একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের তরুণ কবিদের অন্যতম আলমগীর ইমন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলাধীন সবুজেঘেরা ছায়া-সুশীতল নিভৃতপল্লী চরম্বায় তার জন্ম। মাইজবিলা গ্রামের মোহাম্মদ মিয়া ও দিলুয়ারা বেগমের বড় সন্তান কবি। গ্রামে পড়ালেখার প্রাথমিক পাঠ চুকার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য চট্টগ্রাম সিটিতে চলে আসেন। প্রবেশ করেন নাগরিক জীবনের জটিল অথচ কাব্যিক কোলাহলে। ছাত্রত্বকালে সাহিত্যাঙ্গনে আসা ও সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন তিনি। প্রথমদিকে তার যৌথ ও সম্পাদিত লেখা প্রকাশ পেত। সেখান মোড় ফিরান 'হৃৎব্যাকরণ'(২০১৮) কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। এরপর প্রকাশিত হয় একে একে বেশ কয়েকটি বই। মেদহীন, ঝরঝরে ও বাহুল্যবর্জিত লেখা তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি ক্রমাগতভাবে বুনন করে চলেছেন কাব্যজমিন এবং ঋদ্ধ করছেন সাহিত্যভুবনকে।
আলমগীর ইমনের কবিতার মূল উপজীব্য বিষয় মানবীয় প্রেম, বিরহ, সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতি ও স্বদেশ ভাবনা। কবি শাহ নেয়ামত উল্লাহর মতে, 'তিনি প্রেমের কবি।' কবি ও প্রকাশক কাজী সাইফুল হক বলেন, "তার কবিতার প্রধান বিষয় প্রেম। প্রেমের বিষয়, আঙ্গিক, প্রকাশ-পদ্ধতি সমকালের কবিতায় দিয়েছে নতুন প্রাণ, ভিন্ন মাত্রা। তার কবিতায় নারী, প্রেম, রূপ-রস, চিরায়ত পূরাণের মতোই অনিবার্য উপজীব্যে পরিণত হতে দেখি।'' আধুনিককালের কবিরা প্রেমের সর্বপ্রকার রূপ নিয়েই কবিতা লিখেন। বিবাহিত প্রেম, শরীরী প্রেম, আধ্যাত্মিক প্রেম, মানবীয় প্রেম। নারী-পুরুষ শাশ্বত ও চিরন্তন প্রেম নিয়ে লেখালেখি করেন খুবই কম কবি। মানব-মানবীর প্রেমের স্বাভাবিকতা হারায় শারীরবৃত্তীয় বিকৃত রুচির কারণে। এটা দেহ সর্বস্ব বৈকি! একে প্রেম বলা চলে না, হয়তোবা সাময়িক আকর্ষণ!আলমগীর ইমনের প্রচেষ্টা কিন্তু সেদিকে নিবদ্ধ এবং পরিশুদ্ধতাই তার লক্ষ্য।
'হৃৎব্যাকরণ' কাব্যগ্রন্থ কবির সেরা কাজ। প্রায় সব কবিতাই অণুকবিতার পর্যায়ে পড়ে। নিখাঁদ প্রেমের পরিশীলিত রূপায়ন এতে দৃশ্যমান। এতে সৌন্দর্যবোধ এবং উপলব্ধির আশ্চর্য কথামালা রচিত হয়েছে গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে।
"আমার রাত জেগে লিখা যে কবিতাগুলো সৌন্দর্যের কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে, রঙ চড়ায়, নতুন স্বপ্ন দেখায়- কবিতাগুলো তোমার জন্য।" (কবিতাগুলো তোমার জন্য)
অন্য কবিতায় বলেন,
"নিজেই ঘোষণা দেবে-
'পৃথিবীই স্বপ্ন! স্থায়ী হতে চাই অনন্তকাল।'
আমি অভ্যর্থনা জানাবো
চেরাগী পাহাড়ের পাদদেশ থেকে
একগুচ্ছ গ্ল্যাডিওলাস নেবো তোমার জন্য।' (সন্ধ্যাতারা)
সমসাময়িক কবিরা দেহসর্বস্ব বর্ণনায় কবিতার অবয়ব রচনা করেন তিনি তার থেকে যোজন যোজন দূরে। তার কাছে প্রেম স্বর্গীয় সুষমাম-িত পরশমণি। এতে কামনার স্থান অতি গৌণ! তিনি লিখেন,
"বৃষ্টি, শোন-যারা মনের রূপ নয়, সঠিকভাবে শরীরের রূপ-প্রদর্শন করতে পারে তারাই সেলেব্রিটি! (সেলেব্রিটি)
মানব-মানবীর শাশ্বত প্রেম, নারীর সৌন্দর্য জগতের এক অসীম রহস্য ও বিস্ময়কর! এ প্রেম মানুষকে উন্মাতাল ও উদ্ভ্রান্ত করে তোলে। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, চল্ডিদাস-রজকিনীর প্রেম আজও রহস্যঘন উপাখ্যান। এখানে সৌন্দর্যের চেয়ে প্রেমময়ের পবিত্র মিলনই আসল। সেই পরিশুদ্ধতাই প্রেমের পরিপূর্নতা দান ও সার্থক করে তোলে। কবি তার নিজস্ব প্রেমের ইতিহাস রচনায় টেনে এনেছেন সেসব লিজেন্ডারিকে 'ডেবিট-ক্রেডিট'র হিস্যায়। বলেন, 'যে ইতিহাসে চাপা পড়তো ইউসুফ -জুলেখা, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রজকিনী-চণ্ডিদাস, মমতাজ-শাহজাহানের নাম!' পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকপ্রবরকে জানিয়ে দিতে কবি তখন ইবনে বতুতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ছড়িয়ে দেন প্রেমের ইতিহাস ইথারে-পাথারে কিংবা সাহারা মরুভূমির প্রতিটি বালিকণায়।
'শরীরের (কবিতার) ভাঁজে ভাঁজে দেশ-মহাদেশ,
সাগর-মহাসাগর, পর্বত-হিমালয়! (কবিতা)
সুখ-দুঃখের মতোই প্রেম-বিরহও যেনো যমজ ভাই। প্রেমে বিরহকাল না থাকলে খাঁটি হয় না। কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ূন আহমেদ, ফররুখ আহমেদ, মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ প্রায় কবি-সাহিত্যিকেরই প্রচুর বিরহের কবিতা ও গল্প দেখা যায়। বিরহকাল মানে প্রেমের সমাপ্তি নয়, উত্তরোত্তর প্রেমের শ্রীবৃদ্ধি। কাজী নজরুল ইসলাম 'অভিশাপ' কবিতায় বলেন,
'যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
যেদিন আমায় খুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!' (দোলনচাঁপা)
'আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো।' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তারও বেশ কিছু কবিতায় চমৎকার উপমা দেখা যায়! মাঝে মাঝে বিরহের সুরও বেজে উঠে। এ কী কবির আগাম কোনো শংকা? পাঠকদের মনে এ প্রশ্ন জাগতেই পারে! অবশ্য যিনি পাঠককে অবলীলায় প্রেম-অপ্রেমের গল্প শোনাতে ভালোবাসেন তিনি সবসময় প্রেমের স্তুতিগানই করবেন, পাওয়া না পাওয়ার পরোয়া থোরাই কেয়ার করেন। কবি তাই তো প্রেমের ইমনীয় রাজ্যে গেঁথে চলেছেন অজস্র বিরহী কাব্যমালা।
'যদি স্তুপে পরিণত করা হয়
হয়তো হিমালয়কেও হার মানাবে।'
কথাগুলো একান্ত নিজের, আমার মনের,
মনের মানুষের এবং আমার ভালোবাসার।'(কথার দীর্ঘশ্বাস)
'বিরহী সুরে ঘড়ি বলে, 'বসন্ত নেই প্রকৃতিতে, গ্রীষ্মের একচেটিয়া রাজত্ব ইমনীয় রাজ্যে।' (যাযাবর চোখ)
'দূরত্বই বাড়িয়ে তুলছে-জ্যামিতিক হারে দু'প্রজাপতির
মান্দালয় এখন হিরোশিমা-নাগাসাকির সহোদর।' (অন্যোব্য অভিমান)
'হৃৎব্যাকরণ' আসলে হৃদয়েরই ব্যাকরণ। ব্যাকরণ মেনে চললে যেমন কোনো বিষয়ে পা-িত্য অর্জন সহজতর হয়। তেমন হৃদয়ের ব্যাকরণাদির পাঠ জানা থাকলে প্রেমের পৃথিবীতে অবগাহন করে সার্থক প্রেমের মনজিলে পৌঁছা যায়। গ্রন্থটিতে এ বিষয়ে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত নয়, সরাসরি ফর্মুলা বাতলে দেয়া হয়েছে। শাশ্বত প্রেমের নাবিকরা যাতে নোঙর ফেলতে ভুল না করে! পাঁজরের হাড় দিয়ে প্রেমের টাইটানিক তৈরি করলে কখনো কি আটলান্টিকে ডুবতে পারে? কবি বলেন,
পাঁজরের হাড়ে গড়েছি টাইটানিক
ভাসাবো আটলান্টিকে।
চুম্বকীয় আটলান্টিক ভাসাতে নয়, ডুবাতে বিজ্ঞ!
বিজয়ী আটলান্টিক, বিজয়ী টাইটানিক।' (প্রভাষকের মাথাব্যথা)
'নদীর তারুন্য নিয়ে অরণ্যের সজীবতা নিয়ে
আকাশের দীপ্তি নিয়ে মনে কোরো শুধু একবার
তোমাকে জাগায়ে গেল যে পথিক হৃদি-রক্ত দিয়ে
এখনো অলক্ষে থেকে মেলে আছে স্নিগ্ধ দৃষ্টি তার
তোমার পথের পরে যদি নামে অন্ধ ঘন ছায়া
বিস্মৃত ইঙ্গিত তার কেটে যাবে শর্বরীর কায়া।'
(দিলরুবা, সপ্তম স্তবক- ফররুখ আহমদ)
সবশেষে যে প্রেম না হলে মানব প্রেম ধন্য হয় না সেই চির ভালোবাসার মানুষ মাকে দিয়েই কাব্যগ্রন্থের যবনিকা টানা হয়েছে 'আমার মা আমারই জান্নাত' কবিতা দিয়ে।
'আমি না চাইতেই বুঝে যাবে আমার চাওয়া
পূরণে মরিয়া হয়ে উঠবে অবিরত ভালোবেসে!
আমার জন্য শেষ রক্তবিন্দুও উৎসর্গ করতে পারে।
সাত'শ কোটি মানুষের ভীড়ে আমাকে খুঁজে নিয়ে-
বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে অকৃত্রিম মমতায়!'
কবি আলমগীর ইমনের রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হলোঃ আমি মেঘ হবো (যৌথ), সপ্তর্ষি-১ ও সপ্তর্ষি-২ (যৌথ), গ্ল্যাডিওলাস (দ্বৈত), একক গ্রন্থঃ হৃৎব্যাকরণ (২০১৮), অন্য আকাশের ঘুড়ি (২০১৯) ও শার্টের বাঁ কাঁধে ধূলো (২০২০) সম্পাদনা
করেছেনঃ অঙ্গন ও ইতিবৃত্ত ইত্যাদি। শুদ্ধতম সাহিত্যচর্চার আঙিনা ইদানীং লিটলম্যাগ ও সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সালফি পাবলিকেশন্স'র সাথেও যুক্ত আছেন তিনি। বেশ ক'টি সম্মাণনাও তার ঝুলিতে রয়েছে। আশাকরি সাহিত্যজগৎকে তিনি আরো প্রদীপ্ত করবেন সে প্রত্যাশা করতেই পারি। এ গ্রন্থটি পাঠে সাহিত্যপ্রেমী মাত্রকেই আকর্ষণ করবে। 'হৃৎব্যাকরণ' প্রকাশ করেছেন স্বনামধন্য গলুই প্রকাশন।
প্রবন্ধকার: লেখক ও গবেষক
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments