লিটিল ম্যাগাজিন ও লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক_তৈমুর খান
সাহিত্যের বীজতলা লিটিল ম্যাগাজিনের অবদান সর্বকালেই বিশ্ববন্দিত। খুব কম লেখকই আছেন যাঁরা লিটল ম্যাগাজিনে লিখেননি। কিন্তু অধিকাংশ লেখকেরই লিটিল ম্যাগাজিন থেকে উত্থান ঘটেছে। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের কবি-লেখকরা তাঁদের প্রথম লেখাটি লিটিল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন।
ছোট থেকেই এই লিটিল ম্যাগাজিনেরই প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। আজও এই লিটিল মাগাজিনে ভালো লেখাটি প্রকাশিত হলে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হই।
নব্বই দশকের প্রায় প্রথম থেকেই আজ অবদি যে লিটিল মাগাজিনে আমি ধারাবাহিকভাবে লিখে চলেছি তার নাম 'দৌড়', সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাস। প্রায় ছাত্রাবস্থা থেকেই এই ম্যাগাজিনে আমার গদ্য লেখার হাতেখড়ি। এই ম্যাগাজিনের উদ্যোগেই আমার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়: 'কোথায় পা রাখি' এবং 'বৃষ্টিতরু' যার জন্য আমাকে এক পয়সাও খরচ দিতে হয় না। সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাসের কতখানি আন্তরিকতা ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। বীরভূমের একটি প্রান্তিক গ্রাম থেকে তাঁর বাড়িতে কলকাতায় ছুটে যেতাম। রাত্রিযাপনও করতে হতো। আবার বাড়ি ফেরার সময় তিনি সব ব্যবস্থাও করে দিতেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের আর একটি পত্রিকায় দীর্ঘদিন গদ্য লিখেছি, পত্রিকাটির নাম 'কুবাই'। সম্পাদক জিতেন্দ্রনাথ হাটুই প্রতিটি সংখ্যা খুব যত্ন করে পাঠাতেন। আর একটা পত্রিকা অজিতকুমার কুণ্ডুর সম্পাদনায় 'কলতান' নামে হুগলি থেকে প্রকাশিত হতো। সেখানেও প্রতিটি সংখ্যায় গদ্য লিখতাম। হুগলির আর একটি অন্যতম পত্রিকা 'সুপত্র' সম্পাদনা করেন ড. অমিতাভ মুখোপাধ্যায়। এখানেও প্রচুর গদ্য লিখেছি কেবল সম্পাদকের আন্তরিক আহ্বানে। দুর্গাপুরের তপন রায় সম্পাদিত 'আলোর পাখি' পত্রিকার কথাটি কখনও ভুলতে পারবো না। বারাসাত থেকে অতনু মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো 'কপোতাক্ষ'; দীর্ঘদিন এই পত্রিকায় গুচ্ছ গুচ্ছ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে আমার একটি ছোট্ট কাব্য 'বিষাদের লেখা কবিতা' এই কপোতাক্ষ উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করে। কৃষ্ণ সৎপথীর সম্পাদনায় ঝাড়গ্রাম থেকে প্রকাশিত 'মেঠোপথ' পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ লিখেছি। পশুপতি মিশ্রের সম্পাদনায় 'সুবর্ণরেখা'ও ঝাড়গ্রাম থেকেই প্রকাশিত হতো। আমার প্রথম জীবনে বহু লেখা প্রকাশ করেন। একবার আমার অসুস্থতার সময় চিকিৎসা করানোর জন্য কিছু অর্থও প্রেরণ করেন। শ্রদ্ধেয় এই সম্পাদকগণ দেখিয়ে দিয়েছেন কতখানি ত্যাগ ও ভালোবাসা থাকলে লিটিল ম্যাগাজিন করা যায়। আমার বন্ধু স্থানীয় প্রিয়জন আরও বহু আছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: সুবর্ণ রায়, দেবাশিস সাহা, প্রবীর দাস, চারুচন্দ্র রায়, ফজলুল হক, সুনীল মাজি, শুভঙ্কর দাস, সৌরভ ভূঁইয়া, নন্দিতা ব্যানার্জি এবং আরও বহু । এঁদের পত্রিকায় এখনও লিখে চলেছি। যাঁরা এখনও দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি ক্ষেত্রকে উর্বর করে তুলছেন সমস্ত স্বার্থ বিসর্জন দিয়েই নিছক সাহিত্যসেবায়।
যার আকাশ-বাতাস, নক্ষত্রমণ্ডল-গ্রহরাজি, উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণীকুল সবকিছুই এক একটা ছন্দময় স্তবক। স্তবকে স্তবকে পংক্তি বিন্যাস এবং বিস্ময়কর আলোড়ন বিরাজ করছে। আমাদের সাহিত্যের প্রয়াসও এরই ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র। তাই এই আনন্দ মহান স্রষ্টার আনন্দের মতোই ভাষাহীন তীব্র অলৌকিক বোধসম্পন্ন। লিটিল ম্যাগাজিনগুলি তাদের অস্থি দিয়ে যে নাও তৈরি করে, এবং সেই নাও-ই আনন্দের রসের সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের। সুতরাং লিটিল ম্যাগাজিনগুলির কাছে আমরা আজীবন ঋণী একথা বলেই আমাদের দায় শেষ করতে পারি না। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের জীবন অন্বেষা, আমাদের জীবনযাপন, আমাদের দার্শনিকবোধ, আমাদের চৈতন্যজাগরণ সবকিছুরই বাহক হয়ে ওঠে এই লিটিল ম্যাগাজিন।আমাদের ঔদার্য, সহানুভূতি, প্রেম ও মৈত্রীর শিক্ষাও দিতে পারে এই লিটিল ম্যাগাজিনগুলি। আমরা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎএর দিকে যাত্রা শুরু করতে পারি এরই প্রেরণাতে।
তাঁর শ্রমের সমস্ত অর্থ পত্রিকার কাজে ব্যয় করতে। বিরল হলেও এরকম সম্পাদকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কবি-লেখকদের তিনি এতই ভালোবাসেন যে নিজের প্রণিপাত ঘটিয়ে তাঁদের কাব্য সংকলনও বের করেন। হয়তো তাঁদের অবদানের কারণেই সেইসব কবি-লেখকরা ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধির সোপানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠেন। তখন পাঠক আর সেই সম্পাদকের কথা মনে রাখেন না, শুধু কবি-লেখককেই চোখের সামনে দেখতে পান।
কিন্তু একজন সফল কবি-লেখকের আড়ালে একজন জীর্ণ আত্মত্যাগী মহাসাধক সম্পাদকের অবদান থেকেই যায়। অন্ধকার গলিতে অথবা ভাঙাচোরা চায়ের দোকানে বসে তিনি পত্রিকার পরিকল্পনা করতেন, নিজের জীবনকে এবং সংসারকে তাচ্ছিল্য করে পত্রিকার সৌজন্যে তাঁর যৌবন ও ক্ষমতাকে ঢেলে দিতেন— সেই সম্পাদকের মুখটি আর কেউ স্মরণে আনেন না। এঁদের কথা কেউ কখনও লিখেও যান না।
শুধু কালের ইতিহাসে আশ্চর্য ধূলি-ধূসরতায় ঢাকা পড়ে যায়। টোল পড়া মুখ, আকাটা দাড়ি, আইরনবিহীন আধময়লা জামা কাপড়, পায়ের ছেঁড়া চপ্পল দেখে সাময়িকভাবে অসভ্য অমার্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে এঁরাই প্রকৃত সফল কোনো সাহিত্যিকের আশ্রয়দাতা এবং জনক তুল্য। অতীত থেকে বর্তমান ইতিহাসের ধারায় এরকম সম্পাদকেরই দেখা পাওয়া যাবে এবং এঁরাই প্রকৃত সম্পাদক।
আরও বহু পত্রিকার নানা সময়ে উত্থান পতন ঘটেছে। সেইসব পত্রিকার সম্পাদকদের খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁদের জীবনযাপন কত অনাড়ম্বর বাহুল্যবর্জিত তাতে মনে দাগও কেটেছে। ফলে সাহিত্যের প্রতি একটা মমতা বা ভালোবাসা আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। লিটিল ম্যাগাজিন যে একটা বিদ্রোহ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তা বলাই বাহুল্য। অনেক সময় মনে হয়েছে নিজেকে পুড়িয়ে অন্যকে আলো দেখিয়ে পথ চলতে সাহায্য করার মতো। তাই আজও সেইসব সম্পাদকদের কথা স্মরণ করি আর ভেসে ওঠে ওইসব দীপ্ত মুখগুলি।‘পদাতিক’ নামে একটি দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করতেন শঙ্করলাল রায়। তাঁর একটা ছোট্ট শাখা-চুড়ি বিক্রির দোকান ছিল। সেইখানে গিয়ে ভাঙা বেঞ্চে বসতাম। সদ্য লেখা কবিতা নিয়ে। তিনি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে ছন্দপতনগুলি ধরিয়ে দিতেন। কবিতার ভালোমন্দ নিয়ে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করতেন। বহু উদাহরণ দিতেন। কালিদাসের কাব্য থেকে উদ্ধৃতি তুলে মন্দাক্রান্তা ছন্দ বোঝাতেন। আর মাঝে মাঝে পাশে থাকা নারানের চায়ের দোকান থেকে লাল চা এনে দিতেন। চা খাওয়া হলে একটা লাল সুতোর বিড়ি বের করে বলতেন: ধরাও। বিড়ি টানতে টানতে অনেক কথা হতো। তিনি তাঁর মরমি হাত মাথায় রেখে আশীর্বাদও করতেন। সামান্য একটা দোকানে যা আয় হতো, তাতে সংসারই ঠিকমতো চলত না।
তবুও পাঁচ-ছয় কাপ চা খাইয়ে আরও খরচ করে ফেলতেন। পত্রিকায় ছবি এঁকে অলংকরণ করতেন। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখতাম, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক হতে গেলে কতখানি ত্যাগ ও ধৈর্য দরকার। তখন আমি, অনিমেষ মণ্ডল, শ্যামচাঁদ বাগদি, চাঁদ মহম্মদ, তুষার আহাসান সকলেই যেন তাঁর ছাত্র। আজ আর সেসব কল্পনাও করতে পারি না।
তেমনি ‘ডানা’ পত্রিকার দপ্তরেও সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায় নতুন কবিতার নানা বাঁকগুলি তুলে ধরতেন। পত্রিকার জন্য ডাকযোগে আসা কবিতাগুলি পাঠ করতে বলতেন। আর সেসব থেকেই বিচার হতো কোনটি প্রকাশযোগ্য। এই ভাবেই সাহিত্যের বীজতলা আমাদের। লিটিল ম্যাগাজিন এই প্রবহমান স্রোতকে আজও তুলে ধরে আমাদের সংস্কৃতি যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছে। আমরা ভুলে যেতে পারি না এর অবদানগুলি।
খুব সাম্প্রতিক সময়েও কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিনের উদ্যোগে এবং আন্তরিকতায় আমার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল: বর্ধমান থেকে প্রকাশিত বার্ণিক প্রকাশন পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়ে 'জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা' বইটি প্রকাশ করেছে। এবং ক্রমান্বয়ে অনেকগুলো বই প্রকাশ করে চলেছে। আর এইসব বইয়ের জন্য যথারীতি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে রয়্যালিটিও প্রদান করে। কবিমন পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশ করেছে 'উন্মাদ বিকেলের জংশন' কাব্যগ্রন্থটি। নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়ে নিজেই কাব্যটির প্রচ্ছদ এঁকে ভূমিকা লিখে খুব যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। বইটির প্রকাশ অনুষ্ঠান কাঁথি বইমেলায় তা আমার হাতে তুলেও দেন। শুধু বইই নয়, আমাকে এবং আমার গৃহকর্ত্রীর জন্য দুটি কাপড়ও তুলে দেন। এই মহানুভবতার স্পর্ধা যে লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরাও দেখাতে পারেন তা ইতিহাস হয়ে রয়েছে আমার লেখার মধ্যে।
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments