আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-৩

 
১৪ জুন, ২০০৯ রবিবার
 
সকাল সোয়া দশটায়, আমাদের বাস ছাড়ল লন্ডনের দিকে। চার ঘন্টার রাস্তা। কিন্তু মাঝখানে মেরামতরে জন্য রাস্তা বন্ধ থাকায় আমাদেরকে বিকল্প রাস্তায় কিছুটা ঘুরে যেতে হলো। ফলে সময় একটু বেশি লাগল লন্ডন পৌঁছাতে। পথিমধ্যে Rest House-এ ১৫ মিনিটের বিরাম। সেখানে আমরা টয়লেটের কাজ সেরে সামান্য কিছু কিনে খেয়ে নিলাম। চমৎকার রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে শস্য ক্ষেত, মাঝে মাঝে সবুজ বনানী ও তরুলতা আচ্ছাদিত অনুচ্চ পাহাড়ের চমৎকার মনোলোভা দৃশ্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে রাখলো।
লন্ডনের বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া স্টেশনে ঢুকতেই গাড়ির জানালা দিয়ে দেখি মাওলানা আবু আহমদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি হয়ত কিছুটা আগেই এখানে এসে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন। উনি আমাদেরকে নিয়ে দু’টি রাস্তা পেরিয়ে মাটির নিচের রেল গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আমি যদিও ১৯৮৪ সনে লন্ডন সফরকালে পাতাল রেলে উঠেছি, কিন্তু আমার স্ত্রীর এটাই প্রথম পাতাল রেলে ওঠার অভিজ্ঞতা। তাই উৎফুল্ল চিত্তে তার এ প্রথম অভিজ্ঞতা সে প্রাণ ভরে উপভোগ করলো।
মাওলানা আবু আহমদের বাসায় গিয়ে খেয়ে দেয়ে নামায পড়ে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। তারপর আবু আহমদের সাথে গেলাম দারুল উম্মাতে। আছরের পর সেখানে একটি অনুষ্ঠান। প্রফেসর ওমর ফারুক রচিত ‘রক্তাত্ত পিলখানা’ শিরোনামের একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। উৎসবের আয়োজন করেছে লন্ডস্থ ‘রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিশ ইউকে’। এতে আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছে। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ক্যামডেন বারাহ্ কাউন্সিলের মেয়র  কাউন্সিলার ওমর ফারুক আনসারী। সভাপতিত্ব করেন বাংলা পোস্ট-এর সম্পাদক ও রেনেসাঁ সাহিত্য মজলিশের সভাপতি কে এম আবু তাহের  চৌধুরী। রেনেসাঁ মজলিশের প্রচার সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মোঃ জুবায়ের নূর এর কোরআন তেলয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এতে বক্তৃতা করেন সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট পত্রিকার চেয়ারম্যান শেখ মোঃ মফিজুর রহমান, শরীয়া কাউন্সিল ইউ.কের চেয়ারম্যান হাফেজ মাওলানা আবু সায়ীদ, অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল কাদের সালেহ, কবি মনোয়ার হোসেন বদরুদ্দোজা, কবি রহমত আলী পাতনী, আব্দুস সাত্তার খান, ডা. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর আরিফ বিল্লাহ, আলহাজ্ব আব্দুল জলিল, কবি সৈয়দ আকামত আলী রুবেল, মাওলানা সাদিকুর রহমান, মাওলানা আবু আহমদ হিফযুর রহমান, হাফেজ মাওলানা শফিকুর রহমান, জনাব শামসুদ্দিন আহমেদ খান ও নুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন শিহাবুজ্জামান কামাল।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথিকে ফুল দিয়ে বরণ করে ছোট্ট মেয়ে উম্মে মুনিরা চৌধুরী ও উম্মে মারিয়া চৌধুরী। রেঁনেসার পক্ষ থেকে লেখক অধ্যাপক ওমর ফারুককে একটি ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। বক্তারা বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্য কাহিনী শীর্ষক রক্তাক্ত পিলখানা গ্রন্থের প্রশংসা করেন। গ্রন্থের লেখক তার বক্তব্যে বলেন, ২৫ ফেব্র“য়ারি পিলখানায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন দক্ষ অফিসারকে নৃশংসভাবে হত্যা জাতির ইতিহাসে একটি চরম ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
প্রধান অতিথির ভাষণে আমার বক্তব্য ছিল- প্রবাসে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা চর্চা ও লালন করার জন্য তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। পিলখানার ঘটনা এক গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। পলাশীর ঘটনার পর এত বড় কলঙ্কময় ঘটনা জাতির ইতিহাসে আর ঘটেনি। একটি স্বাধীন দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্যই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সেনা অফিসাররা বিডিআর বাহিনীকে এমন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে যে, একজন বিডিআর তিনজন বিএসএফ সদস্যের মুকাবিলা করতে সক্ষম। বিডিআর সদস্যরা সীমান্ত রক্ষার অতন্ত্র প্রহরী। কিন্তু বর্তমানে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। সীমান্ত এলাকায় এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত। সেখানে এখন চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য। ভারত থেকে অবাধে মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে আসছে, যা আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। আর বাংলাদেশ থেকে ডিজেল,পাট, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী  ভারতে পাচার হচ্ছে। এজন্য  ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা ও  তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি  দেয়া উচিত। পিলখানার মর্মšত্তদ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবিরণ দিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে স্বকীয় আদর্শ-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে দেশে এবং বিদেশে সর্বত্র সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে আমি বললাম- বিদেশে থেকেও প্রিয় মাতৃভূমির জন্য প্রবাসীদের যে দরদ ও উৎকন্ঠা তা সত্যই প্রশংসনীয় ও দেশে যারা রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণাদায়ক।
অনুষ্ঠান শেষে সকলকে অপ্যায়িত করা হয়। এরপর মাওলানা আবু আহমদের সাথে আমি তার বাসায় ফিরে এলাম। রাজিব উদ্দিন সাহেব তার গাড়িতে করে আমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিলেন।
 
১৫ জুন, ২০০৯  সোমবার
 
সকালে নাস্তা খাবার পর মাওলানা আবু আহমদ বললেন, চলেন এখানকার সদরঘাট এলাকা দেখে আসি। শুনে আমি তো অবাক! লন্ডনেও সদরঘাট আছে নাকি? বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, চলেন। এরপর বাসে করে আমি, আমার স্ত্রী ও মাওলানা আবু আহমদ চলে গেলাম লন্ডনের White Chappel-এ।
‘লন্ডনের সদরঘাট’ কথাটি শুনে আমি প্রথমে থমকে গিয়েছিলাম এবং সেজন্য সেটা দেখার জন্য আমার আগ্রহ ও  কৌতুহল বেড়ে গিয়েছিল। ইস্ট লন্ডনের একটি প্রধান রাস্তার পাশে দীর্ঘ ফুটপাথ জুড়ে সারি সারি অসংখ্য দোকান। দোকানের পেছনে বড় রাস্তার বিপরীতে বিখ্যাত লন্ডন হসপিটাল। আর দোকনের সামনে সারি সারি বিল্ডিং। সেখানেও রকমারী দোকান। ফুটপাতের দোকানগুলোতে নানারকম পণ্য সাজিয়ে রেখেছে দোকানীরা। জামা-কাপড়, শাক-সবজি, তরি-তরকারী, ফলমূল থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী। দামও অপেক্ষাকৃত সস্তা। আমার স্ত্রী দেখে দেখে বেশ কিছু জিনিস কিনলো। আমি কিনলাম টাটকা শেরি ফল এবং সালমান মাছ।
পূর্ব লন্ডনের বিখ্যাত বিপণি কেন্দ্র White Chappel. এখানকার অধিকাংশ দোকানের মালিক বাংলাদেশী। বাংলায় দর-দাম চলছে। কেনা-কাটা হচ্ছে। পরিচিতজনেরা পরস্পর সালাম-কালামের মাধ্যমে সম্ভাষণ করছেন। মন খুশীতে ভরে গেল। মুসলমানরা যেখানেই যায় সেখানেই সঙ্গে করে নেয় তাদের ঈমান-আকীদা, তাহজিব ও তমুদ্দুন। লন্ডনে এর সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। ইতিহাস এভাবেই বদলে যায়। এক সময় ইংরাজগণ আমাদের দেশে বাণিজ্য করতে এসে কৌশলে শঠতার মাধ্যমে শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। খালি হাতে এসে তারা প্রচুর বিত্ত- বৈভবের মালিক হয়। আমাদের দেশ থেকে অঢেল সোনা-দানা, বিত্ত-বৈভব লুন্ঠন করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আমাদের দেশের শাসন-ক্ষমতা অধিকার ও সম্পদ লুন্ঠনের বিনিময়ে তারা তাদের ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা আমাদের দেশে প্রচার করে। ক্রমান্বয়ে তারা আমাদের দেশে খ্রীস্টান ধর্মের  প্রচলন ঘটায় এবং ইঙ্গ-বঙ্গ সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। ফলে আমাদের দীর্ঘ লালিত ইসলামী শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মূলে আঘাত লাগে। আমাদের দেশে ইংরাজ মন-মানসিকতাসম্পন্ন, ইংরাজি শিক্ষিত টাই-শার্ট পরিহিত বাঙালি সাহেব সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ১৯৪৭ সনে আমরা স্বাধীন হলেও আমাদের উপরতলার প্রভাবশালী ক্ষমতাধর এলিট শ্রেণীর পরাধীন মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রার মধ্যে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। দূর্ভাগ্যবশত তারাই বিভিন্নভাবে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সনে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব আমাদেরকে নানাভাবে গ্রাস করতে উদ্যত। তাই আমাদের সমাজে এখনও আমাদের জাতীয় আর্দশ, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের যথাযথ বিকাশ ঘটতে পারছে না।
লন্ডনে বিশেষত পূর্ব লন্ডনে প্রচুর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত লোকের বসবাস। ১৯৯১ সনের পরিসংখ্যান মতে, পূর্ব লন্ডনে শতকরা ২২.১ জনেরও অধিক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের বসবাস। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সেদিন বাসে দারুল উম্মাহ যাওয়ার পথে রাস্তায় বিভিন্ন স্টপেজে বহু যাত্রী ওঠা-নামা করলো। মনে হলো, যাত্রীদের প্রতি চারজনের একজনই বাংলাদেশী। বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা মহিলা তারা শতকরা ৯০ জন বোরখা পরিহিতা, পুরুষদেরও অনেকেই টুপি-দাড়ির অধিকারী। তারা পরস্পর সালাম-কালাম আদান-প্রদান করছেন। দেখে খুবই ভাল লাগল। হিযাব মুসলিম নারীর জন্য ফরয। মুসলিম পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা কারও কারও মতে ফরয কিন্তু অধিকাংশের মতে সুন্নত। তবে একথা ঠিক যে, প্রত্যেক পুরুষের জন্য এটা একটি স্বাভাবিক ভূষণ। ইসলামে সালাম-কালাম আদান-প্রদান করা সুন্নত। এসব ইসলামী বিধি-বিধান প্রতিপালন একাধারে যেমন ইবাদত  তেমনি তা ইসলামী সংস্কৃতির উজ্জ্বল নিদর্শন। বিদেশে বিজাতীয় ও প্রতিকূল পরিবেশে মুসলমানগণ যেভাবে এটা অনুসরণ করে চলছে, সেটা দেখে যেমন মুগ্ধ হলাম তেমনি তাদের আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসের প্রশংসা করলাম। এ সৎসাহের মূল উৎস ঈমান, তাতে সন্দেহ নেই। বিদেশে মুসলমানগণ যে এরূপ ঈমানের পরিচয় দিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে, এটা কম প্রশংসার বিষয় নয়। তাই আল্লাহর কাছে তাদের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করলাম।
বিকাল চারটায় সিরাজগঞ্জ মোক্তার পাড়ার সনজু মিয়া তার গাড়ি নিয়ে এল আমাদের নেয়ার জন্য। সনজু মিয়া বিশ বছর হল লন্ডন থাকে। টুক টাক ব্যবসা-বাণিজ্য করে। মোক্তার পাড়ায় আমার শ্বশুর বাড়ির ঠিক বিপরীতে ওদের বাসা। আমার শ্বশুরের নিকট প্রতিবেশী এবং আত্মীয়। লন্ডনে আমাদের আসার খবর পেয়ে সে দেখা করতে এবং আমাদেরকে আনোয়ারা খালার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে। আমি ও আমার স্ত্রী তার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়ি চলতে লাগলো। সে তার পাকা হাতে গাড়ি চালানোর সাথে সাথে রাস্তার দু’পাশের উল্লেখযোগ্য স্থান ও দর্শনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদেরকে ধারণা দিতে থাকলো। আমরা লন্ডনের টেমস নদীর নিচ দিয়ে তৈরি করা দীর্ঘ Blackwell tunnel মধ্য দিয়ে চলে গেলাম Greenwich মানমন্দিরের দিকে। যাওয়ার পথে রাস্তার একপাশে দীর্ঘ খোলা জায়গা। এটা দেখে মনে হলো শহরটা বোধ হয় এখানেই শেষ। তাই সনজুর কাছে জানতে চাইলাম, এখানেই কি শহর শেষ হয়েছে? সনজু বলল, না। এরপরেও শহর আছে, এটাও শহরের অংশ। ১৬৬৬ সনে লন্ডনে মহামারী রূপে প্লেগ দেখা দেয়। তাতে লন্ডন শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়, সেসব মৃত ব্যক্তিকে এখানে গণকবর দেয়া হয়। মূলত সে অসংখ্য মৃত ব্যক্তির কবরস্থান হিসাবে এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রায় ১৫/১৬ মাইল দীর্ঘ এ কবরস্থান। প্লেগের প্রাদুর্ভাবের পর একটি বেকারীর দোকন থেকে আগুন লাগে। সে আগুন ছড়িয়ে পরে পুরো লন্ডন শহরে। কবরস্থান বলেই এখানে কোন স্থাপনা নেই। তাই জনশূন্য এ সুবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর দেখে আমার মনে হচ্ছিল, যেন শহরের সীমানা এখানেই শেষ হয়েছে। সনজুর কথা শুনে আমার সে ভুল ভাঙল।
লন্ডনের সে ঐতিহাসিক ভয়াবহ আগুনের স্মৃতিকে ধারণ করে গড়ে উঠেছে বহুতল বিশিষ্ট একটি Tower. অনেকেই যায় সে Tower দেখতে। ইংরাজ জাতি তাদের ইতিহাসের সব উল্লেখযোগ্য বিষয়কে এভাবেই ধারণ ও স্মরণীয় করে রাখে।
কথায় কথায় আমরা পৌঁছে গেলাম গ্রীনিচ মানমন্দিরে। ভূ-তাত্ত্বিক বিশারদগণ এখান থেকেই পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণ দুটি গোলার্ধে ভাগ করেছেন। এখানকার ঘড়ির টাইম দেখেই পৃথিবীর সব দেশের বা অঞ্চলের টাইম ঠিক করা হয়।
এক সময় ইংরাজ জাতি যখন পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকায় সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, তখন বলা  হতো- ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায়না,’ তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে তারা অনেক ক্ষেত্রেই আধিপত্য   বিস্তারের প্রয়াস পেয়েছে। এ মানমন্দির তারই একটি উদাহরণ। এখন পৃথিবীর সবাই এটা মেনে নিয়েছে। তাই বৃটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটলেও বৃটিশের তৈরি অনেককিছুই আমরা এখনও নির্দ্বিধায় অনুসরণ করে চলেছি। কথায় বলে-‘নদী মরে গেলেও তার রেখা থাকে’, বৃটিশ সাম্রাজ্যের এরকম অনেককিছুই সারা পৃথিবীতে এখনও অনুসৃত হয়ে থাকে।
মানমন্দিরের অদূরে টেমস নদীর তীরে একটি মেরিটাইম স্কুল। এখান থেকেই নৌ-বিদ্যা শিক্ষা করে ইংরাজগণ একসময় এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণে বর্হিগত হয়। আমেরিকা, কানাডা, উপমহাদেশ ইত্যাদি অনেক অঞ্চল তখন ছিল পরিচিত বিশ্ব তথা এশিয়া-ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকে কখনও সেসব দেশে গেলেও ইংল্যান্ডের নাবিকদের জন্য ছিল সেটা নতুন জগৎ। তাই তারা সেটাকে তাদের আবিষ্কার বলে উল্লেখ করে থাকে। যাইহোক,  বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে তারা ধীরে ধীরে সে সব এলাকার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে, তারপর সেখানে তারা ছলে-বলে-কৌশলে রাজ্য-বিস্তার ও শাসন-ক্ষমতা হস্তগত করে। এভাবেই একসময় তারা সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়। তাই বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে এ প্রাচীন মেরিটাইম স্কুলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
মানমন্দিরের পাশে এক উম্মুক্ত ময়দানে এক মানব-মূর্তি সগৌঁরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি হলো ক্যাপ্টেন কুক এর মূর্তি। ক্যাপ্টেন কুক সর্বপ্রথম তাঁর জাহাজ নিয়ে কানাডার কিউবেকে উপনীত হন। এরপর ধীরে ধীরে বহু ইংরাজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসতি স্থাপনের জন্য সেখানে চলে যায়। ক্রমান্বয়ে কানাডায় ইংরাজ জাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য ইংরাজ জাতি ক্যাপ্টেন কুককে একজন জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে তাঁর সম্মানে এ মূর্তি স্থাপন করেছে। যাতে এটা দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের অতীত গৌরবময় ইতিহাস স্মরণ করে।
ইংরাজ জাতি তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে তারা যেমন উদ্দীপ্ত হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করার জন্য তারা নানা কিছু আয়োজন করেছে। তাই দেখা যায়, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, বড় বড় বীর-যোদ্ধা, জ্ঞানী-গুণী, মহৎ ব্যক্তি যাঁরা বিভিন্নভাবে তাদের দেশের মান-সম্মান-গৌরব-প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন, তাঁদের স্মরণে প্রত্যেকের জন্য এক একটি মূর্তি বানিয়ে, প্রকাশ্যে পাবলিক প্লেসে তা স্থাপন করে রেখেছে। এসব মূর্তি দেখে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে যেমন অবহিত হওয়া যায়, তেমনি নতুন ইতিহাস গড়বারও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়।
গ্রীনউইচ মানমন্দির দেখতে দেখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এল। আমরা দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। বৃষ্টি আরো জোরে নামল। রাস্তায় পানি জমে গেল। গাড়ি চালানো কষ্টকর। সনজু কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি রাস্তার পাশে নিয়ে দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বৃষ্টি একটু কমলে রাস্তার পানিও সরে যেতে লাগলো। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। অল্প সময় পরই আমরা আনোয়ারা খালার বাসায় পৌঁছে গেলাম।
আনোয়ারা জাহান সনজুর আপন খালা। সালেহা, আনোয়ারা, আখতার তিন বোন। বড় বোন সালেহা খালার ছেলে সনজু। আনোয়ারা খালাই তাকে লন্ডন নিয়ে এসেছিলেন। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই আনোয়ারা খালা আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। বাসায় অন্য যারা ছিল তাদেরকে ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে চা-নাস্তা এসে গেল। খেতে খেতে নানা রকম গল্প। মূলত দেশের কথা, সিরাজগঞ্জ, মোক্তারপাড়া ও নিকটআত্মীয়দের প্রসঙ্গ এবং ছোটবেলার নানা বিষয় ছিল গল্পের প্রতিপাদ্য। আমি বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে ছিলাম। আনোয়ারা খালার নাম শুনেছি, কিন্তু চাক্ষুস তাকে কখনও দেখিনি। এই প্রথম লন্ডন শহরে তাকে দেখলাম। আমার স্ত্রীর সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাই গল্প-গুজব তারাই বেশি করছিল, তাই চুপচাপ, তাদের গল্প শুনছিলাম আর মাঝে মধ্যে হাঁ হু করে তাদের আলাপে সায় দিচ্ছিলাম।
মাঝখানে আনোয়ারা খালার পরিচয়টা একটু দিয়ে নেই। তিনি তার স্বামীর সাথে ১৯৭০ সনে লন্ডন আসেন। তার স্বামী  দেশে সরকারি বড় চাকরি করতেন। এখানে এসেও তিনি সরকারি চাকরিতে জয়েন করেন। ভাল অবস্থায়ই ছিলেন। তিনি লন্ডনে এসে বাড়ি করেছেন এবং বেশ সম্মানের সাথেই জীবন যাপন করেছেন। ১৯৯৮ সনে তিনি    ইন্তিকাল করেন। লন্ডনেই তার কবর হয়েছে। আনোয়ারা খালা লন্ডনে আসার আগে বাংলাদেশে একটি স্কুলে হেড মিস্টেস ছিলেন। এখানে এসেও শিক্ষকতা শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষাও চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডনে একটি হাইস্কুলের হেড মিস্টেস হিসাবে রিটায়ার করেন। এখানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কাজের সাথেও তিনি জড়িত। মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে যান এবং আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর রাখেন। বিলাতে থাকলেও তিনি বিশেষ অতিথিপরায়ণ ও স্বদেশীদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে সস্ত্রীক আমেরিকায় থাকে, ছোট ছেলে ইংল্যান্ডের আরেকটি শহরে থাকে সস্ত্রীক। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি এ বাড়িতে থাকেন। সৌভাগ্যবশত সেদিন আনোয়ারা খালার তিন ছেলেমেয়েই তার বাসায় ছিলেন। তাই তাদের সঙ্গেও দেখা ও পরিচয় ঘটলো।
গল্পে-গল্পে সময় গড়িয়ে গেল। রাত তখন সাড়ে নয়টা। আমরা উঠতে চাইলাম। কিন্তু রাত্রির খানা না খেয়ে আনোয়ারা খালা উঠতে দিবেন না। ডাইনিং রুমে টেবিলে খানা সাজানো হয়েছে। আমরা খানা খেয়ে আবার সনজুর গাড়িতে উঠলাম। সঙ্গে আনোয়ারা খালার মেয়ে লিপিও উঠলো। ফিরতি পথে সনজুকে একা আসতে হবে তাই তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য সেও এল আমাদের সাথে। লিপি এম এ পাশ শিক্ষিতা মহিলা, অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী। একটি অফিসে চাকরি করে। যথেষ্ট বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনও বিয়ে হয়নি। কারণ জানতে চাওয়া অভদ্রতা, তাই ইচ্ছা থাকলেও কৌতুহল নিবৃত্ত করলাম।
আবার সেই বিখ্যাত কবরস্থান, গ্রীনউইচ মানমন্দিরের পাশ দিয়ে ট্রেমস নদীর নিচে ব্লাকওয়াল দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা মাওলানা আবু আহমদের ওবান স্ট্রীটের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম।
 
১৬ জুন, ২০০৯ মঙ্গলবার
 
আজ প্রায় সারাটা দিনই খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামে কেটে গেল। বিকালে মাওলানা আবু আহমদের সাথে দাওয়াতুল ইসলামের অফিসে যাওযার কথা। জনাব রাজীব উদ্দিন তার গাড়ি নিয়ে এসেছেন আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইতঃমধ্যে ড. আবুল কালাম টেলিফোন করলেন তার বাসায় গিয়ে চা খাওয়ার জন্য। এদিকে আবু আহমদের বাসায়ও চা রেডি। ডবল খাওয়া হবে মনে করে আমরা আবু আহমদের বাসায় তৈরি চা না খেয়ে রওয়ানা হলাম ড. আবুল কালামের বাসায় চা খাওয়ার জন্য। কিন্তু চা কোথায়? দস্তুর মত পোলাও ও নানা রকম খাবারের আয়োজন। মাওলানা আবু আহমদকে নামায পড়াতে হবে বলে তিনি কিছু না খেয়েই রাজীব উদ্দিনকে নিয়ে মসজিদে চলে গেলেন। আমাকে থাকতে হলো। আরো কয়েকজন বিশিষ্ট মেহমান এলেন। নানা রকম খাবারের আয়োজন। আমি ডায়াবেটিক পেশেন্ট। তাই ওসব রাজকীয় খাবার আমার উপযুক্ত নয়। তবু সৌজন্যের খাতিরে সামান্য কিছু খেতে হলো। খাওয়া-দাওয়া সেরে মাওলানা রফিকুল ইসলামের সাথে দাওয়াতুল ইসলামের অফিসে গেলাম। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আগত  বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারীস্টার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে দাওয়াতুল ইসলামের নেতৃবৃন্দের বিশেষ  সৌজন্য সাক্ষাৎ উপলক্ষ্যে এক ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। বৈঠকে আমি অকস্মাৎ উপস্থিত হওয়ায় আমাকে বিশেষ অতিথির মর্যাদা দিয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হলো। আন্তরিক পরিবেশে আলাপ-আলোচনা শেষে  আপ্যায়নের পর আমরা ঘরে ফিরে এলাম।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.