দুই টাকা_আহসানুল ইসলাম
আতাহার ছাড়া এই শহরে মনসুরের আর কেউ নেই। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আতাহার মনসুরকে থাকতে দিয়েছে।
আতাহার যে মেসে থাকে সেই মেসে সিঙ্গেল চৌকিতে দুজনের শুতে খুবই কষ্ট হয়। আতাহার ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও মনসুরকে সরাসরি না বলতে পারে না, কেন জানি মায়া হয়।
একই সাথে লেখাপড়া শেষ করে আতাহারের চাকুরি হলেও মনসুরের কেন জানি হয়ে উঠছে না। মনসুর দু’শো টাকা নিয়ে এই মেসে উঠে, খাবার খরচ আতাহারই দেয় তার পরও গতকাল হতে পকেট শূন্য। সর্বশেষ যে পঞ্চাশ পয়সা ছিল তা একটা পান খেয়ে খতম করেছে, পানটা খাবার পরই মনে হয়েছে পঞ্চাশটা পয়সাই জলে গেল। বাকি টাকা কয়েক জায়গায় চাকুরির দরখাস্ত এবং এক জোড়া সেন্ডেল কিনতে খরচ হয়েছে, এই বাজারে দুশো টাকায় এক মাস পাঁচ দিন চলা অষ্টম আশ্চর্যের বিষয় এবং বিষয়টি গ্রিনিজ বইতেও লিপিবদ্ধ করার জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে।
এই পকেট খালি হবার খবর আতাহার জানতে পেরে ভড়কে গেছে, একেতো দুইবেলা খাচ্ছে তার ওপর আবার টাকা-পয়সা ধার চায় কিনা কে জানে? আপদ বিদায় করা দরকার…
মনসুর ভেতরে-ভেতরে হতাশ, তার এখন কী হবে? এতদিন একজনের ঘাড়ে বসে মেহমান হয়ে থাকা বড়ই লজ্জার ব্যাপার।
মনসুর ইদানীং দুপুরে মেসে খেতে আসে না শুধু রাতেই খায়, দুপুরে পেট ভরে পানি খেয়েই চলে যায়। সকালে নাস্তা না খাবার গোপন রহস্য অনেক আগেই তার আয়ত্তে, তবুও মাঝে মধ্যে দু’এক টাকায় মুড়ি, অথবা একটা তন্দুল রুটি তরকারি ছাড়াই সকালের পর্বটা সারা গেছে। কিন্তু আজ হতে পকেট যে মরুভূমি…
সকালে অন্য সবার মতো মনসুরও তারাহুড়ো করে বের হয়, অন্যদেরকে নিজের ব্যস্ততা জাহির করে বুঝিয়ে দেয় আমিও মহাব্যস্ত বৈ কি….
অন্যান্যরা মনসুরকে নিয়ে কানাঘুষা করে টিটকারি করতেও ভুলে না, বরিশালের করিম মিঞা প্রশ্ন করে।
-মিয়া ভাইর কি কোন চাকরি অইলো।
মনসুর অনিচ্ছাসত্ত্বেও উত্তর দেয়।
-না হয় নাই, তবে হবে।
-কী করে বুজলেন?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর মনসুর দিতে পারে না, দেবার চেষ্টাও করে না, কারণ লোকটা প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য নয়, স্রেফ বিব্রত করাই তার উদ্দেশ্য।
লোকটা গায়ে পড়ে আবারো কথা বলে,
-
-হুনেন মিয়া ভাই, একটু জ্ঞান খাটান, একজন মানুষের ওপর এতদিন মেহমান হয়ে থাকা ঠিক না, বেচারা আতাহার তো আপনাকে কিছু বলতে পারে না…
মনসুর লোকটার দিকে এমনভাবে তাকায়, যার মানে হতে পারে- হে গাধা তুই বড়ই গর্দভ, নইলে কেন বুঝিস না আমি মেহমান হবার জন্য কতোটা লজ্জিত।
লোকটা মনসুরের চাহনির সামনে অসহায় হয়ে উঠে; সম্ভবত কিছুটা ভয়ও পেয়ে বসে, সে দ্রুত কেটে পড়ে…
মনসুর সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বের হয় রাস্তায়। ওর সব চাইতে পরিচিত এবং জানাশোনা জায়গা এখন রমনা পার্ক, এখানেই সে দুপুরের নিদ্রা পর্ব সেরে নেয়, অবশ্য প্রথম প্রথম ক’দিন এখানেও সমস্যা হয়েছিল, পার্কে ঘোরাফেরা করা মেয়েরা বিরক্ত করতো, গায়ে পড়ে কথা বলতো, একদম কম বয়সি মেয়েরাও এই লাইনে, দেখে মনসুরের মন বেদনায় রক্তিম হয়ে ওঠে…
অথচ এই মেয়েগুলোই কিনা তাকে অশ্রাব্য প্রশ্ন করে। ঐ দিন গা ঘেঁষে একটা মেয়ে বসেই মনসুরকে প্রশ্ন করে-
-
-কি লাগবো?
মেয়েটা এ লাইনে পাকা। মুহূর্তেই মনসুরের মুখ দেখে বুঝতে পারে: আদমের “পকেট খালি” এর কাছে বসে কোন লাভ নেই…
মেয়েটা নিজেকে তিরস্কার করতে করতে অন্যদিকে চলে যায়।
কয়েকদিনে ঐ মেয়েটার সাথে মনসুরের মুটামুটি একটু ভাব জমে উঠে.. মনসুর মেয়েটাকে পরামর্শ দেয়, এই লাইন বড় খারাপ, এ লাইন ছাড়।
মেয়েটা বাদামের কোয়া আঙ্গুলে পিশে ফু দিয়ে পরিষ্কার করে মুখে চালান করতে করতে নিতান্ত স্বাভাবিক উত্তর দেয়।
-প্রতিদিন একশো করে টাকা দিতে পারবেন, যদি দেন তাইলে আর এ লাইনে থাকবো না। আর না পারলে এমন সস্তা কথা দস্তা বানায়ে নিজের পকেটে নিয়ে বসে থাকেন।
মনসুর কিছু বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু মেয়েটা দ্রুত চলে যাচ্ছে বলে কিছুই বলা হয় না। মনসুর মেয়েটার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।
মেয়েটা হাসতে হাসতে একটা ছেলের দিকে যায়, এবং একটু পরেই বেবিটেক্সিতে করে উধাও…
পরের দিন মনসুরকে অবাক করে দিয়ে সে প্রস্তাব করে।
-এই যে জনাব হতাশ ভাই, ব্যবসা করবেন?
-
-কিসের ব্যবসা?
-
-তাও বুঝেন না, আদম জোগাড় করবেন, পারবেন না?
আদম দিয়ে কি হবে ?
মেয়েটা এবার বিরক্ত হয়, -ধ্যাত কিছুই বুঝেন না, ঢাকা আসছেন ক্যা?
মেয়েটা ঝড়ের বেগে চলে যায়। মনসুরের নিজের কাছে নিজেকে সত্যিই বড় বোকা বোকা বলে মনে হয়। সেতো আসলেই বোকা, ডিগ্রি পাশ করা ছাড়া আর কিইবা তার জানা আছে।
মনসুরের আজ মনে হয়; ঐ মেয়েটার কাছে তার যাওয়া উচিত। ব্যবসা যাই হোক, বৈধ কি অবৈধ, একটা কিছু করা দরকার। মনসুর হাঁটতে থাকে, ধানমন্ডির লেক হয়ে কলা বাগান বাসস্ট্যান্ড তার উদ্দেশ্য। এখান থেকে রমনা পার্ক, সে সেন্ডেলে চট্ চট্ আওয়াজ তুলে সামনে এগোয়.. সে হাঁটছে, এ হাঁটার যেন শেষ নেই…
মনসুর নিজেও হাঁটা থামাতে চায় না কিন্তু নিয়তির ব্রেকে তাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। সেন্ডেলের ফিতা ছিড়েঁ গেছে। অবশ্য আজই প্রথম না। গত সপ্তায়ও একবার ছিঁড়েছিলো, সে দিন অবশ্য পার্কের কোনায় অযতে্ন বেড়ে ওঠা রুগ্ন খেজুরগাছের কাঁটা দিয়ে রিপেয়ারিং করা হয়েছিলো। মনসুর খেঁজুরগাছটার কাছে কৃতজ্ঞ। দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর আজ আবার ছিড়েঁ গেল… আশেপাশে কোন খেঁজুরগাছ নেই, এটা ঠিকনা। মেয়রের উচিৎ রাস্তার পাশে খেঁজুরগাছ রোপন করা; সেন্ডেলের ফিতা ঠিক করতে করতে সেন্ডেল কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে মন।
মনসুরের এই সময় মনে হয়, জুতা মেরামত করা কালি বা পালিশ করার একটা মোবাইল দোকান খুললে কেমন হয়।
ব্যবসা সম্ভবত মন্দ হবে না, চার চাকার ধাক্কা গাড়ির সামনে লেখা থাকবে মনসুরের জুতা সেন্ডেলের দোকান। ব্রাকেটে লেখা থাকবে বি. এ। দেশে এখন থেকে গ্রাজুয়েট মুচি পাওয়া যাবে ব্যাপারটা খুবই আশাব্যঞ্জক বটে। মনসুরের ঠোঁট নেচে হাসি উঠে, এই ব্যবসার সেই হতে পারে প্রথম ব্যক্তি হা… হা…
মনসুরের ব্যবসায়িক ভাবনায় বাধা পড়ে, রাস্তার উল্টো পাশে একটা মিনিবাস ঘ্যাজ ঘ্যাজ শব্দ করে থামে… বাসের ঘ্যাজ ঘ্যাজ শব্দের চাইতেও দ্বিগুণ ঘ্যাজ ঘ্যাজ শব্দে মন প্রাণ উজাড় করে বালক বয়সী হেলপার হাঁক ছাড়ে… এই গুলিস্তান, সাইন্স ল্যাবরেটরি, বাটা সিগন্যাল, কাঁটাবন মসজিদ.. পি..জি- মনসুর হেলপারের আহবান অগ্রাহ্য করতে পারে না। ইতিমধ্যে তার সেন্ডেলের ফিতা প্রাণ পেয়েছে… মনসুর দৌড়ে গাড়িতে ওঠে..
