আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলন_সীমান্ত আকরাম
হাজার বছরের বাঙালির জীবন প্রবাহে যেসব আন্দোলন, সংগ্রাম, গৌরবগাঁথা যুক্ত হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর ভাষা আন্দোলন তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীও বিস্মিত হয়েছে বাঙালির ভাষাপ্রীতিতে। ‘ভাষার জন্য আত্মত্যাগ’ বাঙালিকে বিশ্বের মানুষের কাছে আদর্শিক ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে দৃষ্টান্তরূপে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে তৎকালীন পশ্চিম-পাকিস্তান জুড়ে যায় পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে। একমাত্র ধর্মের মিল ছাড়া এক দেশভুক্ত দু’টি দেশের তেমন সাজুয্য ছিল না। ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির তো নয়ই। এমনই সন্ধিক্ষণে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর নানান গণবিরোধী নীতি চাপিয়ে দিতে শুরু করে ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান। এর মধ্যে রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু করার নীলনকশা বাঙালিতে আহত করে। তবে এই আন্দোলন শুরুর আগে অবরুদ্ধ ভাষা নিয়ে কবি আব্দুল হাকিম রচিত-
‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’
৫২ পরবর্তীতে আমাদের জাতীয় জীবনে, সামগ্রিক চেতনায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই পড়েনি, একুশের মহিমা বাংলা সাহিত্যে ও সাংস্কৃতিতেও বারবার উচ্চকিত হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের মতোই সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রায় সকল শাখায় প্রেক্ষাপট হিসেবে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কবিতার কাব্যিক চোখে, গল্পের শাব্দিক ভাঁজে, গবেষণার আগ্রহী বিষয় হিসেবে, গানের গুঞ্জরনে, নাটক ও চলচ্চিত্রের উদ্দীপক সংলাপ বর্ষণে ভাষা আন্দোলন এখনও প্রাণময়, চেতনাদীপ্ত ও প্রাসঙ্গিক। ফলে সাহিত্য-সংষ্কৃতিতে এমন শিল্পী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি এ প্রেক্ষাপটে অনুরণিত হয়ে কবিতা-গল্প-গান রচনা করেননি। তবে সব সময়ের মতোই, সব প্রেক্ষাপটের পুনঃসঞ্চায়নে ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই অজর-অজ¯্র লেখা হয়েছে।
লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেও হিন্দী ও উর্দু রাষ্ট্রভাষার আসন দখল করার এই তুমুল লড়াইয়ের প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের সচেতন বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদগণ সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবীকে সোচ্চার করে তুলে ধরেছিলেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত আজাদের ১৯৩৭ (২৩ এপ্রিল/১০ বৈশাখ, শুক্রবার) সালের আলোচ্য সম্পাদকীয় তারই পরিচয় বহন করেছে। ১৯৪৭ এর ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জোরালো বক্তব্য ও যুক্তি পেশ করেন। তিনি বলেন, “ কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে। ... যদি বিদেশী ভাষা ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই।” (কারণ উর্দু পাকিস্তানের ডোমিনিয়নের কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। এই অর্থে উর্দুও বিদেশী ভাষা)
“পূর্ব পাকিস্তানের কোর্ট ও বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দীকে গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে।”
১৯৪৩ সালে মোহাম্মদীতে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে জনাব আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়নে হাত দিতে পারবো। ... জাতির যে অর্থে, শক্তি, সময় ও উদ্যম উর্দু প্রবর্তনে অপব্যয় হবে তা যদি আমরা শিক্ষা, সাহিত্যে নিয়োজিত করি তবে পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা শুধু ভারতে নয়, সমগ্র জগতের এমন কি গোটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে পারবো।” (মাসিক মোহাম্মদী, কার্তিক, ১৩৫০)
মাসিক সওগাত এর ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের আশি^ন সংখ্যায় কবি ফররুখ আহমদ ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, “পাকিস্তানের অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্ববাদিসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেরই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলাভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচিন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তরিত করলে ইসলামি ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাদের অভিমত। কী কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পেছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি।”
‘একুশের প্রভাব : বাংলাদেশের কাব্যভাষার বিবর্তন’ প্রবন্ধে কবিতায় ভাষা-আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে আহমেদ মাওলার মূল্যায়ন- “একুশের পর বাঙালির যেন নতুন জন্ম ঘটে, চেতনায় ও সৃজনশীলতায় নতুন এক দিগন্তের সাক্ষাৎ পায় বাঙালি। সাহিত্যের অন্য শাখার তুলনায় কবিতাই হয়ে ওঠে বাঙালির সৃজন-বেদনার প্রিয় ক্ষেত্র। ওই দশকে, একসঙ্গে এত কবির আবির্ভাব, এত কবিতা, সম্ভবত আর কখনও লেখা হয়নি। ভাষা-আন্দোলনের অভিঘাতই বাংলাদেশের কবিতার বাঁকবদল ঘটিয়েছে, অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটেছে বাংলাদেশের কাব্যভাষার।’
সুতরাং সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রভাবের বিষয়টি অস্বীকারও করা যাবে না। এর আগে সাহিত্যে ব্যাপকভাবে আরবী, ফারসী, ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হলেও ভাষা আন্দোলন পরবর্তী বাংলা শব্দের যথাযথ প্রয়োগে কবিরা সচেতন ও তীক্ষè দৃষ্টি রেখে সফলতাও পেয়েছেন।
১৯৪৭ -এর ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা প্রশ্নে প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু?’। প্রচ্ছদসহ ২০ পৃষ্ঠার পুস্তিকাটিতে পাকিস্তানের, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া হয়। তিনটি মাত্র রচনা। ‘আমাদের প্রস্তাব’ শিরোনামের প্রথম রচনায় অধ্যাপক এম আবুল কাসেম পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের দুটি রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব করেন। একটি উর্দু ও অপরটি বাংলা। দ্বিতীয় রচনাটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বুদ্বিজীবী অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেনের। শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’। দীর্ঘ রচনাটি পরে সওগাত পত্রিকার ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তিনি লেখেন, ‘কোনো দেশের লোকে যে ভাষায় কথা বলে, সেইটাই সে দেশের স্বাভাবিক ভাষা। প্রজা সাধারণের ভাষাই রাষ্ট্রভাষা। অতএব পূর্ব পাকিস্তানের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হওয়া স্বাভাবিক এবং সমীচীন।’ তৃতীয় রচনাটির রচয়িতা ছিলেন সাহিত্যিক ও ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। শিরোনাম ছিল ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সাতটি যুক্তি তুলে ধরেন।
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের পরিচালনায় ‘তমদ্দুন মজলিস’ এর মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ প্রকাশিত হয় ১৪ নভেম্বর ১৯৪৮। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত কাব্য গ্রন্থ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশের তিন সপ্তাহের মধ্যে এটি পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ওই সংকলনে পত্রস্থ হয়েছিল এগারোটি কবিতা, আর কবিরা ছিলেন শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমান। এসব কবির সম্মিলিত শব্দেস্রোতে উদ্ভাসিত একুশে ফেব্রুয়ারির কালজয়ী তাৎপর্য, সমবায়ী জাগরণ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অভ্রান্ত ইঙ্গিত আর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সঙ্ঘশক্তির প্রতিবাদের উত্তাপ। স্মরণ করা যায়, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক একুশের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার পর আলাউদ্দিন আল আজাদের ছন্দবদ্ধ প্রতিবাদ উন্মথিত জাগরণ-
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধুলায় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার
ভেঙেছে, ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার।
(আলাউদ্দিন আল আজাদ, ‘স্মৃতিস্তম্ভ’)
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে যে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে যে জাগ্রত করেছে জাতীয়তাবাদী চেতনা, উপর্যুক্ত কবিতাংশে তারই সংহত উদ্ভাসন ঘটেছে। হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ কবিতায় শিল্পিত হয়েছে বাঙালির আত্মজাগরণের ইতিহাস। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার -এইসব থোকা থোকা জ্বলন্ত নাম কীভাবে বাঙালির হৃদয়ে বর্শার ফলার মতো গেঁথে আছে, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় তার পরিচয় উদ্ভাসিত-
আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে তাঁকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুচকে উঠবে-
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার -কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারি নাম তার বর্শার তীক্ষ্ন ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে;
........................................................
যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ন নাম। একসার জ্বলন্ত নাম।
(হাসান হাফিজুর রহমান, ‘অমর একুশে’)
বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উন্মাতাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনা প্রকাশিত হয়েছে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘কোনো এক মাকে’ কবিতায়। খোকা, যে শহীদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনে, আর যে কখনো উড়কি ধানের মুড়কি হাতে প্রতীক্ষারত মায়ের কাছে ফিরে আসবে না, মা তা কিছুতেই বুঝতে চায় না। এ কবিতার শরীরে ও সত্তায় প্রবহমান শহীদের রক্ত-নিংড়ানো আবেগ, যে-আবেগের ধারাজলে স্নাত হয় বাঙালি -খোকার মা হয়ে যায় দেশজননী-
কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝ’রে পড়েছে ডাঁটা;
পুঁইতলাটা নেতানো;
‘খোকা এলি?
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খোকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।
এখন,
মা’র চোখে চৈত্রের রোদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের।
তারপর,
দাওয়ায় ব’সে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খাই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে! কখন আসে!
এখন,
মার চোখে শিশির ভোর,
স্নেহের রোদে
ভিটে ভরেছে।
(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ‘কোনো এক মাকে’)
এইভাবে ভাষা-আন্দোলন আমাদের সামূহিক কবিচৈতন্যে নিয়ে আসে নতুন মাত্রা; ভাষা-আন্দোলন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের কবিদের অবিনাশী শিল্প-আয়োজন। যখনি শৃঙ্খলমুক্তির প্রয়োজন আসে, যখনি প্রয়োজন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-উচ্চারণ, কিংবা জনস্রোতের জোয়ার-আগমন, ভাষা-আন্দোলন আর তার শহীদেরা তখনি দ্রোহের ভূমিকায় হয় অবতীর্ণ। ওই অবিনাশী শক্তির উৎস তাই বায়ান্ন-উত্তর বাংলাদেশের কবিতার এক প্রধান অনুষঙ্গ। যেমনটি শামসুর রাহমানের ‘ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯’ কবিতায়-
বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা
সালামের মুখে আজ তরুণ শ্যামল পূর্ববাংলা।
(শামসুর রাহমান, ‘ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯’)
একুশের প্রথম সৃষ্টি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতায়ও ধ্বনিত হয় যুগ-পরম্পরায় একুশের অবিনাশী আহ্বান, মৃত্যুকে জয় আর প্রতিবাদে উচ্চকিত হওয়ার আহ্বান। সমুত্থিত বাঙালির সম্মিলিত আবেগ আর ঘৃণা আর প্রতিশোধ-বহ্নি যেন সংহতি লাভ করে একটি কবিতার শতাধিক পঙ্ক্তিস্রোতে-
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।
হে আমার মৃত ভায়েরা
সেই নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার
ভেসে আসবে
সেইদিন আমাদের দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নি শিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ আর বিজয়ের আনন্দে।
(মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’)
কালিক এই প্রবণতার কারণে প্রতিজ্ঞার কথা উচ্চারিত হয়েও অন্তিমে প্রশ্ন, কিংবা বলি সংশয়, দেখা দেয়। একুশের আন্তরপ্রেরণায় যে-কবি জনতার সমুদ্রে মিশে গিয়ে যখন সম্মুখ শপথে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠেন, তিনিই শেষে বরকতের মতো শহীদ হতে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’য় ফুটে ওঠে এই ছবি-
‘আমিও অন্তরঙ্গ হয়ে যাই হঠাৎ তখন
জনতার সমুদ্রের সাথে
বাঘের হাতের মতো সনখ শপথ
সোহাগের গাঢ় ইচ্ছা নিয়ে
নেমে আসে মনের ওপর!
নির্মম আদর পেয়ে আমিও রক্তাক্ত হবো
বরকতের শরীরের মতো?’
(আল মাহমুদ, ‘একুশের কবিতা’)
ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত পর থেকে পূর্ববাংলাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা। দেশপ্রেমমূলক এই কবিতা রচনার ধারা ভাষা-আন্দোলনের ভিন্নতর এক প্রতিফলন। ওইসব কবিতার শরীরে ও মর্মে উৎকীর্ণ হয়ে আছে দেশের প্রতি আমাদের কবিদের গভীর অনুরাগের ছবি। প্রকৃতি ও মানুষের মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, সেই জন্মভূমির ছবি চিত্রিত হয় সৈয়দ আলী আহসানের কবিতায়-
আমার পূর্ব বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
সন্ধ্যার উন্মেষের মতো
সরোবরের অতলের মতো
কালো-কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো
বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি...।
(সৈয়দ আলী আহসান, ‘আমার পূর্ব বাংলা’)
কালো পতাকায়
প্রাচীর-পত্রে
অশ্রু-তরল রক্তরঙের লিপি
ক্রোধের
ঘৃণার
ভয়াল বিস্ফোরণ
একুশে ফেব্রুয়ারি।
(সিকান্দার আবু জাফর, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’)
ভাষা-আন্দোলনের অনুষঙ্গে রচিত বেশ কিছু ছোটগল্পের নাম আমরা এখানে উল্লে¬খ করতে পারি। যেমন : শওকত ওসমানের ‘মৌন নয়’, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ’র ‘হাসি’, আনিসুজ্জামানের ‘দৃষ্টি’, মিন্নাত আলী’র ‘রুম বদলের ইতিকথা’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘খরস্রোত’, নূরউল আলমের ‘একালের রূপকথা’, মঈদ-উর-রহমানের ‘সিঁড়ি’, রাবেয়া খাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’, সেলিনা হোসেনের ‘দীপান্বিতা’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘এমনি করেই গড়ে উঠবে’, মুর্তজা বশীরের ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘সম্রাট’, বশীর আল হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে’, শওকত আলীর ‘অবেলায় পুনর্বার’, রাজিয়া খানের ‘শহীদ মিনার’, রিজিয়া রহমানের ‘জ্যোৎস্নার পোস্টার’, মাহমুদুল হকের ‘ছেঁড়া তার’, রশীদ হায়দারের ‘সুদূরের শহীদ’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘মরে যাওয়ার সময় হয়েছে’ এবং জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘কয়েকটি সংলাপ’ ইত্যাদি ছোটগল্প ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক শিল্পকথা হিসেবে উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। এসব ছোটগল্পে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনের এক একটি খ-চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যেসব খ-চিত্রের মৌল প্রত্যয় বাঙালির সত্তাগত রূপান্তর। ভাষা-আন্দোলন বিষয়ক গল্পে যে-মৌল প্রত্যয় শিল্পিত হয়েছে, জহির রায়হানের ‘কয়েকটি সংলাপ’ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করে উপস্থাপন করতে পারি-
পদত্যাগ চাই।
ওদের পদত্যাগ চাই।
বরকতের খুন আমরা ভুলব না।
রফিক আর জব্বারের খুন আমরা ভুলব না।
বিচার চাই।
ফাঁসি চাই ওই খুনীদের।
ভাইসব। সামনে এগিয়ে চলুন।
ওদের গোলাগুলি আর বেয়নেটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলুন।
(জহির রায়হান, ‘কয়েকটি সংলাপ’)
ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক উপন্যাস : ভাষা আন্দোলনের উপর রচিত প্রথম উপন্যাস জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’, শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’, সেলিনা হোসেনের ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, ‘যাপিত জীবন’।
ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক গবেষণা গ্রন্থ : এম আর আখতার মুকুলের ‘একুশের দলিল’, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা’, হুমায়ুন আজাদ এর ‘ভাষা আন্দোলন’, রফিকুল ইসলাম এর ‘শহীদ মিনার’, ‘বাংলা ভাষা আন্দোলন’ এবং মোস্তফা কামাল এর ‘ভাষা আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন’।
ভাষা আন্দোলনের গান : ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ভাষা সেনিক আ ন ম গাজিউল হক এর ‘ভুলবা না ভুলবনা একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবনা’, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ (গানটির প্রথম সুরকার - আব্দুল লতিফ, বর্তমান সুরকার- আলতাফ মাহমুদ), ফজল এ খোদা’র ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ (সুরকার ও শিল্পী- আব্দুল জব্বার), আবদুল লতিফ এর ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ এবং কবির সুমন এর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’।
ভাষা আন্দোলনভিত্তিক নাটক : ভাষা আন্দোলনের উপর রচিত প্রথম নাটক মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ (রচনাকাল ১৯৫৩, প্রকাশ ১৯৬৬) এবং মমতাজ উদ্দীন আহমদ ‘বিবাহ’ (১৯৮৮)।
ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ -এতে প্রথম ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম ব্যবহৃত হয়।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments