বিষাদ সিন্ধু : মীর মশাররফ হোসেন_মহরম পর্ব : ১৪তম প্রবাহ
স্ত্রীলোকমাত্রেই বোর্কা ব্যবহার করিয়া যথেচ্ছ স্থানে বেড়াইতে পারে। ভারতের ন্যায় তথায় পাল্কি-বেহারা নাই। লক্ষপতি হউন, রাজললনাই হউন, ভদ্রমহিলাই হউন, বোর্কা ব্যবহারে যথেচ্ছভাবে ভ্রমণ করিয়া থাকেন। দূর দেশে যাইতে হইলে উষ্ট্রের বা অশ্বের আশ্রয় লইতে হয়।
মায়মুনার গৃহ বেশি দূর নহে। জায়েদা মায়মুনার গৃহে উপস্থিত হইয়া বোর্কা মোচনপূর্বক তাহার শয়নকে যাইয়া বসিলেন। মায়মুনাও নিকটে আসিয়া বসিল। আজ জায়েদা মনের কথা অকপটে ভাঙ্গিলেন।কথায় কথায়, কথার ছলনায়, কথায় ভর দিয়া, কথা কাটাইয়া, কথায় ফাঁক দিয়া, কথায় পোষকতা করিয়া, কথায় বিপতা করিয়া স্বপ বিপ, সকল দিকে যাইয়া আজ মায়মুনা জায়েদার মনের কথা পাইল। মায়মুনার মোহমন্ত্রে জায়েদা যেন উন্মাদিনী।
সপত্নীনাগিনীর বিষদন্তে যে অবলা একবার দংশিত হইয়াছে, তাহার মন ফিরিতে কতক্ষণ? চিরভালবাসা, চিরপ্রণয়ী পতির মমতা বিসর্জন করিতে তাহার দুঃখ কী? এক প্রাণ, এক আত্মা, স্বামীই সকল, এ কথা প্রায় স্ত্রীরই মনে আছে, স্ত্রীরই মনে থাকে, কিন্তু সপত্নীর নাম শুনিলেই মনের আগুন দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ ভাবে জ্বলিয়া উঠে। সে আগুন বাহির হইবার পথ পায় না বলিয়াই অন্তরস্থ ভালবাসা, প্রণয়, মায়া মমতা একেবারে পোড়াইয়া ছারখার করিয়া ফেলে।
মায়মুনার সমুদয় কথাতেই জায়েদা সম্মত হইলেন। মায়মুনা মহা সন্তুষ্ট হইয়া বলিতে লাগিল, "বোন্! এত দিনে যে বুঝিয়াছ, সেই ভাল, আর বিলম্ব নাই, কোন্ সময় কাহার অদৃষ্টে কি ঘটে, কে বলিতে পারে? যত বিলম্ব হইবে, ততই তোমার অমঙ্গলের ভাগ বেশি হইবে। যাহা করিতে বসিলে, তাহার উপর আর কথা কি আছে? শুভকার্যে আর বিলম্ব কেন? ধর, এই ঔষধ নেও।"
হজরত হাসান প্রতিদিনই একবার জায়েদার গৃহে আসিয়া দুই-এক দণ্ড নানাপ্রকার আলাপ করিতেন। কয়েক দিন আসিবার সময় পান নাই, সেই দিন মহাব্যস্তে জায়েদার ঘরে আসিয়া বসিলেন।জায়েদা পূর্বমত স্বামীর পদসেবা করিয়া জলযোগের আয়োজন করিতে লাগিলেন।
হাসান ভাবিয়াছিলেন, জায়েদার ঘরে কয়েক দিন যাই নাই, না জানি জায়েদা আজ কতই অভিমান করিয়া রহিয়াছে। কিন্তু ব্যবহারে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিলেন। জায়েদা পূর্বাপেক্ষা শতগুণে সরলতা শিখিয়াছে, মানসের পূর্ণানন্দে পরিপূরিত রহিয়াছে। এই ভাব দেখিয়া হাসান আজ জায়েদার গৃহে বাস করিবেন, মনে মনে স্থির করিলেন। জায়েদাও নানাপ্রকার হাবভাব প্রদর্শনে স্বামীর মন হরণ করিয়া প্রাণ হরণ করিতে বসিলেন। ঈশ্বরভক্তই হউন, মহামহিম ধার্মিকপ্রবরই হউন, মহাবলশালী বীরপুরুষই হউন, কী মহাপ্রাজ্ঞ সুপণ্ডিতই হউন, স্ত্রীজাতির মায়াজাল ভেদ করা বড়ই কঠিন। নারীবুদ্ধির অন্ত পাওয়া সহজ নহে। জায়েদা এক পাত্রে মধু ও অন্য পাত্রে জল আনিয়া স্বামীর সম্মুখে রাখিলেন।
সকৌতুকে হাসান জিজ্ঞাসা করিলেন, "অসময়ে মধু?"
যাঁহার কৃপাবলে অনন্ত জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে, পর্বত সাগরে মিশিয়াছে, বিজন বন নগরে পরিণত হইয়াছে, জনপূর্ণ মহানগরী নিবিড় অরণ্য হইয়া যাইতেছে, সেই সর্বেশ্বরের অসাধ্য কি আছে? প্রভু মোহাম্মদের সমাধি-মন্দিরের পবিত্রতাগুণে, ঈশ্বরের মহিমায় হাসান আরোগ্য লাভ করিলেন। কিন্তু এই প্রথম বিষপান হইতে (মৃত্যু পর্যন্ত চল্লিশ দিন) প্রায় কোন না কোন প্রকারে শরীরের গ্লানি ছিল। এ কথা (প্রথম বিষপান ও আরোগ্য লাভ) অতি গোপনে রাখিলেন। কাহারো নিকটে প্রকাশ করিলেন না।
প্রণয়ী বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি শত্রু হইয়া দাঁড়ায়, তাহার হস্ত হইতে রক্ষা পাওয়া নিতান্ত কঠিন। চিরশত্রুর হস্ত হইতে অনেকেই রক্ষা পাইতে পারে, কিন্তু মিত্র যদি শত্রু হয়, তাহার হস্ত হইতে রা পাওয়ার আশা কিছুতেই থাকে না। বিশেষত স্ত্রীজাতি শত্রুতাসাধনে উত্তেজিত হইয়া উঠিলে, তাহা শেষ না করিয়া প্রাণ থাকিতে ক্ষান্ত হয় না। জায়েদা ক্ষান্ত হইবেন কেন? জায়েদার পশ্চাতে আরো লোক আছে। জায়েদা একটু নিরুৎসাহ হইলে, মায়মুনা নানাপ্রকারে উৎসাহিত করিয়া নূতন ভাবে উত্তেজিত করিত। একবার বিফল হইলে দ্বিতীয়বারে অবশ্যই সুফল ফলিবে, এ কথাও জায়েদার কর্ণে মধ্যে মধ্যে ফুৎকারের ন্যায় বাজিতে লাগিল।
মায়মুনা মনে মনে ভাবিয়াছিল, যাহা দিয়াছি তাহাতে আর রক্ষা নাই। একবার গলাধঃকরণ হইলেই কার্যসিদ্ধি হইবে। হাসান জায়েদার গৃহে আসিয়া বসিয়াছেন, মধুপানে আত্মবিকার উপস্থিত হইয়াছে, গোপনে সন্ধান লইয়া একেবারে নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া আছে, কোন্ সময়ে হাসানের পুরী হইতে ক্রন্দনধ্বনি শুনিবে, নিজেও কাঁদিতে কাঁদিতে যাইয়া পুরবাসিগণের সহিত হাসানের বিয়োগজনিত ক্রন্দনে যোগ দিবে এইরূপ আলোচনায় সারানিশা বসিয়া বসিয়া কাটাইল; প্রভাত হইয়া আসিল, তবুও ক্রন্দনশব্দ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল না। দুই-এক পদ করিয়া জায়েদার গৃহ পর্যন্ত আসিল, জায়েদার মুখে সমুদয় ঘটনা শুনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, "তবে উপায়?"
হাসান জয়নাবকে বলিয়াছিলেন যে, "গত রাত্রিতে জায়েদার গৃহে বাস করিব ইচ্ছা ছিল, দৈববশে এমনই একটি ঘটনা ঘটিল যে সমস্ত রাত্রি পেটের বেদনায়, শরীরের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। মুহূর্তকালের জন্যও সুস্থির হইতে পারি নাই। ভাবনায় চিন্তায় জায়েদা কোন কথাই মুখে আনিতে পারিল না। কেবলমাত্র বলিয়াছিল যে, 'সকলই আমার কপাল!' তা যাহাই হউক, আজিও আমি জায়েদার গৃহে যাইতেছি!"
হাসানের শরীর সম্যক্ প্রকারে সুস্থ হয় নাই; বিষের তেজ শরীর হইতে একেবারে যে নির্দোষভাবে অপসৃত হইয়াছে, তাহাও নহে। শরীরের গ্লানি ও দুর্বলতা এবং উদরের জড়তা এখনো অনেক আছে। এ সকল থাকা সত্ত্বেও তিনি জায়েদার গৃহে উপস্থিত হইয়া গত রাত্রির ঘটনা আলোচনা করিতে লাগিলেন। সেই মধুর কথাও জিজ্ঞাসা করিরেন। জায়েদা উত্তর করিলেন, "যে মধুতে এত যন্ত্রণা, এত কে¬শ; সেই মধু আমি আবার গৃহে রাখিব? পাত্রসমেত তাহা আমি তৎক্ষণাৎ দূর করিয়া ফেলিয়া দিয়াছি।"
জায়েদার আচরণ হাসান কিছু বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তথাপি সে কথা মুখে আনিলেন না; কাহারো নিকট প্রকাশ করিলেন না। কিন্তু মনে মনে বড়ই দুঃখিত হইলেন। নির্জনে বসিয়া স্বগত বলিতে লাগিলেন, "স্ত্রী দুঃখের ভাগিনী, সুখের ভাগিনী। আর আমার স্ত্রী যাহা-ঈশ্বরই জানেন। আমি জ্ঞানপূর্বক জায়েদার কোন অনিষ্ট করি নাই, কোন প্রকারে কষ্টও দিই নাই। জয়নাবকে বিবাহ করিয়াছি বলিয়াই কী জায়েদা আমার প্রাণ লইতে সঙ্কল্প করিয়াছে? স্বহস্তে পতিবধে প্রবৃত্ত হইয়াছে? সপত্নীসম্বন্ধ তাহার নূতন নহে।হাসনেবানুও তো তাহার সপত্নী। যে জায়েদা আমার জন্য সর্বদা মহাব্যস্ত থাকিত, কিসে আমি সন্তুষ্ট থাকিব, তাহারই অনুসন্ধান করিত, আজ সেই জায়েদা আমার প্রাণবিনাশের জন্য বিষ হস্তে করিয়াছে! একথা আর কাহাকেও বলিব না! এ বাটীতেও আর থাকিব না। মায়াময় সংসার ঘৃণার্হ স্থান। নিশ্চয়ই জায়েদার মন অন্য কোন লোভে আক্রান্ত হইয়াছে। অবশ্যই জায়েদা কোন আশায় ভুলিয়াছে, কুহকে পড়িয়াছে। সপত্নীবাদে আমাকে বিষ দিবে কেন? এ বিষ জয়নাবকে দিলেই তো সম্ভবে। জয়নাবের প্রাণেই তাহার অনাদর হইতে পারে, আমার প্রাণে অনাদর হইলে তাহার আর সুখ কী? স্ত্রী হইয়া যখন স্বামীবধে অগ্রসর হইয়াছে, তখন আর আমার নিস্তার নাই। এ পুরীতে আর থাকিব না। স্ত্রী-পরিজনের মুখ আর দেখিব না, এই পুরীই আমার জীবন বিনাশের প্রধান যন্ত্র।-কিছুতেই এখানে থাকা উচিত নহে। বাহিরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়াও সহজ, কিন্তু ঘরের শত্রু হইতে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর! শত্রু দূরে থাকিলেও সর্বদা আতঙ্ক। কোন্ সময়ে কী ঘটে,-কোন্ সূত্রে, কোন্ সুযোগে, কী উপায়ে, কোন্ পথে, কাহার সাহায্যে, শত্রু আসিয়া কী কৌশলে শত্রুতা সাধন করে, এই ভাবনায় ও এই ভয়েই সর্বদা আকুল থাকিতে হয়। কিন্তু আমার ঘরেই শত্রু! আমার প্রাণই আমার শত্রু! নিজ দেহই আমার ঘাতক! নিজ হস্তই আমার বিনাশক! নিজ আত্মাই আর বিসর্জক। উঃ! কী নিদারুণ কথা! মুখে আনিতেও কষ্ট বোধ হয়! স্ত্রী-স্বামীতে দেহ ভিন্ন বটে, কিন্তু আমি তো আর কিছুই ভিন্ন দেখি না। স্বামী, স্ত্রী এক দেহ হইতে পারে না বলিয়াই ভিন্ন ভাবে থাকে, কিন্তু আত্মা এক, মন এক, মায়া মমতা এক, আশা এক, ভরসা এক, প্রাণ এক,-সকলই এক। কিন্তু কী দুঃখ! কী ভয়ানক কথা! হা অদৃষ্ট! সেই এক আত্মা এক প্রাণ স্ত্রী-তাহার হস্তেই স্বামীবিনাশের বিষ। কী পরিতাপ! সেই কোমল হস্ত স্বামীর জীবন-প্রদীপ নির্বাণের জন্য প্রসারিত!আর এস্থানে থাকিব না। বনে বনে পশুপীদের সহবাসে থাকাই ভাল। এ পুরীতে আর থাকিব না।"
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments