ওয়াজ মাহফিল দ্বীনি দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম_এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান
ওয়াজ অর্থ উপদেশ, নসিহত, বক্তব্য। যিনি ওয়াজ করেন তাকে ওয়ায়েজ বা বক্তা বলে। ওয়াজ-নসিহত বা উপদেশ দ্বীনী দাওয়াতের অন্যতম একটি অংশ। এটি মানব সমাজের উন্নতি ও সংশোধনের অতুলনীয় পন্থা। ইসলামের শুরু থেকেই এর পবিত্র ধারা অদ্যাবধি চলে আসছে।
মহান আল্লাহ হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল নবী-রাসূল ছিলেন ওয়ায়েজ। এই সূত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন। এই উম্মতের দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করবেন ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া তথা নবীদের উত্তরাধিকারী উলামায়ে কিরাম। আর উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব হলো এই দাওয়াতি কাজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’’ [সূরা নাহল : ১২৫]
দাওয়াতি আলোচনার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন : ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি। ‘ওয়াজ’ হলো সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। সাধারণত ওয়াজ সুরেলা কণ্ঠে উপমার মাধ্যমে আকর্ষণীয় উপায়ে কুরআন, হাদীস ও বিভিন্ন গল্প কাহিনীর সমন্বয়ে পরিবেশন করা হয়।
ইমাম গাজালী রাহ. তার লিখিত গ্রন্থ “আইয়্যুহাল ওয়ালাদ” নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া হতে আখিরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রুতাদেরকে পরকালমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা, ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা, সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তন সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরূপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে, তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানগণ যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে। [মাজালিসূল আবরারর : ৪৮২]
ওয়াজে সাধারণত কুরআনের আয়াত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস, ফিকহি মাসায়িল ও উপদেশমূলক কাহিনী মূল প্রতিপাদ্য হওয়া উচিত। যে ওয়াজে কুরআনের বয়ান সবচেয়ে বেশি, তারপর হাদীসের বয়ান এবং গল্প-কাহিনী সবচেয়ে কম, সেই ওয়াজ বেশি উপকারী। ওয়াজের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত-
১. ইসলামের একত্ববাদ ও তাওহিদ সম্পর্কে আলোচনা। বিশেষ করে আল্লাহ এক হওয়ার দলিল পেশ করা। জগতের ¯্রষ্টা একজনের বেশি হতে পারেন না এবং শিরক মারাত্মক ভুল, এ সম্পর্কে আলোচনা।
২. আখিরাত সম্পর্কে আলোচনা। আখিরাত হওয়া কেন জরুরি তার ওপর আলোচনা। স্বাভাবিকভাবে, আখিরাত না থাকলে মানুষ বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় পেত না এবং তারা যা খুশি তা করতে সাহস পেত।
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রই প্রমাণ করে, তিনি ছিলেন সত্য নবী। কুরআন মাজিদই প্রমাণ করে, কোনো মানুষের পক্ষে এটি রচনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাবি যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে পাওয়া, তা অবশ্যই সত্য।
৪. নামাজ, রোজা, হজ সম্পর্কে আলোচনা। এসবের গুরুত্ব এবং এর উপকার সম্পর্কে আলোচনা; জাকাত সম্পর্কে আলোচনা-বিশেষ করে ফসলের জাকাত ও উশর সম্পর্কে আলোচনা।
৫. ওয়াজ মাহফিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর জীবনী নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা উচিত। তাঁর নবীজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো আলোচনা করা দরকার। বিশেষত বদর, ওহুদ ও আহজাব যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার।
৬. খেলাফতে রাশেদার ইতিহাস এবং তাদের সময়ে তাদের সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত।
৭. সুদ হারাম হওয়া সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা জরুরি। সুদ সবচেয়ে বড় হারামগুলোর মধ্যে একটি।
