আলিফ লায়লা : আরব্য রজনী_পর্ব-৫৫
নেকড়ে আর খেঁকশিয়ালের কাহিনী
পরদিন
একশো
উনপঞ্চাশতম
রজনী।
সে এক নেকড়ে আর খেঁকশিয়ালের কাহিনী বলতে শুরু করে :
এক
খেঁক
শিয়াল
তার
মালিক
নেকড়ের
প্রতি
নিয়ত
দুর্ব্যবহারে
অতিষ্ঠ
হয়ে
রাগে
ফুঁসতে
থাকে।
গাছের
কোটরে
বসে
বসে
ভাবে,
কি
করে
এই
শয়তান
নেকড়েটির
হাত
থেকে
নিস্কৃতি
পাওয়া
যায়।
ভাবতে
ভাবতে
নেকড়েটাকে
খুঁজতে
থাকে।
অবশেষে
তাকে
দেখতে
পেয়ে
মনের
রাগ
চেপে
মুখে
কপট
হাসি
টেনে
তার
কাছে
এগিয়ে
গিয়ে
বিনয়ে
বিগলিত
হয়ে
দাঁড়ায়।
নেকড়েটা
অকথ্য
ভাষায়
গালাগাল
দিয়ে
খোঁকিয়ে
ওঠে,
এই
শয়তান
কুকুরের
বাচ্চা
কুকুর,
কিরে,
ব্যাপার
কী?
খেঁকশিয়ালটা
ততোধিক
বিনীত
হয়ে
বলে,
মালিক,
আমার
মাথায়
একটা
জব্বর
বুদ্ধি
এসেছে।
আপনি
যদি
ধৈর্য
ধরে
শোনেন—
নেকড়ে ধমক দিয়ে বলে, বাজে লম্বা ভনিতা ছেড়ে আসল কথাটা কি তাই বল। তা না হলে মেরে হাড় ভেঙে দেব।
খেঁকশিয়াল বলে, আমি কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি হুজুর, আদমকিনটা আমাদের সঙ্গে শয়তানী আরম্ভ করেছে। সারা জঙ্গলটায় সে এক বিরাট ফাঁদ পেতেছে। তার অত্যাচারে সবাই ভয়ে তটস্থ। সে যেন একটা জ্বলন্ত বিভীষিকা। আমরা যদি সবাই মিলে এক জোট হয়ে তাকে না শায়েস্তা করতে পারি তা হলে সমূহ বিপদ।
খেঁকশিয়ালের এই অযাচিত উপদেশে নেকড়ে তেলবেগুনে জ্বলে ওঠে।-ওরে গিধড়, তুই তোর নিজের চরকায় তেল দে। ওসব আজগুবি উদ্ভট কল্পনা করে মগজটাকে নষ্ট করিস নে। ফের যদি শুনি এই মোড়লি কথাবার্তা-মেরে হাড়মাস আলাদা করে দেব।
এই শুনে খেঁকশিয়াল উঠে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি টেনে হাত জোড় করে বলে, আমি যদি কিছু অন্যায় বলে থাকি, আমাকে মাফ করবেন মালিক। আমি নেহাতই বোকা-সোকা প্ৰাণী। কি বলতে কি বেফাঁস বলে ফেলেছি—আপনি মহানুভব প্রভু, নিজ গুণে আমাকে ক্ষমা করে দিন।
খেঁকশিয়ালের এই তোষামদে নেকড়ে কিছুটা নরম হয়।-ঠিক আছে, আজকের মতো ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু মনে থাকে যেন, ভবিষ্যতে আর কখনও, যা বুঝিস না সে-সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবি না। যে কথা তোর মুখে সাজে সেইটুকুই শুধু বলবি। কোনও ফালতু কথা আমি বরদাস্ত করতে পারি না।
–যা বলেছেন হুজুর। পীর-পয়গম্বররা বলে গেছেন, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না? আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করলে গায়ে পড়ে কোনও উত্তর দেবে না। সব সময় নিজের চরকায় তেল দিয়ে যাবে। অন্যের ব্যাপারে অহেতুক নাক গলাবে না।
খেঁকশিয়াল মনে মনে ভাবতে থাকে, ঠিক আছে রে, নেকড়ের বাচ্চা, দিন আমার আসবে, তখন তোমায় আমি দেখে নেবো। আমারও নাম খেঁকশিয়াল–! এখন আমার হাতে ক্ষমতা নাই, গায়ে জোর নাই বলে তোমার সব অপমান, সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছি, কিন্তু মনে রেখ, নেকড়ে, চাকা একদিন ঘুরবেই।
—হুজুর, আপনি তো জানেন, খেঁকশিয়াল করজোড়ে নিবেদন করে, ন্যায় বিচারই পুণ্য। আর ক্ষমা উদারতা। আমার দোষ পর্বত প্রমাণ, আমি জানি। সেই সঙ্গে আমার অনুশোচনাও অসীম। আপনার চমৎকার লাথিটা আমাকে আহত করেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে আমার মনের অন্ধকার কেটে গেছে, আমি প্রভাত সূর্যের নতুন আলো প্রত্যক্ষ করছি।
নেকড়ে প্রীত হয়ে বলে, তোমার চৈতন্য হয়েছে দেখে খুশি হলাম। তোমাকে লাথি মেরে আমিও স্বস্তি পাইনি। যাই হোক, এর পর থেকে সমঝে চলবে, যাতে আমাকে ঐরকম রুষ্ট আচরণ আর না করতে হয়।
খেঁকশিয়াল দুই পা মাথায় ঠেকিয়ে প্রার্থনা জানায়, আল্লাহ আপনাকে আরও ক্ষমতাবান করুন, এই প্রার্থনা করি। আপনার জয়জয়কারে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে–হবে।
নেকড়ে বলে, এখন এসো। আজ থেকে তুমি আমার বিশ্বস্ত অনুচর হলে। যদি কোনও দেবার মতো খবর পাও, সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।
খেঁকশিয়াল বলে, যথা আজ্ঞা হুজুর।
