নতুন খবরেও মেলেনি তার সন্ধান_রওশন রুবী
কর্মচঞ্চল শহর। ভোর হলো কি হলো না, শুরু হয়েছে হাকডাক। মানুষগুলোর ব্যতিব্যস্ততা মুগ্ধ করে রাশিদুলকে। সে ঘুম থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বা ছাদে গিয়ে দেখে নেন অতি চেনা দৃশ্যগুলো প্রতিদিন প্রতিবার। তার মনে হয় এতে করে নিজের মধ্যে সহমর্মী চেতনা জাগ্রত থাকবে, ঝিমিয়ে পড়বে না। দৃশ্যগুলো দেখা অবস্থায় বুয়া একমগ কফি এনে দেবে। আয়েশে কফি খেতে খেতে সে ডুবে থাকে মানুষের মধ্যে। ওদের চালচিত্রগুলো দেখতে দেখতে কখনো হেসে উঠে রাশিদুল; কখনো মলিন হয়। এখন যেমন রাশিদুলের মনটা খুব খারাপ হলো। তিনতলার ছাদ থেকে দেখা দৃশ্য আর সামন থেকে দেখা দৃশ্যের মধ্যে তফাত থাকলেও এই দৃশ্যটি তিনতলার ছাদ থেকে যেমন সামন থেকেও তেমনি।
রাস্তায় বকুল গাছটির নিচে একজন মানুষ গুটিশুটি শুয়ে আছে। তার দু’পাশে দুটো চার, ছয় বছর বয়সী বাচ্চা। একজনের হাতে একটি পালির বোতল। অন্যজনের হাতে একটা রুটি। রুটি ছিঁড়ে শুয়ে থাকা মানুষটির মুখে তুলে দিচ্ছ একজন। অন্যজন পানি এগিয়ে দাঁড়িয়ে। একটু পরই বোতলের পানি শুয়ে থাকা মানুষটির মাথায় ঢালতে শুরু করলো একজন। অন্যজন আরেকটি বোতল নিয়ে একটু তফাতে ওয়াসার নল থেকে পানি আনতে দৌড়ালো। পানি এনে সে ঢালছে এবং অন্যজন খালি বোতল নিয়ে ওয়াসার পানি আনতে ছুটছে। এইভাবে এই ছোট শিশুগুলো তার মাকে যতœ করছে। নিশ্চয় তার মায়ের জ্বর। অথচ, প্রতিবেশী এসপি রাহাত কাকুর সেভেনে পড়ুয়া ছেলে সামির। গতকাল তার মায়ের গায়ে ভাতের থালা ছুঁড়ে মেরেছে। তার মায়ের অপরাধ কেন মুরগির রান রান্না করেনি। রাশিদুলের আরেক প্রতিবেশী অরিয়ন এই ঘটনা দেখে বলেছিল,”আমার বন্ধু নীলয় টাকা পায়নি বলে ঘরের জিনিস পত্র ভেঙেছে। আর বাধা দিতে এলে ওর মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।” এরা দুজনই নয়। ঘরে ঘরে চলছে অবক্ষয়। ঠিক সেসময় ঐ দুটো পথ শিশুর এমন মানবিকতা চোখে জল না এনে পারে না। রাশিদুল কফি মগ ডাইনিংএ রেখে বেরিয়ে গেল। ঐ বাচ্চাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইল,
ওরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। নতুন মানুষের কাছে কিছু বলতে পারলো না। রাশিদুল আবার বললো,
-যদি বলো তবে তোমাদের মায়ের জন্য খাবার অনবো, ঔষধ আনবো, ফল আনবো। বল দেখিকী হয়েছে?
এবার বড়জন মুখ খুললো,
-মায়ের জ্বর হইছে। কতা কয় না। কিছু খায় না। আমগোরেও খাওয়ায় না।
একটু দূরে ঔষধের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও কিছু খাবার কিনে ওদের দিয়ে রাশিদুল বাসায় এলো।
ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে অফিস বেরুল। প্রায় ঘন্টা খানেক পর তার মায়ের ফোন,
-খোকা, আমাদের রাস্তার অপজিটের মার্কটে আগুন ধরেছে। সেকি ভয়াবহ অবস্থা। সাবধানে থাকিস বাবা।
ধড়পড় করে উঠলো বুক। হার্টবিট বেড়ে গেল। সেই বিল্ডিংয়ের আট নং ফ্লোরে প্রিয়তির অফিস। বেলা এগারোটা বাজলে দুজনের ট্রি ব্রেক। সেসময় কথা বলে দুজন মন খুলে। প্রিয়তি বিবাহিত। রাশিদুলও ছেলে মানুষ নয়। তবু কিছু কিছু চাহিদা মানুষের থাকে যা বাহিরমুখী করে মানুষকে। প্রিয়তির সাথে সম্পর্কের আগে বড্ড অস্থির ছিল রাশিদুল। কিছুতেই ভালো লাগা ছিল না। ছিল শুধু বিতৃষ্ণা আর বিতৃষ্ণা। তার স্ত্রী চঞ্চলাকে সবাই নম্র স্বভাবের বলে জানলেও সে সত্যিকার অর্থে একটা লোভী, সার্থপর, বদ মেজাজী মেয়ে। সারাক্ষণ অশান্তি আর অশান্তি। সেই বিভৎসতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে খুঁজতে প্রিয়তিকে পেয়েছে। এখন গায়ে মাখে না চঞ্চলার কোন বিষয়ই। চঞ্চলা রাশিদুলের কাছে আসবাব পত্রের মতোই একটা কিছু। মানুষ নিজেই আসলে নিজেকে ঘৃণার করে তুলতে তুলতে নির্জীব করে ফেলে।
কে জানে প্রিয়তির এখন কী অবস্থা! দ্রুত ফোন করে রাশিদুল। রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে। ফোন তুলছে না কেন প্রিয়তি? রাশেদুল কল করতে করতে বেরিয়ে পড়ে। একটা টেক্সিক্যাপে উঠে বসে। না প্রিয়তি ফোন তুলছে না। ওফ্ কী অসহ্য! কী অসহ্য! আগুনের অবস্থান থেকে এককিলো দূরেও হৈচৈ হট্টোগোল শোনা যাচ্ছে। যতোই এগুচ্ছে ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হচ্ছে শব্দ। বাড়ছে সামনে ভীড়। উৎসুক জনগণ, আত্মীয়-স্বজন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, আইনের লোক। আর যাওয়া যাবে না গাড়ি। নেমে পড়লো রাশিদুল। নেমে ভীড় কেটে কেটে সামনে এগুতে চাইছে। পারছে না। এই মুহূর্তে সবাই এগুতেই চায়। তাই এগুনো যায় না।
ভিড়ের ভেতর হাতের মধ্যে ফোনটা কেঁপে উঠলো। রাশিদুল চর্ট করে হাত উপরে তুলে স্কিনে দেখলো “প্রি”। মানে প্রিয়তি। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় উৎসাহে। সে রিসিভ করতে করতে কেটে যায়। দ্রুত ফোন ব্যাক করে রাশিদুল কিন্তু ভেসে আসে “এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।” পাগল হয়ে উঠে রাশিদুল এগিয়ে যাবার জন্য। পারে না। ক্যামিকেল, আসবাবপত্র পোড়ার গন্ধ চাপি মানুষ পোড়া গন্ধে ভরে যায়। মানুয়ের আহাজারি, করুণ আর্তনাদ বিভৎস করে তুলেছে সময়কে। এসময় কু’রুচিপূর্ণ মানুষেরও ঢল নামে। তারা এই নির্মম ঘটনার মধ্যে ছবি তুলছে, ফেসবুকে ছবি লোড করছে। অথচ ভিড় ঠেলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো ভেতরে ঢুকতে সময় লাগছে। আগুন কি সময় বোঝে? সে তো অবুঝ বড়। গ্রোগ্রাসে পেটে নেয় যা পায় চর্তুপাশে।
পরদিন, তারপরদিন, তারও পরে, তারও পরে, চুড়ি হাট্টার আগুনের কথা নিয়ে অনেক লিখা হলো। লিখছে আজো পত্রিকাগুলো।
-গর্ভবতী স্ত্রী নামতে পারেননি তাই স্বামীও নামেননি। ফলাফল গর্ভের সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু। চার বন্ধু আড্ডা দিচ্ছিলেন প্রতিদিনের মতো। চারটি মাথার পোড়া খুলি পড়ে আছে। বাবার কাছে সন্তান বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে। বাবা বিরিয়ানি নিয়ে ফিরে এসে সন্তানকে এখনো পাননি। জমজ সন্তানদের বয়স এক বছরের মতো। তারা মর্গে বাবাকে খুঁজছে। দুই ভাইয়ের জড়াজড়ি করা লাশ আলাদা করা যাচ্ছে না। আলাদা করার পর তাদের বুকে জড়িয়ে ধরা এক শিশুর লাশ। শিশুকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছিলেন দুই ভাই। ছেলে নর্থসাউথ এ পড়ে, এমন সন্তানের লাশ চাচ্ছে তার মা।একটুকরো মাংসের দলা হলেও চলবে। তিনি শেষবার বুকে জড়িয়ে ধরবেন। মৃত ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করে বাবাকে ফোন দিয়ে বলছে ভাইয়ের লাশ পাবার কথা। আরো কতো কি। কিন্তু প্রিয়তির কোন সংবাদ কোন কাগজে আসেনি। সাংবাদিকেরা লিখেনি দুটো বাক্যও তার নামে। নতুন খবরেও মেলেনি তার সন্ধান।
আহ্ জীবন! তুমি এভাবে গোপনে রয়ে গেলে!
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments