরাট অংশ পূরণ করতে পারে।
ওষুধ হিসাবেও নীলের ব্যবহার ছিল। নীলের বীজ থেকে একপ্রকার তেল বা আরক তৈরী করা হতো। এই আরক মৃগীরোগ, স্নায়ুরোগ, ব্রঙ্কাইটিস, ক্ষত ইত্যাদি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো।
তিন রকম নীল গাছ
নীল চাষ ও নীল তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে অতীতের কয়েকজন লেখকের বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে আছেন পনেরো শতকের উইলিয়াম কিনস ও ট্রাভারনিয়ার। তাঁদের কাছ থেকে নীলচাষ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। নীল গাছ থেকে নীল বের করার কৌশল জানা যায়।
নীল গাছ ছিল দু’হাত উঁচু। শক্ত শেকড় ও কা-ের ওপর এর ছিল অনেক শাখা-প্রশাখা। নীল গাছের ছড়িগুলো আড়াই-তিন ইঞ্চি লম্বা হতো। ছড়ির ভেতর বীজ পাকতো নভেম্বর মাসে। একবার বুনলে এ গাছ বাঁচতো তিন বছর। ফসল কাটা হতো বছরে একবার, আগস্ট-সেপ্টম্বর মাসে।
প্রথম বছর কাটা কোমল নীল গাছ ‘নৌতী’ বা ‘নন্দ’ নামে পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় বছরের নীল গাছের পরিচয় ছিল ‘জীয়ারী’ নামে। শেষ বছরের নীল গাছকে বলা হতো ‘কাটেল’। সবচে’ ভালো নীল পাওয়া যেতো জীয়ারী থেকে।
ইংরেজ কোম্পানীর আমলে প্রতি বছর দু’টি করে ফসল তোলা হতো। নদীর ধারের পলি পড়া জমিতে বীজ ছড়িয়ে দেয়া হতো। তার ওপর দিয়ে একটা কলা গাছ টেনে নিলেই বীজ ঢাকা পড়ে যেত। চাষের কোন প্রয়োজন হতো না। তবে চাষ দেয়া জমিতে ফলন ভালো হতো।
জোড়া জোড়া চৌবাচ্চায় নীল সাদা বুদবুদ
ফসল কাটার পর নীল গাছগুলো ধানের আঁটির মতো আগা-গোড়া করে রশিতে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো কুঠিতে। প্রত্যেক নীল কুঠিতে থাকতো পাথরের তৈরি অনেকগুলো চৌবাচ্চা।
এই চৌবাচ্চাগুলো বসানো থাকতো জোড়া জোড়া। একটি চৌবাচ্চার কিছুটা নীচে আরেকটি চৌবাচ্চা থাকতো। উপরের চৌবাচ্চায় পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হতো নীল গাছ। নয়-দশ ঘন্টা পরে সমস্ত তরল পদার্থে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হতো। বুদ-বুদে ভরে যেতো পানির উপরের ভাগ। যেনো এক্ষুণি পানির ভিতর থেকে উঠে আসবে কোন জীনের বাদশাহ।
বুদবুদগুলো প্রথমে সাদা হতো। তারপর রং পাল্টাতে থাকতো। সবশেষে গাঢ় নীল রং হতো। পানি কিছুটা শান্ত হলে এর ওপর তামা রং-এর সর পড়তো। সে পানি গড়িয়ে নীচের চৌবাচ্চায় ফেলা হতো।
পানি পিটিয়ে নীল
এবারে পানি পিটানোর কাজ। নীচের চৌবাচ্চায় পানি পিটানোর জন্য এক ধরনের হাতল ব্যবহার করা হতো। প্রায় দেড় ঘণ্টা পিটানোর পর আস্তে আস্তে তলায় গাদ জমতো। এভাবে চলতো আরো দু’তিন ঘণ্টা।
তারপর পানি সরিয়ে একজন লোক নামতো চৌবাচ্চায়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা গাদ একটি পাইপের সাহায্যে অন্য একটি চৌবাচ্চায় গিয়ে পড়তো। এই পাত্রটির পাশে থাকতো একটি বয়লার বা চুল্লি। তাপ দেয়ার ফলে গাদের ওপর ভাসতো এক ধরনের তেলতেলে পদার্থ। অন্য একটি চৌবাচ্চায় মোটা পশমি কাপড়ে তা ছেঁকে নেয়া হতো।
পরের দিন সকালে সংগ্রহ করা হতো চুয়ানো নীল। এই নীল শক্ত ব্যাগে পুরে ব্যাগসহ চাপ দেয়া হতো। পরে সাবধানে নীল বের করে তিন ঘনফুট করে কেটে রোদে শুকানো হতো। রোদে শুকানোর সময় নীলের গায়ে সাদা পলি জমতো। ব্রাশ দিয়ে তা পরিষ্কার করা হতো। এই হলো নীল তৈরির মজার কৌশল।
নীলকুঠির বিস্তার
১৭৯৫ সালে বন্ড নামক এক ইংরেজ যশোরের রূপদিয়া গ্রামে তার প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। এরপর তিনি কুঠি গড়েন যশোর জেলার অভয়নগর থানার আলীনগরে। ১৮৩৩ সালে যশোর জেলায় নীলকুঠির সংখ্যা ছিল ৩৩টি।
ঢাকা জেলায় ১৮০১ সালের মধ্যেই অনেক নীলকুঠি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে নীলকুঠির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭টি। প্রত্যেক জেলায় প্রধান প্রধান নীলকুঠকে বলা হতো ‘কনসার্ন’। একেকটি কনসার্নের অধীনে অনেকগুলি নীলকুঠি থাকতো।
পাবনা জেলায় প্রতিটি কনসার্নের অধীনে পনেরো-ষোলটি কুঠি ছিল। পাবনাতে প্রতি চার-পাঁচ মাইল হাঁটলেই একেকটি নীলকুঠি চোখে পড়তো। ১৮৫৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে প্রায় ৫০০ নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে নীল চাষ অনেক বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, ঢাকা, ফরিদপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, মোমেনশাহী ও বরিশাল জেলা ছিল নীল চাষের প্রধান কেন্দ্র।
বাংলাদেশের একটি জেলার নাম নীলফামারী। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং নিউমার্কেটের মাঝখানে একটি জায়গার নাম নীলক্ষেত। এমনি অসংখ্য নাম এক সময়কার নীলকুঠি আর নীল চাষের দুঃখময় স্মৃতি আজো ধরে রেখেছে।
বাংলাদেশের নীল ও বিলাতের শিল্প বিপ্লব
বাংলাদেশের সম্পদ লুঠ করেই ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লব শুরু হয়। কল-কারখানার প্রসার ঘটে। এসব কল-কারখানার কাঁচমাল হিসাবে কাঁচা চামড়া, পাট, কার্পাস ও নীল সংগ্রহ করা হতো বাংলাদেশ থেকে। সে-সব কাঁচামালে তৈরি জিনিসপত্র এনে আবার বিক্রি করা হতো বাংলাদেশে।
শিল্প বিল্পবের ফলে ইংল্যাণ্ডে বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়। বিলাতী কাপড় রং করার জন্য বাংলাদেশের নীলের চাহিদাও বাড়তে থাকে। ঊনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যাণ্ডে ২০ লাখ পাউ- নীলের দরকার হতো। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তখন তারা সংগ্রহ করতো ৪৫ লাখ পাউণ্ডেরও বেশী নীল।
১৮১৩ সালে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৩০ লাখ পাউ- নীল। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ থেকেই তারা এর পাঁচ গুণ নীল আহরণ করতো। বাড়তি নীল বিদেশে রফতানি করে ইংরেজরা আরো অ-নে-ক বেশী মুনাফা করতো।
নীল বানরের কালো দালাল
ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে অনেক বড় বড় নীল কোম্পানী গড়ে ওঠে। ইংরেজরাই ছিল বেশীর ভাগ কোম্পানীর মালিক। নীল চাষ অনেক লাভজনক। তাই কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে অনেক ইংরেজ নীল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। চারটি নামকরা কোম্পানী ও বেশ কিছু নীলকুঠির মালিক ছিল এদেশী জমিদার।
তাদের মধ্যে সবচে’ বিখ্যাত ছিলেন: দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুর। ইংরেজদের নানা রকম দালালী করেই এসব ব্যক্তি রাতারাতি ধনী হয়েছিলেন। তারাই ছিলেন ইংরেজদের শোষণের প্রধান সহায়ক।
নীল চাষের দু’ধরনের ব্যবস্থা ছিল
এক।।
নীলকররা নামে-বেনামে জমি সংগ্রহ করতো। সে জমিতে দু’-তিন টাকা মাসিক বেতনের শ্রমিক দ্বারা নীল চাষ করা হতো। এ ক্ষেত্রে নীল চাষের খরচ নীলকররদের বহন করতে হতো। এই পদ্ধতি নীলকরদের পছন্দ ছিল না।
দুই।।
রায়ত বা চাষীদের এক বিঘা জমির জন্য মাত্র দুই টাকা দাদন বা আগাম দেয়া হতো। দাদনের এই টাকা থেকেই চাষীকে লাঙ্গল, গরু, সার, বীজ কিনতে হতো। নিড়ানী, গাছকাটা প্রভৃতি কাজ করতে হতো।
নীল গাছগুলো কুঠিতে পৌঁছে দিয়ে যে টাকা কৃষকরা পেত তাতে তাদের লোকসান হতো তিন-চার গুণ। ফলে দাদনের টাকা কোনদিন তারা শোধ করতে পারতো না।
আফ্রিকার ক্রীতদাস ও বাংলাদেশী ‘নীল-দাস’
বাংলাদেশের নীল-চাষীদের অবস্থা আমেরিকার এককালের নিগ্রো ক্রীতদাসের চাইতেও শোচনীয় ছিল। আমেরিকার সাদা চামড়ার লোকেরা নিগ্রো ক্রীতদাস কিনতো চড়া দামে। কিন্তু ইংরেজ ও এদেশী নীলকররা নীলচাষী ও তার পুরো পরিবারকে কিনে নিত মাত্র দু’টাকা দাদনের বিনিময়ে।
নিগ্রো ক্রীতদাসরা কাজ করতো মালিকের জমিতে। চাষের লাভ-লোকসানের দায়িত্ব মালিকের। কিন্তু আমাদের দেশের ‘ নীল-দাস’রা কাজ করতো তাদের নিজের জমিতে। এ দেশের চাষীরা চাষ করতো নিজের ব্যয়ে। কিন্তু ফসল পেত নীলকর। সেই ফসল নীলচাষীরা নিজ খরচে কুঠিতে পৌঁছে দিতে বাধ্য ছিল।
আমেরিকার ক্রীতদাসদেরকে তাদের মালিকরা ভরণ-পোষণ দিতো। কিন্তু নীলকরদের সেবা করতে গিয়ে বাংলাদেশের নীল-দাসরা স্ত্রী-পুত্রসহ উপোস করতো।
দেওয়ান ও গোমস্তাদের নির্যাতন
নীলকরদের সাহায্য করতো একদল এদেশী কর্মচারী। এই কর্মচারীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিকে বলা হতো দেওয়ান। পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকা মাসিক বেতন পেতো তারা। এছাড়া দেওয়ানরা চাষীদের কাছ থেকে প্রতি এক টাকায় এক আনা বা আধা আনা কমিশন নিত।
দেওয়ানদের অধীনে ছিল ৫ থেকে ৯ টাকা বেতনের কেরানী বা রাইটার। ব্রহ্মণ ও কায়স্থ সম্প্রদায়ের শিক্ষিত লোকেরা সাধারণত এসব পদ লাভ করতো। নীল চাষ যারা তদারক করতো তাদের পদবী ছিল গোমস্তা। তাদের বেতন ছিল ১২ থেকে ২০ টাকা। গোমস্তাদের সহকারী থাকতো ৩ থেকে ৪ টাকা বেতনের ওভারসিয়ার। চাষী বা রায়তদের ওপর জুলুম করার জন্য কুঠিয়ালদের ছিল লাঠিয়াল বাহিনী। এই লাঠিয়ালরা বেতন পেত। এছাড়া তারা চাষীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা-পয়সা আদায় করতো।
কুঠিয়ালের লাঠিয়াল ও ‘শ্যামচাঁদ’
একবার নীলের দাদান নিলে সারা জীবন নীল চাষ করেও সে দাদানের চুক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতো না। কোন্ জমিতে নীল চাষ হবে, সেটাও নীলকররাই ঠিক করতো। নীল বোনার আগে ওই জমিতে অন্য কোন ফসল বুনতেও তারা পারতো না। নীলকররা সবচে’ ভালো জমি নীলের জন্য বেছে নিত। গোমস্তারা এক বিঘা জমি মাপার নামে আড়াই বিঘা জমি নিয়ে নিত।
ছয় বাণ্ডেল নীল সরবরাহ করে কৃষক পেত দুই বাণ্ডেলের দাম। সে টাকা আবার অনেকটাই ভাগ হয়ে যেত নীল কুঠির গোমস্তা, আমিন আর তাগাদাদারদের মাঝে। এসব কারণে কোন চাষী সহজে নীল চাষে রাজী হতো না।
নীলকর কুঠিয়ালরা নিষ্ঠুর অত্যাচার ও জুলুমের মাধ্যমে কৃষকদেরকে দাদনের চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করতো। এ জন্য চাষীদের ওপর হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো কুঠির লাঠিয়াল। যখন তখন তারা মানুষ খুন করতো। চাষীদেরকে মাসের পর মাস কুঠির গুদামে আটকে রেখে অকথ্য অত্যাচার করা হতো।
নিরীহ নীল চাষীদের ওপর অত্যাচার করার জন্য চামড়া মোড়ানো ‘শ্যামচাঁদ’ নামক চাবুক ব্যবহার করা হতো। চাষীদের গরু-মহিষ আটকে রেখে খেতে না দিয়ে শুকিয়ে মারা হতো। গুন্ডা দিয়ে জমির ফসল নষ্ট করে, বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নীল বুনতে বাধ্য করা হতো।
এই জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ক্ষমতাও নীলচাষীদের ছিল না। নীলকরদের কাছে আইন-আদালত, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট সবাই ছিলেন সহায়।
ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতীফের বিচার
নীলকরদের জুলুম সইতে না পেরে একবার ক’জন নীলচাষী ঐক্যবদ্ধ হলেন। নীলকরদের জুলুম সম্পর্কে তারা যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিযোগ দায়ের করলেন। যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন এক মানব দরদী ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাম আবদুল লতীফ। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতীফ এ জন্য নীলকর হেনরী ম্যাকেঞ্জিকে পরোয়ানা পাঠালেন।
তিনি লিখলেন :
বিচারের উল্টা ফল
এ পরোয়ানার ফল হলো উল্টা। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সেক্রেটারীর কাছে পাল্টা অভিযোগ করলো হেনরী ম্যাকেঞ্জি। কর্তব্যে অবহেলার অজুহাতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতীফকে বদলী করে পাঠানো হলো জাহানাবাদে। এই হলো ইংরেজ কোম্পানীর বিচার!
এই আবদুল লতীফই মুসলমানদের কল্যাণে অবদান রাখার জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি পরবর্তীকালে নওয়াব আবদুল লতীফ নামে খ্যাতি অর্জন করেন।
কালো দালালদের বাঁদরামী
এত অত্যাচার, এত জুলুম করেও নীলকররা তৃপ্ত ছিল না। ১৮৩৫ সালে দু’শ’ জন নীলকর ভারতের ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের কাছে এক দরখাস্ত করে। তাতে তারা লিখে যে, নীলচাষীরা সবাই ঠগ, শঠ, প্রতারক, মিথ্যাবাদী এবং অকর্মন্য। কাজেই কোটি কোটি টাকা খাটিয়েও বেশী লাভ করা যাচ্ছে না। নীলকরদের আরো অভিযোগ, পুলিশ কিংবা আদালতও না-কি তাদরে এই ব্যবসায় খুব বেশী সাহায্য করছে না।
নীলকরদের এই অভিযোগ ছিল সত্যের বিপরীত। এই মিথ্যুক জালিম দরখাস্তকারীরা সবাই ইংরেজ ছিল না। কয়েকজন ছিল এদেশী নীলকর জমিদার। তাদের মধ্যে সবচে’ নামী ব্যক্তি দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই দ্বারকানাথ ঠাকুর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা। দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংরেজদের দালালী করে কলকাতার একজন বড় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। জনগণকে শোষণ করতে তারা ছিলেন ইংরেজদের চাইতে বেশি সেয়ানা ও চালাক।
রক্তে রাঙা নীল
পুলিশ অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেটের চোখের সামনেই নীলকরদের লাঠিয়ালরা চাষীদের জমি দখল করে নিত। খুন-খারাবি করতো। নীলকরদের এই অত্যাচার সম্পর্কে ১৮৪৮ সালে ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষ্য দেন নীল কমিশনের কাছে। তিনি বলেন :
এমন এক-বাক্স নীলও ইংল্যাণ্ডে যায় না, যা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়।
গর্জে ওঠেন মজনু শাহ
সব কিছুর একটা শেষ আছে। নীলকরদের জুলুমের বিরুদ্ধেও সারাদেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সব জায়গায় হলো প্রতিরোধ। পাবনা ছিল নীল বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র। পঞ্চাশ বছরের বেশী সময় ধরে বাংলার কৃষকরা লড়াই করলেন নীলকরদের বিরুদ্ধে।
নীল চাষীদের বিদ্রোহ রূপ নিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো বিদ্রোহ। ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে পরিচালিত ফকির বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল আরো অনেক আগে। সে বিদ্রোহের শুরু হয় নীলকরদের ঢাকা কুঠির ওপর হামলার মাধ্যমে। মজনু শাহের নেতৃত্বে আরো অনেক হামলা হয়েছিল নীলকুঠির ওপর।
তিতুমীরের প্রতিরোধ
তিতুমীর পরিচালনা করলেন জিহাদ আন্দোলন। ইংরেজ ও তার এ দেশী দালালদের জুলুম থেকে এ দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য বাঁশের কেল্লা তৈরি করেছিলেন তিতুমীর। নীলকরদের পরিচালিত নীল কুঠিগুলো ছিল তিতুমীরের হামলার লক্ষ্য। বহু নীলকর তিতুমীরের হামলার ফলে কুঠি এবং নীলের চাষ ছেড়ে জান নিয়ে পালিয়েছিল। তিতুমীরের বাহিনীর কাছে নীলকররা বহুবার পরাজিত হয়েছে।
এভাবে নীল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। দীর্ঘদিন তা স্থায়ী হয়। কুঠিয়াল আর বিদ্রোহ প্রজাদের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল গুরুতর। সেই গোলযোগপূর্ণ দিনগুলোতে বড়লাট ক্যানিং এক চিঠিতে লিখেছিলেন : দিল্লীতে সিপাহী বিদ্রোহের পুরো সময়টাতে আমি যতটা উদ্বিগ্ন ছিলাম, বাংলাদেশে নীলচাষীদের এক সপ্তাহের বিদ্রোহ আমাকে তারচে’ বেশী উদ্বিগ্ন করে রাখে।
তারপরও দীর্ঘদিন চলে নীলকরবিরোধী সংগ্রাম।
নীল বিদ্রোহী সাদেক মোল্লা
পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-ভাগিরথি-দোয়াব নদীর তীর ঘেঁষা নীল বিদ্রোহ সারাদেশকে তখন করে তুলছিল টালমাটাল। এ সময় পল্লীর এক নাম না জানা কবির কবিতা থেকে জানা যায় সাদেক মোল্লা নামক একজন নীল-বিদ্রোহীর কথা :
‘গুলিগোল্যা সাদেক মোল্লা
রেনীর দর্প করলে চূর’
এ ধরনের কত সাদেক মোল্যা তখন বুক টান করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নীলকরদের বিরুদ্ধে। ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের শতকরা আশি ভাগ চাষী মুসলমান। তাই নীল বিদ্রোহে মুসলমানদের অংশই ছিল বেশী। নি¤œশ্রেণীর হিন্দুরাও আত্মরক্ষার এই সংগ্রামে শরিক ছিলেন মুসলমানদের সাথে।
আরেক নাম না জানা- পল্লী কবির এ গান থেকে জানা যায় কৃষক নেতা ছালু সরকারের প্রতিরোধের কথা :
ড্যামরায় আছে ছালু সরকার
করতে দেয় না নীলের কারবার
লাঠি মারে ড্যামরার পচা রায়।
ঊনিশ শতক শেষ হবার আগেই বাংলাদেশের নীল বিশ্বের বাজারে তার সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেছিল। দখল করেছিল শ্রেষ্ঠত্বের আসন। কিন্তু সে ব্যবসা ছিল বিদেশী বণিকদের কুক্ষিগত।
বিদেশীরা আমাদের সম্পদ লুট করে ফুলে-ফেঁপে উঠল। বিনিময়ে আমাদের চাষীরা পেল জুলুম আর বঞ্চনা। দুঃখ আর অবর্ণনীয় দুদর্শা।
নীল-চাষীদের দুঃখের কাহিনী নিয়ে চারণ কবিরা রচনা করেছেন অনেক প্রবাদ। এখনো গাঁয়ের মাঠে, ধান-পাট-সরিষা জমির আইলের কিনারে কান পাতলে শুনা যায় :
জমির শত্রু নীল
কাজের শত্রু ঢিল।
কার্পাস থেকে কাপাসিয়া
ভাওয়ালের জঙ্গল ঘেরা কাপাসিয়া। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানা। কার্পাস উৎপাদনের প্রাচীনতম কেন্দ্র ছিল এই লাল মাটির এলাকা কাপাসিয়া। বাংলাদেশেই প্রথম শুরু হয় কার্পাস তুলার চাষ। কার্পাস থেকেই কাপাসিয়া। কার্পাস আর কাপাসিয়া। পিঠাপিঠি নাম।
দুনিয়ার সব দেশে তখন শিল্প বলতে বোঝাতো হস্ত শিল্প আর কুটির শিল্প। সে যুগে বাংলাদেশ ছিল সেরা শিল্পায়িত দেশ। বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প ছিল দুনিয়ার সেরা। বাংলাদেশের তাঁতীরা ছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ কারগির। সেরা শিল্পী।
কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্র, খ্রীষ্টানদের বাইবেল, ইতিহাস গ্রন্থ পেরিপ্লাস, আরো কত প্রাচীন বই-পুস্তকে লেখা আছে আমাদের বস্ত্রের খ্যাতি।
আট শতকের আরব বণিক সোলায়মান। দশ শতকের আরব লেখক খোরদাদ্বা। তেরো শতকের পর্যটক মার্কোপোলো। পনেরো শতকের চীনা পরিব্রাজক মাহুয়েন। ষোল শতকের রালফফিচ। সবার মুখে মুখে আমাদের কাপড়ের যশ।
মিসরের পিরামিডে ঢাকাই মসলিন
ঈসা (আঃ)-এর জন্মেরও দু’শ বছর আগের কথা। আমাদের দেশের সূতী কাপড় তখন গ্রীসের বাজারে বিক্রি হতো। গ্রীসের যুবকদের কাছে ঢাকার ‘ঝনা’ মলমল প্রিয় ছিল খুব। মলমল মানে মসলিন।
এদেশের কাপড় তখন রফতানী হতো আরব ও ইরানে। প্রাচীন আসিরিয়া, বেবিলন কিংবা রোম। ঢাকাই মসলিন প্রিয় ছিল সবখানে।
আমাদের মসলিনে জড়ানো মমি পাওয়া গেছে পিরামিডের দেশ মিসরে। পাহাড়ের ভেতর প্রাচীন কবরে।
সূক্ষ্ম মসলিন কিংবা শীত নিবারণী মোটা চাদর। সব কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল বাংলাদেশ।
এদেশের প্রায় সব জেলাই কোন না কোন কাপড় তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। সবচে’ বশী সুনাম ছিল ঢাকাই মসলিনের। মসলিন ছিল দুনিয়ার বিস্ময়। মসলিনের পাশে রাখার মতো কাপড় আজো কোথাও তৈরি হয়নি। বিদেশীরা অবাক হয়ে এ কাপড়ের নাম দিয়েছিল ‘হাওয়াই ইন্দ্রজাল’।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments