ভাষা আন্দোলন সূচনালগ্ন ও পটভুমি_আহমদ মতিউর রহমান

 
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন ২১ ফেব্রুয়ারি এটি শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে ( ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পাকিস্তাানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
 
মূলত বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
 
 বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে মুসলমানরা ছিল অবহেলিত অনেক ক্ষেত্রে ঘৃণিত। হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে তারা ছিল জর্জরিত। অবস্থা এমন ছিল যে মুসলমান প্রজাদের হিন্দু জমিদারদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হলে জুতা পায়ে দিতে যেতে পারতেন না, যেতে হতো জুতা খুলে খালি পায়ে। তাদের বলা হতো যবন। মুসলমানের স্পর্শ লাগলে হিন্দুদেরস্নান করতে হতো। পরিস্থিতির উত্তরণে মুসলমানরা ক্রমে সংগঠিত হতে শুরু করে , ১৯০৬ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর প্রচেষ্টায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে কয়েক বছর মুসলিম প্রধান এলাকা ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তবে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু নেতাদের প্রবল আপত্তির মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন চালু হওয়ার পর মুসলিম নেতা শেরে বাংলা কে ফজলুল হক কলকাতার মেয়র যুক্ত বাংলা আসাম রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে মুসলিম নেতৃত্ব সামনে আসে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪০ সালে শেরে বাংলার লাহোর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ধারণা বাস্তব রূপ লাভের আশা জাগ্রত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন অস্তিত্ব জানান দেয়। মূলত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। বাংলা পুনরায় ভাগ হয়ে যায়। হিন্দু প্রধান পশ্চিম বঙ্গ পড়ে ভারতে আর মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গ পড়ে পাকিস্তানে।
 
কিন্তু পাকিস্তনের দুটি অংশ-পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অনেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব বঙ্গ প্রদেশকে পূর্ব পাকিস্তান উ্েল্লখ করে থাকেন। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান নাম হয় আরো পরে  ১৯৫৬ সালে। ততদিনে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে গেছে। পূর্ব বাংলার  বাংলাভাষী মানুষ পাকিস্তানের নতুন প্রশাসনের আকস্মিক অন্যায্য সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন তরুণ অধ্যাপকের নেতৃত্বে গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ। এই সংগঠনের উদ্যোগেপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ?’ এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়।
 
এই পুস্তিকা বাঙলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা পালন করে এবং যারা প্রথমে এই বিষয়টি বুঝতে চান নি বা পারেন নি তাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে। যাই হোক বাঙলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠলে সেই আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
 
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ( ফাল্গুন ১৩৫৮) আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বরকত, রফিক,শফিউর, সালাম, জব্বারসহ আরও অনেকে। এভাবেই শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর পর নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে ভাষার সংগ্রাম এগিয়ে যায় এবং গতি লাভ করে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ২১ ফেব্রুয়ারির শোকাবহ ঘটনা। এই šেদালনের বিভিন্ন পর্যায়ে বহু ভাষা সংগ্রামী জড়িত হয়েছেন এবং ভূমিকা রেখেছেন। তবে সব শহীদের নাম আজো আমরা জানি না। এই জনের নামই প্রচার পেয়েছে বেশি। অলিউল্লাহ বা অহিউল্লাহ নামে এক তরুণের শহীদ হওয়ার কথা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি, কিন্তু বিস্তারিত তথ্য পাই নি। আর উপরোক্ত জনের মধ্যে জন শহীদ হন ২১ ফেব্রুযারি বাংলা ফাল্গুন। ভাষা সংগ্রামীদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুরে এক প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে গুলিতে আহত হন শফিউর। সে দিনই সন্ধ্যায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
 
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তাানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তাানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বিশ্বব্যাপী  গভীরশ্রদ্ধা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে।
        
১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ নগ্ন পায় প্রভাত ফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রুহের মাগফিরাত  কামনা করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর শোক মিছিল মৌনমিছিল প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় একুশের অনুষ্ঠানমালার সাথে অন্যান্য কর্মসূচীও যুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে থাকে।
 
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
বর্তমানের পাকি¯তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি পূর্বে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী‎‎ এবং মৌলভী আবদুল হক প্রমুখদের  চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় উন্নীত হয়। উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষাটি অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো-আর্য ভাষা পালি-প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্তিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কির ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে। দিল্লি সুলতানাত মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়। এর পারসিক-আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যেখানে হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হত।
উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু বাংলার (ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশ) মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা, যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই বহু মুসলিম লেখক কবি এবং  মুসলিম নারী শিক্ষার গ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম লীগ ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল, যা ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গ্রণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর এর পূর্ব অংশের প্রতি পশ্চিম অংশ কম গুরুত্ব প্রদান করে। উর্দুকে পূর্ব বাংলা প্রদেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া হতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিবাদ হয়, কেননা পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষ উর্দুর সঙ্গে ততটা পরিচিত ছিল না, এই ভাষা তারা রপ্তও করে নি। একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এই ঘোষণা শাসকবর্গের কাছ থেকে বার বার আসতে থাকায় ঢাকা বিশ^দ্যিালয়ের ছাত্ররাই প্রথমে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। সেই পর্যায়েই তমদ্দুন মজলিস আরো পরে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়, যেকথা শুরুতে উল্লেখ করেছি।  
 
আন্দোলনের সূচনা
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়: ভারত, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার), সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) এবং পাকিস্তান ,যার মধ্যে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা এখন বাংলাদেশ
 
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) বাংলাভাষী কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকি¯তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকি¯সানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তাবের বিরোধিতা প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাদ দেয় সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান  উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এর প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে।
 
নেতৃস্থানীয় বাঙালি -িতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন। পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন যে, “আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন যে, উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজনিরক্ষরএবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেইঅনুপযুক্তহয়ে পড়বে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন।
 
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটি ব্যতিক্রমী আন্দোলন, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ভাষার প্রশ্ন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলাদেশের জনগণ যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, বিশ্বের ইতিহাসে তার আর কোনো নজীর নেই। গত শতাব্দীতে বাঙালি জাতি যে দুটি শ্রেষ্ঠ অর্জন নিয়ে গর্ব করতে পারে তার একটি হল স্বাধীনতা অর্জন এবং অন্যটি হল রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করা। দুটি অর্জনই অনন্য সাধারণ। যুদ্ধ করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা এই দুটি কোনো জাতির পক্ষেই একসাথে করা সম্ভব হয়নি। শুধু বাংলাদেশে নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য জাতির জন্যও শিক্ষণীয় অবদান রেখেছে।
 
বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালি জাতির এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত। আর এই ভাষা আন্দোলনে নিহিত ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলন। ভাষার প্রশ্নে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে এবং ছিনিয়ে আনে বিজয়। বর্তমানে বিশ্বের সমৃদ্ধশালী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা।
 
তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা আজো চালু করা হয় নি বা বলা যেতে পারে চালু করা যায় নি। এটা আমাদের সবার ব্যর্থতা। আমরা এখনো ইংরেজিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, ভালো ইংরেজি না জানলে চাকুরি হয়না। বেসরকারী কোন বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয় না। তিন চারটি বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয় ছাড়া দেশের অর্ধশতাধিক বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগই নেই। ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাংলা সাইনবোর্ড চোখেও পড়ে না বাংলা। শিক্ষিত শ্রেণী বলে দাবিদার শহুরে ছাত্রছাত্রী নাগরিকরা বাংলা সন বাংলা মাসের তারিখ সম্পর্কে বেখবর। এমনটা হওয়া উচিৎ ছিল না। এসব বিষয়ও আমাদের ভাবতে হবে। আরেকটা কথা সেই সময়ে ভাষা আন্দোলনের ধারে কাছেও ছিলনা এমন এমন সংগঠন ব্যক্তি ভাষা সৈনিকের দাবিদার সাজতে চায়। তাতে আসল ভাষা সৈনিকরা যেন চাপা পড়ে যায় বা যাচ্ছে। এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। নির্মোহ চিত্তে সে সময়ের কথা বর্ণনা করতে হবে, যার যার ভূমিকা তার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় উচিৎ হবে না।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.