বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ১৪তম প্রবাহ

 
স্ত্রী­লো­­মা­ত্রেই বো­র্কা ব্য­­হার করিয়া যথে­চ্ছ স্থা­নে বেড়াই­তে পা­রে। ভা­­তের ন্যায় তথায় পা­ল্কি-বে­হা­রা নাই। লক্ষ­­তি হউন, রা­­­­নাই হউন, ভদ্র­­হি­লাই হউন, বো­র্কা ব্য­­হা­রে যথে­চ্ছ­ভা­বে ভ্র­মণ করিয়া থা­কেন। দূর দে­শে যা­­তে হই­লে উষ্ট্রের বা অশ্বের আশ্রয় লই­তে হয়
মায়মু­নার গৃহ বে­শি দূর নহে। জায়েদা মায়মু­নার গৃ­হে উপ­স্থিত হইয়া বো­র্কা মো­­নপূর্বক তা­হার শয়নকে যাইয়া বসি­লেন। মায়মু­নাও নি­­টে আসিয়া বসিল। আজ জায়েদা মনের কথা অক­­টে ভা­ঙ্গি­লেন।কথায় কথায়, কথার ছল­নায়, কথায় ভর দিয়া, কথা কা­টাইয়া, কথায় ফাঁক দিয়া, কথায় পো­­­তা করিয়া, কথায় বি­­তা করিয়া স্বপ বিপ, সকল দি­কে যাইয়া আজ মায়মু­না জায়েদার মনের কথা পা­ইল। মায়মু­নার মো­­­ন্ত্রে জায়েদা যেন উন্মা­দি­নী
সপ­ত্নী­না­গি­নীর বি­­­ন্তে যে অব­লা এক­বার দং­শিত হইয়াছে, তা­হার মন ফি­রি­তে কত­ক্ষণ? চি­­ভা­­বা­সা, চি­­প্রণয়ী পতির মম­তা বি­­র্জন করি­তে তা­হার দু­ঃখ কী? এক প্রাণ, এক আত্মা, স্বা­মীই সকল, কথা প্রায় স্ত্রী­রই মনে আছে, স্ত্রী­রই মনে থা­কে, কি­ন্তু সপ­ত্নীর নাম শু­নি­লেই মনের আগুন দ্বি­গুণ, ত্রি­গুণ, চতু­র্গুণ ভা­বে জ্ব­লিয়া উঠে। সে আগুন বা­হির হই­বার পথ পায় না বলিয়াই অন্ত­­স্থ ভা­­বা­সা, প্রণয়, মায়া মম­তা একে­বা­রে পোড়াইয়া ছা­­খার করিয়া ফে­লে
মায়মু­নার সমুদয় কথা­তেই জায়েদা সম্মত হই­লেন। মায়মু­না মহা সন্তু­ষ্ট হইয়া বলি­তে লা­গিল, "বো­ন্! এত দি­নে যে বু­ঝিয়াছ, সেই ভাল, আর বি­­ম্ব নাই, কো­ন্ সময় কা­হার অদৃ­ষ্টে কি ঘটে, কে বলি­তে পা­রে? যত বি­­ম্ব হই­বে, ততই তো­মার অম­ঙ্গ­লের ভাগ বে­শি হই­বে। যা­হা করি­তে বসি­লে, তা­হার উপর আর কথা কি আছে? শু­­কা­র্যে আর বি­­ম্ব কেন? ধর, এই ঔষধ নেও।"
এই বলিয়া মায়মু­না শয্যার পা­র্শ্ব হই­তে খর্জু­­­ত্র নি­র্মিত এক­টি ক্ষু­দ্র পা­ত্র বা­হির করিল। তন্ম­ধ্য হই­তে অতি ক্ষু­ত্র এক­টি কৌ­টা জায়েদার হস্তে দিয়া বলিল, "বো­ন্। খুব সা­­ধান! এই কো­টা­টি গো­­নে লইয়া যাও, সু­যো­­মত ব্য­­হার করিয়ো। মন­স্কা­­না পূর্ণ হই­বে, জয়না­বের সু­­­রী ডু­বি­বে, এই কৌ­টার গু­ণে তু­মি সক­লই পা­­বে। যা­হা মনে করি­বে তা­হাই হই­বে।"
জায়েদা কহি­লেন, "মায়মু­না! তো­মার উপ­দে­শেই আমি সকল মায়া পরি­ত্যাগ করি­লাম।জয়না­বের সু­­স্ব­প্ন আজ ভা­ঙ্গিব, জয়না­বের অঙ্গের আভ­রণ আজ অঙ্গ হই­তে খসা­ইব, সেই আশা­তেই সকল স্বী­কার করি­লাম। আমার দশার দি­কে ফি­রিয়াও চা­হি­লাম না। জয়না­বের যে দশা ঘটি­বে, আমারও সেই দশা।ইহা জা­নিয়াও কে­বল সপ­ত্নীর মনে কষ্ট দি­তে স্বা­মী বধ করি­তে প্র­বৃ­ত্ত হই­লাম। দেখ বো­ন্! আমায় অকূল সা­­রে ভা­সাইও না। আমার সর্ব­নাশ করি­তে আমিই তো দাঁড়াই­লাম, তা­হা­তে দু­ঃখ নাই। জয়না­বের সর্ব­নাশ করি­তে আমার সর্ব­নাশ! এখন সর্ব­­ঙ্গল, ইহাও সর্ব­সুখ মনে করি­তে­ছি। কি­ন্তু বো­ন্! তু­মি আমা­কে নি­রা­শ্রয় করিয়া বি­ষা­­­মু­দ্রে ভা­সাইয়া দিয়ো না।"
ধী­রে ধী­রে কথা­গু­লি বলিয়া জায়েদা বি­দায় হই­লেন। মায়মু­নাও গৃ­­কা­র্যে ব্য­পৃত হই­লেন।জায়েদা গৃ­হে আসিয়া কৌ­টা খু­লিয়া যা­হা দে­খি­লেন, তা­হা­তে তাঁহার সর্ব­­রীর শি­­রিয়া উঠিল, ভয়ে হস্ত কাঁপি­তে লা­গিল; কি­ন্তু মায়মু­নার উপ­দে­­ক্র­মে সে ভয় বে­শি­ক্ষণ রহিল না। খা­দ্য­সা­­গ্রীর মধ্যে সেই কৌ­টার বস্তু মি­শা­­বেন, ইহাই মায়মু­নার উপ­দেশ। সে সময় আর কি­ছুই পা­­লেন না, এক­টা পা­ত্রে কি­ঞ্চিৎ মধু ছিল, তা­হা­তেই সেই বস্তুর কি­ঞ্চিৎমা­ত্র মি­শাইয়া রা­খি­লেন। কৌ­টা­টিও অতি যত্নে সং­গো­­নে রা­খিয়া দি­লেন
হজ­রত হা­সান প্র­তি­দি­নই এক­বার জায়েদার গৃ­হে আসিয়া দুই-এক দণ্ড না­না­প্র­কার আলাপ করি­তেন। কয়েক দিন আসি­বার সময় পান নাই, সেই দিন মহা­ব্য­স্তে জায়েদার ঘরে আসিয়া বসি­লেন।জায়েদা পূর্ব­মত স্বা­মীর পদ­সে­বা করিয়া জল­যো­গের আয়োজন করি­তে লা­গি­লেন
হা­সান ভা­বিয়াছি­লেন, জায়েদার ঘরে কয়েক দিন যাই নাই, না জা­নি জায়েদা আজ কতই অভি­মান করিয়া রহিয়াছে। কি­ন্তু ব্য­­হা­রে তা­হার সম্পূর্ণ বি­­রীত দে­খি­লেন। জায়েদা পূর্বা­পে­ক্ষা শত­গু­ণে সর­­তা শি­খিয়াছে, মা­­সের পূর্ণা­­ন্দে পরিপূরিত রহিয়াছে। এই ভাব দে­খিয়া হা­সান আজ জায়েদার গৃ­হে বাস করি­বেন, মনে মনে স্থির করি­লেন। জায়েদাও না­না­প্র­কার হা­­ভাব প্র­­র্শ­নে স্বা­মীর মন হরণ করিয়া প্রাণ হরণ করি­তে বসি­লেন। ঈশ্ব­­­ক্তই হউন, মহা­­হিম ধা­র্মি­­প্র­­রই হউন, মহা­­­শা­লী বী­­পু­রু­ষই হউন, কী মহা­প্রা­জ্ঞ সু­­ণ্ডি­তই হউন, স্ত্রী­জা­তির মায়াজাল ভেদ করা বড়ই কঠিন। না­রী­বু­দ্ধির অন্ত পাওয়া সহজ নহে। জায়েদা এক পা­ত্রে মধু অন্য পা­ত্রে জল আনিয়া স্বা­মীর সম্মু­খে রা­খি­লেন
সকৌ­তু­কে হা­সান জি­জ্ঞা­সা করি­লেন, "অসময়ে মধু?"
মায়াপূর্ণ আঁখি­তে হা­সা­নের দি­কে এক­বার তা­কাইয়া জায়েদা উত্তর করি­লেন, "আপ­নার জন্য আজ আট দিন এই মধু সঞ্চয় করিয়া রা­খিয়াছি। পান করিয়া দে­খুন, খুব ভাল মধু।"
মধুর পেয়ালা হস্তে তু­লিয়া হা­সান বলি­তে লা­গি­লেন, "আমার জন্য আট দিন যত্ন করিয়া রা­খিয়াছ, ধন্য তো­মার যত্ন মায়া! আমি এখ­নই খা­­তে­ছি।" হা­সান সহ­র্ষে এই কথা বলিয়া মধু­পা­ত্র হস্তে তু­লিয়া মধু পান করি­লেন। মুহূর্ত মধ্যেই বি­ষের কা­র্য আর­ম্ভ হইল। শরী­রের অব­স্থার পরি­­র্তন চি­ত্তের অস্থি­­তা­প্র­যু­ক্ত পি­পা­সার আধি­ক্য হইল। ক্র­মে কণ্ঠ, তা­লু জি­হ্বা শু­ষ্ক হইয়া আসিল, চক্ষু লৌ­হি­­­র্ণ হইয়া শে­ষে দৃ­ষ্টির ব্যা­ঘাত জন্মা­­তে লা­গিল। তি­নি যেন চতু­র্দিক অন্ধ­কার দে­খি­তে লা­গি­লেন। জায়েদা­কে বলি­লেন, "জায়েদা! কী হইল? কে­মন মধু? এত জল পান করি­লাম, পি­পা­সার শা­ন্তি হইল না। ক্র­মেই শরীর অবশ হই­তে­ছে, পে­টের মধ্যে কে যেন আগুন জ্বা­লিয়া দিয়াছে। ইহার কা­রণ কি? কি­সে কি হইল?"
জায়েদা বায়ুব্য­­নে প্র­বৃ­ত্ত হই­লেন। মস্ত­কে শী­তল জল ঢা­লি­তে লা­গি­লেন, কি­ছু­তেই হা­সান সু­স্থির হই­লেন না। ক্র­মেই শরী­রের জ্বা­লা বর্ধিত হই­তে লা­গিল। বি­ষের যন্ত্র­ণায় অস্থির হইয়া সা­মা­ন্য শয্যার উপর গড়াগড়ি দি­তে লা­গি­লেন। পে­টের বে­­না ক্র­­শঃই বৃ­দ্ধি। হা­সান অত্য­ন্ত কা­তর হইয়া অব­শে­ষে কা­­­স্ব­রে জি­জ্ঞা­সা করি­রেন, "জায়েদা! কি­সের মধু? মধু­তে এত আগুন? মধুর এমন জ্বা­লা! উঃ! আর সহ্য হয় না! আমার প্রাণ গেল! জায়েদা! উঃ! আর আমি সহ্য করি­তে পা­রি না।"
জায়েদা যেন অবা­ক্; মু­খে কথা নাই। অনে­­ক্ষণ পরে কে­বল মা­ত্র এই কথা, "সক­লই আমার কপা­লের দোষ। মধু­তে এমন হই­বে, তা কে জা­নে! দে­খি দে­খি, আমিও এক­টু খাইয়া দে­খি।"
হা­সান এই অব­স্থা­তেই নি­ষেধ করিয়া বলি­তে লা­গি­লেন, "জায়েদা! আমার কথা রাখ; মধু তু­মি খাইয়ো না। আমার মা­থা খাও, মধু মু­খে দিয়ো না! ছুঁইয়ো না! জায়েদা! মধু নয়, কখ­নোই মধু নয়! তু­মি-খো­দার দো­হাই, মধু তু­মি ছুঁইয়ো না! আমি যে যা­­না ভোগ করি­তে­ছি, তা­হা আমিই জা­নি।জায়েদা ঈশ্ব­রের নাম কর।"
পত্নী­কে এই কথা বলিয়া হা­সান ঈশ্ব­রের নাম করি­তে লা­গি­লেন। কা­হা­কেও সং­বাদ দি­লেন না, জায়েদার ঘরেই ঈশ্ব­রের প্র­তি নি­র্ভর করিয়া রহি­লেন। পবি­ত্র হৃদয়ে পবি­ত্র মু­খেই দয়াময়ের পবি­ত্র নাম পু­নঃ­পু­নঃ উচ্চা­রণ করি­তে লা­গি­লেন। বি­ষের বি­ষম যা­­না না­মের গু­ণে কতক পরি­মা­ণে অল্প বোধ হই­তে লা­গিল।জায়েদা সম­স্ত রা­ত্রি জা­গিয়া সে­বা-শু­শ্রূষা করি­লেন। প্র­ভা­তী উপা­­নার সময়ে অতি কষ্টে জায়েদার গৃহ হই­তে বহি­র্গত হইয়া প্র­ভু মো­হা­ম্ম­দের সমা­ধি-মন্দি­রে গমন করি­লেন। মন্দি­রের সম্মু­­স্থিত প্রা­ঙ্গ­ণে উপ­বে­শন করিয়া বি­নী­­ভা­বে ঈশ্ব­রের নি­কট সকা­­রে প্রা­র্থ­না করি­তে লা­গি­লেন
যাঁহার কৃ­পা­­লে অন­ন্ত জগৎ সৃ­ষ্ট হইয়াছে, পর্বত সা­­রে মি­শিয়াছে, বি­জন বন নগ­রে পরি­ণত হইয়াছে, জনপূর্ণ মহা­­­রী নি­বিড় অর­ণ্য হইয়া যা­­তে­ছে, সেই সর্বে­শ্ব­রের অসা­ধ্য কি আছে? প্র­ভু মো­হা­ম্ম­দের সমা­ধি-মন্দি­রের পবি­ত্র­তা­গু­ণে, ঈশ্ব­রের মহি­মায় হা­সান আরো­গ্য লাভ করি­লেন। কি­ন্তু এই প্র­থম বি­­পান হই­তে (মৃ­ত্যু পর্য­ন্ত চল্লিশ দিন) প্রায় কোন না কোন প্র­কা­রে শরী­রের গ্লা­নি ছিল। কথা (প্র­থম বি­­পান আরো­গ্য লাভ) অতি গো­­নে রা­খি­লেন। কা­হা­রো নি­­টে প্র­কাশ করি­লেন না
প্রণয়ী বি­শ্বা­সী ব্য­ক্তি যদি শত্রু হইয়া দাঁড়ায়, তা­হার হস্ত হই­তে রক্ষা পাওয়া নি­তা­ন্ত কঠিন। চি­­­ত্রুর হস্ত হই­তে অনে­কেই রক্ষা পা­­তে পা­রে, কি­ন্তু মি­ত্র যদি শত্রু হয়, তা­হার হস্ত হই­তে রা পাওয়ার আশা কি­ছু­তেই থা­কে না। বি­শে­ষত স্ত্রী­জা­তি শত্রু­তা­সা­­নে উত্তে­জিত হইয়া উঠি­লে, তা­হা শেষ না করিয়া প্রাণ থা­কি­তে ক্ষা­ন্ত হয় না। জায়েদা ক্ষা­ন্ত হই­বেন কেন? জায়েদার পশ্চা­তে আরো লোক আছে। জায়েদা এক­টু নি­রুৎসাহ হই­লে, মায়মু­না না­না­প্র­কা­রে উৎসা­হিত করিয়া নূতন ভা­বে উত্তে­জিত করিত। এক­বার বি­ফল হই­লে দ্বি­তীয়বা­রে অব­শ্যই সু­ফল ফলি­বে, কথাও জায়েদার কর্ণে মধ্যে মধ্যে ফুৎকা­রের ন্যায় বা­জি­তে লা­গিল
মায়মু­না মনে মনে ভা­বিয়াছিল, যা­হা দিয়াছি তা­হা­তে আর রক্ষা নাই। এক­বার গলা­ধঃ­­রণ হই­লেই কা­র্য­সি­দ্ধি হই­বে। হা­সান জায়েদার গৃ­হে আসিয়া বসিয়াছেন, মধু­পা­নে আত্ম­বি­কার উপ­স্থিত হইয়াছে, গো­­নে সন্ধান লইয়া একে­বা­রে নি­শ্চি­ন্ত­ভা­বে বসিয়া আছে, কো­ন্ সময়ে হা­সা­নের পু­রী হই­তে ক্র­ন্দ­­ধ্ব­নি শু­নি­বে, নি­জেও কাঁদি­তে কাঁদি­তে যাইয়া পু­­বা­সি­­ণের সহিত হা­সা­নের বিয়োগ­­নিত ক্র­ন্দ­নে যোগ দি­বে এইরূপ আলো­­নায় সা­রা­নি­শা বসিয়া বসিয়া কা­টা­ইল; প্র­ভাত হইয়া আসিল, তবুও ক্র­ন্দ­­­ব্দ তা­হার কর্ণে প্র­বেশ করিল না। দুই-এক পদ করিয়া জায়েদার গৃহ পর্য­ন্ত আসিল, জায়েদার মু­খে সমুদয় ঘট­না শু­নিয়া আশ্চ­র্যা­ন্বিত হইল। জি­জ্ঞা­সা করিল, "তবে উপায়?"
জায়েদা উত্তর করিল, "উপায় অনেক আছে। তু­মি বা­জার হই­তে আমা­কে কি­ছু মি­ষ্ট খে­জুর আনিয়া দাও। এবা­রে দে­খিয়ো কি­ছু­তেই রক্ষা হই­বে না!"
"খে­জু­রে কী হই­বে?"
"মধু­তে যা­হা হইয়াছিল, তা­হাই হই­বে।"
"তি­নি কী তো­মার ঘরে আসি­বেন?"
কেন আসি­বে না?"
"যদি জা­নিয়া থা­কেন-ঘু­ণা­ক্ষ­রে যদি টের পাইয়া থা­কেন, তবে তো­মার ঘরে আসা দূরে থা­ক্, তো­মার মুখও দে­খি­বেন না।"
"বো­ন্! তু­মি আমার বয়সে বড়, অনেক দে­খিয়াছ, অনেক শু­নিয়াও থা­কি­বে, কি­ন্তু তো­মার ভ্রমও অনেক। স্ত্রী­জা­তির এম­নি এক­টি মো­হি­নী­­ক্তি আছে যে, পু­রু­ষের মন অতি কঠিন হই­লেও সহ­জে নোয়াই­তে পা­রে, ঘু­রা­­তে পা­রে, ফি­রা­­তেও পা­রে। তবে অন্যের প্রণয়ে মজি­লে এক­টু কথা আছে বটে, কি­ন্তু হা­তে পাইয়া নি­র্জ­নে বসা­­তে পা­রি­লে, কা­ছে ঘেঁষিয়া মো­হন মন্ত্র­গু­লি ক্র­মে ক্র­মে আওড়াই­তে পা­রি­লে অব­শ্যই কি­ছু-না-কি­ছু ফল ফলা­­তে পা­রি­বই পা­রি­বে। যে না পা­রে সে না­রী নহে। আর আমি তাঁহা­কে বি­­পান করা­ইব কথা তো তি­নি জা­নেন না, কেহ তো তাঁহা­কে সে কথা বলে নাই; তি­নিও তো সর্ব­জ্ঞ নহেন যে, জয়না­বের ঘরে বসিয়া জায়েদার মনের খবর জা­নি­তে পা­রি­বেন। যে পথে দাঁড়াইয়াছি, আর ফি­রিব না, যা­হা করি­তে হয়, আমিই করিব।"
মায়মু­না মনে মনে সন্তু­ষ্ট হইয়া মনে মনেই বলিল, "মা­নু­ষের মনের ভাব পরি­­র্তন হই­তে ক্ষ­­কালও বি­­ম্ব হয় না।" প্র­কা­শ্যে কহিল, "আমি খে­জুর লইয়া শী­ঘ্রই আসি­তে­ছি।" মায়মু­না বি­দায় হইল।জায়েদা অব­শি­ষ্ট মধু, যা­হা পা­ত্রে ছিল, তা­হা আনিয়া দে­খিয়া দে­খিয়া বলি­তে লা­গি­লেন, "যে­মন মধু তে­­নই আছে; ইহার চা­রি ভা­গের এক ভাগও যদি উদ­­স্থ হইত, তা­হা হই­লে আজ এত­ক্ষণ জয়না­বের সু­­­রী ডু­বিয়া যা­ইত, সু­খের বা­সা ভা­ঙ্গিয়া একে­বা­রে দু­­খের সা­­রে ডু­বিত, স্বা­মী­সো­হা­গি­নীর সাধ মি­টিয়া যা­ইত! এই সু­­ধুর মধু­তেই জায়েদার আশা পরিপূর্ণ হইত। প্র­­মে যে ভাব হইয়াছিল, আর কি­ছু­ক্ষণ সেই ভা­বে থা­কি­লে আজ জয়না­বের আর হা­সি­মুখ দে­খি­তাম না; আমারও অন্তর জ্ব­লিত না। এক বার, দুই বার, তিন বার, যত বার হয় চে­ষ্টা করিব; চে­ষ্টার অসা­ধ্য কী আছে?"
মায়মু­না খে­জুর লইয়া উপ­স্থিত হইল। বলিল, "সা­­ধান! আর আমি বি­­ম্ব করিব না। যদি আব­শ্যক হয়, সময় বু­ঝিয়া আমার বা­টী­তে যাইয়ো।" এই কথা বলিয়া মায়মু­না চলিয়া গেল। জায়েদা সেই খে­জু­­গু­লি বা­ছিয়া বা­ছিয়া দুই ভাগ করি­লেন। এক ভা­গের প্র­ত্যেক খে­জু­রে এমন এক এক­টি চি­হ্ন দি­লেন যে তি­নি ভি­ন্ন অন্য কা­হা­রো চক্ষে তা­হা পড়িবার সম্ভা­­না রহিল না। অব­শি­ষ্ট অচি­হ্নিত খে­জু­­গু­লি­তে সেই কৌ­টার সা­­ঘা­তিক বিষ মি­শ্রিত করিয়া, উভয় খে­জুর এক­ত্র করিয়া রা­খিয়া দি­লেন
হা­সান জয়না­­কে বলিয়াছি­লেন যে, "গত রা­ত্রি­তে জায়েদার গৃ­হে বাস করিব ইচ্ছা ছিল, দৈবব­শে এম­নই এক­টি ঘট­না ঘটিল যে সম­স্ত রা­ত্রি পে­টের বে­­নায়, শরী­রের জ্বা­লায় অস্থির ছি­লাম। মুহূর্ত­কা­লের জন্যও সু­স্থির হই­তে পা­রি নাই। ভা­­নায় চি­ন্তায় জায়েদা কোন কথাই মু­খে আনি­তে পা­রিল না। কে­­­মা­ত্র বলিয়াছিল যে, 'সক­লই আমার কপাল!' তা যা­হাই হউক, আজিও আমি জায়েদার গৃ­হে যা­­তে­ছি!"
জয়নাব বি­শেষ সন্তু­ষ্ট হইয়া হা­সা­­কে বি­দায় দান করি­লেন। জয়না­বের ইচ্ছা যে, কা­হা­রো মনে দু­ঃখ না হয়, স্বা­মী­­নে কে­হই বঞ্চিত না হয়। সে ধনে সক­লেই সম­ভা­বে অধি­কা­রি­ণী প্র­ত্যা­শি­নী
হা­সা­নের শরীর সম্য­ক্ প্র­কা­রে সু­স্থ হয় নাই; বি­ষের তেজ শরীর হই­তে একে­বা­রে যে নি­র্দে­­­ভা­বে অপ­সৃত হইয়াছে, তা­হাও নহে। শরী­রের গ্লা­নি দু­র্ব­­তা এবং উদ­রের জড়তা এখ­নো অনেক আছে। সকল থা­কা সত্ত্বেও তি­নি জায়েদার গৃ­হে উপ­স্থিত হইয়া গত রা­ত্রির ঘট­না আলো­­না করি­তে লা­গি­লেন। সেই মধুর কথাও জি­জ্ঞা­সা করি­রেন। জায়েদা উত্তর করি­লেন, "যে মধু­তে এত যন্ত্র­ণা, এত কে¬; সেই মধু আমি আবার গৃ­হে রা­খিব? পা­ত্র­­মেত তা­হা আমি তৎক্ষ­ণাৎ দূর করিয়া ফে­লিয়া দিয়াছি।"
জায়েদার ব্য­­হা­রে হা­সান যা­­­­নাই সন্তু­ষ্ট হই­লেন। সু­যোগ পাইয়া জায়েদা সেই খর্জু­রের পা­ত্র ইমাম হা­সা­নের সম্মু­খে রা­খিয়া, নি­­টে বসিয়া খর্জুর ভণে অনু­রোধ করি­লেন। হা­সান স্ব­ভা­­তঃই খর্জুর ভা­­বা­সি­তেন, কি­ন্তু গত রজ­নী­তে মধু­পান করিয়া যে কষ্ট পাইয়াছি­লেন, তা­হা মনে করিয়া এক­টু ইত­স্তত করি­তে লা­গি­লেন। চতু­রা জায়েদা স্বা­মীর অগ্রেই চি­হ্নিত খে­জু­­গু­লি খা­­তে আর­ম্ভ করিয়া দি­লেন। দে­খা­দে­খি, ইমাম হা­সানও চি­হ্নিত এবং অচি­হ্নিত উভয়বিধ খে­জুর এক­টি এক­টি করিয়া খা­­তে আর­ম্ভ করি­লেন।ঊর্ধ্ব সং­খ্যা সা­­টি উদ­­স্থ হই­লেই বি­ষের কা­র্য আর­ম্ভ হইল। হা­সান সন্দে­­প্র­যু­ক্ত আর খা­­লেন না, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থির হইয়া পড়িলেন। আর বি­­ম্ব করি­লেন না, কোন কথাও কহি­লেন না; নি­তা­ন্ত দু­­খি­­ভা­বে প্রা­ণের অনুজ হো­সে­নের গৃ­হা­ভি­মু­খে গমন করি­লেন। এবা­রো কা­হা­কে কি­ছু বলি­লেন না; কি­ছুণ ভ্রা­তৃ­গৃ­হে অব­স্থি­তি করি­লেন। নি­দা­রুণ বি­ষের যন্ত্র­ণা ক্র­মশ অস­হ্য হইয়া উঠিল। পু­­রায় তি­নি প্র­ভু মো­হা­ম্ম­দের 'রওজা মো­বা­­কে' (পবি­ত্র সমা­ধি­ক্ষে­ত্রে) যাইয়া ঈশ্ব­রের নি­­টে আরো­গ্য প্রা­র্থ­না করি­তে লা­গি­লেন। দয়াময় এবা­রেও হা­সা­­কে আরো­গ্য করিয়া প্রাণ রক্ষা করি­লেন
জায়েদার আচ­রণ হা­সান কি­ছু বু­ঝি­তে পা­রিয়াছি­লেন। তথা­পি সে কথা মু­খে আনি­লেন না; কা­হা­রো নি­কট প্র­কাশ করি­লেন না। কি­ন্তু মনে মনে বড়ই দু­­খিত হই­লেন। নি­র্জ­নে বসিয়া স্ব­গত বলি­তে লা­গি­লেন, "স্ত্রী দু­­খের ভা­গি­নী, সু­খের ভা­গি­নী। আর আমার স্ত্রী যা­হা-ঈশ্ব­রই জা­নেন। আমি জ্ঞা­নপূর্বক জায়েদার কোন অনি­ষ্ট করি নাই, কোন প্র­কা­রে কষ্টও দিই নাই। জয়না­­কে বি­বাহ করিয়াছি বলিয়াই কী জায়েদা আমার প্রাণ লই­তে সঙ্ক­ল্প করিয়াছে? স্ব­­স্তে পতি­­ধে প্র­বৃ­ত্ত হইয়াছে? সপ­ত্নী­­ম্ব­ন্ধ তা­হার নূতন নহে।হা­­নে­বা­নুও তো তা­হার সপ­ত্নী। যে জায়েদা আমার জন্য সর্ব­দা মহা­ব্য­স্ত থা­কিত, কি­সে আমি সন্তু­ষ্ট থা­কিব, তা­হা­রই অনু­­ন্ধান করিত, আজ সেই জায়েদা আমার প্রা­­বি­না­শের জন্য বিষ হস্তে করিয়াছে! এক­থা আর কা­হা­কেও বলিব না! বা­টী­তেও আর থা­কিব না। মায়াময় সং­সার ঘৃ­ণা­র্হ স্থান। নি­শ্চয়ই জায়েদার মন অন্য কোন লো­ভে আক্রা­ন্ত হইয়াছে। অব­শ্যই জায়েদা কোন আশায় ভু­লিয়াছে, কু­­কে পড়িয়াছে। সপ­ত্নী­বা­দে আমা­কে বিষ দি­বে কেন? বিষ জয়না­­কে দি­লেই তো সম্ভ­বে। জয়না­বের প্রা­ণেই তা­হার অনা­দর হই­তে পা­রে, আমার প্রা­ণে অনা­দর হই­লে তা­হার আর সুখ কী? স্ত্রী হইয়া যখন স্বা­মী­­ধে অগ্র­সর হইয়াছে, তখন আর আমার নি­স্তার নাই। পু­রী­তে আর থা­কিব না। স্ত্রী-পরি­­নের মুখ আর দে­খিব না, এই পু­রীই আমার জী­বন বি­না­শের প্র­ধান যন্ত্র।-কি­ছু­তেই এখা­নে থা­কা উচিত নহে। বা­হি­রের শত্রু হই­তে রক্ষা পাওয়াও সহজ, কি­ন্তু ঘরের শত্রু হই­তে রক্ষা পাওয়া দু­ষ্কর! শত্রু দূরে থা­কি­লেও সর্ব­দা আত­ঙ্ক কো­ন্ সময়ে কী ঘটে,-কো­ন্ সূত্রে, কো­ন্ সু­যো­গে, কী উপায়ে, কো­ন্ পথে, কা­হার সা­হা­য্যে, শত্রু আসিয়া কী কৌ­­লে শত্রু­তা সা­ধন করে, এই ভা­­নায় এই ভয়েই সর্ব­দা আকুল থা­কি­তে হয়। কি­ন্তু আমার ঘরেই শত্রু! আমার প্রা­ণই আমার শত্রু! নিজ দে­হই আমার ঘা­তক! নিজ হস্তই আমার বি­না­শক! নিজ আত্মাই আর বি­­র্জক। উঃ! কী নি­দা­রুণ কথা! মু­খে আনি­তেও কষ্ট বোধ হয়! স্ত্রী-স্বা­মী­তে দেহ ভি­ন্ন বটে, কি­ন্তু আমি তো আর কি­ছুই ভি­ন্ন দে­খি না। স্বা­মী, স্ত্রী এক দেহ হই­তে পা­রে না বলিয়াই ভি­ন্ন ভা­বে থা­কে, কি­ন্তু আত্মা এক, মন এক, মায়া মম­তা এক, আশা এক, ভর­সা এক, প্রাণ এক,-সক­লই এক। কি­ন্তু কী দু­ঃখ! কী ভয়ানক কথা! হা অদৃ­ষ্ট! সেই এক আত্মা এক প্রাণ স্ত্রী-তা­হার হস্তেই স্বা­মী­বি­না­শের বিষ। কী পরি­তাপ! সেই কো­মল হস্ত স্বা­মীর জী­বন-প্র­দীপ নি­র্বা­ণের জন্য প্র­সা­রিত!আর এস্থা­নে থা­কিব না। বনে বনে পশু­পী­দের সহ­বা­সে থা­কাই ভাল। পু­রী­তে আর থা­কিব না।"
এইরূপে দৃঢ়সঙ্ক­ল্প হইয়া হা­সান আপন প্র­ধান মি­ত্র আব্বাস কতিপয় এয়ার সম­ভি­ব্যা­হা­রে মদি­নার নি­­­স্থ মু­সাল নগ­রে গমন করি­লেন। মু­সা­­বা­সী­রা হজ­রত ইমাম হা­সা­নের শু­ভা­­­নে যা­­­­নাই আন­ন্দিত হইয়া অতি সমা­­রে বি­শেষ ভক্তি-উপ­হা­রে অভ্য­র্থ­না করি­লেন, কি­ন্তু এখা­নে তাঁহার ভা­গ্যে বে­শি দিন বি­শ্রাম ঘটিল না

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.