গজল রচয়িতা মনিরউদ্দীন ইউসুফ_মোবারক হোসেন খান
আমি বেতারে চাকরি করি। আর বেতারে চাকরি করার লাভ হলো বিভিন্ন স্তরের মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ। শিল্পি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী থেকে শুরু করে মুটে মজুর আর চাষী ভাইদের সাথে এখানে মেলামেশার সুযোগ পাওয়া যায়। আর এমনিভাবেই পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটেছিলো বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকের সাথে। তাঁর নাম মনিরউদ্দীন ইউসুফ। আজ থেকে বিশ বছরেরও আগের কথা। বেতারের অনুষ্ঠানে কথিকা পাঠের জন্যে মনিরউদ্দীন ইউসুফের সাথে দেখা করি। তারপর থেকে সে দেখা আরো ঘন হয়েছে। সেই সাথে তাঁর সাথে ক্রমশ ঘনিষ্ঠতাও বেড়েছে। আমাদের দু'জনের মাঝে বয়সের তারতম্য ছিল বটে, কিন্তু মনের দিক থেকে আমাদের তফাৎ আছে বলে মনে হতো না। আমাকে তিনি স্নেহ করতেন। তাঁর স্নেহের সাথে আমার প্রতি একটি শ্রদ্ধাবোধও ছিল। তার কারণ হয়তো আমার বংশ পরিচয়। আমার বাবা ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ। সঙ্গীতের সাধক। আমার চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ । সঙ্গীতের সম্রাট। আমি তাঁদের বংশেরই সন্তান। স্বাভাবিক কারণে আমার জন্যে তাঁর মনে যুগপৎ স্নেহ ও শ্রদ্ধা বাসা বেঁধেছিলো।
আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম। সমীহ করতাম। ফলে আমাদের মাঝে একটা চমৎকার হৃদ্যতা গড়ে ওঠেছিলো।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ ছিলেন খুব মিষ্টভাষী। কথা শুনলে মনে হতো প্রতিটি কথার সাথে যেন মধু ঝড়ে পড়ছে। তাঁর কথিকার ভাষা ছিল অত্যন্ত সাবলীল আর অনবদ্য। সহজ আর সরল। স্বচ্ছন্দ আর গতিশীল। তাই তাঁর কথিকা প্রচার করে আমি তৃপ্তি পেতাম। মনের ভেতর একটা আনন্দ বোধ করতাম। বাংলাদেশের অনেক কথকের কথিকাই প্রচার করার সুযোগ আমার জীবনে এসেছে, কিন্তু তাঁর মতো এমন মিষ্টি করে সহজ ভাষায় কাউকে কথিকা পাঠ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ বাংলা সাহিত্যের একজন সব্যসাচী লেখক ছিলেন। সাহিত্যের সবগুলো বিভাগেই তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ পদচারণা। কি প্রবন্ধ, কি অনুবাদ, কি গল্প-উপন্যাস, কি কবিতা, কি গান-গজল তাঁর হাতের ছোঁয়া পেয়ে যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠতো। তাঁর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ যেন প্রতিটি ছত্রে, প্রতিটি অনুচ্ছেদে, প্রতিটি অধ্যায়ে অনুরণিত। সাহিত্য ভুবনে তাই তিনি অমর স্রষ্টা হিসেবে সাহিত্য-প্রেমিক মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।
বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম অক্ষয়-অমর হয়ে আছেন। তাঁর লেখনি বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে অভাবিতভাবে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যের কোনো শাখাই তাঁর রচনা থেকে বাদ পড়ে নি। আবার গানের রাজা হিসেবেও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলা ভাষায় আধুনিক, পল্লী, কীর্তন প্রভৃতি গান লেখার পাশাপাশি তিনি বিদেশি ভাষায় রচিত খেয়াল, গজল আর কাওয়ালি বাংলা ভাষায় ভাষায় রচনা করে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। নজরুল ছিলেন বাংলা সঙ্গীতে গজল গানের সার্থক স্রষ্টা ও সফল প্রবর্তক। গজল পারস্যের প্রেম সঙ্গীত। নজরুলই প্রথম গীতিকার যিনি সার্থকভাবে গজলের সুরটিকে বাংলা গানের কাঠামোতে ফুটিয়ে তোলেন।
গজলের রাজ্যে পরবর্তীকালে মনিরউদ্দীন ইউসুফের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আগে তিনি লিখেছেন গান। তাঁর রচিত গান চমৎকার। আর গান লেখার কথা আলোচনা করতে গিয়েই তাঁর গজল রচনার কথা আমি জানতে পেরেছিলাম। বলতে গেলে হঠাৎ। আমি তক্ষুণি তাঁকে কিছু গজল গান দিতে বললাম। তিনি আমার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। পাঠিয়ে দিলেন কয়েকটা গজল।
আমি সেগুলো সুরারোপ করে শিল্পির কণ্ঠে রেকর্ড করার ব্যবস্থা করলাম। অপূর্ব। আর এই গজল গানকে উপলক্ষ্য করেই তাঁকে আমি গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করিয়ে নিয়েছিলাম। গজল রচনার ক্ষেত্রে তাঁর অদ্ভুত দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়।
প্রেমের আর্তির যে রূপ গজলের প্রাণ মনিরউদ্দীন ইউসুফ রচিত গজলগুলোতে যেন তা বাঙ্ময় রূপে ফুটে ওঠেছে। তিনি গজল গান রচনাতেই যে শুধু পারদর্শী ছিলেন তা নয়, বাংলা ভাষায় গজল রীতির কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও তিনি পথিকৃতের
ভূমিকা পালন করেন। গজলের অন্তর্নিহিত ভাব শুধু বাংলাদেশের কবিকেই প্রভাবিত করে নি, ইউরোপীয় কবিরাও গজলের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফও গজলের সেই ফল্গুধারার প্রবাহে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাই তাঁর লেখনি গজল রচনায় হয়ে ওঠেছিলো উচ্ছল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কবিদের ওপর গজল গানের প্রভাবের কথা মনিরউদ্দীন ইউসুফ উল্লেখ করেছেন তাঁর রচিত 'বেতস পাতা জলের ধারা' গজলগ্রন্হে। তিনি বলেছেন, উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ইয়োরোপীয় কবি গ্যেটে হাফিজের 'গজল' দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি 'নির্মলতর প্রাচ্যের স্বচ্ছ জলধারায় 'অবগাহন করে সুস্হ হতে
চেয়েছিলেন ও 'প্রাচ্য ও প্রতীচ্য 'দীওয়ান' নামে একটি কাব্যগ্রন্হ রচনা করে প্রাচ্যের গীতিধারার প্রতি নিবেদন করেছিলেন তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা।'
বাংলা ভাষায় গজল গানের প্রবর্তক নজরুলের ওপর পারস্য দেশের যে অপরিসীম প্রভাব পড়েছিলো তাঁর রচিত অসংখ্য গজল তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
মনিরউদ্দীন ইউসুফও পারস্য গজলের অন্তর্নিহিত রূপে মুগ্ধ হয়ে গজলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং বাংলা ভাষায় গজল রচনায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি পারস্যের গজলের আঙ্গিক দক্ষতার সাথে আত্মস্হ করতে পেরেছিলেন। গজল সম্পর্কে তাঁর অভিমত থেকেই তা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। তিনি বলেছেন- 'সনেটের মতো প্রাচ্যের ক্ষুদ্র লিরিক জাতীয় কবিতা হলো গজল। আরবি, ফারসি ও উর্দুতে শ্রেষ্ঠ কবিগণ গজল রচনা করে গেছেন। বিশেষ করে ফারসি ভাষায় হাফেজ ও উর্দু ভাষায় গালিবের নাম গজলের উৎকর্ষের সঙ্গে জড়িত।'
মনিরউদ্দীনে ইউসুফের গজলের রূপ সম্পর্কে খুবই স্বচ্ছ ধারণা ছিল। হয়তো সেজন্যেই গীতিকার হিসাবে তিনি গজল রচনার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়িছিলেন। গজলের আঙ্গিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, গজলে বিশেষ ধরনের মিল প্রয়োগ করা হয়। এই মিল শুধু একটি দুটি অক্ষর বা ধ্বনির মিল নয়; অর্থপূর্ণ বাক্যাংশ এবং শব্দের সঙ্গে ধ্বনির মিলও। পরের পঙক্তিগুলি পরস্পর সমিল হয়। তবে প্রতি দুই পঙক্তির শেষ পঙক্তিতে প্রথম পঙক্তির মিল হুবহু ফিরে আসবে। 'গজলের প্রতও দুই পঙক্তিতে থাকে ভাব ও চিন্তার নতুন বিন্যাস এবং দুই পঙক্তিতে কবির ভণিতাসহ গজল শেষ হয়। ধ্বনি ও শব্দ মিলের পুনরুক্তি ও কবির ভণিতাই গজলের পঙক্তিকে একটি গুচ্ছের মতো ধরে আছে বলে মনে হতে থাকে ।'
মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনেক গজল লিখেছেন। তার কিছু 'বেতস পাতা জলের ধারা' গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। তাঁর রচিত গজলের ভাব আর রস মানবমনের চিরন্তন রূপকেই যেন চিত্রায়িত করে তুলেছে। তিনি বলেছেন,
রমণী রহস্য ছিল, প্রেম হয়ে তারে
দিয়েছি ধরা,
গান হয়ে ছবি হয়ে কথা হয়ে দেখ
দিয়েছি ধরা ।'
মনিরউদ্দীন ইউসুফের প্রতিটি গজলেই উপমার প্রয়োগ অত্যন্ত সুন্দর হয়ে ধরা পড়েছে। ফলে গজলের সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। আর সৌকর্যও হয়েছে অপরূপ।
দয়িতার কাছে দয়িতের যে নিবেদন, তার আর্তি মনিরউদ্দীন ইউসুফের গজলের আবেদন চিরায়ত করে তুলেছে। তিনি লিখেছেন,
'অধরে অধর রবে যাব না ফিরে
রাত যদি ভোর হয়, যাব না ফিরে।'
জীবনানন্দ দাশ তাঁর অমর কবিতা 'বনলতা সেন'-এর মাঝে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফও বনলতা সেনের আকর্ষণ এড়াতে পারেন নি। তেমনি প্রিয়ার চন্দ্রবদনের একটি তিলের জন্যে সমরখন্দ-বোখারা বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে কবি হাফেজ তাঁর কথাও মনিরউদ্দীন ইউসুফ গজলে ধরে রেখেছেন অত্যন্ত কুশলীর মতো। তিনি লিখেছেন,
বনলতা সেন বুঝি নাটোরের মেয়ে
হাজার বছর
কবি তারে পায় যদি সে ত হবে আরো
হাজার বছর।
কালেরে স্তম্ভিত করে যে মোহিনী
কাল তিল গালে,
হাফেজের প্রিয়া সেই আসে প্রতিদিন
হাজার বছর।
মনিরউদ্দীন ইউসুফ বাংলা সাহিত্যের ভুবনে একটি অতি প্রতিষ্ঠিত নাম। সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে তাঁর অবাধ বিচরণ। অনুবাদে, বিশেষ করে, ফারসী সাহিত্য অনুবাদে, তার জুড়ি পাওয়া বিরল। আর সেজন্যে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর গজল আমার কাছে তুলনাহীন বলে মনে হয়। আমি তাঁকে করো সাথে তুলনা করতে চাই না। আমি শুধু তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্টে মহিমান্বিত গজলের প্রশংসা করতে চাই। কারণ সত্যিই তিনি ছিলেন গজলের অসাধারণ গীতিকার।
*মনিরউদ্দীন ইউসুফ সংকলন [স্মারকগ্রন্থ], বেলাল চৌধুরী সম্পাদিত, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ থেকে নেয়া হয়েছে।
ভূমিকা পালন করেন। গজলের অন্তর্নিহিত ভাব শুধু বাংলাদেশের কবিকেই প্রভাবিত করে নি, ইউরোপীয় কবিরাও গজলের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফও গজলের সেই ফল্গুধারার প্রবাহে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাই তাঁর লেখনি গজল রচনায় হয়ে ওঠেছিলো উচ্ছল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কবিদের ওপর গজল গানের প্রভাবের কথা মনিরউদ্দীন ইউসুফ উল্লেখ করেছেন তাঁর রচিত 'বেতস পাতা জলের ধারা' গজলগ্রন্হে। তিনি বলেছেন, উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ইয়োরোপীয় কবি গ্যেটে হাফিজের 'গজল' দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি 'নির্মলতর প্রাচ্যের স্বচ্ছ জলধারায় 'অবগাহন করে সুস্হ হতে
চেয়েছিলেন ও 'প্রাচ্য ও প্রতীচ্য 'দীওয়ান' নামে একটি কাব্যগ্রন্হ রচনা করে প্রাচ্যের গীতিধারার প্রতি নিবেদন করেছিলেন তিনি অপরিসীম শ্রদ্ধা।'
দিয়েছি ধরা,
দিয়েছি ধরা ।'
রাত যদি ভোর হয়, যাব না ফিরে।'
হাজার বছর
কবি তারে পায় যদি সে ত হবে আরো
হাজার বছর।
কালেরে স্তম্ভিত করে যে মোহিনী
কাল তিল গালে,
হাজার বছর।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments