আব্দুল আলীম কিংবদন্তিতূল্য অমর লোকসঙ্গীত শিল্পী_মনোজিৎ কুমার দাস

 
বাংলাদেশের পল্লীগীতি লোকসংগীতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক অবিস্মরণীয় নাম সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল আলীম। কণ্ঠস্বরের অসাধারণ জাদু নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। বাংলাদেশের লোকসংগীতকে অবিশ্বাস্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ইসলামি ইত্যাদি গানের শিল্পী হিসেবে তিনি আজও প্রবাদপ্রতিম। আব্দুল আলীমের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই।
তিনি লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই আলীম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন; আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালা পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। প্রাইমারি স্কুলে পড়বার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনে গান গাইবার জন্য আগ্রহ জন্মে। ছোটবেলায় তার সঙ্গীত গুরু ছিলেন সৈয়দ গোলাম আলী। অল্প বয়স হতেই বাংলার লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো "তোর মোস্তফাকে দে না মাগো" এবং "আফতাব আলী বসলো পথে" এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত-কিংবদন্তি পুরুষ।
পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় যান এবং সেখানে আব্বাসউদ্দিন কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গান করেছেন। তিনি লোক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর দীক্ষা নিয়েছেন বেদারউদ্দিন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের কাছে। লেটো দলে, যাত্রা দলে কাজ করেছেন।
দেশ বিভাগের পরে আব্দুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রমুখ মুখোশসহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলোলালন ফকির সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তার। আব্দুল আলীম তার আধ্যাত্মিক মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। কবি বাংলার লোক সঙ্গীতের গবেষক কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, "সমাজাটকে যাঁরা জাগিয়েছেন আব্দুল আলীম তাঁদের একজন" পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক।
আব্দুল আলীম বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন; এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন।বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।
তিনি প্রায় যে ৫০ টি ছবিতে নেপথ্যে কন্ঠশিল্পী ছিলেন সেগুলো হলো- এদেশ তোমার আমার, তোমার আমার, তোমার আমার, জেয়ার এলো, সুতরাং, পরশমণি, বেদের মেয়ে, রূপবান, সাত ভাই চম্পা, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এলো, সুতরাং, পরশমণি, বেদের মেয়ে, রূপবান, সাত ভাই চম্পা, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তার বেশ কিছু লোকগীতি পল্লীগীতি আজিও সমানভাবে জনপ্রিয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পরের জায়গা পরের জমি, নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখি, মেঘনার কূলে ঘর বাধিলাম, এই যে দুনিয়া, দোল দোল দোলনি, দুয়ারে আইসাছে পালকি, মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়, বন্ধুর বাড়ি মধুপুর ইত্যাদি।
আব্দুল আলীমের প্রথম জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। এখানের সেইসব কথা কিছুটা বললে আত্মরতি হবে না।
১৯৪২ সাল। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। শেরে বাংলা কে ফজলুল হক এলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আবদুল আলীমকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে।
 
শিল্পী ধীর পায়ে মঞ্চে এসে গান ধরলেন, ‘সদা মন চাহে মদিনা যাবো।মঞ্চে বসে আব্দুল আলীমের গান শুনেশেরে বাংলাশিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন তার বুকে। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা, পাঞ্জাবি, জুতা, পুটি, মোজা সব কিনে দিলেন। এই হচ্ছে আব্দুল আলীম। তার গানে আপ্লুত হয়নি এমন লোক বিরল।
আগেই বলা হয়েছে, দেশভাগের পর তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন।
 
১৯৪৭ সালের সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা আসেন পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন, ‘ মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।
তারপর পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের সঙ্গে আবদুল আলীমের পরিচয় হয়। কবি জসীম উদ্দিন তাকে পাঠালেন জিন্দাবাহার দ্বিতীয় লেনের ৪১ নম্বর বাড়িতে। এক সময় দেশের বরেণ্য সংগীত গুণী শিল্পীরা এখানে থাকতেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। মমতাজ আলী খান আবদুল আলীমকে পল্লী গানের জগতে নিয়ে এলেন। পরবর্তীতে তিনি কানাই শীলের কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন।
 
গান শেখার ক্ষেত্রে আর যারা তাকে সব সময় সহযোগিতা উৎসাহ দিয়েছেনতাদের মধ্যে বেদার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল লতিফ, শমশের আলী, হাসান আলী খান, মো. ওসমান খান, আবদুল হালিম চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লোকসঙ্গীতের অমর কণ্ঠশিল্পী মরহুম আববাস উদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মো. হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় পাঁচশত লোকগীতি পল্লীগীতি রেকর্ড করেন
যাদুকরী কণ্ঠের অধিকারী আবদুল আলীম জীবদ্দশায় মরণোত্তর বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সংগীত পরিবেশন করে আবদুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।
সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে তিনি ১৯৬৩ সালে রাশিয়া এবং ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। তিনি এছাড়াও বিভিন্ন দেশে বাংলা লোকগীতি কে করে তোলেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লোকগীতি পরিবেশন করে দেশের জন্য প্রচুর সুখ্যাতি বয়ে আনেন। তারস্যার দরাজ কণ্ঠের সুরেলা লোকগীতি পল্লীগীতি শ্রোতারা শুনেছ মন্ত্রমুগ্ধ মুগ্ধ হতেন। আজও তার কণ্ঠে রেকর্ডকৃত গান শুনে  মন্ত্রমুগ্ধ হায় শ্রোতারা।
 
এই লোকসংগীত শিল্পী মাত্র ৪৩ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ আবদুল আলীম নেই। কিন্তু আছে তার গান। তিনি তার গানের মাঝে সংগীতপিপাসু জনগণে কাছে আমার হয়ে থাকবেন থাকবে যুগ যুগ ধরে। তার জন্মদিনে তাক শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই। 

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.