৮. সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী কী করতে হবে, তা বলা দরকার। ইসলাম সুবিচারকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে।
৯. অশ্লীলতার বিরুদ্ধে আলোচনা করতে হবে। অশ্লীলতা সমাজের নৈতিকতা ধ্বংস করে দেয়। সব ধরনের অশ্লীলতার বিরুদ্ধেই জোর দিয়ে বলতে হবে। বাজে বিজ্ঞাপন, বাজে পত্রিকা, ইন্টারনেটের অশ্লীলতা ইত্যাদি ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে।
১০. প্রধান প্রধান ইসলামী আইন সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। যেমন- বিবাহের আইন, তালাকের আইন ও উত্তরাধিকার আইন। কী কী খাওয়া হারাম; কী কী কাজ নিষিদ্ধ, এসব সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে।
১১. এতিম ও মিসকিনদের সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় এতিম ও মিসকিনদের কথা বলা হয়েছে। জাকাতের একটি খাত হচ্ছে, মিসকিনদের সাহায্য করা। কুরআনে এ কথা বলা হয়েছে যে, এতিমের মাল যেন কেউ ভক্ষণ না করে।
পর্যাপ্ত শিক্ষাগত ইলমি যোগ্যতা, অবয়ব সুরত সুন্নাত মুতাবিক হওয়া, আখলাক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে আদর্শিত হওয়া, তাকওয়ার অধিকারী মুত্তাকি হওয়া, ইখলাসওয়ালা মুখলিস হওয়া, তাওয়াক্কুল-আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা থাকা, ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হওয়া, কপটতামুক্ত সরলমনা হওয়া, বিনয়ী হওয়া, সুমিষ্টভাষী হওয়া, ভদ্র ও মার্জিত রুচিসম্মত হওয়া, দূরদর্শী হওয়া, সব বিষয়ে মতামত না দেওয়া বা কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য না করা, নিজের বিদ্যা ও পা-িত্য জাহির না করা, হিকমতের সঙ্গে কথা বলা, প্রয়োজনমতো কুরআনের আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করা, সহীহ কাহিনী বলা, উদ্ধৃতি যেন নির্ভুল হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা, শব্দ-বাক্য ও উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়া, তাজবিদসহ বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা, গ্রামারসহ আরবি পাঠ করা, কথায় ও কাজে মিল থাকা, উম্মতের ইসলাহ তথা সংশোধন ও কল্যাণকামিতার মনোভাব থাকা, ইতিবাচক কথা ও আশার বাণী শোনানো এবং নিয়ত সহীহ থাকা।
ফাতওয়ায়ে আলমগীরিতে ওয়ায়েজিনদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্যক বলা হয়েছে। সেগুলো হলো :
১. ইলম, কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম।
২. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য থাকা।
৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা।
৪. বক্তা শ্রুতাদের ওপর দয়াদ্র ও বিন¤্র হয়ে কথা বলা।
৫. বক্তা ধৈর্য্যশীল ও সহনশীল হওয়া। [ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০]
১. ওয়াজকে ইবাদাত হিসেবে গন্য করে তার পবিত্রতা ও স্বচ্ছতায় ফিরিয়ে নেওয়া। সুর ও চিৎকারকে মুখ্য হিসেবে গন্য না করা, যদি এগুলো মুখ্য হয়, বুঝতে হবে এটা বিনোদনের চাহিদা। ইবাদতের চাহিদা নয়।
২. আওয়াজকে শ্রোতাম-লী পর্যন্ত সীমিত করে রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। বিশেষত রাতের বেলায়। অন্যের ঘুম, ইবাদাত বন্দেগি এবং অন্যান্য কার্যক্রম যেন ওয়াজ মাহফিলের কারণে ব্যাহত না হয় সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। মনে রাখতে হবে দাওয়াতী কার্যক্রম যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়ে যায়।
৩. অপরাধপ্রবনতা দূরীকরণে ইতিবাচক ওয়াজ করা দরকার। দলিল ও যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করা। হৃদয়ের ভাষায়, দরদ দিয়ে কথা বলা। অনর্থক ও অযৌক্তিক চেঁচামেচি ও চিৎকার পরিহার করা।
৪. কোন পক্ষকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকা। মনোপলি মনোভাব পরিহার করা। মনুষ্যত্ব কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব নয়। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের আঘাত না করে দ্বীন দুনিয়ার সমন্বয়ের পয়গাম শ্রোতাদের মাঝে তুলে ধরা।
৫. নিজের নামের সাথে বাহুল্য পদবি ও উপাধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। মুফাচ্ছিরে কুরআন, মুহাদ্দিস এগুলো তাফসির ও হাদীস শাস্ত্রের নিজস্ব পরিভাষা। মুফাসসির ও মুহাদ্দিস এর গুণাবলী ও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও এসব পরিভাষার ব্যবহার মিথ্যাচারের শামিল। সুতরাং এগুলো পরিহার করা উত্তম।
৬. চরমপন্থা পরিহার করে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। মানুষকে সুসংবাদ দেওয়া; যত্রতত্র দুঃসংবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকা। মানুষকে নিরাশ না করা। যাকে তাকে কাফের না বানানো। ওয়াজ তো কাফেরকে মুসলমান বানানোর জন্য, মুসলমানকে কাফির বানানোর জন্য নয়।
৭. ওয়াজ করতে নির্ধারিত হারে টাকা দাবি করা শারিয়া সম্মততো নয়ই; রুচিহীনতাও বটে। তবে ওয়ায়েজিনদেরকে যাতায়াত খরচ এবং যুক্তিসঙ্গত হাদিয়া দেওয়া যেতে পারে।
হাদিয়া দেওয়া ও নেওয়া সুন্নত। তবে ওয়াজ করে তার বিনিময় গ্রহণ না করাই উত্তম। এতে এর সুফল বা প্রভাব কমে যায়। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘অনুসরণ করো তাদের, যারা তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথপ্রাপ্ত।’’ [সূরা ইয়াসিন : ২১]
ধর্মীয় সেবা দিয়ে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হলেও তা উত্তম নয়। তাই সামর্থ্যবানদের জন্য তা পরিহার করাই শ্রেয়। এটাই ইখলাস ও তাকওয়ার উচ্চ স্তর। নবী-রাসূলগণ দাওয়াতি কাজের শেষে সাধারণত এভাবেই বলতেন, ‘‘আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না; আমার পুরস্কার তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে।’’ [সূরা শোআরা : ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪ ও ১৮০]
৮. ওয়াজে বিতর্কিত মাসআলা-মাসায়িল, অপ্রয়োজনীয় অভিনব বিষয়, মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ, ভুল-বোঝাবুঝি ও সংশয় সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো বিষয় না রাখা।
১. ওয়াজ মাহফিলগুলো সাধারণত মানুষের অনুদানে পরিচালিত হয়। দ্বীনি কাজে ব্যবহারের নিয়তে তারা অনুদান দিয়ে থাকেন। অতএব তা ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন খুবই জরুরি। অপচয় কোনভাবেই কাম্য নয়।
২. যেসব এলাকায় মাদরাসা রয়েছে, সেখানে মাদরাসার মাহফিলই মূল মাহফিল হয়ে থাকে। মাদরাসাগুলো ওয়াজের মাধ্যমে জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে থাকে। এ মাহফিলের মাধ্যমেই মাদরাসাগুলোর সারা বছরের খরচের একটি বড় অংশ আহরিত হয়। যা দ্বীনী শিক্ষায় গতি যোগায়। অতএব সম্ভব হলে স্থানীয় সংস্থার ওয়াজকে মাদরাসার ওয়াজের সাথে যুক্ত করে নেওয়া যেতে পারে।
৩. অতিথি নির্বাচনে সেসব আমলদার ও বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামকে প্রাধান্য দিন, যাদের ওয়াজ জীবনঘনিষ্ঠ ও ইতিবাচক। ক্বুরআন, সহীহ হাদীস, প্রামাণ্য ও বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাবলী দ্বারা যাদের বক্তব্য সজ্জিত । অনির্ভরযোগ্য ও মিথ্যা কাহিনীমুক্ত নিত্যকার প্রয়োজনীয় আমল আখলাকের কথা যাদের বক্তব্যে রয়েছে।
৪. অহেতুক আলোকসজ্জা করা এবং ব্যয়বহুল সুউচ্চ তোড়ন নির্মাণ করা বর্তমানের ধর্মসভাগুলোর আরেকটি ত্রুটি। প্রয়োজনীয় আলোর জন্য পর্যাপ্ত বাতির ব্যবস্থা করা তো দোষণীয় নয়। কিন্তু নিছক বিলাসিতা ও শৌখিনতার জন্য, জাঁকজমক করার জন্য রঙবেরঙের বাহারি বাতি জ্বালানো দ্বারা ধর্মীয় গাম্ভীর্যতা নষ্ট হয়। আধ্যাত্মিকতার অপমৃত্যু ঘটে। তাই অহেতুক আলোকসজ্জা, ব্যয়বহুল সুউচ্চ তোড়ন নির্মাণ করা যাবে না এবং অপচয় পরিহার করা দরকার।
৫. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লাভ, তহবিল বাড়ানো, বিরাট গণ জমায়েত ও সুখ্যাতি লাভের আশা না করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করতে হবে।
৬. নির্দিষ্ট সময়ে মাহফিলের মাঠে নামাযের ব্যবস্থা করা। তাহলে যারা পাবন্দির সঙ্গে জামাতে নামায আদায় করেন, তারা যেমন সহজেই জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করতে পারবেন, যারা নিয়মিত নামায পড়েন না, তারাও মাহফিলে শরিক হওয়ার সুবাদে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করতে পারবেন। কে জানে, হয়তো এর মধ্য দিয়ে এমন কারও জীবনে শুরু হয়ে যেতে পারে নামাযের ধারাবাহিকতা!
৭. মাহফিলের যেখানে আয়োজন, এর আশেপাশের মসজিদগুলোর নির্ধারিত নামাযের সময় যদি বয়ান চলতে থাকে, তাহলে সেসব মসজিদে নামাযরত মুসল্লিদের নামাযেও ব্যাঘাত ঘটবে-এটাই স্বাভাবিক। মাহফিল চলাকালীন নামাযগুলো যদি আশেপাশের মসজিদগুলোর সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে স্বাভাবিক সময়ে আদায় করা হয় তাহলে সহজেই এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা যেতে পারে।
৮. গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ চালিয়ে নেওয়া। সাধারণত এমন কাউকেই গভীর রাতে ওয়াজের মঞ্চে নিয়ে আসা হয়, যার কথা শ্রোতাদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। অনেকক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মিও হয়ে পড়েন বক্তাগণ। আর এ রাতদুপুরে যারা ওয়াজ করেন তাদেরকে হয়তো প্রায়ই রাত জাগতে হয়। একারণে হয়তো তারা দিনের বেলায় কোনো একটা সময় বিশ্রামের জন্যে ঠিক করে নেন। কিন্তু যারা বছরে এক-দুইবার গভীর রাত জেগে ওয়াজ শোনেন, তারা তো আর রাত জাগতে অভ্যস্ত নন। এতে যে তাদের পরের দিনের নিয়মিত কাজগুলো বিঘিœত হবে কেবল তা-ই নয়, বরং একটু পরের ফজরের নামাযের জামাত ছুটে যাওয়ার, এমনকি নামাযটি কাজা হয়ে যাওয়ারও সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। যারা নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করেন, এ আশঙ্কা থেকে মুক্ত নন তারাও। শ্রোতাদের কেউ কেউ হয়তো এমনিতেই ফজরের নামায পড়ত না, কিন্তু ওয়াজ শেষে গভীর রাতে কিংবা শেষ রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে যদি নামাযের সময় সজাগ হতে না পারে, তাহলে এর দায় তো মাহফিল কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না। তাই মাহফিলগুলোকে রাত ১২টার আগেই শেষ করার মানসিকতা রাখতে হবে।
৯. মাহফিল চলাকালে এর আওয়াজ কতদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হবে-তাও একটি বিবেচনার বিষয়। আয়োজনের কথা যখন নানানভাবে জানিয়ে দেওয়া হল, মাইকিং পোস্টার তোরণ ইত্যাদি সম্ভাব্য সকল পদ্ধতিতে, তখন যার মনে ওই ওয়াজ শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হবে সে তো মাহফিলেই শরিক হবে। আগত শ্রোতাদের উপস্থিতি যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, মাইকের সংযোগও ততদূর পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা মাহফিলে আসেনি, হয়তো আসার ইচ্ছাই করেনি, কিংবা আসতে চেয়েও পারেনি- অসুস্থতা জাতীয় কোনো ওজরের কারণে, এমনকি কারও ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে-পরদিন সকালে তাকে বসতে হবে পরীক্ষার টেবিলে, মাহফিল কর্তৃপক্ষ যদি এ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে উপস্থিত-অনুপস্থিত সকলের জন্যেই ওয়াজ শোনার ব্যবস্থা করে এবং দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মাইক ছড়িয়ে দেয়, তাহলে কতজন যে কতভাবে কষ্টের শিকার হয়-তাও ভেবে দেখা দরকার।
১০. দিন যাচ্ছে, বাড়ছে মাহফিল। বাড়ছে মাহফিলের জন্যে তহবিল সংগ্রহের কৌশলও। ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে চাপে ফেলে যেমন টাকা আদায় করা হয়, তেমনি সুযোগমতো সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় চাদা। সিএনজি অটোরিকশার মতো যানবাহন যেসব রাস্তায় চলে, এর আশপাশে যদি কোনো মাহফিল হয়, কখনো দেখা যায়, রাস্তার পাশে মাইক বাজছে, টাকা নেওয়ার জন্যে কয়েকজন বসেও আছে। কিন্তু সমস্যার কথা হল, ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে এমন প্রতিটি যানবাহনকে তারা আটকিয়ে দিচ্ছে। এরপর চলে মাহফিলের জন্যে টাকা আদায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাত্রীদের কেউ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত ওই গাড়িটিকেও ছাড়া হচ্ছে না। কথা হল, কেউ যদি স্বেচ্ছায় টাকা দিয়ে অংশগ্রহণ না করে, তার কাছ থেকে যদি চাপাচাপি করে টাকা আদায় করা হয়, এ টাকা ব্যবহার করা কি বৈধ হবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার।
ওয়াজ নিয়ে সরকারি নিদের্শনা
ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে ওয়াজ মাহফিল এখন আর ময়দানে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে শোনা যায় ওয়াজ মাহফিল। আর এর মাধ্যমে উঠে আসে ওয়াজ মাহফিলের নানা চিত্র। পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়, সুষ্ঠুভাবে ওয়াজ মাহফিল পরিচালনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছয়টি নির্দেশনা প্রদান করেছে। নির্দেশনাগুলো হলো-
১. ওয়ায়েজ হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, সে জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
২. যাঁরা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করার চেষ্টা চালান, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রো-অ্যাকটিভ উদ্বুদ্ধকরণ।
৩. অনেক আলেমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির মতো উচ্চশিক্ষা ছাড়া যাঁরা ওয়াজ করেন, তাঁরাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাই মাদরাসায় উচ্চশিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা।
৪. অনেকেই আছেন, যাঁরা হেলিকপ্টারযোগে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টাচুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তাঁরা নিয়মিত ও সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করেন কি না তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা।
৫. ওয়ায়েজ হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং উসকানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানো বক্তব্য দিলে তাঁদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাঁদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেওয়া এবং
৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা।
“আল্লামা মাহমুদুল হাসান : ওয়াজে লাগামহীন কথাবার্তা বলা উচিত নয় বলে মনে করেন যাত্রাবাড়ী মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও গুলশান কেন্দ্রীয় মাসজিদের খতিব আল্লামা মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, দ্বীন প্রচারের মূলনীতি অনুসরণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ওয়াজ করা উচিত।
আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি : ন¤্র ভাষায় দাওয়াত দিয়ে তাবলিগ জামাত সফলতা পেয়েছে। সুতরাং এভাবেই দ্বীন প্রচার করা উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রামের মহাপরিচালক আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি। তিনি বলেন, ওয়াজের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসা। এটাও দাওয়াতের অংশ।
আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ : যাঁরা ঈমান ও ইসলামের কথা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছেন, তাঁদের ঢালাওভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয় বলে মত ব্যক্ত করে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমাম শাইখুল হাদিস আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসঊদ। তিনি বলেন, আলেমরা সমাজের আয়না। ঢালাওভাবে আলেম-উলামার ওয়াজ নিয়ন্ত্রণ ঠিক হবে না। তবে যদি সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, ঢালাওভাবে ওয়াজ নিয়ন্ত্রণ করলে বাস্তব ক্ষেত্রে সমাজ পিছিয়ে পড়বে। দ্বীনের আলো সমাজে কমতে থাকলে অন্ধকার এখানে জায়গা করে নেবে। সমাজকে আলোকিত করতেই এই সমাজের বাতাসে দ্বীনের কথা ছড়িয়ে দিতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতেও আলেমদের ওয়াজ ও বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লামা আরশাদ রাহমানি : ওয়াজ মাহফিলে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চাই না, তবে বক্তাদের সংযম চাই-এই মর্মে অভিমত দিয়েছেন ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকার মুহতামিম আল্লামা আরশাদ রাহমানি।
মাওলানা মামুনুল হক : জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও সময়ের জনপ্রিয় বক্তা মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ওয়াজ মাহফিলের যে বিষয়গুলো বিভ্রান্তি তৈরি করছে বলে মনে করা হয়, সেসব বিষয়ে আলেমদের সর্বোচ্চ অথরিটি আল-হাইয়াতুল উলয়া একটি ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদের এই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ সুফল বয়ে আনবে না এবং তা গ্রহণযোগ্যও হবে না।” [কালের কণ্ঠ, ০৪ এপ্রিল, ২০১৯]
“মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী : হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ বুকে ইসলামকে লালন করেন। দেশের রাষ্ট্রধর্মও ইসলাম। সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। ইসলামের প্রচারার্থে ওয়াজ মাহফিলে বাধা প্রদান বা শরিয়তসম্মত কোনো বক্তব্যকে হেয় করা বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা প্রকারান্তরে ইসলামেরই বিরোধিতা করার শামিল। এটা সরাসরি ইসলামের ওপরে নগ্ন হস্তক্ষেপ।” [ দৈনিক ইনকিলাব, ০৬ এপ্রিল, ২০১৯]
মানুষ কুরআন-হাদীসের কথা শোনার জন্য সব থেকে বেশি পাগল। আর সেটা হতে হবে কোন আলেমের মুখ থেকে। কোন আলেম যদি বক্তৃতা করেন, মানুষ মনযোগ দিয়ে সেটা শোনে। ভক্তি সহকারে আলেমদের ওয়াজ তারা হদয়ঙ্গম করে নেয়। কেননা, আলেমগণই কুরআন-হাদীসে পারদর্শি। তারা সব থেকে বেশি কুরআন-হাদীস জানে। কুরআনের অর্থ, কুরআনের তাফসীর-ব্যাখ্যা আলেমরাই ভাল বলতে পারেন।
যুগ যুগ ধরে জাতির রাহবার ওলামায়ে কেরাম উম্মতের হিদায়াতের লক্ষে দ্বীনের অন্যান্য খিদমতের পাশাপাশি একনিষ্ঠতার সাথে ওয়াজ মাহফিলের কাজ চালিয়ে গেছেন। খেয়ে না খেয়ে, দেশ দেশান্তরে সফর করে দ্বীন প্রচার করেছেন ওলামায়ে কেরামগণ। তথ্যনির্ভর ইখলাস ও নিষ্ঠাপূর্ণ নসিহতের মাধ্যমে কুরআন-হাদীসের কথাগুলো পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। আওয়াম মানুষও তাদের বয়ান শুনে ইতিবাচকগুলো গ্রহণ ও নেতিবাচকগুলো বর্জন করে খুঁজে নিয়েছেন ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ। বর্তমান জামানায় দাওয়াতি কার্যক্রম (ওয়াজ মাহফিল) বহুগুণে বেড়েছে। মাদরাসা ও মাসজিদের পাশাপাশি বিভিন্ন সঙ্ঘ কর্তৃক অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা-সম্মেলন। এগুলো খুব মহৎ উদ্যোগ। যারা এগুলোর আয়োজন করেছেন আল্লাহর দরবারে সহীহ নিয়তের কারণে অবশ্যই এর প্রতিদান পাবেন, পুণ্যের অধিকারী হবেন। ইখলাস ও নিষ্ঠাবিহীন ওয়াজ কখনো কারো উপকারে আসে না।
স্বার্থবাদী (কনটাক্টওয়ালা, ইখলাস ও ইলমহীন আলেম) বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালে ওয়াজে কারো হিদায়াত আসবে না। ওয়াজে ইখলাস ও নিষ্ঠা জরুরি। ওয়াজ দ্বারা মানুষ ও সমাজকে পাল্টাতে হলে সর্বাগ্রে সবার নিয়ত পরিশুদ্ধ করা দরকার।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments