আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৪০
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
সারকানের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। সিংহের মতো গর্জে ওঠে। তলোয়ারে তলোয়ারে লড়াই শুরু হয়। ইস্পাতে ইস্পাতে ঘর্ষণে ক্ষণে ক্ষণেই আগুনের ফুলকী ঠিকরে বেরুতে থাকে। যাকে বলে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। কেউই কাউকে কাবু করতে পারে না। এইভাবে দিনের আলো ফুরিয়ে আসে। সে দিনের মতো রণে ভঙ্গ দিয়ে যে যার ডেরায় ফিরে যায়।
সারকান অবাক হয়ে ভাবতে থাকে। তার সমকক্ষ বীরপুরুষ তামাম দুনিয়ায় তো কেউ নাই। তবে কেন সে তাকে কাবু করতে পারলো না? তার যে-সব মোক্ষম মার ডাকসাইটে জাদরেল যুদ্ধবাজরাও এড়াতে পারে না, মনে হলো, অতি সহজে সেগুলো পাশ কাটিয়ে গেলো সে।
পরদিনও সারাদিন ধরে চললো তাদের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। কিন্তু না, সারকান পরাস্ত করতে পারে না। আক্রোশে, উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁিপতে তাঁবুতে ফিরে যায়। পরদিন আবার তারা রণক্ষেত্রে হাজির হয়। এইদিন খ্ৰীষ্টান সেনাপতি এক সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে পড়ে যায়। সারকান তলোয়ার বাগিয়ে ধরে। কোপ মারতে যাবে, এমন সময় হাত তুলে সে থামতে বলে, থামো, তুমি না বিশ্ববিজেতা উমর অল-নুমানের পুত্র সারকান। তোমার মতো বিক্রম বীর নাকি সারা আরব দুনিয়ায় নাই। এই তোমার বীরত্ব! একটা অসহায় নিরস্ত্ব নারীর ওপর তলোয়ার চালাতে লজ্জা করে না তোমার।
সারকান হতভম্ব হয়ে পড়ে।
—ইরবিজা—তুমি? আমি তো চিনতেই পারিনি, সোনা?
সারকান ঘোড়া থেকে নেমে ইরবিজাকে জড়িয়ে ধরে। চুমু খায়।—এইভাবে আমার সঙ্গে লড়াই করলে? যদি আমার একটা মারও ঠেকাতে তোমার পলকমাত্র দেরি হতো, আমি ভাবতে পারছি না সোনা, কি অঘটনই না ঘটে যেতো। আল্লাহ মেহেরবান, তিনিই রক্ষা করেছেন।
ইরবিজা একজনকে নির্দেশ করলো, সারকানের বন্দীদের এখানে নিয়ে এসো। দেখবে, কোনও অসম্মান যেন না হয়।
এর পর তারা দুজনে দুশো সৈন্যসামস্তের বাহিনী নিয়ে বাগদাদের পথে রওনা হয়ে যায়।
এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
পরদিন একান্নতম রজনী।
শাহরাজাদ। আবার গল্প শুরু করে।
সারকান ইরবিজার সহচরীদের বলে, তোমরা রণসাজ খুলে ফেলো। নিজের নিজের পোশাকে সেজে নাও।
সারকান তার কয়েকজন সেনাপতিকে বললো, তোমরা তীরগতিতে বাগদাদের পথে পাডি দাও। সুলতান উমর অল-নুমানকে সংবাদ দাও আমরা আসছি।
সে রাতটা তারা ওখানেই তাঁবুতে কাটালো। পরদিন সকালে উঠে গোসল এবং খানাপিনা। সেরে রওনা হলো।
বিশ দিনের পথ অতিক্রম করে অবশেষে তারা বাগদাদে এসে পৌছয়। উজির দানদান তাদের যথাযোগ্য অভ্যর্থনা করার জন্যে শহরের প্রবেশ মুখে এক হাজার অশ্বারোহীর এক বাহিনী দাঁড় করিয়েছিলো। সারা শহর আর তোরণদ্বার আলোর মালায় সাজানো হয়েছিলো।
দরবারে ঢুকেই যথাবিহিত কুর্নিশ জানায় সারকান। উমর অল-নুমান পুত্রকে পেয়ে খুশি হয়। ইরবিজার সঙ্গে সারকানের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানায় তার বাবাকে। ইরবিজা সম্রাট হারদুবের কন্যা। তাকে বলতে গেলে, শয়তান আফ্রিাদুনের ফাঁদ থেকে বঁচিয়েছে। তার নানা গুণের কথা বলতে বলতে সারকান-এর বুক গর্বে ফুলে ওঠে। ইরবিজার মতো সর্বগুণসম্পন্না মেয়ে তামাম দুনিয়াতে কোথাও নাই। সারকানকে সে যেমন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, তেমনি তার অসাধারণ রণকৌশল দেখেও সে বিস্মিত হয়েছে। দুনিয়াতে এমন কোন যোদ্ধা নাই যে তার অব্যৰ্থ অসির আঘাত প্রতিহত করতে পারে, কিন্তু ইরবিজা এমনই দক্ষ যে, সে সব মারের প্যাঁচ অতি সহজেই সে পাশ কাটিয়ে দিয়েছে।
উমর অল-নুমান-এর মনে পাশবিক প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। অনেক দিন সে নতুন মেয়ের স্বাদ পায়নি। সারকানের মুখেইরবিজার অসাধারণ রূপ আর যৌবনের কথা শুনে ধৈর্য আর বাঁধ মানে
—তাকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো, আলাপ করতে চাই।
সারকান বাবার অভিপ্রায় আঁচ করতে পারে না। বললো, এখুনি তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, জাঁহাপনা।
একটু পরে ইরবিজা এসে আভূমি আনত হয়ে উমরকে কুর্নিশ করে দাঁড়ালো। সুলতানের ইশারায় দরবার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো সবাই। শুধু রইলো ইরবিজ, খোজা আর উমর অল-নুমান?
–পরিষ্কার আরবী ভাষায় জবাব দিলো।
–তোমার বাবা?
—তা হলে তুমি তো খ্ৰীষ্টান!
এই ‘সুন্দরী’ সম্বোধনে ইরবিজা বিস্মিত হয়।–আপনি আমাকে ইরবিজা বলেই ডাকবেন,
উমর অল-নুমান-এর অট্টহাসিতে শূন্য দরবার মহল চকিত হয়ে ওঠে।—একই নারী কারো মা, কারো কন্যা, আবার কারো বা ভগ্নী হতে পারে। তা আমার তোমার সম্পর্কটা না হয়। পরেই ঠিক করা যাবে। থাক ওসব কথা, শুনলাম আমার ছেলে সারকানকে তুমি খুব সাহায্য করেছে। তোমার বুদ্ধির জোরেই সে আফ্রিাদুনের ফাদ থেকে কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এবং এ-ও শুনলাম রণ-বিদ্যায় তুমি নাকি পারদর্শ? তা শিখলে কার কাছে?
উমর অল-নুমান ইরবিজাকে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে, আফ্রিদুনের সেই অলৌকিক পাথর তিনখানা নাকি তোমার কাছেই আছে?
—একবার দেখাবে?
খোজটাকে বললো, মতিয়াকে বলো, সে যেন আমার হাত বাক্সটা নিয়ে আসে।
মতিয়া একটা ছোট্ট রূপের বাক্স নিয়ে এসে ইরবিজার হাতে দেয়। বাক্সটা খুলে তার মধ্য থেকে আরও ছোট একটা সোনার বাক্স বের করলো ইরবিজা। এই বাক্সে রাখা ছিলো সেই দৈব-শক্তিসম্পন্ন পাথর তিনখানা। বাক্সটা সুদ্ধ সে উমর আঁল-নুমানের দিকে এগিয়ে দেয়।—জাঁহাপনা, এই আমার সেলামী–
উমর-এর চোখ নেচে ওঠে। এই মাণিক্যের কথা সে বহুকাল ধরে শুনে আসছে। আজ তার হাতের মুঠোয় এসে গেলো। বাক্সটা সুদ্ধ ইরবিজার হাতখানা সে চেপে ধরে। ইরবিজা অস্বস্তি বোধ করে। বাক্সটা হাতে তুলে দিয়ে প্রায় জোর করেই হাতটা ছিনিয়ে নেয়। উমরের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। কিন্তু সে মুহূর্ত মাত্র। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তলোয়ার-ধরা হলে কি হয়, হাতটা তোমার ফুলের কলির মতো নরম।
ইরবিজার এ-সব কথা ভালো লাগে না। উঠে পড়ে বলে, এবার যদি অনুমতি করেন। জাঁহাপনা, আমি তবে আসি?
ইরবিজা কুর্নিশ করে বলে, যো হুকুম, জাঁহাপনা।
খোজা এবং মতিয়াকে সঙ্গে করে সে দরবার ত্যাগ করে নিজের মহলে চলে যায়।
উমর অল-নুমান সারকানকে ডেকে পাঠায়। সারকান এসে কুর্নিশ জানায়। একখানা পাথর এগিয়ে দিয়ে উমর বলে, এটা তোমার কাছে রাখে।
সারকান বলে, আর দু’খানা কি হলো জাঁহাপনা?
–দু-আল-মাকান?
উমর বললো, তুমি নুজাতের কথা শুনেই বাইরে চলে গেছে। কিন্তু তার পরেই সফিয়া আর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। মাকান আর নুজাৎ যমজ ভাই বোন।
সারকানের মুখ কালো হয়ে যায়। এত বড় দুঃসংবাদ শুনবে, আশা করেনি। সারকানকে বিষণ্ণ দেখে উমর বলে, কিন্তু এতে তোমার মন খারাপ করার কি আছে, সারকান! আমি অনেক আগেই ফরমান জারি করে দিয়েছি, তুমিই হবে আমার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। সুতরাং তোমার তো মন খারাপ করার কোনও কারণ নাই।
সারকান নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আল্লাহ ওদের সুখে রাখুন।
আবার কুর্নিশ জানিয়ে দরবার থেকে বেরিয়ে সে ইরবিজার কাছে যায়। সারকানকে চিন্তিত দেখেইরবিজা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, তোমার মুখ এত গভীর কেন, সারকান? কোনও খারাপ খবর আছে নাকি?
ইরবিজা চমকে ওঠে। তাহলে তার আশঙ্কা মিথ্যা নয়। উমরের চোখে ইরবিজা দেখেছিলো লালসারই আগুন–কিন্তু সারকান, এও শুনে রাখো, আমি সম্রাট হারদুবের কন্যা। যতক্ষণ ধড়ে প্রাণ আছে সজ্ঞানে আমার দেহ স্পর্শ করতে পারবে না সে। আমার যুযুৎসুর প্যােচ তুমি দেখেছে, আমার তলোয়ারের মার তোমার অজানা নাই। প্রয়োজন হলে, সে তোমার বাবাই হোক আর যেই হোক, তার সদ্ব্যবহার করতে কসুর করবো না। ও নিয়ে তুমি কোনও দুর্ভাবনা করো না সারকগন। নিজেকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আমি তোমার বাবার তিনশ একষট্টিতম রক্ষিতা হয়ে আমার জীবন বরবাদ করে দেব না, এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থেকে। তাকে খুশি করার তো মেয়ের অভাব নাই। তবু আমার দিকে তার এই লোভ কেন?
এর পর ইরাবিজা। আর সারকগন খানাপিনা করলো। সারকান বললো, আমি দিন কয়েকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে আবার দেখা করবো।
সারকান প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই উমর আসে। সফিয়ার কামরায়। সফিয়া তার দুই সন্তান নুজাৎ আর দু-আল-মাকানকে নিয়ে প্রাসাদের এই কক্ষে বাস করে। সুলতানকে এই অসময়ে তার কামরায় আসতে দেখে সফিয়া অবাক হয়। যেমন, খুশি হয় তার চেয়েও বেশী।
জাঁহাপনা এ-সময়ে বাদীকে মনে পড়লো।
উমর বলে, তুমি যে কনসতান্তিনোপল-এর সম্রাট আফ্রিদুনের কন্যা, সে কথা আমাকে আগে বলো নি কেন সফিয়া?
—আপনি মহানুভব শাহেনশাহ। আমার তো কোনও অসম্মান অমর্যাদাই আপনি করেন নি। বেগম যেইজৎ পায় আপনি কি তার চেয়ে কিছু কমইজৎ করেছেন আমাকে? এই ফুলের মতো দু’টো সস্তান আমাকে উপহার দিয়েছেন। একটা মেয়ের পক্ষে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? আপনি মনে কোন ক্ষোভ রাখবেন না, জাঁহাপনা। দুনিয়াতে আমার মতো সুখী, আমার মতো ভাগ্যবতী কজন আছে?
সফিয়া খুশি হয়ে বলে, খুব ভালোই করেছেন। ও পাথর কাছে থাকলে কোন অসুখবিসুখ হয় না। এই পাথর তিনখানা আমার বাবা আমাকে যৌতুক দিয়েছিলেন। আমি সম্রাট হারদুবের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। জানি না। আপনার হাতে কি করে এলো?
উমর জবাব দেয়, না, যুদ্ধ তার সঙ্গে হয় নি।
সফিয়া অবাক হয়, তবে?
–ইরবিজা? সম্রাট হারদুবের একমাত্র সস্তান? সে আপনার হারেমের বাঁদী হয়েছে?
—জাঁহাপনা কি তাকে বেগম করে রাখবেন?
–আর তোমার?
উমর বলে, ইরাবিজাকে এখনও কোনও প্রস্তাব আমি দিইনি। হয়তো সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও করতে পারে।
সফিয়া বিস্ফারিত চোখে তাকায়।-শাহেনশাহ উমর অল-নুমানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার দুঃসাহস তার হবে কি করে?
—হুকুম করুন জাঁহাপনা।
–হুকুম নয় নয়। সফিয়া, আদর আর ভালোবাসার উপহার স্বরূপ তোমার জন্যে নতুন এক প্রাসাদের ব্যবস্থা করেছি। এই রক্ষিতামহলে আর তুমি থাকবে না। তুমি আমার নুজাৎ আর মাকান-এর মা। এখন থেকে তুমি আমার বেগম-তোমার যোগ্য মর্যাদায় তুমি থাকবে তোমার নিজের প্রাসাদে! দেওয়ানকে আমি বলে দিয়েছি, তোমার ঘরদের মন মতো করে সাজিয়ে দেবে। দাসী বাদী খোজা যা দরকার সব চাওয়া মাত্র পাবে। তোমার জন্যে দশ হাজার দিনার মাসোহারা মঞ্জুর করেছি।
আনন্দে সফিয়ার চোখ নেচে ওঠে। গর্বে ভরে ওঠে। বুক। মুখে বলে, আপনার ভালোবাসা যখন পেয়েছি, প্রাসাদের বিলাস বৈভবে। আর কি প্রয়োজন ছিলো জাঁহাপনা! কিন্তু আপনি দিচ্ছেন, আপনার ভালোবাসার দান আমি মাথা পেতে নেব।
সফিয়াকে প্রাসাদ থেকে অন্য প্রাসাদে সরাবার একটাই উদ্দেশ্য, ইরাবিজার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক গড়ে উঠছে তা যাতে সফিয়া জানতে না পারে। প্রতিদিন সন্ধ্যা হতে না হতেই উমর এসে উপস্থিত হয় ইরবিজার ঘরে। নানা কথায় তাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। বেগম করে রাখবে। সাতমহলা প্ৰাসাদ বানিয়ে দেবে। হীরে জহরতে ভরে দেবে তাকে। কিন্তু ইরাবিজার মন গলাতে পারে না।
-আমি আপনার বেগম হতে আসিনি, জাঁহাপনা। আপনার পুত্র সারকানের সঙ্গী হয়ে থাকতে এসেছি। এতে যদি আপনার অমত থাকে, আমি ফিরে যাবো। আমার বাবার কাছে।
উমর বিমর্ষ হয়ে ফিরে যায়। কামনার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। শেষে একদিন উজির দানাদানকে বলে ইরবিজার এই প্রত্যাখ্যান আমি তো আর সইতে পারছি না। উজির। কিভাবে তাকে পাওয়া যায়। তার একটা মতলব বাৎলে দাও।
উজির বলে, সম্রাট হারদুবের রক্ত আছে ওর শরীরে। সহজে সে বশ্যতা স্বীকার করবে, মনে হয় না।
উমর বলে, তবে? তবে কি উপায়?
—সাব-বা-স, উমর আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, তোমার ফন্দী বেশ চমৎকার, উজির। আমার মনে হচ্ছে, এই চালেই বাজীমাৎ করে দেব।
সন্ধ্যেবেলা উমর এলো ইরবিজার ঘরে। ইরবিজা নিরাসক্তভাবে সুলতানকে স্বাগত জানায়। বলে, বসুন জাঁহাপনা।
উমর বলে, আমি কাল বাইরে যাবো ইরবিজ, তাই আজ তোমার ঘরে একটু বেশিক্ষণ কাটিয়ে যাবার সাধ।
–তা বেশ তো, থাকুন না, যতক্ষণ ইচ্ছে।
— শুধু শুধু আর কতক্ষণ কাটানো যায় বলো, একটু যদি খানাপিনার ব্যবস্থা কর, ভালো হয়।
–এ আর এমন বেশী কি কথা হুজুর। কি খাবেন বলুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
উমর বলে, তোমার যা খুশি, ভালো একটু সরাব দাও, তা হলেই হবে।
সোনার পেয়ালায় দামী সরাব ঢেলে দেয়া ইরবিজা। কিন্তু উমর পেয়ালা হাতে নেয় না।–না, না, সে হয় না। আমি একা একা খাবো না। তুমি না খেলে মৌজ হবে কি করে?
—সে কি? সম্রাট হারদুবের কন্যা, তায় আবার খ্ৰীষ্টান, সরাব তোমার ভালো লাগে না?
উমর বলে, তা মনে কর না কেন, আজ একটা বিশেষ উৎসবের দিন। কাল আমি বাইরে চলে যাবো। আজ আমাকে না হয় বিদায় সম্বর্ধনাই জানালে।
ইরাবিজা আর আপত্তি করে না।–বেশ, আপনি যখন বলছেন, আপনার সম্মানেই খাবো।
আরও একটা পেয়ালায় সরাব ঢেলে নেয় ইরবিজা। নানা কথার ফাঁকে ফাঁকে টুকটুক করে তিন পেয়ালা সরাব শেষ হয়ে যায়।ইরাবিজা বলে, আজ এই পর্যন্তই থাক জাঁহাপনা, আবার যখন ফিরে আসবেন, আবার একদিন আপনার সঙ্গে খাবো।
উমর বলে, কিন্তু মদের আমেজ তো এখনও লাগেনি ইরবিজা।
ইরবিজা বলে, দামী মদ, নেশা ধরতে একটু সময় লাগবে জাঁহাপনা, তা ছাড়া যত মন্দই খাই না। কেন, বেহেড মাতাল আমি কোনও দিনই হই না। এই তো ভালো হাল্কাগুলাবী নেশা-এতেই তো বেশি আনন্দ পাওয়া যায়।
ইরবিজা ভাবে, সুলতানের মাথায় শয়তানী বুদ্ধি খেলা করছে। সরাবের নেশায় তাকে বেহ্শ করে দিতে চায়। কিন্তু ইরবিজা হাঁদা-বোকা নয়। সবই বুঝতে পারে। এসব পুরোনো কায়দায় তাকে ঘায়েল করা যাবে না।
উমর আবদার ধরে, বেশ আর খাবে না। শুধু আমার অনুরোধে শেষবারের মতো আর এক পেয়ালা। তার অর্ধেকটা আমি খাবো। আর এ পেয়ালাটা আমি তুলে দেব তোমার মুখে। কেমন, রাজি?
ঠিক আছে জাঁহাপনা, এই-ই শেষবার। আপনি নিজে হাতে ঢেলে দেবেন, শুধু সেই আনন্দেই না করতে পারলাম না।
সোনার ঝারি থেকে সোনার পেয়ালা পূর্ণ করে সরাব ঢাললো স্বয়ং সুলতান উমর অল-নুমান। নিজে আগে চুমুক দিয়ে খায় খানিকটা। শেরওয়ানীর পকেট থেকে ঘুমের বডিটা বের করে ইরবিজার অলক্ষ্যে টুক করে পেয়ালার মধ্যে ফেলে দেয়। তারপর পেয়ালাটা ইরবিজার ঠোঁটে ধরে বলে,
ইরবিজা কোন আপত্তি করে না। উৎফুল্লও হয় না। নির্বিকার ভাবে এক চুমুকে নিঃশেষ করে দেয়।
সুলতান-এর চোখে শয়তানীর হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে, বাঃ এই তো কেমন লক্ষী মেয়ে! নাও, চলো, এবার খানা সেরে নিই।
দু’জনে খাবার-এর টেবিলে গিয়ে বসে। নানা রকম শাহী খানায় সারা টেবিল জোড়া। মতিয়া এগিয়ে এসে রেকল্পবী পেতে দেয়। সুলতান হাতের ইশারায় তাকে বাইরে চলে যেতে বলে।, আজ আমি নিজে হাতে ইরবিজাকে পরিবেশন করবো। আরিরবিজা খানা সাজিয়ে দেবে আমার রেকবী ভরে। তোমরা সব বাইরে চলে যাও। কেউ থাকবে না ঘরে।
ইরবিজা দেখলো, সুলতান-এর কথা জড়িয়ে আসছে। মদের নেশা বেশ ধরেছে।–আপনি কিছু ভাববেন না, জাঁহাপনা, সবাইকে আমি বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘরে আছি এখন শুধু আমি আর আপনি। আমি আপনাকে খাওয়াবো, আর আপনি আমাকে খাওয়াবেন। এর মধ্যে ওরা থাকবে কেন?
—বাঃ বেড়ে, মজাদার পাকিয়েছে তো? তুমি খাও? এই নাও, খাও।
সুলতান নিজে হাতে একটু মাংস পুরে দেয় ইরবিজার মুখে। কিন্তু মাংসটা আর মুখে রাখতে পারে না। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে ওঠে। সুলতান দেখলো, বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ইরবিজার মাথাটা সামনে ঝুলে পড়ে। এবার হয়তো কুর্শি থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। পাঁজাকোলা করে ইরবিজার দেহটা তুলে এনে শয্যায় শুইয়ে দেয় উমর।
খানিক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে ঝড়ের বেগে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায় সুলতান। মতিয়া ঘরে ঢুকে দেখে, ইরবিজা বিবস্ত্ৰা। মড়ার মতো অসাড় নিস্পন্দ তার দেহটা এলোমেলো শয্যায় নেতিয়ে পড়ে আছে। ভীত সস্ত্বস্ত হয়ে কাছে আসে। বুকে হাত রেখে অনুভব করে—না, বুকের স্পন্দন ঠিকই আছে। তার কোনও হ্রস নাই। মুখ দিয়ে গ্যােজলা উঠছে। কি বিশ্ৰী ওষুধ খাইয়ে সর্বনাশ করে গেছে। কেয় গায়ের জামাকাপড় সংযত করে একখানা শাল চাপা দিয়ে দেয় মতিয়া।
সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলে ইরবিজা বুঝতে পারে, কাল রাতে কি যেন ঘটে গেছে। তলপেটটায় বেশ ব্যথা হয়েছে। মতিয়া কাছে আসে। ওর চোখে জল।
–কি রে, মতিয়া, কাঁদছিস কেন?
চমকে ওঠে ইরবিজা। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলতে পারে, শয়তান—
তারপরই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মতিয়া বলে, গতকাল রাতে আপনাকে সরাবের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে এই সর্বনাশ করে গেছে সুলতান।
ইরবিজা ক্ৰোধে ফেটে পড়ে। পালঙ্কের বাজুতে মুষ্ঠ্যাঘাত করে বলে, এর বদলা চাই।
কিন্তু কি করে বদলা আপনি নেবেন, মালকিনা! সে সুলতান। আর আপনি তারই হারেমে আশ্রিতা।
—আশ্রিতা, কিন্তু আমি তার বাদী রক্ষিতা নাই। সে ভেবেছে, অত সহজেই পার পেয়ে যাবে? আমার বাবা সম্রাট হারদুব। ওর সালতানিয়তে ঘুঘু চরিয়ে ছেড়ে দেবে সে।
মতিয়া শান্ত করার চেষ্টা করে।—আপনি চুপ করুন, রাজকুমারী। চারদিকে সুলতানের চর আছে। আমাদের কথা শুনতে পেলে বিপদ বাড়বে। তার চেয়ে আমি বলি কি, ঠাণ্ডা মাথায় মতলব আঁটুন। সুলতানকে কি করে এর সমুচিত শিক্ষা দেওয়া যায় তার উপায় ভাবুন।
ইরবিজা মাথা নাড়ে, তুই ঠিকই বলেছিস মতিয়া। মাথা গরম করলে সব ভেস্তে যাবে। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। আচ্ছ এক কাজ কর, দরবারে খবর পাঠিয়ে দে আমার শরীর খুব খারাপ। এখন আমি কিছুদিন সুলতানের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করবো না।
ইরবিজা এক এক নিজের ঘরে দিন কটায়। একমাত্র মতিয়া তার সঙ্গী। আর কারো সঙ্গে দেখা করে না। মাস দুই পরে ইরবিজা বুঝতে পারে, সে সন্তান-সম্ভবা। কান্নায় ভেঙে পড়ে। মতিয়াকে বলে, এখন কি হবে মতিয়া? সারকান শহরে নাই। এখন কি করি আমি।
মতিয়া পরামর্শ দেয়, যেভাবেই হোক, এখান থেকে পালাতে হবে, রাজকুমারী।
–কোথায় যাবো?
কিন্তু বাবা যদি আমার প্রতি বিরূপ থাকেন? তা হলে কি হবে?
–তুই ঠিকই বলেছিস, মতিয়া। বাবার রাগ বড় চণ্ডালী? তার প্রতিজ্ঞা বড় মারাত্মক। তিনি যদি একবার পণ করেন, উমর-এর সর্বনাশ করবেন, তা তিনি করবেনই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—এই প্রাসাদপুরী থেকে পালাবো কি করে! কোনও পুরুষ মানুষের সাহায্য ছাড়া এতটা পথ যাবেই বা কি করে। লোকে সন্দেহ করবে না?
ইরবিজা বলে ঠিক বলেছিস। নিগ্রো সঙ্গে থাকলে সাধারণ লোক সাত হাত দূরে দিয়ে চলবে। তুই ওকে ভজাবার চেষ্টা কর। বলবি নোকরীর জন্য কিছু ভেবো না। সারাজীবন সুলতানের প্রাসাদের দ্বাররক্ষী থেকে যা রোজগার করবে। তার দশগুণ টাকা তোমাকে একসঙ্গে দিয়ে দেব। শুধু তুমি সিসারিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। তারপর তোমার পয়সা কডি নিয়ে দেশে গিয়ে বাস করবে। সুলতান উমর তোমার। একগাছি চুলও ছিঁড়তে পারবে না।
পরদিন মতিয়া এসে বলে, নিগ্রোটারাজি হয়েছে, রাজকুমারী। আগামী জুম্মাবার নামাজ শেষ করে সুলতান শিকারে যাবে। সেইদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা দুজনে খিড়কীর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবো। নিগ্রোেটা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে তিনটে খচ্চর নিয়ে। শুধু বলে দিয়েছে, তুমি খুব সাধারণ সাজ পোশাকে সাজবে লোকে দেখে যাতে মনে করে, একটা সাধারণ দাসী বাদী।
শুক্রবার দিন সন্ধ্যাবেল খিড়কীর দরজার পাশে তিনটি খচ্চর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিগ্রোটা। ভাবে; ভালো একটা মওকা পাওয়া গেছে। সম্রাট হারদুবের মেয়ে, খুবসুরৎ লেড়কী। হীরে জহরৎও অনেক পাওয়া যাবে। ভালো করে দেহের ক্ষিদেটাও মিটিয়ে নিতে পারবো।
কিছুদিন ধরেই ইরবিজার শরীরটা একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে। কিছুই খেতে পারে না। যা খায় বমি হয়ে যায়। সারা শরীর গুলিয়ে যেতে থাকে। মতিয়া বলে, ওতে ভয়ের কিছু নাই। এ সময় ও রকম হয়। আবার কয়েকদিন বাদেই দেখবেন, সব ঠিক হয়ে গেছে।
–কিন্তু মতিয়া, শরীরে আমি কোনও জোর পাচ্ছি না রে। মনে হচ্ছে ছ’মাসের রুগী।
–এ কোনও অসুখ নয়, রাজকুমারী। পেটে বাচ্ছা এলে প্রথম প্রথম সব মেয়েরই এরকম হয়। নিন তৈরি হয়ে নিন, নিগ্রোটা বোধহয় এসে দাঁড়িয়ে আছে।
মতিয়া ওকে সাধারণ সাজ পোশাক পর্যায়। একটা মাঝারি গোছের অতি সাধারণ বাক্সে ভরে সব হীরে জহরতের গয়নাগাটি। সবারই অলক্ষে আস্তে আস্তে খিড়কীর দরজার কাছে চলে আসে। তিনটে খচ্চর নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো নিগ্রোটা। বলে, বহুৎ দেরি করলেন, লিন, চটপট উঠে। পড়ুন।
কৃষ্ণপক্ষের মাঝামাঝি। আকাশে তখনও চাঁদ ওঠেনি। অন্ধকার পথ। গা ছমছম করে নিগ্রোটা বলে, কোন ভয় নাই, লাগামটা শক্ত করে চুপচাপ বসে থাকুন। কোনও শালা কাছে ঘেঁসিতে সাহস পাবে না। আর যদি কেউ হামলা করতে আসে, আমার এক এক কোপে সাবাড় করে দেব সব। মাঝরাত বরাবর আসমানে চাঁদ উঠবে। তখন আর পথ চলতে কষ্ট হবে না।
নিঝুম নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত্রি। খচ্চর তিনটের পায়ের শব্দ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই কানে আসে না। মাঝে মাঝে হয়তো বা কোনও রাত জাগা পাখির আওয়াজ, কিংবা শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। অনেক মাঠ ঘাট জঙ্গল পেরিয়ে চলতে থাকে ওরা। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের সময় আকাশে ভাঙ্গা চাঁদ দেখা গেলো। ইরাবিজা বললো, মতিয়া, শরীরটা বড়ই খারাপ করছে রে, রাতের মতো কোথাও বিশ্রাম করলে হয় না?
নিগ্রোটা বললো, এই বাঁকটা পেরোলেই একটা বাগান পাওয়া যাবে। ওখানে গাছের তলায় রাতটা কাটিয়ে লিন। তারপর আবার ভোরবেলা রওনা হওয়া যাবে।
মতিয়া বললো, তাই করো।
একটু পরেই নিগ্রোটা বললো, এইখানে নেমে পড়ুন আপনারা।
ইরাবিজা আর মতিয়া নেমে পড়ে। একটা গাছের তলায় চাঁদর বিছিয়ে মতিয়া বলে, এখানে একটু শুয়ে ঘুমিয়ে নিন, রাজকুমারী। আমি জেগে আছি।
ইরবিজার শরীর এলিয়ে পড়েছিলো। আর দ্বিরুক্তি না করে শুয়ে পড়লো। মতিয়াও পাশে বসে ঝিমাতে লাগলো। হঠাৎ একটা বিদঘুটে আওয়াজে দুজনেরই তন্দ্ৰা ছুটে যায়। ধড়মড় করে উঠে বসে ইরবিজা। দেখে মতিয়া ভয়ে কাঁপছে।
সামনে দাঁড়িয়ে সেই নিগ্রোটা। দৈত্যের মতো চেহারা। একেবারে উলঙ্গ। মুখে তার শয়তানের হাসি। হাতে শাণিত তলোয়ার।
একা একা শুয়ে শুয়ে রাত কাটবে। তাতো হবে না। রাজকুমারী! আজি আমি তোমার লাগব হবে। কেন, আমাকে দেখে কি পছন্দ লয়! নাকি সতীপনা করছে? তা বাবা সুলতান উমর তো তোমার সতীপনা খতম করে দিয়েছে।
—চোপ রাহ, বেয়াদপ!
ইরবিজা গর্জে ওঠে। নিগ্রোটা কিন্তু চুপ করে না। ভয়ও পায় না। বলে আ–হা, অত চট্টছে। কেন, মালকিন। চটে কোনও লাভ নাই। এখানে তোমার কোনও বাপ বাঁচাতে আসবে না। যা বলছি ভালো মেয়ের মতো শোনো। তা না হলে এই যে দেখছে—
ইরাবিজা রাগে থর থর করে বলে, শুয়ার কা বাচ্চা! ও দিয়ে আমাকে কন্তুজায় আনতে পারবি না।
ইরবিজা হাঁপাতে থাকে। একে অসুস্থ শরীর। তায় এই উত্তেজনা। মনে হয় এখুনি বুঝি টলে পড়ে যাবে সে। মতিয়া ওকে জাপটে ধরে। আপনি উত্তেজিত হবেন না, রাজকুমারী। শান্ত হোন। লোকটা যে এমন শয়তান তাতো ঘৃণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।
নিগ্রোটা আবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, কই কি হলো? সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না দেখছি।
ইরবিজা উঠে দাঁড়ায়। সারা শরীর কাঁপতে থাকে। একটা পাথরের চাই পড়েছিলো পাশেই। তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারতে চেষ্টা করে।–শয়তান, ভেবেছিস, তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে সর্বনাশ করবি। তা কিছুতেই হবে না।
যে হাতে একদিন গন্ধমাদন পর্বত উপড়ে ফেলার ক্ষমতা ছিলো, সেই হাতে আজ সে সামান্য পাথরের ঢেলা ছুড়তে পারলো না। ব্যর্থতার আক্রোশে দিশেহারা হয়ে ঘুষি বাগিয়ে সে নিগ্রোটার দিকে ছুটে যায়।-মেরেই ফেলবো, হারামজাদাকে।
কিন্তু মারা আর হলো না। নিগ্রোর তলোয়ারের ফলা আমূল বিদ্ধ হয়ে গেলো তার বুকে। সেই নিশুতি নিস্তব্ধ নির্জন রাতে ইরবিজার রক্তাক্ত দেহ ধুলায় লুটিয়ে পড়লো।
এইভাবে কুড়িতেই বিনষ্ট হয়ে গেলো তার অমূল্য জীবন।
এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।
পরদিন বাহান্নতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়।
নৃশংস ভাবে নিহত হলো। এইভাবে অকালে বিনষ্ট হয়ে গেলো, ফুলের মতো সুন্দর একটা জীবন।
ইরবিজার যা কিছু ধনরত্ন ছিলো, সব নিয়ে নিগ্রোটা পাহাড়ের পথে উধাও হয়ে গেলো। মতিয়া বসে বসে কাঁদতে থাকে। এমন সময় দেখা গেলো, সারা আকাশবাতাস কাঁপিয়ে এক অশ্বারোহী বাহিনী ছুটে আসছে। আর একটু কাছে আসতেই মতিয়া সৈন্যবাহিনীর সাজ পোশাক দেখে বুঝতে পারলো, সিসারিয়া সম্ব্রাট হারদুনের বাহিনী। মনে কিছুটা ভরসা পায়। উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ইশারা করতে থাকে। হারদুব এসে থেমে পড়ে। ইরবিজার রক্তাপুত দেহ দেখে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে আসে।-কে? কে করলে আমার এই সর্বনাশ?
বাগদাদের সুলতান উমর-ইল-নুমানের ক্রীতদাস এক নিগ্রোর হাতে কি ভাবে ইরবিজা নিহত হয়েছে এবং সুলতান উমর তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কি জঘন্য উপায়ে তার উপর বলাৎকার করেছে, সব সবিস্তারে বললো মতিয়া।
সম্রাট হারদুর্ব রাগে গর্জে ওঠে, হুম। এতো বড় স্পর্ধা, তোমার উমর! আমার মেয়েকে বাদী রক্ষিতা পেয়েছে? এর প্রতিদান তোমাকে পাই পাই করে করে মিটিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে আমার আদরের দুলালীর শেষকৃত্য সমাধা করতে হবে।
সারকানের হাতে হারদুবের একশত সৈন্যসামন্ত নিহত হওয়ার পর বাঁদী সর্দারনী সে বুড়িটার মুখ থেকে যখন হারদুব শুনলো, বাগদাদের সুলতান-এর পুত্র সারকান ইরবিজাকে তুক তাক করে ভুলিয়ে তার দেশে নিয়ে গিয়ে উমরের বাঁদী করে রেখেছে, হারদুব তখন এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য এক বিশাল অশ্ব বাহিনী নিয়ে বাগদাদের দিকে ধাবমান হচ্ছিলো। পথিমধ্যে এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়লো সিসারিয়ার সম্রাট হারদুব তার সেনাপতিদের নির্দেশ দিলো, আগে রাজকুমারীর মৃতদেহ যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করতে হবে। তারপর শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করা যাবে।
সুতরাং সম্রাট হারদুব আপাততঃ আক্রমণ স্থগিত রেখে কন্যার মৃতদেহ নিয়ে দুর্গে ফিরে এলো। বাদী সর্দারনী বুড়ি কেঁদে আকুল।—হায় হায়, আমার সোনার বাছার এই হাল কে করলো?
সম্রাট হারদুব বলে, কে আবার, সেই সাচ্চা মুসলমানের বাচ্চা-উমর। শয়তানটা আমার মেয়ের উপর বলাৎকার করেছে। আর তারই ক্রীতদাস দিয়ে হত্যা করিয়েছে। এও তোমাকে বলে রাখছি, সর্দারনী, এর প্রতিশোধ আমি নিজে হাতে নেবো। দেখবো, সুলতান উমর কত বড় শাহেনশাহ! বাদী সর্দারনী বলে, -সম্রাট আপনি অধৈর্য হবেন না। উত্তেজিত হয়ে প্রতিশোধ নিতে গেলে কার্যসিদ্ধি হবে না। প্রতিশোধ নিতে হয়। ঠাণ্ডা মাথায়। মুসলমানরা বলে, শত্রু যখন সব ভুলে নিজেকে অসতর্ক অরক্ষিত করে রাখবে সেই সুযোগে তাকে আক্রমণ করে কাজ হাসিল করো। দরকার হলে এই সুযোগের জন্য চল্লিশ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। শয়তানটাকে কি করে সমুচিত শিক্ষা দিতে হয় আমি আপনাকে দেখিয়ে দেব। সারা পৃথিবীর লোক অবাক হয়ে তারিফ করবে, হ্যাঁ এর নাম বদলা। আমি ওকে সবংশে নিধন করবো। শুধু আমি যা বলি, ভালো করে শুনুন এবং আমাকে সাহায্য করুন। প্রথমে আপনার সারা সাম্রাজ্য খুঁজে গোটা পাঁচেক সুন্দরী কিশোরী সংগ্রহ করুন। তাদের শিক্ষা দীক্ষার জন্যে সবচেয়ে সেরা জনা কয়েক মুসলমান শিক্ষক দরকার। আপনার সাম্রাজ্যে তার অভাব নাই। এই শিক্ষকগুলোর কাজ হবে এই মেয়েগুলোকে তালিম দিয়ে পাক্কা মুসলমানী আদব কায়দায় গড়ে তোলা। আরব ইতিহাস তাদের নখদর্পনে থাকবে। খলিফাদের চৌদ্দ পুরুষের ঠিকুজি কুষ্ঠি মুখস্থ থাকবে। কথাবার্তা চালচলন আদিবাকায়দা নাচ-গান খানা-পিনা রীতি-নীতি আচার আচরণ সব এমন ভাবে তাদের রপ্ত করাতে হবে যাতে কেউ না সন্দেহ করতে পারে-তারা খানদানী মুসলমান ঘরের মেয়ে নয়। এই সব শিক্ষা-দীক্ষা দিতে যদি দশ বছরও সময় লাগে, লাগবে। তবু চুল-চেরা নিখুত নিখাদ হওয়া চাই। কারণ এই মেয়েগুলোই আমার প্রতিশোধ নেবার একমাত্র হাতিয়ার। আপনি বোধ হয় জানেন সম্রাট, ওই অসভ্য জংলী সুলতানটা দাসী বাঁদীদের সঙ্গে ব্যভিচার করে। শুনেছি, তার হারেমে নাকি বেগম ছাড়াও তিনশো ষাটটি রক্ষিতা আছে। সারা বছর ধরে প্রতি রাতে এই জানোয়ারটা এক একটি রক্ষিতার মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। এখন আবার সোনায় সোহাগা হয়েছে আমাদের রাজকুমারী ইরবিজ, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো একশোটা কুমারী। এখন তারাও ভোগের সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানোয়ারটার ভোগলালসার চরম নিবৃত্তি কেমন করে মেটাতে হয় আপনি দেখবেন।
সম্রাট হারদুব-এর মনটা কিছু হাল্কা হয়। বাদী সর্দারনীকে সাবাস জানিয়ে বলে আজই তোমাকে পাঁচটা স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী কিশোরী পাঠিয়ে দিচ্ছি। এমন মেয়ে পাঠাবো, কালে যাতে তারা রগরগে যুবতী হতে পারে।
এই সময়ে শাহরাজাদ দেখলো, রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো সে।
No comments