ইসলামি গানের ভূবনে কবি ফররুখ আহমদ_ওয়াসিম আকরাম
ফররুখ
আহমদ একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি
কবি। এই বাঙ্গালী কবি
‘মুসলিম রেঁনেসার কবি’ হিসেবে পরিচিতি
লাভ করেছিলেন। তাঁর কবিতায় বাংলার
অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দির এই
কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর
কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাকপ্রতিমার অনন্য
বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর
কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা
থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট।
ফররুখ আহমেদের জন্ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে (তৎকালিন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার।
তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ-এর দশকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তারা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহ মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান [আহমদ আখতার], সৈয়দ মুহম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কোলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধ্যাবেলা ঢাকায়।
ইসলামি
রেঁনেসার কবি ফররুখ আহমদ
বহুমাত্রিকতা সুবিদিত। কবিতা, কাব্য-নাটক, অনুবাদ কবিতা, ছড়া, কিশোর-কবিতা,
গল্প, প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি বিপুলসংখ্যক গানও
লিখেছেন। তাঁর রচনাবলীর বৃহদাংশ
এখনও অগ্রন্থিত। বাংলা একাডেমি থেকে ২ খন্ড
রচনাবলী প্রকাশের পর অজ্ঞাত কারণে
অপর খন্ডগুলো এখনও আলোর মুখ
দেখেনি। এ কারণে তাঁর
সকল গানও আমাদের সামনে
আসেনি। এখনও তা লোকচক্ষুর
অন্তরালেই রয়ে গেছে। তবে
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ‘ফররুখ
আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র (প্রকাশক : ফররুখ
স্মৃতি তহবিল, চট্টগ্রাম; প্রকাশকাল : ১০ জুন ১৯৭৫)
পরিশিষ্টে মুদ্রিত তাঁর শতাধিক কাব্যগীতি,
হামদ, নাত, গজল ও
ইসলামী গানের তালিকা দেখে সর্বপ্রথম তাঁর
গানের ভান্ডার সম্পর্কে উৎসাহী সকলের উৎসুক জাগে।
অবশ্য এর আগেই কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘নব দিগন্তের গান’ এবং নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ সম্পাদিত ‘নবজীবনের গান’ সংকলনে ফররুখ আহমদের অনেক কাব্যগীতি অন্তর্ভুক্ত হয়। যাই হোক, এ উৎসুক মেটাতেই ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ও একক গানের বই ‘মাহফিল’। প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর প্রকাশনা বিভাগ। দীর্ঘদিন পর ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে গানের জগতে ইসলামি গান একটি পৃথক মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের ভাস্বর। ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের ঝোঁক-প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে ইসলামি গানের প্রতিও তাদের আগ্রহ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর এ ধারায় আমাদের অর্জন খুব একটা উল্লেখ করার মতো নয়। এক্ষেত্রে কবি ফররুখ আহমদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাঁর রচিত গান ইসলামি গানের স্বতন্ত্র ধারাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখেছে। এখনও তাঁর অনেক গান সংগৃহীত হয়নি বলে আমরা জানি। বেতার-এর প্রয়োজনে রচিত তাঁর অনেক গানই কণ্ঠশিল্পীদের সংগ্রহে আছে বলে জানা যায়। তাই তাঁর ‘গীতি সমগ্র’ প্রকাশিত হলে এ ধারাটি আরও সমৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। যে সকল কণ্ঠশিল্পী কবির গানে সুরারোপ করেছেন ও কণ্ঠ দিয়েছেন, এরা অনেকেই লোকান্তরিত। বাকিরাও বয়োবৃদ্ধ। তাই তারা জীবিত ও কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় এসব গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এ বিষয়ে কবি পরিবার, বিশেষভাবে ইসলামী গানের সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে পারে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই প্রস্তাবিত ‘গীতি সমগ্র’ মুদ্রণেরও উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।
আলোচ্য
‘মাহফিল’ গ্রন্থটি দু'টি খন্ডে
বিভক্ত। প্রথম খন্ডে পাঁচটি বিভাগ। বিভাগগুলো হচ্ছে : হামদ, নাত, নামাজ, জুমা
ও মুহাররাম। ‘হামদ’ বিভাগে ৩১টি হামদ, ‘নাত’
অংশে ১২টি নাত এবং
‘নামাজ’ অংশে ৫টি, ‘জুমা’
অংশে ৪টি ও ‘মুহাররাম’
অংশে ৬টি গজল মুদ্রিত
হয়েছে। দ্বিতীয় খন্ডের প্রথম ভাগে রবিউল আউয়াল,
ঈদে মিলাদুন্নবী বিষয়ক গজলসহ অন্যান্য ৩৩টি ইসলামি গান
এবং দ্বিতীয় ভাগে ৩৫টি দোয়া
ও মুনাজাত স্থান পেয়েছে। গ্রন্থে মুদ্রিত গানের সর্বমোট সংখ্যা ১২৬টি।
এসব গানের বাণীতে ফররুখ আহমদের আল্লাহ ও রাসূল প্রেম এবং ইসলামের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম অনুরাগ ও বিশ্বাসের প্রকাশ পেয়েছে। একজন ঈর্ষণীয় কবির কবিসত্তার শক্তিমত্তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্যান্য রচনাবলীর মতো গানের ক্ষেত্রেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। গ্রন্থে মুদ্রিত ‘মহাপরিচালকের কথা’য় সাবেক সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক, বিশিষ্ট লেখক এ জেড এম শামসুল আলম যথার্থই বলেছেন : ‘এসব সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর প্রেমের যে আন্তরিকতাময় প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, তা নিখাঁদ ও হৃদয়ের গভীর উপলব্ধিজাত। ঈমানী আলোকে হৃদয় পরিপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত না হলে কারো পক্ষে এ ধরনের সঙ্গীত রচনা করা সম্ভব নয়। ফররুখ আহমদ ব্যক্তিজীবন ও আচার-আচরণে ছিলেন ইসলামি জীবন-আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী। সে কারণেই তাঁর কলমে এত নিবিড় অনুভূতিজাত ইসলামি সঙ্গীত রচনা হওয়া সম্ভব হয়েছে।’
‘মাহফিল’ গ্রন্থে মুদ্রিত ১২৬টি ইসলামি গানের শুরুতে যে ‘হামদ’টি স্থান পেয়েছে তা সূরা ফাতেহার ভাবানুবাদ :
‘সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ- রাববুল আ’লামিন
তুমি রহমান, রহিম তোমার রহমত শেষহীন॥
কুল আলমের পালক হে প্রভু!- তুমি দাতা, দয়াময়
রোজ কিয়ামতে বিচার দিনের মালিক অসংশয়,
.................................................
ভ্রান্তিতে লীন যারা পেল শুধু ব্যর্থতা কিস্মতে,
যাদের উপরে আছে অভিশাপ রাত্রি ছায়া মলিন॥’’
একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। বাংলা ভাষায় মধ্যযুগ থেকে বিপুল সংখ্যক নাতে রাসূল সা. রচিত হয়েছে। এসব নাতে ভক্তির আতিশয্যে রাসুলুল্লাহ সা.-এর উপর অবতারণ আরোপের একটি ক্ষীণ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সেই সাথে ‘মীম’ শব্দের অপব্যাখ্যাও হয়েছে যথেচ্ছাভাবে। এ বিষয়ে কবি ফররুখ আহমদের সচেতনতা উল্লেখ না করে পারা যায় না। গ্রন্থের ৩৪ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত তিন সংখ্যক ‘নাত’-এর দু'টি পঙক্তি হচ্ছে : ‘ইঞ্জিলে দেন ঈসা নবী তোমার আসার সুসংবাদ,/‘আহমদে’ রয় গোপন কি; আর রাহমাতুল্লিল আলামীন।’-এখানে কবি ‘আহমদ’ শব্দটিতে একটি টীকা সংযোজন করে লিখেছেন, ‘আহমদ শব্দে ‘মিম’ হরফের অপব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। শরীয়তপন্থী সাধকদের মতে ‘মিমের’ অর্থে মখলুকাত বা সৃষ্টিসমূহের প্রতি ইঙ্গিত। রাসূলে করীম সা. সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ কথাই এতে প্রমাণিত হয়।’ কবির এ টীকা সংযোজন থেকে প্রতীয়মান হয়, ফররুখ আহমদ তাঁর হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গান রচনায় ইসলামি শরীয়তের শুদ্ধতার প্রতি অত্যন্ত মুখলেছ ও মনোযোগী ছিলেন।
বিভিন্ন ভাবে সংগৃহীত ফররুখ আহমদের কিছু উল্লেখযোগ্য হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গান তুলে ধরা হল।
১. তুমি ছাড়া আল্লাহ মাবুদ তো আর নাই
২. আমরা সবাই সত্য-ন্যায়ের উজ্জ্বল পথে চলব
৩. যখন আমায় ডাকবে না কেউ
৪. শোন মুজাহিদ শোন জেহাদের ঝান্ডা যেন রয় উঁচা
৫. আল্লাহ হাদি করো তুমি সুপথ প্রদর্শন
৬. আজ আমিনা মায়ের কোলে কে এলো কে এলো
৭. আজ বিশ্বব্যাপী অবিচারের এ কোন অভিশাপ
৮. চল মুমিন চল আবার জুময়ার জামাতে
৯. তারা চাসনে কিছু কারো কাছে
১০. শোন মৃত্যুর তূর্য-নিনাদ, ফারাক্কা বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ
১১. শহিদের খুন রাঙা কাস্মীর কাস্মীর
১২. আজকে ওমরপন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন
১৩. যখন আমায় ডাকবে না কেউ ডাকবে তুমি
১৪. সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ- রাববুল আলামিন
১৫. তোমার নেতা আমার নেতা আল-আরাবী মোস্তফা
১৬. জাগরে আঁধার রাতের ভালে নবী মোহাম্মদ
১৭. ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা খোদার সেরা দান
১৮. তোমার দয়া আছে খোদা জানি সকল দিকে
১৯. আমরা সবাই আলোর খুনি দীপ্ত কিশোর দল
২০. রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী
যাই হোক, ‘মাহফিল’ গ্রন্থটি দীর্ঘদিন পর পুনমুদ্রিত হওয়ায় ফররুখ-ভক্তরা উপকৃত হয়েছেন। বিশেষত যারা ইসলামি গানের জগতে কাজ করছেন, তারা কবির অনেকগুলো গান (১২৬টি) একত্রে পেয়ে গেলেন। সেই সাথে কবি ফররুখ আহমদের বহুমাত্রিকতার আরেকটি দিকও উন্মোচিত হল।
সবশেষে কবির রচিত একটি মুনাজাতের নিচের চারটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে মহান আল্লাহ তা'আলার দরবারে তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি:
‘রোজ হাশরে তোমার নবী মুহাম্মদের সম্মুখে
দিয়ো না রব লজ্জা আবার;-তওবা আমার কবুল করো॥
জীবনব্যাপী যে পাপ আমার তোমার নবীর উসিলায়
মাফ করে সব দাও গো এবার;- তওবা আমার কবুল করো॥’
ফররুখ আহমেদের জন্ম ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে (তৎকালিন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার।
তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ-এর দশকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তারা হলেন- সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহ মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান [আহমদ আখতার], সৈয়দ মুহম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কোলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধ্যাবেলা ঢাকায়।
অবশ্য এর আগেই কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘নব দিগন্তের গান’ এবং নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ সম্পাদিত ‘নবজীবনের গান’ সংকলনে ফররুখ আহমদের অনেক কাব্যগীতি অন্তর্ভুক্ত হয়। যাই হোক, এ উৎসুক মেটাতেই ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ও একক গানের বই ‘মাহফিল’। প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর প্রকাশনা বিভাগ। দীর্ঘদিন পর ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে গানের জগতে ইসলামি গান একটি পৃথক মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের ভাস্বর। ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের ঝোঁক-প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে ইসলামি গানের প্রতিও তাদের আগ্রহ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর এ ধারায় আমাদের অর্জন খুব একটা উল্লেখ করার মতো নয়। এক্ষেত্রে কবি ফররুখ আহমদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাঁর রচিত গান ইসলামি গানের স্বতন্ত্র ধারাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখেছে। এখনও তাঁর অনেক গান সংগৃহীত হয়নি বলে আমরা জানি। বেতার-এর প্রয়োজনে রচিত তাঁর অনেক গানই কণ্ঠশিল্পীদের সংগ্রহে আছে বলে জানা যায়। তাই তাঁর ‘গীতি সমগ্র’ প্রকাশিত হলে এ ধারাটি আরও সমৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। যে সকল কণ্ঠশিল্পী কবির গানে সুরারোপ করেছেন ও কণ্ঠ দিয়েছেন, এরা অনেকেই লোকান্তরিত। বাকিরাও বয়োবৃদ্ধ। তাই তারা জীবিত ও কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় এসব গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এ বিষয়ে কবি পরিবার, বিশেষভাবে ইসলামী গানের সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে পারে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই প্রস্তাবিত ‘গীতি সমগ্র’ মুদ্রণেরও উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।
এসব গানের বাণীতে ফররুখ আহমদের আল্লাহ ও রাসূল প্রেম এবং ইসলামের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম অনুরাগ ও বিশ্বাসের প্রকাশ পেয়েছে। একজন ঈর্ষণীয় কবির কবিসত্তার শক্তিমত্তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্যান্য রচনাবলীর মতো গানের ক্ষেত্রেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। গ্রন্থে মুদ্রিত ‘মহাপরিচালকের কথা’য় সাবেক সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক, বিশিষ্ট লেখক এ জেড এম শামসুল আলম যথার্থই বলেছেন : ‘এসব সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর প্রেমের যে আন্তরিকতাময় প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, তা নিখাঁদ ও হৃদয়ের গভীর উপলব্ধিজাত। ঈমানী আলোকে হৃদয় পরিপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত না হলে কারো পক্ষে এ ধরনের সঙ্গীত রচনা করা সম্ভব নয়। ফররুখ আহমদ ব্যক্তিজীবন ও আচার-আচরণে ছিলেন ইসলামি জীবন-আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী। সে কারণেই তাঁর কলমে এত নিবিড় অনুভূতিজাত ইসলামি সঙ্গীত রচনা হওয়া সম্ভব হয়েছে।’
‘মাহফিল’ গ্রন্থে মুদ্রিত ১২৬টি ইসলামি গানের শুরুতে যে ‘হামদ’টি স্থান পেয়েছে তা সূরা ফাতেহার ভাবানুবাদ :
‘সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ- রাববুল আ’লামিন
তুমি রহমান, রহিম তোমার রহমত শেষহীন॥
কুল আলমের পালক হে প্রভু!- তুমি দাতা, দয়াময়
রোজ কিয়ামতে বিচার দিনের মালিক অসংশয়,
.................................................
ভ্রান্তিতে লীন যারা পেল শুধু ব্যর্থতা কিস্মতে,
যাদের উপরে আছে অভিশাপ রাত্রি ছায়া মলিন॥’’
একটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। বাংলা ভাষায় মধ্যযুগ থেকে বিপুল সংখ্যক নাতে রাসূল সা. রচিত হয়েছে। এসব নাতে ভক্তির আতিশয্যে রাসুলুল্লাহ সা.-এর উপর অবতারণ আরোপের একটি ক্ষীণ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সেই সাথে ‘মীম’ শব্দের অপব্যাখ্যাও হয়েছে যথেচ্ছাভাবে। এ বিষয়ে কবি ফররুখ আহমদের সচেতনতা উল্লেখ না করে পারা যায় না। গ্রন্থের ৩৪ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত তিন সংখ্যক ‘নাত’-এর দু'টি পঙক্তি হচ্ছে : ‘ইঞ্জিলে দেন ঈসা নবী তোমার আসার সুসংবাদ,/‘আহমদে’ রয় গোপন কি; আর রাহমাতুল্লিল আলামীন।’-এখানে কবি ‘আহমদ’ শব্দটিতে একটি টীকা সংযোজন করে লিখেছেন, ‘আহমদ শব্দে ‘মিম’ হরফের অপব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। শরীয়তপন্থী সাধকদের মতে ‘মিমের’ অর্থে মখলুকাত বা সৃষ্টিসমূহের প্রতি ইঙ্গিত। রাসূলে করীম সা. সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ কথাই এতে প্রমাণিত হয়।’ কবির এ টীকা সংযোজন থেকে প্রতীয়মান হয়, ফররুখ আহমদ তাঁর হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গান রচনায় ইসলামি শরীয়তের শুদ্ধতার প্রতি অত্যন্ত মুখলেছ ও মনোযোগী ছিলেন।
বিভিন্ন ভাবে সংগৃহীত ফররুখ আহমদের কিছু উল্লেখযোগ্য হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গান তুলে ধরা হল।
১. তুমি ছাড়া আল্লাহ মাবুদ তো আর নাই
২. আমরা সবাই সত্য-ন্যায়ের উজ্জ্বল পথে চলব
৩. যখন আমায় ডাকবে না কেউ
৪. শোন মুজাহিদ শোন জেহাদের ঝান্ডা যেন রয় উঁচা
৫. আল্লাহ হাদি করো তুমি সুপথ প্রদর্শন
৬. আজ আমিনা মায়ের কোলে কে এলো কে এলো
৭. আজ বিশ্বব্যাপী অবিচারের এ কোন অভিশাপ
৮. চল মুমিন চল আবার জুময়ার জামাতে
৯. তারা চাসনে কিছু কারো কাছে
১০. শোন মৃত্যুর তূর্য-নিনাদ, ফারাক্কা বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ
১১. শহিদের খুন রাঙা কাস্মীর কাস্মীর
১২. আজকে ওমরপন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন
১৩. যখন আমায় ডাকবে না কেউ ডাকবে তুমি
১৪. সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ- রাববুল আলামিন
১৫. তোমার নেতা আমার নেতা আল-আরাবী মোস্তফা
১৬. জাগরে আঁধার রাতের ভালে নবী মোহাম্মদ
১৭. ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা খোদার সেরা দান
১৮. তোমার দয়া আছে খোদা জানি সকল দিকে
১৯. আমরা সবাই আলোর খুনি দীপ্ত কিশোর দল
২০. রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী
যাই হোক, ‘মাহফিল’ গ্রন্থটি দীর্ঘদিন পর পুনমুদ্রিত হওয়ায় ফররুখ-ভক্তরা উপকৃত হয়েছেন। বিশেষত যারা ইসলামি গানের জগতে কাজ করছেন, তারা কবির অনেকগুলো গান (১২৬টি) একত্রে পেয়ে গেলেন। সেই সাথে কবি ফররুখ আহমদের বহুমাত্রিকতার আরেকটি দিকও উন্মোচিত হল।
সবশেষে কবির রচিত একটি মুনাজাতের নিচের চারটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে মহান আল্লাহ তা'আলার দরবারে তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি:
‘রোজ হাশরে তোমার নবী মুহাম্মদের সম্মুখে
দিয়ো না রব লজ্জা আবার;-তওবা আমার কবুল করো॥
জীবনব্যাপী যে পাপ আমার তোমার নবীর উসিলায়
মাফ করে সব দাও গো এবার;- তওবা আমার কবুল করো॥’
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments