আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৫১
ইংরেজি অনুবাদ : ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
বাংলা অনুবাদ : ক্ষিতিশ সরকার
চরস খোরের কাহিনী
নিগ্রো মেয়েটা বলতে থাকে :
যাই হোক, তখন তার অতি দীন দশা। জামা কাপড় কেনার পয়সা নাই-পরণে শতছিন্ন ময়লা পোশাক। খালি পা। ভিক্ষে করে খায়। একদিন বাজারের পথে পথে ঘুরে ভিক্ষে করছিলো, এমন সময় পায়ে একটা পেরেক ঢুকে যায়। অনেক রক্তপাত হতে থাকে। কিছুতেই বন্ধ করা সম্ভব হলো না। একটুকরো কাপড় ছিঁড়ে বাঁধলো। কিন্তু রক্ত আর বন্ধ হয় না।
শহরে গরীবদের জন্য নিখরচায় স্নানের হামাম ঘর আছে। সেখানে গিয়ে বসার ঘরে ঢুকে বসে পড়লো। একটু বিশ্রাম কোরর পর একটা কলের কাছে গিয়ে পোটা ধুয়ে সাফ করছে এমন সময় নজবে পড়লো, একটা লোক তার পাশে, যে লোকটা বসেছিলো, সে যেন কি একটা জিনিস চিবুচ্ছে। কেমন যেন কৌতূহল হলো। লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, কি চিবুচ্ছে গো?
লোকটি তার চোয়াল থেকে এক টুকরো বের করে ওর হাতে দিয়ে বললো, খাও, দিল-এর সব দুখ দরদ বেমালুম সাফ হয়ে যাবে।
আমাদের গল্পের নায়ক হাসিসের টুকরোটা নিয়ে মুখে মুরে চিবুতে থাকলো। কোনও
খাওয়ার অভ্যোস নাই, তাই সে একটু পরেই বিনা কারণে খিক্ খিক্ করে হাসতে লাগলো। উপস্থিত সবাই এ দৃশ্য দেখে অবাক! লোকটা পাগল নাকি। একটু পরেই শ্বেতপাথরের মেজেয় শুয়ে পড়ে প্রলাপ বকতে শুরু করলো। সেই প্রল্যাপোক্তি থেকে এই কাহিনীটুকু দাঁড় করানো হয়েছে।
একটা হামামে তাকে নাংটো করে ফেলা হয়েছে। দুটো নিগ্রো তার হাত পা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। আর একজন মাঞ্জাদার ধোঁধলের খোসা দিয়ে আগাপাছতলা ঘসে মেজে শরীরের ময়লা সাফ করছে। তাদের খেয়ালখুশি মতো তা যে দিকে ইচ্ছে ঘোরাচ্ছে ফিরাচ্ছে। তার কোনও ওজর আপত্তিই তারা শুনছে না। এমনভাবে তারা দলাই মলাই করছে—যেন হাড় মাংস আলাদা হয়ে যাবে; আড়াইমনি এক মক্কেল তার ভূডিটার ওপর চেপে বসে জঙ্ঘার পাশের দাবনা দু’খানা খাবলে খাচ্ছে।
এইভাবে স্নান সমাপন হলে বড় বড় তিনখানা তুর্কি তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর ঢেকে ওরা বললো, সময় হয়ে গেছে, হুজুর। তাড়াতাডি করুন। এবার আপনার পাত্রীর ঘরে যেতে হবে।
-পাত্রী? পাত্রী কি বলছে? আমি তো শাদীই করিনি!
একটা কালো বোরখা পরিয়ে লোকটিকে নিগ্রো দুটো রাস্তায় বের করে নিয়ে আসে। একটু পরে তারা তাকে একটা বিরাট শয়নকক্ষে এনে বসায়। দামী দামী খাট পালঙ্ক চেয়ার টেবিল আলমারীতে ঘরটা বেশ সাজানো গোছানো। একদিকে টেবিলের উপর একটা প্রকাণ্ড ফুলের বাঁপি। সারা ঘর ধূপ, গোলাপজল আর আতরের খুশবুতে ভরপুর। এ পাশের টেবিলে থরে থরে সাজানো নানা জাতের ফল, হালওয়া, পেস্তা, বাদাম, আখরোট মিঠাই মণ্ড সরবৎ। নিগ্রো দুটো কুর্নিশ জানিয়ে বিদায় নিলো।
একটু পরে ঢুকলো একটি খানসামা। ঘরে ঢুকে কুর্নিশ জানিয়ে বললো, হুকুম করুন জাঁহাপনা, বান্দা হাজির।
লোকটা ফিকফিক করে হাসে।–লোকগুলো সবাই হাসিস খেয়ে চুর হয়ে আছে নাকি? আমাকে বলে কিনা জাঁহাপনা। আরে-আমার চৌদ্দপুরুষের কেউ কখনও সুলতান বাদশাহর সুরৎ দেখেনি। এদিকে এসো বাবা, একটা তরমুজ কাটো, দেখি। আধখানা আমাকে দাও, আর বাকী আধখানা তুমি খাও, বুঝলে? তরমুজের মতো ফল হয় না। আপেল বলো আর আঙুরই বলো-তরমুজই ফলের বাদশাহ।
খানাসামাটা একটু পরে টইটম্বর পাকা তরমুজ এনে সামনে ধরে।
—চমৎকার। কাটো। বেশ ফালা ফালা করে কাটো।
খানসামা তার কথা মতো সরু সরু ফালি করে কেটে রেকবীতে সাজিয়ে দিলো।
লোকটার জিভে জল আসে।-বহুৎ আচ্ছা। কিন্তু এমন রসের জিনিস শুধু মুখে তো ভালো লাগবে না। তুমি এক কাজ কর। একেবারে দুর্গ আনকোরা-বুঝলে? মনে থাকে যেন—একেবারে আনকোরা—একটা ডবকা মেয়েছেলে নিয়ে এসো দিকিনি। তা না হলে এমন রসের জিনিস জমবে না।
খানসামা আজ্ঞাবহ দাস।। হুকুম পাওয়া মাত্র সে একটা নবযৌবন উদ্ভিন্ন কিশোরীকে নিয়ে এসে দাঁড় করালো। মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমর দোলাতে থাকে। লোকটা উত্তেজিত হয়ে মেয়েটিকে জাপটে ধরে কোলের ওপরে বসায়।
এই সময় পিঠে ঠাণ্ডা লাগছে বুঝতে পেরে সে শ্বেতপাথরের মেঝের উপর উঠে বসে। তার চারপাশ ঘিরে শ’খানেক লোক। সবাই তার এই মজার প্রলাপ বাণী শুনতে শুনতে স্নানের কথা ভুলে গেছে। লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন খুঁজলো। তারপর সামনের লোকগুলোর উদ্দেশে বললো, মেয়েটাকে তোমরা কোথায় সরিয়ে নিলে?
নিগ্রো মেয়েটার গল্প শুনতে শুনতে কান মা কানা হেসে গড়াগডি যায়। —তুমি বেড়ে মজাদার কিসসা বলতে পারো গো।
বুড়ি বলে, বাবা, এই আমার কাজ। দোরে দোরে ভিক্ষা করে খাই না। প্রাণখুলে কিসসা, বলি, যদি কারো ভালো লাগে, ভালোবেসে কেউ যদি কিছু দেয়, হাত পেতে নিই।
কান মা কানা বলে, তোমাকে আমি খুশি করে দেব, বুড়ি মা। তুমি আর একটা মজাদার গল্প শোনাও।
নিগ্রো বুড়ি আর একটা কাহিনী শোনাবার তোড়জোড় করছে এমন সময় তীবুর সামনে এক ঘোড়সওয়ার এসে দাঁড়ালো। কান মা কানা তলোয়ার খুলে বেরিয়ে আসে।
–কে? কি চাই।
—আমি বাগদাদ থেকে আসছি। উজির দানদানের দূত। আমার মতো আরও একশো ঘোড়সওয়ারকে তিনি আরবের নানা দেশে পাঠিয়েছেন। প্রতি গ্রামে গ্রামে গঞ্জে গঞ্জে শহরে শহরে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি।
কান মা কানা প্রশ্ন করে, কেন, কি কারণে?
এখন আমরা জনেজনে জিজ্ঞেস করে ফিরছি, কেউ যদি তাঁকে দেখে থাকেন, তাঁর সন্ধান জেনে থাকেন মেহেরবানী করে জানাবেন এই আমার প্রার্থনা। আমরা আবার তাকে ফিরে পেতে চাই।
ঘোড়সওয়ার দূতের কথা শুনে কান মা কানা পুলকিত হয়। সাব্বাকে গিয়ে গলাখাটো করে কানে কগানে বলে, সব ফসলই সময় হলে পাকে। চলো দোস্ত, এবার যাবার সময় বিহঙ্গের। বাগদাদে যেতে হবে।
ঘোড়সওয়ার কিন্তু শাহজাদার মৃদুকণ্ঠের কথাও সব শুনতে পায়। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই যুবকই তাদের ভাবী সুলতান কান মা কানা। সঙ্গে সঙ্গে সে আভূতি আনত হয়ে কুর্নিশ জানায়। সেই নিগ্রো বুড়ি আর সাব্বাও তার দেখাদেখি কুর্নিশ জানালো। কান মা কানা সাব্বাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার জিগরী দোস্ত। এখন কেন কুর্নিশ জানাচ্ছে। যখন সিংহাসনে বসবো, তখন সে-সব হবে।
নিগ্ৰো বুড়িটাকে বললে, বুড়ি মা, তুমিও বাগদাদে চলল। আমাকে নিত্যি নতুন মজাদার কাহিনী শুনাবে।
বুড়ি বলে, যাবাে, হুজুর, নিশ্চয়ই যাবাে।
দূতকে নানা ইনাম নিয়ে বাগদাদে রওনা করে দিলাে। —উজির সাহেবকে জানাও আমি বহাল তবিয়তে আছি। আজই আমরা রওনা হচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছে যাবে।
এরপর কাতুল-এর পিঠে চাপলে কান মা কানা। বুড়িকে চাপানাে হলাে একটা খচ্চরের পিঠে। উটের পিঠে বােঝাই করা হলাে সামান পত্র। সাব্বা জানােয়ারগুলােকে গুছিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকলাে।
সারা বাগদাদ শহর আলাের মালায় সাজানাে হয়েছে। রাস্তার মােড়ে মােড়ে তােরণ তৈরি করা হয়েছে। শহরবাসী আনন্দে আত্মহারা। তাদের ভাবী সুলতান আসছে শহরে। উজির দানদানের নির্দেশে সারা প্রাসাদ অপরূপ সাজে সাজানাে হয়েছে। নাচ-গান হৈ-হল্লা খানা-পিনার লহর ছুটেছে।
কাতুলে চেপে কান মা কানাকে আসতে দেখে শহর প্রান্তের সিংহদ্বারে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নগরবাসী হর্ষধ্বনি করে ওঠে। বয়সের ভারে ন্যুজ উজির দানদানও ঘােড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটে যায়। কান মা কানাকে জড়িয়ে ধরে বুকে। দানদান অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে, তােমার প্রতীক্ষাতেই বসে আছি, ভাই। তােমার সিংহাসন তুমি বুঝে নাও।
প্রাসাদে এসে কান মা কানা সব আগে ছুটে যায় মায়ের ঘরে। কেঁদে কেঁদে মায়ের চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আদর করে। দুচোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। মুখে কোনও কথা সরে না।
–মা–মাগাে, কথা বলছে না কেন?
কান মা কানা বলে, কই, রােগা তাে হইনি মা। দিব্বি, দেখছে না, কেমন তাগড়াই চেহারাখানা হয়েছে। তুমি মা তাে—তাই তােমার নজরে পড়ছে না।
মা হাসে। আনন্দ বেদনা মিশ্রিত সে হাসি। বড় মধুর। কান মা কানা জিজ্ঞেস করে, নসিবার খবর কি মা? সে কেমন আছে?
ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নুজাতের ঘরে আসে। বিষন্ন বিষাদগ্ৰস্ত মা মেয়ে কান মা কানাকে দেখে। আনন্দে দুলে ওঠে। কিন্তু ভয়, না জানি কান মা কানা কিভাবে তাদের গ্রহণ করবে।
–পিসি কেমন আছ?
নসিবা মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে চেয়ে থাকে। এতকালের চাপা অভিমান আজ যেন উথলে উঠতে চায়। যাবার আগে কান মা কানা তাকে একটা খবর পর্যন্ত দিয়ে যায়নি। এতকাল দূরে দূরে রইলাে, একটিবার খোঁজও করেনি, সে বাঁচালাে কি মরলাে। দুচোখ জলে ভরে আসে তার। কিন্তু মা-মনির নজরে পড়ার লজ্জায় জানলার গরাদ ধরে বাইরে বাগিচার দিকে চেয়ে থাকে।
সেরাতেই তাদের শাদী এবং মধুযামিনী হলাে। কান মা কান নসিবাকে বুকে টেনে নেয়, আমি যখন ছিলাম না, আমার কথা মনে পড়তাে তােমার ?
–ছাই মনে পড়তাে। পুরুষ মানুষের মন বলে কোনও পদার্থ আছে নাকি? হৈ-হল্লা করে নেচে বেড়িয়েছে। নতুন নতুন মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করেছে, আমার কথা তােমার মনে পড়বে কোন্ দুঃখে।
–ইয়া আল্লাহ! আমার সম্বন্ধে এই তােমার ধারণা? তুমি সাব্বাকে জিজ্ঞেস করাে, সেই তােমাকে সব বলবে। যতদিন বিদেশে ছিলাম সেই আমার একমাত্র সঙ্গী ছিলাে।
–সাব্বা কে?
–ডাকাত? নসিবা আঁৎকে উঠে। ভয়ে জড়িয়ে ধরে কান মা কানাকে।
–তুমি ডাকাতের দলে ছিলে?
–ভালােবাসার জন্যে আবার কেউ ডাকাত হয় নাকি?
এই মধুযামিনী থেকেই তাদের মধুর জীবনের সুখপাত্র। তারপর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নসিবা কান মা কানা সুখের সায়রে গা ভাসিয়ে কাটিয়ে দিলাে।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। শাহরাজা বললাে, নসিবা কান মা কানার কাহিনী শুনলেন, জাঁহাপনা। এবার আপনাকে পশু-পাখির মজাদার কাহিনী শােনাবাে। আজ আর সময় নাই। রাত্রি শেষ হয়ে এলাে। এবার গল্প থামাচ্ছি।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments