সংগীত
মানব মনে কতটুকু প্রভাব রাখে, এ প্রশ্ন আজ অবান্তর। আজকের বাংলা গানের ইতিহাস
হাজার বছরের ওপর। বাংলা ভাষা যেমন প্রাচীন, গানও তেমন সুপ্রাচিন কালের। সময়কাল বছর
হাজারের এক দীর্ঘ পরিক্রমা। মহামহোপাধ্যায় হর প্রাসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয়
গ্রন্থাকার থেকে তিনটি পুঁথি সংগ্রহ করেন যা ১৯১৬ সালে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য
পরিষদ কর্তৃক ‘হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষার বৌদ্ধ গাঁন ও দোঁহা’ নামে প্রকাশ
পায়। ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত এ পুঁতিগুলোই আদি গান।
প্রতিটি
শিল্পের একটি ধারানুবর্তিতা থাকে। উৎস থাকে। বিকাশের যোগসূত্রিতা থাকে। সংযোগ
বিচ্ছিন্নতা মানব মনেনেতিবাচক প্রভাব রাখতে বাধ্য। বিশেয়টি পুংখানু পুংখ
বিশ্লেষনযোগ্য। এ জন্য যে সম্ভবত! সংগীতই মানুষের জীবন- চেতনায় সবচাইতে গভীর
অর্ন্তমুখী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। শিল্পের এ প্রাচীন কুলিন মাধ্যমটিকে ঘিরে যতো
অবিমিদ্রতা- চিন্তা এবং বিপ্রতীক কথা থাকুক নাÑ এর বিকাশ অন্তহীন ধারায় নিরত
বেগবান।
সংগীতের
সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্ক বন্ধনের মৌন উপলক্ষ্য কিন্তু ধর্ম। ‘চর্যাপদ’ নামে
যে আদি পুঁথি বা গীত লিখিত সংগীত পাই, তার মৌল ভাব আত্মানুসন্ধান- আধাত্মবাদ। মৌল
বিশ্বাস হচ্ছে, ¯্রষ্টার প্রতি নিবেদন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। প্রশংসা। আত্মার আশ্রয়
খোঁজা। চিরকালীন আবাসের দিকে আবাসের আকুলতা।
হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী সংগৃহীত পুঁথিতে গীত সংখ্যা ছিল সাড়ে ছেচল্লিশ। অর্থাৎ একটি গানের
অর্ধেখটুকু পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্মেও নানা গৃঢ় লৌকিক সাধনতত্ত্ব এর বিষয়বস্তু হলেও
কখনও উপেক্ষিত সাধারন মানুষের দুঃখ বেদনার চিত্রও এতে স্থান পেয়েছে। যাঁরা গান
লিখেছেন তারা অধাত্ম সাধনায় সিদ্ধ পুরুষ। সংখ্যায় ২৩ জন। এঁদের কিছু নাম :
কাহ্নপাদ, ভুসুকপাদ, সবহ্পাদ, কুক্করীপাদ, লুইপাদ, গম্ভুরী পাদ, চাটিল পাদ,
কম্বলাম্বর পাদ, ডোম্বী পাদ, শান্তি পাদ, মহীধর পাদ, বীনা পাদ, আজদেও চেতনা পাদ,
দারিক পাদ, ভাদে পাদ, তাড়ক পাদ, কক্কন পাদ, জয়নন্দী, ধামপাদ প্রমুখ।
বাংলা
গানের উৎপত্তি ও বিকাশের একটি ‘মূল ধারা’ আমরা যা জানতে পারি তা এমনটি-
১. চর্যাপদ
২. নাথ গীতি
৩. শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন : বড় চন্ডীদাস
৪. বৈষ্ণব পদাবলি : বৈষ্ণব পদাবলি কীর্তন
৫. মঙ্গল গান : মঙ্গল কাব্য
৬. শাক্ত গীতি : শাক্ত পদাবলি
৭. বাংলা টম্পা গান : আধুনিকতার ছোঁয়া
৮. ধ্রুপদ সংগীত
৯. কাব্য গীতি
১০. বাংলাদেশের গান
১১. আধুনিক গান
১২. রবীন্দ্র- নজরুলের গানের ধারা
আমরা
পূর্বাপর ধারা সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো না। আমাদের অনেক সমৃদ্ধ
ঐতিহ্যের মধ্যে সংগীতের একটি অতি সম্পন্ন ধারা ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য- চেতনা এ
দেশের মানুষকে সংগীত - প্রেমিক করেছে বরাবর। মাটি ও মানুষ জীবন- চেতনা থেকে
উৎসারিত এসব সংগীত যা লোক সংগীতের ধারা আজ ক্রম অবলুপ্তির পথে, অথচ- আধুনিক সংগীত
সৃষ্টির সজ্জায় ও মাংসে এ লোকে সংগীতের সুর ও ধ্বনি কি ভাবে পরিপুষ্ট যুগিয়েছে আজ
আর অনেক সংগীত রসিক, শিল্পী না জানলেও এটা চরম সত্য।
আবহমান
বাংলার মানুষের জীবন - চেতনার যে ধর্মবোধ ও বিশ্বাসের শক্ত খুঁটি গেঁড়েছে যেখান
থেকেই আমাদের সংগীতের জন্ম কথা। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও রাসূলের প্রেমকে ধারণ
করেই মধ্য যুগে মরমী ও ভাববাদী কাব্য গানের বিস্তার ঘটে- সেই ধারানুবর্তিতাই
আমাদেও সংগীত। অবশ্য একটি কথা এক্ষেত্রে সংযোজন করা করা কর্তব্য, তা হলো- আমাদের
উপমহাদেশে যে ক’টি ধর্মের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় তার প্রতিটি ধর্মালম্বী জনগনের
একাংশ এক সময় বৈরাগ্য ভাবানুতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এটার মৌল কারন অনেকগুলো।
তবেবিশেষত রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে আসুবিকতা, রাজ্য বিস্তারে হানা হানি, যুদ্ধ,
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। নানা ষড়যন্ত্র রাজনীতির জটীলতায় আবর্ত থেকে মানুষের শান্তি
অন্বেষনের হৃদয়বৃত্তি মানুষের মনে ধর্মবোধকে নিরাপদ ও নির্দিষ্ট পরিসীমায় আবদ্ধ
দেখতে চাইলো। পার্থিব জীবনের ‘জ্বালা-যন্ত্রনা’ থেকে ‘নির্বান’ লাভের সহজ
প্রক্রিয়ায় উৎসাহিত হলো। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের বিপর্যয়, মহাযুদ্ধ, দিকে দিকে
আত্ম নিয়ন্ত্রন অদিকার অর্জনের হানাহানি, জাতি গোষ্টীর রক্তপাত বৌদ্ধ- হিন্দুর
মারাত্মক হনন, মুসলমানদের ওপর ত্রিশূল শক্তির আক্রমন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের
মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে সূফীতত্ত্বের আড়ালে এক ধরনের বৈরাগ্যবাদী ধারার বিস্তার
লাভ করে। এই সূফীদের একাংশ আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সাধন কর্মের একটি প্রক্রিয়া
হিসেবে অনেকেই সংগীতকে আত্ম বিকাশের অনুষদ করলেন। সংগীত চর্চের মধ্য দিয়ে আল্লাহর
প্রশংসা, রাসূলের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ ঘটাতে থাকে। সেই ধারার অপভ্রংশ আজো চলছে।
লালন শাহ, শীতালং শাহ, দুদ্দু শাহ, পাগলা কানাই, দেখ ভানু, মঙ্গল শাহ, মুসলিম শাহ,
আরকুম শাহ, হাসান রাজা, এঁরা সবাই সাধন মার্গীয় সংগীতের ধারা প্রণিধান ব্যক্তিত্ব।
এঁদের সংগীতের সুর কথা খুবই মৌলিক অন্তগর্ত তত্ত্ব ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ ও ইসলামী
আদর্শের সঙ্গে নিকট সম্পর্কযুক্ত। মূল প্রেরণা বা ভাব আল্লাহর নৈকট্য লাভের
আকাঙ্খা।
ইসলাম
ধর্মে সুফীবাদের স্বীকৃতি ও প্রভাব কতটুকু আছে বা নেই সে বিতর্কে না গিয়েও অন্তত
এতটুকু বলা যেতে পারে যে, মুসলিম সমাজে সুফীবাদের প্রভাব কিন্তু বহমান কাল থেকে
চলে আসছে। এমন এক সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সুফীদের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপকভাবে
বিস্তৃতি লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে এর সাথে কিছু কিছু মেকী ভন্ডামী জড়িয়ে পড়ায়
ইসলামী চিন্তাবিদগন ন্যায়তই একে সংশয়ের চোখে দেখতে শুরু করেন।
বলা
বাহুল্য, সুফীদের আচার-আচরনে ইসলামের যথার্থ অনুশীলন ঘটুক বা না ঘটুক বাংলাদেশের
বুকে ইসলাম বিস্তৃতির ইতিহাসে সূফীদের অবদানকে কিন্তু অস্বীকার করা চলে না মোটেই।
সূফীবাদ সম্পৃক্ত মরমী সাধকদেও কাব্য-কবিতা ও মরমী গান বাংলা সাহিত্যেও একটি
উজ্জ্বল ও উর্বর প্রান্তর দখল করে আছে। ইসলাম পূর্ব যুগ থেকেই পৌত্তলিক আরবদের
সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ছিল সরাসরি। ইসলাম পরবর্তী যুগেও সেটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন
হয়নি বরং ইসলাম প্রচারকদের আনাগোনাতে যোগাযোগটা আরও ঘনিষ্টতর হতে শুরু
করেছিল। মুসলমান কর্তৃক বদও বিজয়ের পর
আরব, ইরান তুর্কীস্থান থেকে বহু সংখ্যক পীর-ফকির, সুফী সাধকগন তৌহীদের বানী নিয়ে এদেশে
আসতে শুরু করেন। তাঁদের দ্বারা প্রচারিত ইসলামের উদারতা। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। শান্তির
অমোস বিধানের প্রতি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকেরা যারা বর্ণ প্রথার নিষ্পেষন ছিল
অতিষ্ঠ। তারা উদার ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। এসব সুফীদের কণ্ঠে কণ্ঠে
প্রচারিত গান, কিংবা কাব্য সুষমা মানুষের চিন্তার রাজ্যে দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব রেখে
আসছে। তাছাড়া মধ্যযুগে সুফীদেও দ্বারা যে ভাববাদেও গানের বিকাশ হয় তার মূল উপজীব্য
যেহেতু আল্লাহর প্রতি ভক্তি-ভালবাসা, রাসূলের প্রশংসা। প্রেম ছিল যেহেতু তা
ইসলামের মল আদর্শবিচুৎত তাও বলা যাবে না। একটি উদাহরন দিচ্ছি- কুরআন পাকের সূরা
আযহাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগন নবী বা
রাসূলে করীম সা: এর উদ্দেশ্যে ‘নাত’ বা দরুদ পাঠান। হে বিশ্বাসী মানবগন, তোমরার
তাঁর প্রতি দরুদ বা নাত পাঠ করো।
এ
পর্যন্ত আলোচনার মূল কথা হলো গীতিকার কবি মতিউর রহমান মল্লিক সংগীতকে নীজ জীবনের
মূল কর্মকান্ড হিসেবে প্রেরণার উৎস হিসেবে নেন কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের
ধারার কারনেই। এ সম্পর্ক সংগীতের সঙ্গে ইসলামী আদর্শের নাড়ীর। তিনি অনুধাবন করতে
পেরেছিলেন মানুষের হৃদয়ে আদর্শের বানী প্রবেশ করাতে সংগীত একটি মোক্ষম বাহন হতে
পারে। শুধু যে কাজটি তিনি করলেন তা হলো - সংগীতকে ভাববাদ থেকে ফিরেয়ে এনে বাস্তব
জীবনের ব্যাখা সমন্বিত আদর্শ নির্ভর বক্তব্য ও বিষয় নির্ভর এবং আধুনিক সুর সংযোজন
করে প্রচার করা। যে কারণে মল্লিকের গান বলা যায় এক নতুন পথের সন্ধান দেয় - এদেশের
মানুষের মনের জাগায় নতুন প্রেরনা। আদর্শ প্রচারে উৎকৃষ্ট পথ।
মতিউর
রহমান মল্লিক (১৯৫৬-২০১২ ) এক বহুমুখী প্রতিভার নাম। একাধারে তিনি ছিলেন কবি,
গীতিকার, সংগীত শিল্পী, সুরকার, সংগঠক, সাহিত্য সম্পাদক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক,
বাগ্মী ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর উপস্থিতি দু’টো ক্ষেত্রেই প্রবল - এক,
গীত রচয়িতা এবং দুই, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ত্ব। জীবদ্দশায় এই কবি ও সংগীতিক
ব্যক্তিত্ত্ব অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে ছিলেন। মৃতৎর পরও এক বিশাল জনমন্ডলীর ওপর
লোকপ্রিয়তার শাসন প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। তাই, এমন ব্যক্তিত্বের ওপর কোন কিছু বলতে
যাওয়ায় ঝুঁকি আছে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য যে সময় অতিবাহিতের বিষয় থাকে,
সংগ্রহ করার নীরব আয়োজন করতে হয়, তা এখনো ঘটেনি। আমার জন্য আরেকটি বিপদ, আলোচ্য
ব্যক্তি আমার সমসাময়িক কালের একজন কবি নন ব্যক্তিগত সম্পর্কের সখ্যতায় অন্যতম
বন্ধুজন ছিলেন। এতদসত্ত্বেও এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই এ লেখার বিস্তার। বিলক্ষণ
জানি, আমার শ্রম সার্থক হবার নয়। তবুও, যতটুকু বীজ ছড়ান যায় তার মধ্য দিয়ে কিছু
কথার অংগুরদগম যা ঘটবে তাও মন্দ কী- নীরবতার চেয়ে?
কবি
ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক জন্মগ্রন করেছিলেন বাগের হাট থানা ও জেলার অন্তগর্ত
ফকিরহাট অঞ্চলের বারুই পাড়া নামক একটি ছোট্র গ্রামে। গ্রামটি ছায়া সুনিবিড়, নানা
ফল ফলারি, সুপারি ও গাছ-গাছালি ঘেরা মায়াবী পরিবেশ বেষ্টিত। পাখ-পাখালি, ঝিঁঝি,
জোনাকি জ্বলা এক মুগ্ধকর পরিবেশে কবির শৈশব অতিবাহিত করেন। ধার্মিক- পাবন্ধ পিতা-
মাতার ইসলামী শিক্ষা তাঁর বাল্যকালকে যেভাবে একটি ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার পথকে
প্রশস্ত করেছে তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় কুরআন - হাদীস এবং শরীয়ত
সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অর্জন তাকে জীবনের সঠিক পথচলার আলোক বর্তিকা হিসেবে পথ
দেখিয়েছে। পরবর্তীতে ইসলামী সংগঠনের সংস্পর্শে এসে তিনি দ্বীনকে শুধুমাত্র নিজ
জীবনকে আলোকিত করার জন্য নয় ‘ইকামাতে দ্বীন’ এর দায়িত্ব পালনেও তিনি উদ্ধুদ্ধ হন।
সেই দায়িত্ববোধ হতেই তিনি ইসলামী সংগীত রচনা, সুর সংযোগ। ভিন্ন ব্যক্তির কণ্ঠে
তুলে দেওয়া, সংগীতকে সাংগঠনিক রূপদান। বহু মানুষের কানে কানে, দেশে দেশে মানুষের
দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার একে একে কর্মপ্রচেষ্টা গ্রহন করেন। তাঁর এ সব প্রচেষ্টার
প্রথম যে সংগঠনটি জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভ করে - সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী। এরপর
সারাদেশে বিভিন্ন নামে কয়েকশ’ শিল্পী গোষ্ঠীর জন্ম লাভ করে তাঁর প্রেরনায় ঊৎসাহে
এবং আনুকূল্যে। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন কবি মতিউর রহমান মল্লিকের বড়
সফলতা তিনি সারা দেশে ইসলামী ভাব ধারায় সংগীতের সুবাতাসকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।
বিভিন্ন জেলা- উপজেলা শহরে পর্যন্ত নানা নামে গানের সংগঠন গড়ে ওঠেছে যাদের কণ্ঠে
ইসলামী ভাব ধারার সংগীত প্রতিদিন গীত হয়ে থাকে। চর্চা ও অনুশীলন অব্যাহত রয়েছে। তিনি
আত্ম প্রতিষ্ঠা কাতর ছিলেন না। নিজের গানকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেননি বরং অনেকের
গান, অনেকের কণ্ঠ। বহুজনের ভেতর সঞ্চার করার আকুতি নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন শহর গ্রাম
পর্যন্ত দিনের পন দিন। আত্মভোলা, উড়নচন্ডি নৈব্যর্ক্তিক স্বভাবের এ মানুষটি নিজের
সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারেও ছিলেন অগোছালো। যে কারণে তাঁর সৃষ্টিরাজির পুষ্পিত
প্রসূনসমূহ কোথায় কোথায় প্রস্ফুটিত বিরাজিত তাও অজ্ঞাত, আড়াল আড়ালে রয়েছে। এসব
অমূল্য পুষ্পসম্ভার আমাদের একত্রিত করতে হবে। ‘কবি মল্লিকের গীতি সম্ভার’ যেদিন
একত্রিত হবে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে পারবো ইসলামী সংগীতের কী অমূল্য ভান্ডার তিনি
রেখে গেছেন। এর আগে পর্যন্ত আমরা সঠিকভাবে বলতে পারছি না প্রকৃত পক্ষে কতগুলো গান
তিনি সৃষ্টি করেছেন। তবে আমরা তাৎক্ষনিকভাবে খোঁজ-খবর করে তাঁর গানের যে চিত্রটি
পেয়েছি তা হলো-
প্রকাশিত
গানের বই -
১. ঝংকার (১৯৭৮, ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০২) গানের সংখ্যাÑ ৫২
২. প্রত্যয়ের গান (সংকলন - ১৯৮৪) গানের সংখ্যাÑ
৯২
৩. সুরে শিহরণ
৪. যতো গান গেয়েছি
৫. প্রাণের ভেতর প্রান (২০১১) গানের
সংখ্যাÑ ৪৯
৬. নির্বাচিত হামদ (আসাদ বিন হাফিজ সম্পাদিত-
১৯৯৬) গানের সংখ্যাÑ ১৮
৭. নির্বাচিত না‘ তে রাসূল (আসাদ বিন হাফিজ
সম্পাদিত- ১৯৯৬) গানের সংখ্যাÑ ১৯
গানের
ক্যাসেট
৮. প্রতীতি -১
৯. প্রতীতি -২
১০. মল্লিকের গান (নিজ কণ্ঠে গীত গানের সিডি) গানের সংখ্যাÑ ৪৫
এ
ছাড়া বিভিন্ন শিল্পী গোষ্ঠী কতৃর্ক প্রকাশিত ও প্রচারিত বহু ক্যাসেটেও সিডিতে
মতিউর রহমান মল্লিকের কয়েকশ গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা আমাদের পক্ষে নানা
সীমাবদ্ধতার কারণে এক্ষণে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
উপরে
যে গানের তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং গানের সংখ্যা পাশে উল্লেখ করা হয়েছে যোগফলের
মাধ্যমে নিরূপন করা সম্ভব নয়। কারণ একই গান বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে স্থান করে
নেওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা এর যোগফলের অনেক কম হবে। আমরা ভিন্ন একটি গবেষনা কর্মে কবির
গানের প্রকৃত তালিকা প্রনয়নের কাজটি করছি। এখানে আমরা তাৎক্ষনিকভাবে যে গানগুলোর
তালিকা প্রনয়ন করতে সক্ষম হয়েছি তা নি¤œরূপ - ১. ঝংকার Ñ৫০, ২. প্রত্যয়ের গান Ñ৬১,
৩. যতো গান গেয়েছি .........., নির্বাচিত
হামদ ........., নির্বাচিত নাতে রাসূল ............, প্রাণের ভেতর প্রান Ñ ৪৯,
বিভিন্ন প্রকাশিত সিডি এবং অনৃপম সাংস্কৃতিক সংসদের নিজস্ব সংগ্রহ ইত্যাদি উৎস
থেকে ৪২।
কবি
মতিউর রহমান মল্লিকের গানের সংখ্যাটি ধূপছায়া আঁধারিতেই রয়ে গেল। অনেকটা চেষ্টা
চরিত ও বহুজনকে অনুরোধ করেও সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য যেসব উপাত্ত ও উপলক্ষ্য প্রয়োজন,
যা সাধ্যমত লাভ করতে পারি নি। এ ব্যাপারে মৌখিকভাবে বিভিন্ন জনের মত গ্রহণ করেছি
যা আমার কাছে পরস্পর ব্যবধান দুস্তর এবং কেবলই অনুমান নির্ভর মনে হয়েছে। কবি
চৌধুরী গোলাম মাওলঅ তাঁর ‘অধিরোহী মল্লিকের অনুরতি গান’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেনÑ
“লেখিতা সাবিনা মল্লিক (কবি মল্লিকের স্ত্রী) এর ধারনা মতে প্রায় সত শত মতান্তরে
এক সহ¯্র গান রয়েছে তাঁর। আবার তরুন কবি আহমদ বাসির সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বেশ
জোর দিয়েই দাবী করেন - ‘মল্লিকের গানের সংখ্যা দুই সহ¯্রাধিক এতে কোন সন্দেহ নেই।’
সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুরের মতে- সংখ্যাটি
পাঁচ শতাধিক।
মতিউর
রহমান মল্লিক মূলত ইসলামী ভাবার্দশকে ধারণ করে গান রচনা করলেও তাঁর গানে এসেছে
নানা ধরনের বিষয় ও ভাব যা সাধারনত এই ধারার গীতিকবিদের ক্ষেত্রে কদাচিৎ দেখা যায়।
যেভাবে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় চার হাজার গানের (প্রকৃত সংখ্যা এখনো
অনিরূপিত) মধ্যে যেমন বিচিত্র বিষয় ও ভাবের সমাহার তেমনি বিচিত্র সুর (মিশ্র)
সংযোজন করে একক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন তেমান আমাদের আলোচ্য গীতিকবি মতিউর
রহমান মল্লিকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বাধিক ইসলামী গানের রচয়িতা এবং বিষয় বৈচিত্র্য,
ভাব ও আধুনিক সুর ও শব্দ সংযোজন করে অনন্য ধারা সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখ্য,কাজী
নজরুল ইসলামের গানের সংখ্যা (বাংলা ভাষায় তো বটেই পৃথিবীর সকল ভাষায় এতো অধিক
গানের রচয়িতা কাউকে সনাক্ত করা যায়নি) সে বিচারে শীর্ষ স্থানটি স্বীকার করে আরেক
শীর্ষ চূড়ার অধিকারী আমাদের আলোচ্য কবি মতিউর রহমান মল্লিক তা হলো একক ইসলামী
গানের রচয়িতা হিসেবে। কাজী নজরুল ইসলামের গানের সংখ্যা দেড় শতাধিক বলে জানা গেছে।
তবে সংখ্যা বিচারে নয় গুন বিচারে এবং জনপ্রিয়তা বিচারেও কাজী নজরুলের সঙ্গে তুলনীয়
নয়। তাছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে নয় সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে
যে ‘সুরের জগৎ’ সৃষ্টি করে গেছেন তার সমকক্ষ কেউ নন। রবীন্দ্রনাথও অনেক দূরে।
সংখ্যা ও গুনের বিচারেই।
মতিউর
রহমান মল্লিক ইসলামী গানের ভেতর নতুন বিষয়,ভাব,মাত্রা আনতে সক্ষম হয়েছেন। মূলত
অতীতে আল্লাহ প্রেম, রাসূল প্রশস্তিমূলক গানের মাধ্যমেই ইসলামী গানের ধারা বহমান
ছিল। মতিউর রহমান মল্লিক ইসলামী গানের ভেতর যিনি যুগ যন্ত্রনা, মানবতা,
আনÍর্জাতিকতা, ব্যক্তিগত বোধ, সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা, সমাজ দর্শন, রাজনীতি ,পররাষ্ট্রনীতি,
ভাতৃত্ব, আত্বানুসন্ধান, বিনোদন ইত্যাদি নানা বিষয় প্রসঙ্গ ভাবকে ধারন করে গান
রচনা করেছেন যার মৌলিক পথটি হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের পথে চলার প্রেরনা সঞ্চার,
উদ্বুদ্ধকরন, এবং সংগবদ্ধতা অর্জন। মল্লিকের বহুমুখী চিন্তা ও দর্শনের বিশ্লেষন
এখানে পুংখানুপুংখ সম্ভব নয়।আমরা এখানে শুধু অঙুলি নির্দেশ করতে পারি।
এটা
ঠিক মতিউর রহমান মল্লিক প্রথাগত গান শিক্ষা অর্জন করে বিশেষ করে
সারগাম,রাগ-রাগিনী, গানের সহায়ক যন্ত্রের উপর দক্ষতা দখল করে গান রচনা এবং সুর
সংযোজনের দুরুহ কাজটিতে হাত দেননি। নিতান্ত আত্বগত উচ্ছাস এবং জীবন চেতনার তাগিদে
তিনি সংগীতকে অবলম্বন হিসেবে গ্রহন করেন। তবে তিনি অভিজ্ঞতার এক লম্বা তোরণ
অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তার গানগুলো তাই এত জীবন ঘনিষ্টএবং মানুষের
আতœজিজ্ঞাসার উওর হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। [আল মাহমুদের ভাষায়Ñ“অন্তরাল
পরায়ন প্রকৃতি সংলগ্ন কবি মল্লিক প্রকৃতির মধ্যে
আনন্দ তার সৌন্দর্যও রহস্য রুপের আড়ালে মহান ¯্রষ্ঠার সান্নিধ্য ভাবনা সহজ
সরল ভাষায় নানা উপমাও উৎপ্রেক্ষায় অনাঘ্রাত কুসুমের মতো প্রস্ফুটিত করেন। কিন্তু
মজার ব্যাপার হলো, সংগীতে মল্লিক আরো অধিক সাহজ , খোলা মেলা, নিত্যকার শব্দরাজি ও
ভাববোধের অপূর্ব সমন্বয়ে গীতিকার মল্লিক অনায়াসেই শ্রোতার কাছে তার আরাধ্য আবেদনকে
সঞ্চারিত করেন- এখানেই তার দুটি পৃথক সত্তার অপূর্ব সাফল্য ও সার্থকতা।”
[অধিরোহী
মল্লিক এর অনুরতি গান-চৌধুরী গোলাম মওলা (প্রবন্ধ) নোঙ্গর, এপ্রিল ২০১১ পৃষ্ঠা ৫৭]
মতিউর
রহমান মল্লিকের বিশিষ্ট দিক হচ্ছে তার লিখিত গানের অধিকাংশই সুরারোপ তিনি নিজেই
করেছেন। কিছু কিছু গান তার অনুজপ্রতিম শিষ্যতুল্য শিল্পীগন সুর সংযোজন করেছেন যা
তার জীবদ্দশায়(মল্লিক কতৃক) ইষৎ সংশোধিত এবং অনুমোদিত। মতিউর রহমান মল্লিকের গান
এখন সারা বাংলাদেশে‘মল্লিক গীতি’ হিসেবে গীত হচ্ছে। যে কোন ইসলামী মাহফিল, জলসা,
সমাবেশ কিংবা রামাদান মাসে মধ্যরাতে সাহরিতে জাগিয়ে দেওয়া কাফেলার কন্ঠে মল্লিক
গীতির অনিবার্যতা প্রমান করে এ গান মানুষের প্রানে প্রানে ঠাঁই করে নিয়েছে। এক সময়
যেভাবে মুসলিম সমাজে নিষিদ্ধ বেড়াজাল ভেঙ্গে আব্বাস উদ্দীনের গান ঘুমন্ত সমাজকে
স্বাধীনতা ও স্বজাত্য বোধে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল ‘ভারতের স্বাধীনতা সূর্য’
ছিনিয়ে আনতে- তেমনি মল্লিকের গানও এ দেশের মানুষকে মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধকরণ
সবিশেষএকটা ইসলামী সমাজ বিনির্মানে যুগে যুগে প্রেরণা সঞ্চার করবেই। বিশ্ব মানবতাকে
ডাকবে এভাবে- ‘এখনো মানুষ মরে পথের পরে/এখনো আসেনি সুখ ঘরে ঘরে/কি করে তাহলে তুমি
নিবে বিশ্রাম/কি করে তাহলে ছেড়ে দিবে সংগ্রাম।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments