আমার প্রিয় সাইয়্যেদ শেখ আবুল কাসেম মিঠুন_শরীফ বায়জীদ মাহমুদ

শুরুর কথা :
জন্ম-মৃত্যুর মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। পৃথিবীতে আমরা এসেছি তাঁর নির্দেশে এবং চলেও যেতে হবে তাঁরই হুকুমে। এটিই স্বাভাবিক, তারপরেও কোন কোন মৃত্যু মানুষকে বেশি কাঁদায় বেশি ভাবায়, করে দেয় অনেকটা অসহায়ের মতো। শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের মৃত্যুও ঠিক তেমনি হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে।
 
কোন মাটির সন্তান শেখ মিঠুন :
ইসলামের জন্য সব সময়ে উর্বর ভূমি সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন লাগোয়া আশাশুনি থানার দরগাহপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে ১৯৫১ সালে ১৮ এপ্রিল জম্ম গ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতা শেখ আবুল হোসেন, মাতা হাফেজা খাতুন। ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। কন্যা সন্তানের জনক শেখ আবুল কাসেম মিঠুন রেখে গেছেন  স্ত্রী মুনিরা পারভীনসহ অগণিত ভক্ত-অনুরক্ত এবং শুভাকাক্সক্ষী। পিতা-মাতার দেয়া নাম শেখ আবুল কাসেম। কিন্তু আদর করে ডাকতেনমিঠুবলে। চলচ্চিত্রকার শেখ নজরুল ইসলামমিঠুরনাম পরিবর্তন করেমিঠুনরাখেন তাঁর পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী রহ. স্ত্রীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদ থেকে আসেন। আশাশুনি উপজেলার  দরগাহপুর এসে তিনি এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে তিনি এখানেই  বসতি গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান আলেম। দরগাহপুর গ্রামেই তাঁর দুই সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। পুত্রদ্বয়ের বংশধরগণ দরগাহপুরের আদি অধিবাসী। শেখ  মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদীর  অন্যতম সপ্তম উত্তর পুরুষ মরহুম শেখ আব্দুল মতিন। শেখ আব্দুল মতিনের দৌহিত্র শেখ আবুল কাসেম মিঠুন। শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের আব্বার বড় মামা জগৎ বিখ্যাত আলেম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর সভাপতি ভারতীয়  লোকসভার সাবেক সদস্য, বুখারী শরীফের বঙ্গানুবাদক মাওলানা বজলুর রহমান দরগাহপুরী এই গ্রামেই জন্ম গ্রহণ করেন। 
 
ছাত্র জীবনে শেখ আবুল কাসেম মিঠুন :
১৯৭২ সালে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত পাইকগাছা উপজেলার রাড়লির আর. কে.বি.কে.এইচ.সি ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি চলে আসেন খুলনায়। এখানে এসে তিনি ফুফাতো ভাই শেখ আব্দুল জলিল এবং বংশের বড়  বোন হাজেরা জলিলের বাসায় ওঠেন। এইচএসসিতে ভর্তি হন খুলনা সিটি কলেজে। এখান থেকে ১৯৭৪ সালে পাস করে একই কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। সময় তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন।
 
কর্ম জীবন শুরু :
১৯৭৮ সালে নূর মোহাম্মদ টেনা সম্পাদিতসাপ্তাহিক কালান্তরপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনিকালান্তরএর  কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। -ছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন। সংস্কৃতির প্রতি সদা দুর্বল শেখ আবুল কাসেম মিঠুন ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম অভিনিত ছবিতরুলতা প্রথম ছবিটিতেই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তাঁর আরো অনেক জনপ্রিয় সিনেমা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঈদ মোবারক’ ‘ভেজা চোখ’ ‘নিকাহ’ ‘কুসুমকলিপ্রভৃতি। নায়ক ছাড়াও তিনি সিনেমার পার্শ্ব চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। -ছাড়াও তিনি অসংখ্য সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপরও তিনি স্ক্রিপ রাইটার গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়। তিনি দিগন্ত টিভিতে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রযোজিত ঈদ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের সফল উপস্থাপক। এছাড়াও ইসলামিক টিভির জনপ্রিয় ‘‘হেরার আলো’’ অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় আলোচক ছিলেন। অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাসেম মিঠুন আজীবন সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার। ২০১০ সালের ১১ আগস্ট (প্রথম রমজানের  সেহরীর সময়) বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, কবি গীতিকার, ইসলামি সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান মল্লিক ইন্তেকাল করেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিকেরই নিরলস প্রচেষ্টায় সারা দেশে নতুন ধারার ইসলামি সঙ্গীত চর্চা শুরু হয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে। খ্যাতিমান এই কবির মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাসেম মিঠুনবাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্র হাল ধরেন। তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক।
 
তাঁর সাথে আমার পরিচয় :
শেখ মিঠুন এর সাথে আমার পরিচয় নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে। চলচ্চিত্র জগত থেকে ফিরে তিনি তখন সবে মাত্র সত্য সুন্দরের পক্ষে সরব। তাঁকে কাছে থেকে যতই দেখেছি, ততই অবাক হয়েছি। একজন মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন সবার কাছে অতি প্রিয়। যার সাথেই কথা হয় তিনিই বলেন মিঠুন ভাই আমাকে অত্যন্ত স্নেহ অথবা সম্মান করতেন। আমি মনে করি এটিই জনপ্রিয় মানুষের অন্যতম নমুনা, একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে ভালো সার্টিফিকেট আর কি হতে পারে।
 
একজন উঁচু মনের মানুষ :
আমার নেতা শেখ আবুল কাসেম মিঠুন একজন অসাধারণ উঁচু মানের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং বড় মনের মানুষ ছিলেন। প্রত্যেকটি মানুষের ব্যাপারে তাঁর ঔদার্য এবং সুধারণা পোষণ তারই প্রমাণ। আমার লেখার আরো বড়  প্রমাণ পেলাম বিগত ১৩ জুন শেখ আবুল কাসেম মিঠুন স্মৃতি সংসদ আয়োজিত তাঁর মাগফিরাত কামনা আলোচনা সভায় প্রদত্ত তাঁর এক সময়ের একান্ত কাছের মানুষদের বক্তব্যের মাধ্যমে। ২১ পদক প্রাপ্ত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, শত ব্যস্ততা থাকলেও শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারতাম না। কারণ মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল। আমাদের দেশের মানুষ  পোশাকে আশাকে আধুনিকতা অর্জন করলেও মিঠুন মানসিকতায় কিভাবে আধুনিকতা আনা যায় সেজন্য কাজ করতেন। মিঠুন চেয়েছিলেন, সংস্কৃতি অঙ্গনে একটা বিপ্লব আনতে, কিন্তু তা শেষ করে যেতে না পারলেও কিছুটা হলেও শুরু করে গেছেন। চলচ্চিত্রকার শেখ নজরুল ইসলাম শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের চলচ্চিত্রে আসা এবং কাজ করা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, মিঠুন এমনই অসাধারণ গুণের অধিকারী ছিলেন যে, বেদনা বুকে নিয়েও হাসতে পারতেন।  নবধারার সভাপতি কবি আল মুজাহিদী বলেন, মিঠুনের মধ্যে একটা বিশাল মানুষের  দেখা আমি পেতাম। কারণ তার হাসিমাখা মুখ দেখলে আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো। মিঠুন যে আলো ছড়িয়ে গেছেন সে আলোর দিকে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। মিঠুন পুরনো ধ্যান-ধারণার সমাজ ভেঙ্গে নতুন ইট সুরকির সমাজ বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিটিভি সাবেক ডিডিজি মাহবুবুল আলম গোড়া বলেন, আবুল কাসেম মিঠুন বিনোদনধর্মী সৃষ্টিশীলতায় থেকে আদর্শধর্মী সৃষ্টিশীলতার দিকে এগুচ্ছিলেন এবং এর গভীরতায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার এই কাজ দিয়ে পুরো বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
সবচেয়ে বাস্তব কথাটি বলেন এক সময়ের ম্যাগাষ্টারখ্যাত নায়ক আশরাফ উদ্দিন উজ্জল তিনি অনেকটা আফসোসের সুরে বলেন- মিঠুন এমন এক বিশাল সমর্থকশ্রেণি তৈরি করে গেছেন যারা আজকে তাকে স্মরণ করছে বা ভবিষ্যতেও মনে রাখবে কিন্তু আমরা মরে গেলে আমাদের কেউ মনে রাখবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। মানুষ হিসেবে মিঠুন অনেক বড় মাপের ছিলেন। মিঠুনকে ভুলে যাওয়াটা কঠিন বলে মন্তব্য করেন অভিনেতা মিজু আহমেদ। নায়ক হেলাল খান বলেন, মেকাপ নিয়েও মিঠুনকে নামায পড়তে দেখেছি। তিনি একজন পাকা মুসলমান ছিলেন।
 
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশাল এক শূন্যতা :
শেখ আবুল কাসেম মিঠুন এর মৃত্যু আমাদেরকে অনেকটা অসহায় করে দিয়ে গেল। কারণ তাঁর মতো সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দ্বিতীয়টি আর কই? তিনিতো চলে গেলেন ওপারের সুন্দর জীবনে আপন প্রভুর সান্নিধ্যে, আর আমরা রয়ে গেলাম ধরায় অসহায় হয়ে। জানি না, পরম প্রভূ তাঁর শূন্যতা কিভাবে পূরণ করবেন। তিনিই তা ভালো জানেন।
 
কি এতো ভাবতেন তিনি :
বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ্য করতাম সেমিনার কিংবা ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠান কিংবা বড় কোন পাবলিক গ্যাদারিং সব জায়গায় বসে আনমনে কি যেন ভাবছেন। কখনো প্রশ্নও করা হয় নাই। হয়তো তিনি তাঁর সকল চিন্তা-ভাবনাগুলো নিয়ে একান্তে মিটিং করতেন কিংবা তাঁর মালিক প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে হিসাব নিকাশ করতেন। এমনও কখনো হয়েছে মিটিং চলছে মতামত জানতে মিঠুন ভাইকে প্রশ্ন করলে দেখতাম তিনি অন্য জগতে অন্য  কোথাও অন্য কোন খানে। তিনি আমার সভাপতি ছিলেন আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তাঁর মতো নেতার নেতৃত্ব মাবুদ যদি আরো কিছুটা সময় দিতেন তা হলে হয়তো বা কবি মল্লিক এর রেখে যাওয়া অসম্পন্ন কাজগুলো আরো দ্রুত সম্পন্ন করা সহজ হতো কারণ তিনি সবার কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতেন, উৎসাহ দিতেন, উদ্বুদ্ধ করতে জানতেন। ছোট বড় সবার প্রিয় ছিলেন এই নিরাহংকারী সদালাপী মৃদুভাষী ব্যক্তিটি। আমি তাঁর সেক্রেটারি হলেও সাংগঠনিক আনুগত্য, ত্যাগ-কুরবানী এবং শৃঙ্খলা বোধের যে উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন তার নজির মেলা সত্যিই দুরূহ। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল তাঁর প্রিয় কাজের মধ্যে অন্যতম। যার জন্য তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এবং কাজটি তিনি করেছেন জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে অসুস্থতার মাঝেও। ইসলাম এবং সম-সাময়িক বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল সুবিস্তৃত, এর প্রমাণ মেলে তার সকল লেখা এবং সামাজিক সাইটে ছোট ছোট সকল পোষ্টগুলো।
 
মালিকের কাছে প্রার্থনা :
মহান মাবুদের কাছে তাঁর জন্য সর্বোত্তম পুরস্কারের বিনীত আবেদন জানাই। আর প্রার্থনা করি আল্লাহ যেনো তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার শক্তি সামর্থ আমাদের দান করেন।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.