আড্ডার গল্প : রাজ্জাক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ_কাজী জহিরুল ইসলাম

 
ছেলেবেলায় দেখতাম পাড়ার লোকেরা আব্বাকে রাজ্জাক ভাই বলে ডাকে। তিনি দেখতে তখন ঠিক রাজ্জাকের মতোই ছিলেন। তাঁর মধ্যেও রাজ্জাক হওয়ার নেশা চাপে। শেষমেশ রাজ্জাক হতে পারেননি, ইবনে মিজানের কয়েকটি ছবিতে এক্সট্রার রোল করে ফিরে আসেন। আমার মধ্যেও কি এই রোগ ছিল? জিনের কারসাজি? হতে পারে। আব্বা রাজ্জাককে এতো অনুসরণ করতেন, আমরা যে তিন ভাই দুই বোন এখানেও তিনি রাজ্জাকের সাথে মিল খুঁজে পেতেন। রাজ্জাকের পরিবারের সকলের ছবি দিয়ে একটি ভিউকার্ড বের হয় আশির দশকে। সেখানে তাঁর তিন ছেলে, দুই মেয়ে স্ত্রীর সাথে নায়করাজের ছবি ছিল। আব্বা আমাদের তিন ভাই দুই বোন আম্মাকে নিয়ে এইরকম একটি গ্রুপ ছবি তোলেন। আব্বা যখন এফডিসিতে যেতেন তখন নাকি রাজ্জাকও আব্বাকে রাজ্জাক ভাই বলে ডাকতেন।
 
আশির দশকের শেষের দিকে আমি একটি সংগঠন করি, শতাব্দী সাংস্কৃতিক সংসদ। সংগঠন চালাতে টাকা লাগবে। টাকার জোগাড় হবে কি করে? সদস্যদের কাছ থেকে দশ/বিশ টাকা চাঁদা তুলে সংগঠন চালানোর পক্ষে আমি না। টাকার কুমির আব্বাস উল্লাহ শিকদারকে সংগঠনের সভাপতি করলাম। তিনি বনানীর হামিদ চেয়রাম্যানের ছেলে। পরে তাঁর প্রযোজিত বেদের মেয়ে জোছনা সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ১০ কোটি টাকা ব্যবসা করে। কিন্তু আব্বাস ভাই হাড়কিপটে লোক। তাঁর পকেট থেকে একটি আধুলিও বের করা যায় না। আমি হলাম সহসভাপতি, কাজী কনক সাধারণ সম্পাদক, আরো বেশ জন সহসভাপতি ছিলেন, কাস্টমসের আলী আহমেদ, অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর ভাই নুরুন্নাহার বেগম, শিল্পী হীরা নওশের প্রমূখ। অনু (খোশনূর) আপার বোন বিনু আহমেদ ছিলেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক, এমন অনেককে নিয়ে ২৫ সদস্যের কমিটি। প্রায় প্রতি মাসেই আমাদের কিছু না কিছু থাকত। প্রচুর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশিষ্ট জনদের সম্মাননা দেওয়া, এইসব করতাম।
 
আমি আর কনক আব্বাস ভাইয়ের কাছ থেকে পয়সা বের করার একটা তরিকা বের করি। বড় বড় অনুষ্ঠানগুলিতে সামান্য কিছু বুকিং দিয়ে পুরো হল ভাড়াটাই বাকি রাখতাম। অনুষ্ঠানের দিন হল ম্যানেজমেন্ট টাকা চাইলে সভাপতিকে দেখিয়ে দিতাম। আব্বাস ভাইয়ের পাঞ্জাবীর পকেট ভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। প্রথমে কাঁইকুঁই করলেও শেষ পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর আব্বাস ভাই হিসাব-নিকাশের ব্যাপারে আগ্রহী হন। অনুষ্ঠানের আগে আগে টাকা পয়সার ব্যবস্থা কীভাবে কি হল খোঁজ নিতে শুরু করেন। নিজে যখন টাকা-পয়সার দায়িত্ব নিতে শুরু করেন তখন তিনি কিছু ডোনারও জোগাড় করে দেন। তাঁদের একজন বনানীর হাজী সাহাবুদ্দিন। পরবর্তীতে তিনি বনরূপা হাউজিং করেন, মহাখালিতে হাজী সাহাবুদ্দিন শপিং কমপ্লেক্স ইত্যাদি করেন। হাজী সাহেবের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায় অল্প দিনের মধ্যেই। এমন ঘনিষ্ঠতা যে পরিবারের কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বিয়ে, মুসলমানির দাওয়াত খেতে গেলেও আমাকে নিয়ে যেতেন। লোকেরা বলাবলি করত, হাজী সাহাবুদ্দিন আমার কাছে তাঁর মেয়ে বিয়ে দিতে চান। অনুষ্ঠান করার জন্য টাকা-পয়সার দরকার হলে আমি গিয়ে হাজির হতাম হাজী সাহেবের বনানীর অফিসে। তিনি পকেট থেকে চেক বই বের করে সেক্রেটারিকে বলতেন, জহিরের নামে পাঁচ হাজার লেখো। হাজী সাহেব পড়ালেখা জানতেন না। শুধু নামটা সই করতে পারতেন। চেক বইয়ে এমনভাবে হাজী সাহাবুদ্দিন লিখতেন, দেখে হাসি পেত। তো আব্বাস ভাই-সূত্রে আমার পরিচয় ঘটে চলচ্চিত্রের অনেক মানুষের সাথে। রোজিনা, দিতি, সিদ্দিক জামাল নান্টু, রাজ্জাক, কাজী হায়াত প্রমূখের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে এবং পরিচয় ঘটে শত শত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে।
 
বলে রাখি, এই সূত্রেই, অনেক পরে, কাজী হায়াতেরলাভ স্টোরিছবিতে অভিনয় করি। পরবর্তিতে আমাকে হিরো বানাবেন বলেছিলেন কাজী হায়াত কিন্তু এর কিছুদিন পরেই মুক্তির সাথে পরিচয় ঘটাতে আমি বাস্তব জগতের হিরো হয়ে যাই, চলচ্চিত্রের হিরো হওয়া আর আমার হলো না। মুক্তির কড়া নির্দেশ, এফডিসি আর বিটিভি, এই দুটি জায়গায় পাও রাখতে পারবে না। আমি তাঁর নির্দেশ মেনেছি, পরবর্তী দশ বছর বিটিভিতে যাইনি এবং আজ অবধি, এই বাইশ বছরে, আর কোনোদিন এফডিসিতে যাইনি।
 
বছর খানেকের জন্য আমি ঢাকার বাইরে চাকরি করতে যাই। ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে ব্র্যাকের চাকরি ছেড়ে হবিগঞ্জ থেকে ফিরে আসি। যোগ দেই সাপ্তাহিক পূর্ণিমায়। রবি আরমান তখন পূর্ণিমার সিনেজগতটা দেখতেন। শতাব্দী সাংস্কৃতিক সংসদ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য রাজ্জাককে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। খবরটা জানার সাথে সাথে রবি আরমান আমাকে বলেন আপনি রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনকে জানেন। চলচ্চিত্রে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তিনি অনেক স্ট্রাগল করেছেন। যদি এগুলো তাঁর মুখ থেকে বের করে আনতে পারেন দারুণ কাজ হবে। আমরা ধারাবাহিকভাবে এগুলো ছাপবো। আমি বলি, রবি ভাই আমি যদি তাঁর বায়োগ্রাফি লিখি তাহলে কেমন হয়? তিনি সাথে সাথে লাফ দিয়ে ওঠেন, বলেন, পারবেন? আমি বলি, চেষ্টা করে দেখতে পারি। অনুষ্ঠানের আগে রাজ্জাকের সাথে বেশ কয়েক দফা আমাকে যোগাযোগ করতে হয়। সব সময় মাথায় ছিল রাজ্জাকের বায়োগ্রাফি লিখতে হবে, কিন্তু কথাটা তাঁকে বলতে পারছি না। অনেকেই রাজ্জাক সম্পর্কে আমাকে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তাঁর ব্যবহার ভালো না। আজে-বাজে কথা বলেন, সাংবাদিকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। অনেক সাংবাদিক নাকি তাঁর সাথে দেখাই করতে পারেননি। এইসব কথার কারণেই আমি বায়োগ্রাফি লেখার বিষয়টা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আমি অবশ্য যতটা না সাংবাদিক তাঁর চেয়ে অনেক বেশি কবি বা লেখক ছিলাম, মনের দিক থেকে, তাই প্রথাগত সাংবাদিকদের মত বেহায়া হয়ে কারো পেছনে লেগে থাকতে পারতাম না। একবার আনোয়ার হোসেন আমাকে একটি খারাপ কথা বলেছিলেন, বেশ অপমানজনক কথা, কারণে আমার অনেক দিন মন খারাপ ছিল। রবি আরমান আমাকে খুব সাহস দিতেন। আপনি কোনো স্টার-ফেস্টার পাত্তা দিবেন না। সে তাঁর জগতে স্টার, আপনি আপনার জগতে স্টার। ওরা পারবে আপনার মত একটা রিপোর্ট লিখতে?
 
এরই মধ্যে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আমি রাজ্জাককে নিয়ে পূর্ণিমায় বেশ কিছু রিপোর্ট করি। তিনি সেগুলো দেখেন এবং আমার প্রতি একটা সফট কর্নার তৈরী হয়। অনুষ্ঠানটি হয় মহাখালির নিপসম মিলনায়তনে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের প্রচুর স্টার সেই অনুষ্ঠানে আসেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলাম আমি। কাজেই কারো কাছে যেতে আমার কোনো বাঁধা ছিল না। অনুষ্ঠান শেষে আমি রাজ্জাকের পাশে, সোফায় বসে, অনেকক্ষণ কথা বলি। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি অনেকক্ষণ ছিলেন। তখন তাঁকে বায়োগ্রাফির কথাটা বলি। তিনি বেশ কয়েকজন সাংবাদিক/লেখকের নাম করে বলেন, এঁরা সবাই চেষ্টা করেছে, সবাইকে না করে দিয়েছি। ঠিক আছে, তোমাকে সময় দেব। তুমি সপ্তাহে দুদিন রাজলক্ষীতে আসবে। আমি দুঘন্টা করে আমার জীবনের গল্প বলে যাব। আমি ভীষণ এক্সাইটেড। মনে হচ্ছিল, তাঁর বায়োগ্রাফি লিখতে পারলে আমার জীবন সার্থক হয়ে যাবে।
 
নির্দিষ্ট দিনে আমি প্রস্তুত হয়ে কাকরাইলের রাজলক্ষী প্রোডাকশনের অফিসে যাই। কিন্তু তিনি আসেননি। অফিস ম্যানেজার বা সহকারীকে জিজ্ঞেস করি কখন আসবেন? তিনি বলেন, আজ তো তিনি আসবেন না। আমার মেজাজ খারাপ হয়। আমি তাকে বলি বাসায় ফোন দেন, আমাকে আসতে বলেছেন। কিন্তু লোকটি আমাকে কোনো গুরুত্বই দিল না।
 
আমি হেঁটে হেঁটে সিদ্দিক জামাল নান্টুর অফিসে যাই। নান্টু ভাইকে কথাটা বলি। তিনি বলেন, বাদ দেও এইসব। তিনি তাঁর বীরত্বগাঁথা বয়ান করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় সীলমোহর তিনি ডিজাইন করেছেন এই কথা গর্বের সাথে বলতে শুরু করেন। শুধু বলেনই না, ড্রয়ার খুলে এই বিষয়ে যত রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, সেগুলোর পেপার কাটিং দেখান। একটু পরে সোহেল রানা আসেন। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা, তখন মুক্তিযুদ্ধের নানান বিষয় নিয়ে গল্প জমে ওঠে।
 
এরপর আমি আর রাজ্জাকের সাথে যোগাযোগ করিনি। আর কারো বায়োগ্রাফি লিখবো না বলে শপথ করলেও আরো একবার একজন বড় কবির বায়োগ্রাফি, দৈনিক জনকন্ঠের অনুরোধে, লিখতে শুরু করি। সেটাও অল্প কিছুদিন লেখার পরে বন্ধ হয়ে যায়। সেই কবির কথা অন্য আরেক দিন বলবো।
 
আমি যখন . ইব্রাহীমের বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্রে কাজ করি, আমার একজন সহকর্মী ছিলেন ওমর ফারুক হায়দার। তিনি বেশ বই টই পড়তেন। সাপ্তাহিক যায় যায় দিন পত্রিকার সকল কপি তাঁর সংগ্রহে ছিল। আরামবাগের মেসে বেশ আরামেই ব্যাচেলর জীবন কাটছিল তাঁর। একদিন আমাকে বলেন, জহির, আমাকে একদিন চলচ্চিত্রের শ্যুটিং দেখাতে নিয়ে যাবেন। আমি তাঁকে নিয়ে যাই গুলশানে, রাজ্জাকের বাড়িতে। সেখানে উত্তর ফাল্গুনী ছবির শ্যুটিং চলছে। এই প্রথম আমি রাজ্জাককে কাজের মধ্যে দেখি। শট দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম শিশুর মতো উচ্ছল এক মানুষ। নানান রকম অঙ্গভঙ্গি এবং বাচ্চাসুলভ ফান করছেন। এর পেটে খোঁচা দিচ্ছেন, ওর কানে টোকা দিচ্ছেন, হাসছেন এবং মানুষকে হাসাচ্ছেন। তাঁকে খুব ছেলেমানুষ লাগছিল, অথচ তখন তাঁর যথেষ্ঠই বয়স হয়েছে। কিন্তু যেই লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন শব্দ তিনটি উচ্চারিত হয়, অমনি তিনি অন্য মানুষ, একেবারে চরিত্রের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। কোনো ধরণের পারফর্মেন্সের আগে জড়তামুক্ত এবং ফুরফুরে মেজাজে থাকার এটি একটি কৌশল হিসেবে আমি সেদিন এই মহানায়কের কাছ থেকে শিখে নিই।
 
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। মার্চ, ২০১৮।

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.