কন্ট্রাকটর পিছনের সিটে জায়গা করে দেয়। চার জনের মাঝে গাদাগাদি অবস্থা। নড়া চড়ার উপায় নেই। প্রচন্ড গরম। দেখতে দেখতে মানুষের গিজ-গিজ গরমের প্রচণ্ডতা আরো বৃদ্ধি পায়।
মনসুরের গা-ভিজে জবজবে হয়ে ওঠে।
শুধু যে গরমে গা ভিজে যাচ্ছে ব্যাপারটা শুধু তা নয়, মূল কারণ ওর পকেটে কোন পয়সা নেই। কন্ট্রাকটর ভাড়া উঠাতে উঠাতে এ দিকেই আসছে। এই বিপদে কি দোয়া পড়লে উদ্ধার পাওয়া যাবে তা ওর জানা নেই, জানা থাকলে ভাল হতো।
কন্ট্রাকটর প্রচণ্ড ব্যস্ত, কারো সাথে এক কথার জায়গায় দু’কথা বলার সময় নেই। তার লোকাল বাস। যে কোন স্টপেজে ভাড়া না দিয়ে যে কোন ভদ্রলোক নেমে যেতে পারে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাড়া উঠাচ্ছে, মনসুর ঘুমের ভান করে, কন্ট্রাকটর ভাড়া চাইতেই, অত্যন্ত স্বাভাবিক উত্তর দেয়,
-
-পাঁচ টাকার নোটটা তো ভাই একবার দিলাম।
-কহন দিলেন।
-ক্যান ঐ জায়গায় যখন দাঁড়ানো ছিলাম। বলেই সামনের দিকে দেখায়। কন্ট্রাকটর কথা না বাড়িয়ে দু’টাকা ফেরৎ দেয়, মনসুর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় বাম হাতে টাকাটা পকেটে রাখে আর ভেতরে ভেতরে আলোড়িত হয়, অবিশ্বাস জন্মে নিজের প্রতি। সে এত সুন্দর মিথ্যে বলা শিখে গেছে?
জি.পি.ওর সামনে নেমে তার বিখ্যাত সেন্ডেলে আওয়াজ তুলে হাঁটতে থাকে, রাস্তার বাম পাশে গোল হয়ে মানুষের জটলা, মনসুর ভিড় ঠেলে প্রবেশ করে।
লজ্জাবতী গাছের শেকড় নিয়ে এক ভদ্রলোক লেকচার দিচ্ছে, মানুষ অভিভূত হয়ে লোকটার কথা শুনছে – সেক্স বিষয়ক এমন রোগ নেই যা ভাল হয় না এই শেকড়ে।
শুধু এটা নিয়ম মত সংগ্রহ এবং নিয়ম মত ব্যবহার করলেই ফল। লজ্জাবতী গাছের শেকড় বিক্রি ভালই হলো, দু’ইঞ্চি শেকড়ের দাম বিশ টাকা।
মনসুর মনে মনে প্রস্তুতি নেয়, লেকচার মুখস্ত করে।
আপনার যে কোন ধরনের সমস্যা… এই যে জনাব ভায়াগ্রার দরকার নেই… আমার এই শেকড় আপনাকে… আঠারো মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত… অশ্বশক্তি এনে দিবে।” মনসুরের ঠোঁট নেচে হাসি নেমে আসে। শেকড়ের ব্যবসা কাল হতেই শুরু করবে। শেকড়ের বিদ্যাই বড় বিদ্যা!
মনসুর চিট্ করে আনা দুই টাকা বের করে চোখের সামনে ধরে। এক হাতে ধরে অন্য হাতের আঙ্গুলে টোকা দেয়। কাল যেই পকেটে পঞ্চাশ পঁয়সার আধুলিও ছিল না, সেখানে আজ দুই টাকা। দুই টাকা হতে দুহাজার, দুহাজার হতে দুই লক্ষ হতে কতক্ষণ? মনসুর রমনা পার্কের দিকে হাঁটা দেয়। লজ্জাবতী গাছ খুঁজতে হবে।
তার প্রচুর শেকড় দরকার…
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments