শুদ্ধ গানের প্রতীক দেশের কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী। উনার গান মানেই ভিন্নস্বাধ। এখনো মনে এঁকে যায় সেই সুর, সেই গান, সেই গানের বানী। নতুন নতুন জনপ্রিয় সব গান উপহার দিয়ে ভক্তদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই শিল্পীর ৩০ নভেম্বর ৬৬ তম জন্মদিন। একুশে পদকপ্রাপ্ত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী আপনাকে জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, কামনা করছে যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
ঘটা করে জন্মদিন পালন না করলেও প্রতিবারেই জন্মদিনে ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হতে সুবীর নন্দী । তবে এবারই প্রথমবার নিরবে ভক্তদের ভালোবাসা এক আকাশের তারা হয়ে একায় একায় দেখবেন! সুবীর নন্দী প্রয়াণের পর প্রথম জন্মদিন আজ। বাংলা গানের জগতে সুবীর নন্দীর আবির্ভাব হয় ধুমকেতুর মতো। দীর্ঘ চার দশক চলচ্চিত্র ও শুদ্ধ-আধুনিক বৈচিত্রময় কাব্য কথার গান গেয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন সারা বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে। তিনিই একমাত্র শিল্পী, যিনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত ও স্বনামধন্য গীতিকার ও কবিদের লেখা গানে কণ্ঠ দান করেন। তিনি এত কাব্যময় কঠিন-কঠিন সুরের গান গেয়েছেন যা কেউ এর আগে আর গাননি। তার সব থেকে বড় গুণ ছিল গানের প্রতি তাঁর আজন্ম শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসা।
১৯৫৩ সালের ৩০ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়া মহল্লায় জন্মগ্রহন করেন সুবীর নন্দী।শিল্পীর বাবা সুধাংশু নন্দী একজন মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তাঁর মা পুতুল রানী ছিলেন কন্ঠ শিল্পী।বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশব কেটেছে চা বাগানে।প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় মা-এর কাছে তার সঙ্গীতে হাতখড়ি। এরপর ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। তারপর লোকসঙ্গীত ও আঞ্চলিক গানের তালিম নেন প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত গবেষক,সুরকার ও গায়ক পন্ডিত বিদিত লাল দাসের কাছে। ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে আঞ্চলিক ও লোকগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার সুযোগ পান।এরপর ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার সুযোগ পান।সুবীর নন্দীরপ্রথম র্রেকড করা গান ’যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’।গানটি লিখেছিলেন মোহাম্মদ মোজাক্কের ও সুর করেছিলেন ওস্তাদ মীর কাসিম খান। এটি র্রেকড করা হয় ১৯৭২ সালে। একই বছর তিনি জনতা ব্যাংকে চাকরি নেন। ২০১০ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগ পযর্ন্ত জনতা ব্যাংকেই তিনি কর্মরত ছিলেন।সুবীর নন্দী প্রথমে রেডিওতে তারপর টেলিভিশনে গান গেয়ে ব্যাপক পরিচিতি পান।এই সময় তিনি ও আকরামুর ইসলাম দু’জনে মিলিত ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন “সুরমা নদীর তীরে” নামে একটি লোকসঙ্গীত ও আঞ্চলিক গানের একটি দল। এই দলের পরিচালক ও প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন পন্ডিত বিদিত লাল দাস। এই শিল্পগোষ্ঠির আঞ্চলিক ও লোকগীতি নিয়মিত ভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারীত হতো।এই শিল্পগোষ্ঠির সদস্য থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সালে বিশিষ্ট আলোকচিত্রশিল্পী আব্দুস সামাদ পরিচালিত ’সূর্যগ্রহন’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করার সুযোগ পান। এই চলচ্চিত্রে ‘মেনে নিলাম তো আকাশের নিচে’গানটি গেয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পান। এরপর ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অশিক্ষিত’ চলচ্চিত্র। এই সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমিন আর সুবীর নন্দী দ্বৈতকন্ঠে প্লেব্যাক করেন “মাষ্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই”। সেই সময় এই গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এই গানটি লিখেছিলেন মোঃ রফিকুজ্জামান ও সুর করেছিলেন সত্যসাহা। ধীরে ধীরে তার কন্ঠের রোমান্টিক আধুনিক গান ছড়িয়ে পড়েু মানুষের মুখে মুখে। এরপর সুবীর নন্দীকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।ভক্ত-শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণে গাইতে হয়েছে একের পর এক অসংখ্য গান। এই সময়কার শিল্পীর বিখ্যাত গানগুলো হলো: ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শক্র বলে গন্য হলাম’, আমর এ দু’টি চোখ পাথর তো নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’,’আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’,’পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝড়না বলো’,’আমি কাটাঁ ভূবনে আলোর পিয়াসী’,’দিন যায় কথা থাকে’, ‘বন্ধু তোর বরাত লইয়া আমি যামু,’কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়,’ও আমার উড়াল পঙ্ক্ষীরে,’ইত্যাদি গান। এসব গানগুলো সুবীরনন্দীকে পৌঁছে দিয়েছে ভক্ত-শ্রোতাদের হৃদয়ে।পাচঁ দশকের ক্যারিয়ারে আড়াই হাজারের বেশী গানে কন্ঠ দিয়েছেন বরেণ্য এই প্রয়াত কন্ঠশিল্পী।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে সেরা পুরুষ বিভাগে ‘মহানায়ক’(১৯৮৪), ‘শভদা’(১৯৮৬), ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’(১৯৯৯), ‘মেঘের পরে মেঘ’(২০০৪) এবং ’মহুয়া সুন্দুরী’(২০১৫)- পাচঁবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সাল তিন বার বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন গুনী এই শিল্পী। দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ এপ্রিল পরিবারের সাথে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত ১১ টার দিকে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তাছাড়াও তার হার্টে বাইপাস অপারেশন করা হয়েছিল। আবার কিডনিতেও সমস্যা ছিল। টানা ১৬ দিন সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৩০ এপ্রিল উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুর নেওয়ার কয়েকদিন পর সুবীর নন্দীর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তারপর থেকে ক্রমেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সেখানে চিকিৎসা চলাকালেও তিনি পরপর তিনবার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। শেষমেষ গত মঙ্গলবার (৭ মে) ভোর সাড়ে চারটার দিকে তিনি দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলা আধুনিক গানের উজ্জ্বলতর এক অধ্যায়।
বাংলা গান যতদিন থাকবে ততদিন শাস্ত্রীয় শুদ্ধ সংগীতের শুদ্ধতম শিল্পী, চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানের এই অমর শিল্পী অনির্বাণ শিখা হয়ে সংগীতপ্রিয় বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন সুবীর নন্দী। আজ তার জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা আর বুকভরা ভালোবাসায়।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments