আত্মার প্রেতাত্মা_শ্রেয়সী শিখা মনি

 
জীবের অংশ যা কোন শরীর নয়। আধ্যাত্মিক বিশেষজ্ঞগণ বিশ্বাস করেন যে, আত্মা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে এবং পৃথিবীর যে কোন জিনিষ কে বদলে দিতে পারে। আত্মার কতগুলো ভাগ আছে যেমন -পরমাত্মা, দেবাত্মা, মানব আত্মা প্রেতাত্মা (ভূত) দেবাত্মা হলো পরমাত্মা দ্বারা নিয়োজিত শক্তি।
 
এই শক্তি তাদের কাজ শেষে পরমাত্মার কাছে ফিরে যান। অপর দিকে প্রেতাত্মা, এমন একটি আত্মা যে বা যা পরমাত্মার কাছে ফিরে যেতে পারে না।  প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ভুত প্রেতাত্মা বা অশরীরি হলো মৃত ব্যক্তির আত্মা যা, জীবিত ব্যক্তিদের সামনে দৃশ্য, আকার গ্রহন করা বা অন্য কোন উপায়ে  আত্ম প্রদশর্ন করতে সক্ষম। প্রেতাত্মা বলতে মৃত ব্যক্তির প্রেরিত আত্মা কে বোঝায়।
 
২.
সাল ১৯৮১
স্থান যোধপুর পার্ক
শহর কলিকাতা
যোধপুর বাস স্টপে নেমে দুই মিনিট হাঁটলে ডান দিকে একটা গলি। গলিতে ঢুকতেই একটি ছিমছাম বাজার। বাজার ছাডিয়ে  সামনে এগোলে বাম পাশে একটি গলি। গলিটির দুই পাশে সারি সারি বাড়ি মাথা তুলে তাদের আভিজাত্য প্রকাশ করছে। গলিটির শেষ মাথায় একটি ছোট তিনতলা বাড়ি দাঁডিয়ে। এই তিন তলা বাড়ির দোতালায় আমাদের ভাই-বোনের সংসার।
 
 
৩.
আমার ঘরের সাথে ছিল ছোট বারান্দা। ভোরে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতাম। খুব পছন্দের বাড়ি ছিল। সব কিছুই ভাল লাগছিল শুধু একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি  আমাকে বলতো, ঘরে আমি একা নই, কেউ আছে, কেউ দেখেছে আমাকে। অদ্ভুত না!
 
নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে প্রথম টা পাত্তা দিই নি। পড়াশুনা, কাজকর্ম, বাইরে যাওয়া-আসলে ব্যপারটা এক পাশে সরিয়ে রাখার চেষ্টা। কিন্ত অবচেতন মন জানান দেয়। কাওকে জানালাম না। বিশ্বাস ও তো করতো না কেউ।
 
ছোট বেলা থেকে আমার অভ্যেস গান ছেড়ে পড়া। তেমনি এক সন্ধ্যায় আমি গান ছেড়ে পড়তে শুরু করেছি। টেবিলের পাশে একটি আলমারি ছিল। আমি কিছু একটা নোট নিচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো আলমারির পাশে কেও আছে এবং সে আমাকে দেখছে। তাকাতেই দেখি, নেই তো! চোখ ফেরেলাম খাতায় আবার...
 
একটু পরে মনে হলো someone behind my back. আমি চোখ বোঝে নিজেকে বোঝালাম আমার মনের ভুল। nothing unusual at all. এমন সময় দরজায় শব্দ হলো, দরজা খুলে দিতে দাদা ঢুকলো। কিছু একটা বলতে গিয়ে আমার মুখ দেখে বললো কী হয়েছে? ভয়টা বোধহয় মুখে ধরা পড়েছিল। এড়িয়ে গেলাম আপাতত...
 
 
৪.
আরেকটি দিনের শুরু। রাতে একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি  আমাকে তুলে দিচ্ছে প্রায়। যে বাড়িতে আমরা থাকতাম, সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই হল রুম। বাম পাশে পরপর রান্না ঘর, বাথরুম. ছোট একটা জায়গা। ডানদিকে টানা তিনটি শোবার ঘর। সদর দরজার উল্টো দিকের ঘরটা তালা মারা।
 
সন্ধ্যায়  আমি গান ছেড়ে লেখা পড়া আরম্ভ করেছি, গানের শব্দ বন্ধ হয়ে অদ্ভুত আওয়াজ। ভাবলাম যান্ত্রিক গোলযোগ। বন্ধ করে আবার চালালাম। একই শব্দ। সব স্টেশন একই রকম। একটি কন্ঠ কিছু বলছে কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। সময় বোধহয় থমকে গিয়েছিল । চারিদিক শান্ত শুধু ঐ শব্দটি ছাড়া। মনে হলো কেউ ডাকলো আমায়, আমি যেন চেতনা ফিরে পেলাম।
 
যে ডাকলো ধরা যাক তাঁর নাম তুষার। দাদাদের ছোটবেলার বন্ধু। আমার আর এক দাদা। দরজায় নক করে সাড়া না পেয়ে ডাকা ডাকি করছে। বললাম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো। সত্যি কারন টা বলা হলো না।
 
 
৫.
এরপর থেকে প্রতি রাতে একটা সময় আমার ঘুম ভেঙে যেতে লাগল। চোখ খোলার পর ঘরের বাতাস ভারী মনে হয়। কারো উপস্থতিথি টের পাই কিন্তু দেখতে পাই না। এরপর একদিন বাহির থেকে  ঘরে ফিরেছি। বাথরুমে গিয়ে দেখি জলে ভরা মেঝে। যেন কেউ একটু আগে বাথরুমে ছিল। কিন্তু আমরা তো ছিলাম না। দাদা বললো কুঁজো ছিদ্র হয়েছে হয়তো। সকালে ভারী এসে দেখে বললো কোন ছিদ্র নেই। জল ভরে চলে গেল।
 
এবার আমি সত্যি ভয় পেলাম। দাদা কে বললাম। খুব একটা বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। রাতে আমার ঘরে শুতে গেলাম। ঘুম ভাঙতেই সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি। আমি স্পষ্ট বুঝলাম ঘরে কেও আছে। আমার পায়ের কাছে মশারির বাইরে কেও দাঁডিয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে সে বলতে আরম্ভ করলো” তুমি ভয় পাচছো কেন? আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করবো না। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই, এই দ্যাখো আমি তোমার পাশে বসছি” বলে সে মশারির এক পাশ তোলা আরম্ভ করলো। আর আমি? মশারির অন্যপাশ ঝাটকা মেরে তুলে দাদার ঘরে দৌড়ে গেলাম। দাদা কে তুললাম, বললাম আমার ঘরে কেও একজন আছে। দাদা কাওকে দেখতে পেলো না। সেই রাতে আমি দাদার ঘরেই শুলাম।
 
৬.
এই ভাবে কয়েক দিন দাদার ঘরেই শেয়ার করে ঘুমালাম। এক দিন তুষার দা তাঁর মাসতুত বোন কে নিয়ে আসলো আমার সাথে থাকার জন্য কিছুদিন। আমি তুষার দার দিকে তাকালাম।  তুষার দা না জানালো। বুঝলাম কিছু জানে না বুড়ি। আমি শুধু ভাবলাম না জানি কী হয় রাতে।  দু’জনে বারান্দায় বসে অনেক গল্প করলাম। এক সময় বুড়ি ঘুম পেয়েছে বলে উঠে পরলো। আমি কিছুক্ষন পরে আসছি বললাম। বারান্দায় থাকতে ভাল লাগছিল আর অবচেতন মনে বোধহয় অপেক্ষা করছিলাম আমি ভুল না সত্যি দেখেছি তা বোঝার জন্য। এইভাবে বারান্দায় কতক্ষন কেটেছে বলতে পারব না। হঠাৎ শুনলাম বুড়ি ডাকছে ঘুমাতে। আমি শুয়ে পড়লাম এসে। সকালে উঠে দেখি বুড়ি কাপড় চোপড় পড়ে তৈরী। কী ব্যপার ? সে থাকবে না। তাঁর মার জন্য খারাপ লাগছে। সে এখনই যাবে। সে চা ও খাবে না, তুষার দা তাকে নিয়ে গেল। খুব তাডাহুডো করে সে চলে গেল। দাদা ও তুষার দা অবাক।
 
আমি বুঝতে পারলাম কিছু দেখে সে ভয় পেয়েছে। তুষার দা ফিরে এলো। কী ব্যপার বুড়ি কিছু বলেছে? তুষার দা জানালো বুড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁর মাকে বলেছে সে আর কোনদিন এই বাড়িতে আসবে না। এই বাড়িতে ভূত আছে। কাল রাতে আমি যখন বারান্দায় ছিলাম বুড়ি শুয়ে পড়েছিল তখন সে পায়ের কাছে একজন কে দেখেছে এবং সেই অচেনা চেহারা তাঁর দিকে খুব রেগে মেগে তাকিয়ে ছিল। বুড়ির ঐ রুমে থাকাটা আমার সাথে পছন্দ করছে না  তুষার দা আমার হাতে একটা লোহার চাবি দিল। তাঁর মাসী চাবিটা বালিশের নীচে দিয়ে শুতে বলেছে। লোহা থাকলে ভূত ধারে কাছে আসবে না। বেশ, আমি লোহা বালিশের নীচে রেখে শুয়ে পড়লাম। আজ আমি দরজায় ছিটকিনি না দিয়ে এমনি আলগা বন্ধ করলাম। বই পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
 
৭.
ঘুম ভাঙতে ফ্যানের শব্দ শুনতে পেলাম। ফ্যানের বাতাসে মশারিটা দুলছে, রাস্তার আলো আমার ঘরে এসে পরছে। চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম, না কোথাও কিছু নেই। একটু স্বস্তি পেলাম, ভাবলাম চাবিটা কাজ দিলো তাহলে। চোখ বোঝার পরপরই মনে হলো মশারির বাইরে কেও দাঁডিয়ে। এবার পায়ের কাছে নয়, আমার শরীরের মাঝ বরাবর নিশ্বাস ফেলছে।
 
এই অনুভূতি আমাকে চোখ খুলতে বাধ্য করলো। চোখ মেলতে তার দিকে তাকালাম আমি। চোখে চোখ পড়তে সে বলতে লাগলো  বেশ রেগে মেগে“ কী ভেবেছো, তোমার ঐ লোহা আমার হাত থেকে বাঁচাবে? আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করতে চাই নি, শুধু তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমার পাশে থাকতে চেয়ে ছিলাম। তুমি কেন ওদের কথা শুনলে? এই দ্যাখো, আমি মশারির ভিতর তোমার পাশে বসবো। ঐ লোহায় আমার কিছু হবে না, আজ আমি তোমাকে ছোঁব। আমি ভূত নই, আমি আত্মার প্রেতাত্মা। এই বাড়ির এই ঘরে আমি আত্ম হত্যা করেছিলাম। আমার দেহটা পুড়ে গেছে। কিন্তু আমার অতৃপ্ত জীবন, আমার বিষাদ, অতৃপ্ত আত্মা এই বাড়িতে রয়ে গেছে। আমি ছেলেটির পুরো অববয় দেখতে পারছিলাম। প্রায় আমারই বয়সী সে, হয়তো একটু বড় হবে।
 
“আমি তোমাকে পাহারা দিচ্ছিলাম শুধু। তুমি একা থাক, যাতে তোমার কোন ক্ষতি না হয়, আমি পাশে আছি এটাই বোঝাতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি বুজলে না। এই যে আমি ঢুকছি তোমার বিছানায়। “মশারি তোলার সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে সে আমাকে ছুঁতে গেল। অদ্ভুত   স্পর্শ! তীব্র ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে, বিছানা থেকে লাফ মেরে দাদার কাছে গেলাম। আমার শরীর কাঁপছিল। কাঁদতে কাঁদতে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। মেঝে তে বিছানা করে দাদার পাশে শুলাম, আর বললাম আমি ঐ ঘরে আর শোব না। কিছু একটা আছে ঐ রুমে। তারপরের দিন তুষার দা ঐ ঘরে শুলো। সকালে বললো সে ঐ ঘরে শোবে না। দাদা কে শুতে দিলাম না। এর কিছুদিন পর আমরা বাড়ি ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ছেলেটির কন্ঠ স্বর “আমি আত্মার প্রেতাত্মা” আজো আমি ভুলতে পারিনি ...

⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN

🔗 MY OTHERS CHANNELS

🔗 FOLLOW ME

🔗 MY WEBSITE

🔗 CALL ME
+8801819515141

🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com 

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.