এই বলে সে বনের মধ্যে চলে যায়। চলতে চলতে এক সময় সে এক দ্রাক্ষাকুঞ্জে এসে পড়ে। খেঁকশিয়াল জানতো এইখানে একটা মস্ত খাদ আছে। এই কারণে এ পথটা সে এডিয়ে চলে। মহাপুরুষেরা বলেছেন, দেখে শুনে পথ চলো। না হলে পতন অনিবার্য। খেঁকশিয়াল ভাবে, আদমকিনের নানারকম ছদ্মবেশ এবং তার ছলচাতুরী আমার জানা হয়ে গেছে। যদি দেখি, এই দ্রাক্ষাবনে খেঁকশিয়ালের কোনও নকল মূর্তি রাখা আছে তা হলে আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়াবো না। বুঝবো, এ আর কেউ নয়, সেই আদমকিনের নতুন কোনও ফাঁদ।
পা টিপে টিপে সে এগুতে থাকে। পিছনের দিকটা ভালো করে দেখে নেয়। এখানে ওখানে মাটি শুকে শুকে কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করে। একটু কোনও আওয়াজ পেলেই কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। এইভাবে সে ঐ বিপদসঙ্কুল পথটুকু অতিক্রম করে চলে আসে। একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। মনে হয় সামনে একটা গর্ত। কে বা কারা কিছু ডালপালা আর মাটি দিয়ে গর্তের মুখটা বন্ধ করে গেছে। এক অজানা আনন্দে নেচে ওঠে তার হৃদয়।
একটু পুরে নেকড়ের সঙ্গে দেখা করে সে বলে, একটা সুখবর আছে, জনাব। মনে হচ্ছে, সৌভাগ্যের দরজা এবার খুলে গেলে।
নেকড়ে ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলে, কাব্যি রাখ, সাফ কথা কি–সোজা বাৎ বল দেখি বাপু।
খেঁকশিয়াল বলে দ্রাক্ষাবনে আজ আনন্দের লহর ছুটেছে। বনের মালিক দেহ রেখেছে পাশেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি।
—বেশ করেছি। তা এখানে হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন? গতরখানা নড়াও না! যাও, সেখানে গিয়ে পাহারা দাও। আমি যাচ্ছি।
খেঁকশিয়াল আগে আগে চলতে থাকে। নেকড়ে তার পিছনে পিছনে যায়।
খেঁকশিয়াল বলে, এই সেই জায়গা হুজুর।
থোকা থোকা পাকা আঙুর দেখে নেকড়ে আর লোভ সামলাতে পারে না। প্রচণ্ড একটা লাফ দিয়ে আঙুরগুলো পাড়তে চায়। কিন্তু নিজের দেহের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পেরে আছাড় খেয়ে নিচে পড়ে যায়। আর পড়বি তো পড় একেবারে সেই ডালপালা চাপা দেওয়া গর্তটিার মুখেই গিয়ে সে পড়ে। আসলে ঐ গর্তটা একটা ফাঁদ। নেকড়ের দেহের ভরে গর্তটার মুখ খুলে আলগা হয়ে পড়ে। আর পুরো দেহটা ঢুকে যায়। গর্তের নিচে।
খেঁকশিয়াল আনন্দে লাফাতে থাকে। নেকড়ে তখন ওপরে ওঠার জন্যে নানারকম কায়দা কসরৎ করে চলেছে। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। অসহায়ের মতোকাঁদতে থাকে সে।
খেঁকশিয়ালটাও ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। নেকড়ে মাথা তুলে বলে, বন্ধু এখন কি কান্নার সময়! একটা উপায় বের করো-যাতে আমি উপরে উঠতে পারি। জানি, এক সময়ে আমি তোমার উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছি। কিন্তু সে-সব কথা এখন তো মনে করলে চলে না ভাই। তুমি আমার বউ বাল-বাচ্চাদের একটা খবর দাও। তারা এসে দেখুক, আমি কি বিপদে পড়েছি।
খেঁকশিয়ালটা খেঁকিয়ে ওঠে, ওরে হতচ্ছাড়া পাঁজি বদমাইশ, তুই কি ভাবছিস, তোর দুঃখে। আমি কাতর হয়ে কেঁদেছি। আমি কেঁদেছি তার কারণ, তোর মতো একটা শয়তানের হাত থাকে আরও আগে কেন রক্ষা পাইনি। কেঁদেছি এই কারণে যে, তোর এই আজকের দশা এক বছর আগে কেন হয়নি। তাহলে হাড়ে আমার বাতাস লাগতো। এবার তুই মর, তোর কবরে আমি থুথু ফেলবো, মর-মার। আমরা দল বেঁধে মহচ্ছিব করবো।–তুই এক্ষুণি মর রে হতভাগা।
নেকড়ে কাতরভাবে মিনতি করে, এখন কি এসব কথা বলার সময় বন্ধু! তুমিই আমার একমাত্র ভরসা, অগতির গতি। এ বিপদে তুমি না। উদ্ধার করলে কেউ আমাকে বীচাবে না ভাই। এই তো কিছুক্ষণ আগেও তুমি আমাকে কত ভালো ভালো জ্ঞানের কথা শোনালে। কত প্রতিজ্ঞ করলে। সে-সব কি এর মধ্যে ভুলে গেলে ভাই? এ কথা ঠিক, তোমার সঙ্গে আগে আমি একটু আধটু খারাপ ব্যবহার করেছি। কিন্তু সে-কথা কি এখন মনে রাখলে চলে?
-ওরে
বোকা
পাঠা,
নেকড়ে
তুই
এখন
বলছিস
একটু
আধটু
খারাপ
ব্যবহার
করেছিস?
ওরে
শয়তান,
তোর
সেই
কলজে-ফাটা
লাথির
ব্যথা
তো
এখনও
আমার
যায়নি।
এর
মধ্যেই
তা
ভুলে
গেছিস।
তোর
প্রতিটি
দিনের
অত্যাচারের
কোনও
কথা
আমি
ভুলিনি।
সেই
কারণেই
তোর
এই
মরণ
দশায়
সবচেয়ে
আমি
বেশি
খুশি
হয়েছি।
নেকড়ে করুণ ভাবে মিনতি জানায়, তুমি কত মহৎ, কত উদার। আজ এই বিপদের সময় তোমার মনে যত দুঃখই দিয়ে থাকি, তুমি আমাকে উদ্ধার করবেই। আমি জানি, যা বলছি সবই তোমার মুখের কথা-মজা করছি। আসলে তোমার অন্তরটা খুব নরম। ও সব কথা থাক ভাই। এখন তুমি একটা রশি এনে গাছের ডালে বেঁধে আমার কাছে নামিয়ে দাও। আমি উঠে আসি। তারপর দেখে নিও, সারা জীবন ধরে তোমাকে মাথায় করে রাখবো।
—ধীরে, বন্ধু ধীরে। তোমার ভালো ভালো মধু মাখা কথাগুলো এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে, সখা? গর্তটা থেকে তোমার আত্মাটাই শুধু উঠে আসতে পারবে। কিন্তু দেহটা নৈব নৈব চ। এর জন্যে তুমিই একমাত্র দায়ী। এত দিন তুমি কাউকেই মানুষ জ্ঞান করনি। ধরাকে সরা মনে করেছি। তার প্রতিফল পেতে হবে না! ওহে মাথা মোটা নির্বোধি-উদ্ধত জানোয়ার, সেই বাজপাখির কাহিনী কি তুমি শোনোনি?
নেকড়ে
বলে,
বাজপাখির
আবার
কি
কাহিনী?
খেঁকশিয়াল
বলে,
তবে,
শোনো
: আমি
একদিন
এই
দ্রাক্ষাবনে
আঙুর
পেড়ে
পেড়ে
খাচ্ছি,
এমন
সময়
দেখলাম,
একটা
বিরাট
বাজ
এসে
বাঁপিয়ে
পড়লো
একটা
ছোট্ট
তিতির
পাখির
উপর।
যাইহোক,
আল্লাহর
দোয়াতে
তিতির
সে
যাত্ৰাটুক
করে
নিজের
গর্তের
মধ্যে
ঢুকে
পড়ে
প্রাণরক্ষা
করতে
পেরেছিলো।
বাজ
কিন্তু
আশা
ছাড়ে
না।
গর্তের
মুখে
ঘাপটি
মেরে
বসে
থাকে।
কখন
সে
বেরুবে
সেই
প্রত্যাশায়।
মনে
মনে
বলে,
আমার
ছোবল
থেকে
তুমি
রেহাই
পাবে?
তা
কি
কখনও
হয়।
সেই
ধরা
তুমি
দেবেই,
মাঝখান
থেকে
খানিক
হয়রানি
করবে।
আমাকে-এই
আর
কি!
তারপর
একটু
চড়া
সুরেইশতিতিরকে
শুনিয়ে
শুনিয়ে
বলতে
থাকে,
ওহে
ছোট্ট
সোনা, আত ভয় পাওয়ার কি আছে? বেরিয়ে এসো। আমি জানি তোমার খুব খিদে পেয়েছে। তাই তোমাকে ধরে কিছু দানা খাওয়াতে চেয়েছিলাম। আর তুমি আমনি ভয় পেয়ে গর্তে ঢুকে গেলে? বোকা মেয়ে কোথাকার—বেরিয়ে এসো। খিদে পায়নি বুঝি?? বেরিয়ে এসো, দেখ, কি সুন্দর সব দানা এনেছি, পেট পুরে খাও। তুমি তো জানো না, তোমাকে আমি কত ভালোবেসে ফেলিছি। বেরিয়ে এসো, সোনা লক্ষ্মী মেয়ে।
রাজ্যের মধুঢালা কথায় বিশ্বাস করে বোকা-সরল তিতির গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। আর তৎক্ষণাৎ হিংস্র বাজ টুক করে তার থাবার মধ্যে পুরে নেয়। তাকে।
তিতিরের প্রাণ যায় যায়। রাগে সে ফেটে পড়ে, ওরে শয়তান বদমাইশ বিশ্বাসঘাতক, এই তোর মনে ছিলো। আমাকে খেয়ে ভাবছিস হজম করবি। আল্লাহর দোয়ায় তোর পেটে ঢুকে আমি জহির হবো। তোরও জান শেষ করবো।
বাজ কিন্তু তার কথায় ভ্বক্ষেপ করলো না। মুখে পুরে গিলে ফেললো। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য, আল্লাহর কি অপোর মহিমা, তিতিরের আকুল প্রার্থনা তিনি বুঝি শুনেছিলেন, পাখিটাকে গিলতে না গিলতেই বাজপাখিটা চিৎপাৎ হয়ে পড়ে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ।
শুনলে তো হে নেকড়ে? তোমারও আজ সেই দশা। অধৰ্ম অবিচার অত্যাচার চিরকাল চলে ন। একদিন তার প্রতিফল পেতেই হয়। তুমি আমার ওপর এতকাল যে দুর্ব্যবহার করে এসেছ বিনা দোষে আমাকে লাথি-বঁটা মেরেছি, আজ সেই বিচারের দিন। আল্লাহ তার যোগ্য শাস্তিরই ব্যবস্থা করেছেন।
নেকড়ে আকুলভাবে কাঁদতে থাকে, দয়া করো বন্ধু, দয়া করো। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। দেখো, আমি এ ঋণ তোমার শোধ করে দেব। আমিই তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু হবো। আমার মতো সুপরামর্শদাতা তুমি আর পাবে না জীবনে।
চতুর খেঁকশিয়াল কিন্তু নেকড়ের মিষ্টি কথায় ভোলে না।–তুমি দেখছি কোনও নীতি কথাই
-কী নীতি কথা?
খেঁকশিয়াল
বলে,
মহাজনরা
বলে
গেছেন,
তোমার
মতো
হত।
কুৎসিৎ
চেহারার
লোক-এর
চোখের
শয়তানী
দেখেই
মনের
আসল
চেহারা
পড়ে
নিতে
হবে।
এতক্ষণ
তুমি
যে-সব
সুন্দর
কথা
বলে
গেলে
তা
পরম
উপাদেয়।
কিন্তু
বন্ধু,
তোমার
মুখের
সারল্য
কোথায়।
তোমার
চোখ
দুটো
আমন
শয়তানীতে
ভরা
কেন
বলতে
পারো?
তুমি
আমাকে
সুপরামর্শ
দান
করবে
বলে
আশ্বাস
দিয়েছ।
খুব
ভালো
কথা।
কিন্তু
একটা
কথা
বলি
নেকড়ে
মশাই,
তোমার
ঘটে
যদি
অতখানিই
বুদ্ধি
থাকবে
তবে
কি
আজ
এই
গর্তে
পড়ে
প্রাণ
হারাতে
বসে।
নিজেকে
খুব
ধূর্ত
চালাক
ভাবো।–তাই
না?
তোমার
মতো
হাঁদা
আমি
আর
দুটি
দেখিনি।
তাহলে
আমার
কথায়,
আগে
পিছে
বিবেচনা
না
করেই,
দ্রাক্ষাবনে
হুড়পাড়
করে
এলে
কেন?
আর
এলেই
যদি
আমন
নির্বোধের
মতো
লম্ফঝৰ্ম্মফ
বা
করতে
গেলে
কেন?
সামনে
যে
একটা
অজানা
আশঙ্কা
থাকতে
পারে,
আগে
তা
ভালো
করে
পরীক্ষা
করে
দেখলে
না
কেন?
ঘটে
নাই
এক
ছটাক-অন্যকে
দেবে
উপদেশ!
তোমার
দশা
দেখে
সেই
ডাক্তারের
কাহিনী
মনে
পড়ছে।
—আবার কাহিনী?
খেঁকশিয়াল
বলতে
থাকে
: এক
ভদ্রলোকের
ডান
হাতে
একটা
আবি
হয়েছিলো।
দিন
দিন
আবটা
এমনি
বড়
হতে
থাকলো
যে
ব্যথায়
সে
আর
কাজ
কাম
করতে
পারে
না।
শহরের
নামজাদা
ডাক্তারকে
সে
ডেকে
পাঠায়।
ডাক্তার
এলো।
তার
এক
চোখে
পটি
বাঁধা।
রুগী
প্রশ্ন
করে,
ডাক্তারবাবু,
আপনার
চোখে
কি
হয়েছে?
ডাক্তার
জবাব
দেয়,
চোখে
একটা
আবি
উঠেছে,
বাপু।
চোখটা
প্রায়
বন্ধই
হয়ে
যাচ্ছে।
রুগী অবাক হয়, সে কি আপনি না ডাক্তার। আপনার নিজের চোখে আবি হয়েছে।–তাই আপনি সারাতে পারছেন না? তাহলে আমার আবে সারাবেন কি করে? থাক, আর দরকার নাই। এবার আপনি আসুন।
সুতরাং নেকড়ে মশাই বুঝতে পারলেন, অন্যের রোগ সারাবার আগে নিজের রোগটা সারাবার যোগ্যতা আছে কি না সে একবার যাচাই করে দেখা ভালো না, কী? আজ যে বিপদে তুমি পড়েছ তা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্যে তোমার মূল্যবান মগজের খানিকটা অন্তত খরচ করো। নিজে বাঁচলে তো বাপের নাম। তারপর আমাকে উপদেশ দেবার স্পর্ধা করো। আর তো যদি না পারো, যেখানে এখন পড়েছ–সেখানেই থাকো-যতদিন বাচো। কেমন?
নেকড়ে
হাউ
মাউ
করে
কাঁদতে
থাকে।—বন্ধু
তোমার
লেজটা
নিচে
নামিয়ে
দাও,
আমি
ওটা
ধরে
উপরে
উঠে
আসি।
আগে
যে
সব
দুর্ব্যবহার
তোমার
সঙ্গে
আমি
করেছি।
তার
জন্যে
আমি
অনুতপ্ত
ভাই!
তুমি
আমাকে
একটিবার
ক্ষমা
করো।
আমি
কথা
দিচ্ছি।
আমার
থাবার
নখগুলো
ঘসে
সমান
করে
দেব।
আর
এই
লম্বা
লম্বা
দাঁতগুলো—সব
আমি
সাঁড়াশী
দিয়ে
টেনে
তুলে
ফেলে
দেব।
নখ
আর
দাঁত
যদি
না
থাকে
তা
হলে
ঝগড়া
বিবাদই
বা
করবো
কি
দিয়ে।
মাছ
মাংস
ছোব
না,
বলতে
গেলে
নদীর
জল
খেয়েই
প্ৰাণ
ধারণ
করবো।
দেখবে
তখন
আমি
কি
সাত্ত্বিক
লোক
হয়ে
গেছি।
সব
সময়
আল্লাহর
নামগান
করেই
কাটাবো।
কিন্তু এতেও ডাল গলে না। খেঁকশিয়াল মিষ্টি কথায় ভুলবোর পাত্র নয়।-একটা দুষ্ট, খল, শঠ, শয়তান তার স্বভাব্যচরিত্র রাতারাতি পালটাতে পারে এরকম কোন নজির ইতিহাসে নাই। তুমি কি নব-ইতিহাস রচনা করতে চাও, নেকড়ে সন্তান? তুমি আমাকে অতোই বোকা পাঠা পেয়েছ, তুমি বললে আর আমনি আমার লেজটা নামিয়ে দেব তোমার থাবায়। আমি এখন দেখতে চাই, কি করে তুমি তিলে তিলে মর। পীর পয়গম্বররা কি বলে গেছেন জানতো? দুষ্কৃত নিধনেই পৃথিবী পাপমুক্ত হতে পারে।’
নেকড়ে তখন তার সামনের পা দু’খানা একত্র করে করজোড়ের ভঙ্গীতে বলে, প্রাণের বন্ধু খেক, তুমি কত বড় খানদানী ঘরের সন্তান। তোমাদের বংশের খ্যাতি জগৎজোড়া। তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা, আচার বিনয় বিদ্যার কোনও তুলনা নাই। তোমাদের বিচার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত। তোমাদের সততা উদারতা মহত্ব-এর কাহিনী দিগদিগন্তে ছড়িয়ে আছে। সর্বোপরি পরোপকারই তোমাদের জীবনের একমাত্র ব্বত। একথা তো সবাই জানে বন্ধু।
নেকড়ের এই তোষামোদের ঢং দেখে খেঁকশিয়াল হেসে আর বাঁচে না। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। আর কি? বলে, তোমার দেখি এখনও শৈশবদশী কাটেনি। তুমি মুখ জানতাম, কিন্তু এতটা মুখ ভাবতে পারিনি। শোনো, তোমাকে একটু জ্ঞান দিই। সব রোগই হয়তো সারাতে পারে, কিন্তু মৃতকে জীবন দান করা যায় না। হীরা ছাড়া সব বস্তুতে ভেজাল মেশানো সম্ভব। আমরা সবই এড়াতে পারি, একমাত্র নিয়তি ছাড়া।
এই মাত্র তুমি বললে, আমি যদি তোমাকে উদ্ধার করি, সারা জীবন তুমি আমার অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে থাকবে। সেই খল সাপের কাহিনী শুনেছি? তবে শোনো : একটা সাপ একদিন কোনও ক্রমে সাপুড়ের ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। অনেক দিন তাকে না খেতে দিয়ে ঝুডিতে ভরে রাখার ফলে তার দেহে কোন শক্তি ছিলো না। তাই শত চেষ্টা করেও সে পালাতে পারছে না দেখে এক পথচারীর প্রাণে মায়া হলো। সাপটাকে কাঁধে করে সেবাড়ি নিয়ে গেলো। নিয়মিত দুধকলা খাইয়ে বেশ তাগড়াই করে তুললো তাকে। সাপ যেদিন বুঝতে পারলো এবার সে একাই যত্রতত্র চলাফেরা করতে পারবে, প্রথম রাতেই সে তার জীবনদাতার মাথায় ছোবল; বসিয়ে দিলো। এবং বলাবাহুল্য, সেই ছোবলের বিষে তার প্রাণান্ত ঘটেছিলো।
সুতরাং নেকড়ে ভায়া, আর নয়, এবার চলি, টা টা।
খেঁকশিয়ালটা বাইরে বেরিয়ে এসে একটা উঁচু টিলার উপরে দাঁড়িয়ে হুক্কা হুয়া—হুক্কা হুয়া করে চিৎকার করতে থাকলো। তার চিৎকারে আঙুর ক্ষেতের মালিক ছুটে আসে। খেঁকশিয়াল ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে নেকড়ের গর্তটার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে।
মালিক ভিতরে ঢুকে গর্তের নিচে নেকড়েকে দেখে ইয়া বড় বড় পাথরের চাই এনে ওর মাথার উপর ফেলতে লাগলো। খেঁকশিয়াল শুনতে পায়—মৃত্যুর আগে যেমন আকাশ-ফাটা চিৎকার দেয় তেমনি এক শেষ চিৎকার দিয়ে নেকড়েটা নীরব হয়ে গেলো।
এই সময় শাহরাজাদ গল্প শেষ করে একটুক্ষণের জন্য থামালো। দুনিয়াজাদ এক গেলাস পিস্তার সরবৎ এনে হাতে দেয়। সরবৎটুকু খেয়ে শাহরাজাদ বলে, এবার বলুন, জাঁহাপনা, কেমন শুনলেন?
বাদশাহ
শারিয়ার
উৎফুল্ল
হয়ে
বলে,
চমৎকার।
নিশ্চয়ই
নেকড়েটাকে
হত্যা
করা
হয়েছিলো।
এরকম
শয়তানের
মৃত্যুই
একমাত্র
সাজা।
আমি
খুব
খুশি
হয়েছি।
এর
পর,
অন্ধবিশ্বাসের
পরিণাম
যে
শুভ
হয়
না—সেই
নিয়ে
একটা
কাহিনী
শোনাও।
সে এক নেকড়ে আর খেঁকশিয়ালের কাহিনী বলতে শুরু করে :
নেকড়ে ধমক দিয়ে বলে, বাজে লম্বা ভনিতা ছেড়ে আসল কথাটা কি তাই বল। তা না হলে মেরে হাড় ভেঙে দেব।
খেঁকশিয়াল বলে, আমি কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি হুজুর, আদমকিনটা আমাদের সঙ্গে শয়তানী আরম্ভ করেছে। সারা জঙ্গলটায় সে এক বিরাট ফাঁদ পেতেছে। তার অত্যাচারে সবাই ভয়ে তটস্থ। সে যেন একটা জ্বলন্ত বিভীষিকা। আমরা যদি সবাই মিলে এক জোট হয়ে তাকে না শায়েস্তা করতে পারি তা হলে সমূহ বিপদ।
খেঁকশিয়ালের এই অযাচিত উপদেশে নেকড়ে তেলবেগুনে জ্বলে ওঠে।-ওরে গিধড়, তুই তোর নিজের চরকায় তেল দে। ওসব আজগুবি উদ্ভট কল্পনা করে মগজটাকে নষ্ট করিস নে। ফের যদি শুনি এই মোড়লি কথাবার্তা-মেরে হাড়মাস আলাদা করে দেব।
এই শুনে খেঁকশিয়াল উঠে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি টেনে হাত জোড় করে বলে, আমি যদি কিছু অন্যায় বলে থাকি, আমাকে মাফ করবেন মালিক। আমি নেহাতই বোকা-সোকা প্ৰাণী। কি বলতে কি বেফাঁস বলে ফেলেছি—আপনি মহানুভব প্রভু, নিজ গুণে আমাকে ক্ষমা করে দিন।
খেঁকশিয়ালের এই তোষামদে নেকড়ে কিছুটা নরম হয়।-ঠিক আছে, আজকের মতো ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু মনে থাকে যেন, ভবিষ্যতে আর কখনও, যা বুঝিস না সে-সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবি না। যে কথা তোর মুখে সাজে সেইটুকুই শুধু বলবি। কোনও ফালতু কথা আমি বরদাস্ত করতে পারি না।
–যা বলেছেন হুজুর। পীর-পয়গম্বররা বলে গেছেন, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না? আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করলে গায়ে পড়ে কোনও উত্তর দেবে না। সব সময় নিজের চরকায় তেল দিয়ে যাবে। অন্যের ব্যাপারে অহেতুক নাক গলাবে না।
খেঁকশিয়াল মনে মনে ভাবতে থাকে, ঠিক আছে রে, নেকড়ের বাচ্চা, দিন আমার আসবে, তখন তোমায় আমি দেখে নেবো। আমারও নাম খেঁকশিয়াল–! এখন আমার হাতে ক্ষমতা নাই, গায়ে জোর নাই বলে তোমার সব অপমান, সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছি, কিন্তু মনে রেখ, নেকড়ে, চাকা একদিন ঘুরবেই।
—হুজুর, আপনি তো জানেন, খেঁকশিয়াল করজোড়ে নিবেদন করে, ন্যায় বিচারই পুণ্য। আর ক্ষমা উদারতা। আমার দোষ পর্বত প্রমাণ, আমি জানি। সেই সঙ্গে আমার অনুশোচনাও অসীম। আপনার চমৎকার লাথিটা আমাকে আহত করেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে আমার মনের অন্ধকার কেটে গেছে, আমি প্রভাত সূর্যের নতুন আলো প্রত্যক্ষ করছি।
নেকড়ে প্রীত হয়ে বলে, তোমার চৈতন্য হয়েছে দেখে খুশি হলাম। তোমাকে লাথি মেরে আমিও স্বস্তি পাইনি। যাই হোক, এর পর থেকে সমঝে চলবে, যাতে আমাকে ঐরকম রুষ্ট আচরণ আর না করতে হয়।
খেঁকশিয়াল দুই পা মাথায় ঠেকিয়ে প্রার্থনা জানায়, আল্লাহ আপনাকে আরও ক্ষমতাবান করুন, এই প্রার্থনা করি। আপনার জয়জয়কারে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে–হবে।
নেকড়ে বলে, এখন এসো। আজ থেকে তুমি আমার বিশ্বস্ত অনুচর হলে। যদি কোনও দেবার মতো খবর পাও, সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।
খেঁকশিয়াল বলে, যথা আজ্ঞা হুজুর।
এই বলে সে বনের মধ্যে চলে যায়। চলতে চলতে এক সময় সে এক দ্রাক্ষাকুঞ্জে এসে পড়ে। খেঁকশিয়াল জানতো এইখানে একটা মস্ত খাদ আছে। এই কারণে এ পথটা সে এডিয়ে চলে। মহাপুরুষেরা বলেছেন, দেখে শুনে পথ চলো। না হলে পতন অনিবার্য। খেঁকশিয়াল ভাবে, আদমকিনের নানারকম ছদ্মবেশ এবং তার ছলচাতুরী আমার জানা হয়ে গেছে। যদি দেখি, এই দ্রাক্ষাবনে খেঁকশিয়ালের কোনও নকল মূর্তি রাখা আছে তা হলে আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়াবো না। বুঝবো, এ আর কেউ নয়, সেই আদমকিনের নতুন কোনও ফাঁদ।
পা টিপে টিপে সে এগুতে থাকে। পিছনের দিকটা ভালো করে দেখে নেয়। এখানে ওখানে মাটি শুকে শুকে কি যেন অনুভব করার চেষ্টা করে। একটু কোনও আওয়াজ পেলেই কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। এইভাবে সে ঐ বিপদসঙ্কুল পথটুকু অতিক্রম করে চলে আসে। একটা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। মনে হয় সামনে একটা গর্ত। কে বা কারা কিছু ডালপালা আর মাটি দিয়ে গর্তের মুখটা বন্ধ করে গেছে। এক অজানা আনন্দে নেচে ওঠে তার হৃদয়।
একটু পুরে নেকড়ের সঙ্গে দেখা করে সে বলে, একটা সুখবর আছে, জনাব। মনে হচ্ছে, সৌভাগ্যের দরজা এবার খুলে গেলে।
নেকড়ে ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলে, কাব্যি রাখ, সাফ কথা কি–সোজা বাৎ বল দেখি বাপু।
খেঁকশিয়াল বলে দ্রাক্ষাবনে আজ আনন্দের লহর ছুটেছে। বনের মালিক দেহ রেখেছে পাশেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি।
—বেশ করেছি। তা এখানে হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন? গতরখানা নড়াও না! যাও, সেখানে গিয়ে পাহারা দাও। আমি যাচ্ছি।
খেঁকশিয়াল আগে আগে চলতে থাকে। নেকড়ে তার পিছনে পিছনে যায়।
খেঁকশিয়াল বলে, এই সেই জায়গা হুজুর।
থোকা থোকা পাকা আঙুর দেখে নেকড়ে আর লোভ সামলাতে পারে না। প্রচণ্ড একটা লাফ দিয়ে আঙুরগুলো পাড়তে চায়। কিন্তু নিজের দেহের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পেরে আছাড় খেয়ে নিচে পড়ে যায়। আর পড়বি তো পড় একেবারে সেই ডালপালা চাপা দেওয়া গর্তটিার মুখেই গিয়ে সে পড়ে। আসলে ঐ গর্তটা একটা ফাঁদ। নেকড়ের দেহের ভরে গর্তটার মুখ খুলে আলগা হয়ে পড়ে। আর পুরো দেহটা ঢুকে যায়। গর্তের নিচে।
খেঁকশিয়াল আনন্দে লাফাতে থাকে। নেকড়ে তখন ওপরে ওঠার জন্যে নানারকম কায়দা কসরৎ করে চলেছে। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা। অসহায়ের মতোকাঁদতে থাকে সে।
খেঁকশিয়ালটাও ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। নেকড়ে মাথা তুলে বলে, বন্ধু এখন কি কান্নার সময়! একটা উপায় বের করো-যাতে আমি উপরে উঠতে পারি। জানি, এক সময়ে আমি তোমার উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছি। কিন্তু সে-সব কথা এখন তো মনে করলে চলে না ভাই। তুমি আমার বউ বাল-বাচ্চাদের একটা খবর দাও। তারা এসে দেখুক, আমি কি বিপদে পড়েছি।
খেঁকশিয়ালটা খেঁকিয়ে ওঠে, ওরে হতচ্ছাড়া পাঁজি বদমাইশ, তুই কি ভাবছিস, তোর দুঃখে। আমি কাতর হয়ে কেঁদেছি। আমি কেঁদেছি তার কারণ, তোর মতো একটা শয়তানের হাত থাকে আরও আগে কেন রক্ষা পাইনি। কেঁদেছি এই কারণে যে, তোর এই আজকের দশা এক বছর আগে কেন হয়নি। তাহলে হাড়ে আমার বাতাস লাগতো। এবার তুই মর, তোর কবরে আমি থুথু ফেলবো, মর-মার। আমরা দল বেঁধে মহচ্ছিব করবো।–তুই এক্ষুণি মর রে হতভাগা।
নেকড়ে কাতরভাবে মিনতি করে, এখন কি এসব কথা বলার সময় বন্ধু! তুমিই আমার একমাত্র ভরসা, অগতির গতি। এ বিপদে তুমি না। উদ্ধার করলে কেউ আমাকে বীচাবে না ভাই। এই তো কিছুক্ষণ আগেও তুমি আমাকে কত ভালো ভালো জ্ঞানের কথা শোনালে। কত প্রতিজ্ঞ করলে। সে-সব কি এর মধ্যে ভুলে গেলে ভাই? এ কথা ঠিক, তোমার সঙ্গে আগে আমি একটু আধটু খারাপ ব্যবহার করেছি। কিন্তু সে-কথা কি এখন মনে রাখলে চলে?
নেকড়ে করুণ ভাবে মিনতি জানায়, তুমি কত মহৎ, কত উদার। আজ এই বিপদের সময় তোমার মনে যত দুঃখই দিয়ে থাকি, তুমি আমাকে উদ্ধার করবেই। আমি জানি, যা বলছি সবই তোমার মুখের কথা-মজা করছি। আসলে তোমার অন্তরটা খুব নরম। ও সব কথা থাক ভাই। এখন তুমি একটা রশি এনে গাছের ডালে বেঁধে আমার কাছে নামিয়ে দাও। আমি উঠে আসি। তারপর দেখে নিও, সারা জীবন ধরে তোমাকে মাথায় করে রাখবো।
—ধীরে, বন্ধু ধীরে। তোমার ভালো ভালো মধু মাখা কথাগুলো এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে, সখা? গর্তটা থেকে তোমার আত্মাটাই শুধু উঠে আসতে পারবে। কিন্তু দেহটা নৈব নৈব চ। এর জন্যে তুমিই একমাত্র দায়ী। এত দিন তুমি কাউকেই মানুষ জ্ঞান করনি। ধরাকে সরা মনে করেছি। তার প্রতিফল পেতে হবে না! ওহে মাথা মোটা নির্বোধি-উদ্ধত জানোয়ার, সেই বাজপাখির কাহিনী কি তুমি শোনোনি?
সোনা, আত ভয় পাওয়ার কি আছে? বেরিয়ে এসো। আমি জানি তোমার খুব খিদে পেয়েছে। তাই তোমাকে ধরে কিছু দানা খাওয়াতে চেয়েছিলাম। আর তুমি আমনি ভয় পেয়ে গর্তে ঢুকে গেলে? বোকা মেয়ে কোথাকার—বেরিয়ে এসো। খিদে পায়নি বুঝি?? বেরিয়ে এসো, দেখ, কি সুন্দর সব দানা এনেছি, পেট পুরে খাও। তুমি তো জানো না, তোমাকে আমি কত ভালোবেসে ফেলিছি। বেরিয়ে এসো, সোনা লক্ষ্মী মেয়ে।
রাজ্যের মধুঢালা কথায় বিশ্বাস করে বোকা-সরল তিতির গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। আর তৎক্ষণাৎ হিংস্র বাজ টুক করে তার থাবার মধ্যে পুরে নেয়। তাকে।
তিতিরের প্রাণ যায় যায়। রাগে সে ফেটে পড়ে, ওরে শয়তান বদমাইশ বিশ্বাসঘাতক, এই তোর মনে ছিলো। আমাকে খেয়ে ভাবছিস হজম করবি। আল্লাহর দোয়ায় তোর পেটে ঢুকে আমি জহির হবো। তোরও জান শেষ করবো।
বাজ কিন্তু তার কথায় ভ্বক্ষেপ করলো না। মুখে পুরে গিলে ফেললো। কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য, আল্লাহর কি অপোর মহিমা, তিতিরের আকুল প্রার্থনা তিনি বুঝি শুনেছিলেন, পাখিটাকে গিলতে না গিলতেই বাজপাখিটা চিৎপাৎ হয়ে পড়ে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ।
শুনলে তো হে নেকড়ে? তোমারও আজ সেই দশা। অধৰ্ম অবিচার অত্যাচার চিরকাল চলে ন। একদিন তার প্রতিফল পেতেই হয়। তুমি আমার ওপর এতকাল যে দুর্ব্যবহার করে এসেছ বিনা দোষে আমাকে লাথি-বঁটা মেরেছি, আজ সেই বিচারের দিন। আল্লাহ তার যোগ্য শাস্তিরই ব্যবস্থা করেছেন।
নেকড়ে আকুলভাবে কাঁদতে থাকে, দয়া করো বন্ধু, দয়া করো। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। দেখো, আমি এ ঋণ তোমার শোধ করে দেব। আমিই তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু হবো। আমার মতো সুপরামর্শদাতা তুমি আর পাবে না জীবনে।
চতুর খেঁকশিয়াল কিন্তু নেকড়ের মিষ্টি কথায় ভোলে না।–তুমি দেখছি কোনও নীতি কথাই
-কী নীতি কথা?
—আবার কাহিনী?
রুগী অবাক হয়, সে কি আপনি না ডাক্তার। আপনার নিজের চোখে আবি হয়েছে।–তাই আপনি সারাতে পারছেন না? তাহলে আমার আবে সারাবেন কি করে? থাক, আর দরকার নাই। এবার আপনি আসুন।
সুতরাং নেকড়ে মশাই বুঝতে পারলেন, অন্যের রোগ সারাবার আগে নিজের রোগটা সারাবার যোগ্যতা আছে কি না সে একবার যাচাই করে দেখা ভালো না, কী? আজ যে বিপদে তুমি পড়েছ তা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্যে তোমার মূল্যবান মগজের খানিকটা অন্তত খরচ করো। নিজে বাঁচলে তো বাপের নাম। তারপর আমাকে উপদেশ দেবার স্পর্ধা করো। আর তো যদি না পারো, যেখানে এখন পড়েছ–সেখানেই থাকো-যতদিন বাচো। কেমন?
কিন্তু এতেও ডাল গলে না। খেঁকশিয়াল মিষ্টি কথায় ভুলবোর পাত্র নয়।-একটা দুষ্ট, খল, শঠ, শয়তান তার স্বভাব্যচরিত্র রাতারাতি পালটাতে পারে এরকম কোন নজির ইতিহাসে নাই। তুমি কি নব-ইতিহাস রচনা করতে চাও, নেকড়ে সন্তান? তুমি আমাকে অতোই বোকা পাঠা পেয়েছ, তুমি বললে আর আমনি আমার লেজটা নামিয়ে দেব তোমার থাবায়। আমি এখন দেখতে চাই, কি করে তুমি তিলে তিলে মর। পীর পয়গম্বররা কি বলে গেছেন জানতো? দুষ্কৃত নিধনেই পৃথিবী পাপমুক্ত হতে পারে।’
নেকড়ে তখন তার সামনের পা দু’খানা একত্র করে করজোড়ের ভঙ্গীতে বলে, প্রাণের বন্ধু খেক, তুমি কত বড় খানদানী ঘরের সন্তান। তোমাদের বংশের খ্যাতি জগৎজোড়া। তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা, আচার বিনয় বিদ্যার কোনও তুলনা নাই। তোমাদের বিচার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত। তোমাদের সততা উদারতা মহত্ব-এর কাহিনী দিগদিগন্তে ছড়িয়ে আছে। সর্বোপরি পরোপকারই তোমাদের জীবনের একমাত্র ব্বত। একথা তো সবাই জানে বন্ধু।
নেকড়ের এই তোষামোদের ঢং দেখে খেঁকশিয়াল হেসে আর বাঁচে না। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। আর কি? বলে, তোমার দেখি এখনও শৈশবদশী কাটেনি। তুমি মুখ জানতাম, কিন্তু এতটা মুখ ভাবতে পারিনি। শোনো, তোমাকে একটু জ্ঞান দিই। সব রোগই হয়তো সারাতে পারে, কিন্তু মৃতকে জীবন দান করা যায় না। হীরা ছাড়া সব বস্তুতে ভেজাল মেশানো সম্ভব। আমরা সবই এড়াতে পারি, একমাত্র নিয়তি ছাড়া।
এই মাত্র তুমি বললে, আমি যদি তোমাকে উদ্ধার করি, সারা জীবন তুমি আমার অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে থাকবে। সেই খল সাপের কাহিনী শুনেছি? তবে শোনো : একটা সাপ একদিন কোনও ক্রমে সাপুড়ের ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। অনেক দিন তাকে না খেতে দিয়ে ঝুডিতে ভরে রাখার ফলে তার দেহে কোন শক্তি ছিলো না। তাই শত চেষ্টা করেও সে পালাতে পারছে না দেখে এক পথচারীর প্রাণে মায়া হলো। সাপটাকে কাঁধে করে সেবাড়ি নিয়ে গেলো। নিয়মিত দুধকলা খাইয়ে বেশ তাগড়াই করে তুললো তাকে। সাপ যেদিন বুঝতে পারলো এবার সে একাই যত্রতত্র চলাফেরা করতে পারবে, প্রথম রাতেই সে তার জীবনদাতার মাথায় ছোবল; বসিয়ে দিলো। এবং বলাবাহুল্য, সেই ছোবলের বিষে তার প্রাণান্ত ঘটেছিলো।
সুতরাং নেকড়ে ভায়া, আর নয়, এবার চলি, টা টা।
খেঁকশিয়ালটা বাইরে বেরিয়ে এসে একটা উঁচু টিলার উপরে দাঁড়িয়ে হুক্কা হুয়া—হুক্কা হুয়া করে চিৎকার করতে থাকলো। তার চিৎকারে আঙুর ক্ষেতের মালিক ছুটে আসে। খেঁকশিয়াল ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে নেকড়ের গর্তটার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে।
মালিক ভিতরে ঢুকে গর্তের নিচে নেকড়েকে দেখে ইয়া বড় বড় পাথরের চাই এনে ওর মাথার উপর ফেলতে লাগলো। খেঁকশিয়াল শুনতে পায়—মৃত্যুর আগে যেমন আকাশ-ফাটা চিৎকার দেয় তেমনি এক শেষ চিৎকার দিয়ে নেকড়েটা নীরব হয়ে গেলো।
এই সময় শাহরাজাদ গল্প শেষ করে একটুক্ষণের জন্য থামালো। দুনিয়াজাদ এক গেলাস পিস্তার সরবৎ এনে হাতে দেয়। সরবৎটুকু খেয়ে শাহরাজাদ বলে, এবার বলুন, জাঁহাপনা, কেমন শুনলেন?
⭐ FOR ANY HELP PLEASE JOIN
🔗 MY OTHERS CHANNELS
🔗 FOLLOW ME
Facebook: facebook.com/molakat
Facebook: facebook.com/afsarnizam
Facebook: facebook.com/samoiki
Instagram: instagram.com/molakat
Instagram: instagram.com/afsarnizam
Twitter: twitter.com/afsarnizam
🔗 MY WEBSITE
🔗 CALL ME
+8801819515141
🔗 E-MAILL
molakatmagazine@gmail.com
No comments