আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-৪

 
১৭ জুন, ২০০৯ বুধবার
আনোয়ারা খালার কাছ থেকে আমার বন্ধু ড. আলী আসগরের টেলিফোন নং পেলাম। ড. আসগরের বাড়ি শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ি গ্রামে। পাবনা কলেজে আমরা পড়াশোনা করেছি। আমি যখন আই এ দ্বিতীয় বর্ষে ও তখন প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়। কলেজে আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের এক্সট্রা একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। বিশেষত, সাহিত্য-সংস্কৃতির কাজ। আমি তখন পাবনা জেলা সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং কলেজের চারটি দেয়াল পত্রের কোনটায় সম্পাদক, কোনটাতে উপদেষ্টা ইত্যাদি হিসাবে জড়িত। আলী আসগর কবিতা লিখতো। তার কবিতা ছাপা হতো কলেজের  দেয়াল পত্রিকায়। আমি, নূরুল আলম রইসী, আলী আসগর, সাইদুর রহমান, জামাল উদ্দীন আহমদ, সোনা মিয়া প্রমুখ কয়েকজনকে ঘিরে তখন কলেজে যে একটি প্রাণবন্ত সাহিত্য-চক্র গড়ে উঠেছিল,  সেটাকে ছাত্র-ছাত্রীরা তো বটেই, শিক্ষকরাও বিশেষ সমীহের দৃষ্টিতে দেখতেন। আমাদের সে হারিয়ে যাওয়া সুখের দিনগুলোর কথা মনে হলে আমি এখনো স্মৃতি-কাতরতায় ব্যাকুল হয়ে উঠি।
১৯৬০ সনে আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ (বাংলা) ক্লাসে ভর্তি হই। আসগর ১৯৬১ সনে বিএ পাশ করে কী করবে তা নিয়ে বিষম দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকে। কারণ আমাদের সকলের আর্থিক অবস্থাই ভাল নয়। এমতাবস্থায় ঢাকায় থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা কঠিন ব্যাপার। অথচ উচ্চ শিক্ষা লাভের আগ্রহ আমাদের সকলের মধ্যেই প্রবল। এ ব্যাপারে পরামর্শ চেয়ে আলী আসগর আমাকে চিঠি লেখে। ঠিক ঐ সময় নিউ মার্কেটের পশ্চিম পাশে সোশাল ওয়েলফেয়ার-এ এমএ ক্লাস চালু করেছে। নতুন বিষয় তাই ছাত্র-ছাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ ভাতারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি আলী আসগরকে তাড়াতাড়ি এসে তাতে ভর্তি হতে বললাম। সে সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো এবং ভর্তি হয়ে গেল। সেখানে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা ছিল এবং সে যা ভাতা পেত, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে তার খাওয়া-পরা, পড়াশোনা ইত্যাদি সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর্থিক কারণে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব ছিল না। এখানে ভাতার ব্যবস্থা থাকায় তার উচ্চশিক্ষা লাভের পথ অনেকটা সুগম হল। আলী আসগর ঢাকায় আসার ফলে তাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পেলাম।
এমএ পাশ করার পর আসগর লন্ডনে ব্যারিস্টারী পড়তে যাবে। আমি তার কাগজ-পত্র সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়ার সময় তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, ব্যারিস্টারী পড়ে আইন ব্যবসা করা, তোমার পোশাবে না, তাই অন্যকিছু পড়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করো। সে আমার কথা রেখেছিলো। ব্যারিস্টারী না পড়ে সোশাল ওয়েলফেয়ারে ডক্টরেক্ট করে কলেজে শিক্ষকতা করে এখন রিটায়ার করেছে। অবশ্য লন্ডনে প্রাথমিক অবস্থায় সে নানা ধরনের ছোটখাট কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। অনেক সংগ্রাম করে এখন সে লন্ডনে দুটি বাড়ি এবং ঢাকার উত্তরাতেও একটি বাড়ির মালিক। মানুষ হিসাবে সে অত্যন্ত অমায়িক, দয়ার্দ্র ও সমাজ-দরদী। লন্ডনে সে বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। পূর্ব লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশীদের সম্পর্কে সে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছে। এটা তার পিএইস ডি থিসিসের বিষয় ছিল। গ্রন্থটি পড়লে লন্ডনে বাংলাদেশীদের বসবাস, তাদের জীবনযাত্রা, তাদের বিভিন্নমুখী সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়। অবসর জীবনে সে এখন বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক  কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে।
আমি তার টেলিফোন নম্বর হারিয়ে ফেলেছিলাম। আনোয়ারা খালার কাছ থেকে তার নম্বর পেয়ে টেলিফোন করে তার সাথে কথা বললাম। আমার টেলিফোন পেয়ে সে খুব উল্লসিত হল। সে বললো, বিকাল ছয়টার পর সে এসে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। অতএব আমি যেন প্রস্তুত থাকি। আলী আসগর এল সাড়ে ছয়টায় তার গাড়ি নিয়ে। আমাকে ও আমার স্ত্রীকে নিয়ে সে গেল তার বাসায়। ছোট ছিমছাম একটি দোতলা বাসা। বাসার পেছনের দিকে একটি বাগান। এখানে সব বাসার পেছনেই একটি করে বাগানের জায়গা আছে। আলী আসগরের বাগানে লাউ-কুমড়া, উচ্ছে, শাক-সবজির ইত্যাদির আবাদ। নানারকম ফল ও ফুলের বাহার। বড় চমৎকার সবুজের বিচিত্র সমারোহ। আলী আসগরের স্ত্রী মাজেদা সম্পর্কে আমার আত্মীয়। সেই মূলত বাগানের যতœ নিয়ে থাকে। বাগানের চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখে আমরা ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম। চা-নাস্তা এলো।  চা-নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই মাগরিবের আযান হলো। আলী আসগরের গাড়িতে করে তার এলাকার ‘নুরুল ইসলাম মসজিদে’ গেলাম নামায পড়তে। খুব প্রশান্তির সঙ্গে নামায পড়লাম। মসজিদ মুসল্লিতে ভরে গেছে। এখানে বিশাল আকারে এক আধুনিক মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র নির্মাণের আয়োজন চলছে। শুনেই আনন্দে মন ভরে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত মুসলমানদের উদ্যোগেই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। তবে পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশী ও অন্যান্য দেশের মুসলমানরাও তাতে শরিক রয়েছে। মসজিদের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা দেখে খুব ভাল লাগল।
নামায পড়ে আসগরের বাসায় গেলাম। খানা প্রস্তুত। খেয়ে-দেয়ে রাত এগারোটায় আসগর তার গাড়িতে করে আমাদেরকে ওবান স্ট্রীটে মওলানা আবু আহমদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, পরের দিন সকাল দশটায় সে আবার আসবে এবং আমাদেরকে নিয়ে এখানকার কিছু দর্শনীয় স্থান দেখাবে।
 
১৮ জুন, ২০০৯ বৃহস্পতিবার
সকাল দশটায় এলো আলী আসগর। আমি, আমার স্ত্রী ও মাওলানা আবু আহমদ আলী আসগরের গাড়িতে করে বের হলাম শহর দেখতে। প্রথমে গেলাম হোয়াইট চ্যাপেলে অবস্থিত আলী আসগরের মেয়ের ল’ চেম্বারে। মেয়ে রেবেকার সাথে আরো তিনজন বাংলাদেশী তরুণ ব্যারিস্টার বসে চেম্বারে। সাবাই সলিমিটরের কাজ করে। এখানে ছোট-বড় অনেক বিষয়ে আইনের পরামর্শ নিতে আসে লোকেরা। তাই আলী আসগর তার ল’পাশ করা মেয়ের জন্য তার রিটায়ারমেন্টের সব টাকা দিয়ে এ চেম্বার করে দিয়েছে। অবসর জীবনে কিছু করার নেই, তাই মেয়ের চেম্বারে সেও নিয়মিত অফিস করে মেয়েকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার জন্য।
হোয়াইট চ্যাপেল থেকে আমরা গেলাম লন্ডনের ব্যাংক পাড়ায়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ সবগুলো বড় বড় ব্যাংকের হেড অফিস রয়েছে এখানে। পুরাতন ও অতিশয় মজবুত ধরনের বিল্ডিংÑস্থাপত্য শিল্পের চমৎকার সব নিদর্শন। ব্যাংক পাড়া ছাড়িয়ে আমরা গেলাম এমন একটি জায়গায়, যেটা বাংলাদেশের একটা স্মৃতি ধারণ করে আছে। বিল্ডিংয়ের গায়ে লেখা আছে-এখানে ব্যারীস্টার আলী মোহাম্মদ আব্বাসের বাসস্থান। সিটি কর্পরেশনের পক্ষে নেমপ্লেটটি লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বৃটিশরা এভাবে তাদের দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিরদের স্মরণ করে থাকে।
ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আব্বাস ছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলার (তখন অবিভক্ত পাবনা জেলার) প্রথম ব্যারিস্টার। তিনি ব্যারিস্টারী পড়তে এসে আর দেশে ফিরে যাননি। বৃটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করে এখানেই আজীবন সুনাম ও দাপটের সাথে আইন ব্যবসা করে গেছেন। এম পি ইলেকশনেও তিনি এ এলাকা থেকে কয়েকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। দেশের স্বার্থে তিনি সব সময় কথা বলেছেন। বিশেষত, বৃটেনে অভিবাসীদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। ছোটবেলা থেকে তার নাম শুনেছি এবং পাবনার লোক হিসেবে বিশেষভাবে গর্ব অনুভব করেছি। লন্ডন থেকে  তিনি ইংরাজিতে Our Home  নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করতেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক এম এ হামিদ পাবনা থেকে Our Home পত্রিকার বাংলা সংস্করণ ‘আমাদের দেশ’ পত্রিকা বের করতেন। ১৯৯৮-১৯৬০ সন পর্যন্ত আমি যখন এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশোনা করতাম, তখন উক্ত পত্রিকার সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। সম্পাদনা বোর্ডের সম্পাদক ছিলাম আমি এবং এর অন্য দু’জন সদস্য ছিল আমার বন্ধু নূরুল আলম রইসী ও আলী আসগর। তবে মূলত অধ্যাপক এম এ হামিদের তত্ত্বাবধানে সব দায়িত্ব আমি একাই পালন করতাম। সে হিসাবে ব্যারিস্টার আলী আব্বাসের সাথে আমার একটি পরোক্ষ সম্পর্ক ছিল।
ওখান থেকে আমরা গেলাম রিজেন্ট পার্ক মসজিদে জোহরের নামায পড়তে। লন্ডনের নামকরা বিশাল একটি পার্ক এটি। এর চারপাশে সব সম্ভ্রান্ত ও ধনী লোকের বসবাস। অত্যন্ত দামী এলাকা। সৌদি বাদশাহ প্রস্তাব দিলেন এ পার্কেরই এক পাশে তিনি একটি সুরম্য ও দর্শনীয় মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র নির্মাণ করবেন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় স্বল্পসংখ্যক ইহুদী বাসিন্দা তুমুল আপত্তি জানালো। পরিবেশ নষ্ট হবে, আযানের শব্দে প্রতিবেশীদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে, মসজিদের বিশেষ স্থাপত্য শিল্পের কারণে এলাকার উবসড়মৎধঢ়যরপ বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি হবে ইত্যাদি নানা ছুতা-নাতা যুক্তির অবতারণা করা হলো। শেষ পর্যন্ত সৌদী বাদশাহর চাপে যুক্তরাজ্য সরকার রাজী হলো এবং বিপুল অংকে নির্মিত এক বিশাল ও সুদৃশ্য মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হল। ইংল্যান্ডে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারে এ মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্রের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আমরা মসজিদে নামাজ পড়ে মসজিদের পাশের পার্কের খোলা জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। পার্কের  মাঝখানে একটি কৃত্রিম পুকুর। পুকুর পাড়ে সুন্দর বসার জায়গা। আমরা সেখানে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আজগরের বউ মাজেদা বাসা থেকে দুপুরের খাবার তৈরি করে প্যাকেট করে দিয়েছিল। আমরা সেটা তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিলাম। খেয়ে-দেয়ে পার্কের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। বিশাল পার্ক। পার্কের মধ্যে পুকুর, একটি ছোট স্রোতস্বিনী- তার উপর ব্রীজ, এরপর সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ পার্ক। পার্কের একপাশে রয়েছে চিড়িয়াখানা। এতসব দেখতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের হাতে অত সময় ছিল না। তাই সামান্য কিছুু দেখে এবং মুখে মুখে সবকিছুর বর্ণনা শুনে আমরা আবার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
এরপর আমরা গেলাম বার্মিংহাম প্যালেসে। ইংল্যান্ডের রাণী বসবাস করেন এ প্যালেসে। বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছে তাঁর প্রাসাদ। তবে প্রাসাদের আয়তন অতটা বড় নয়। তিন দিকে বাগান, সামনে একটি বিল্ডিং। বিল্ডিংটি প্রাচীন এবং অনতিবিশাল। প্রাচীনত্বে, ঐতিহ্যে, আভিজাত্যে ও মর্যাদায় এ বাড়িটির শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা অনেক বেশি। তাই প্রতিদিন অসংখ্য লোক দেখতে আসে বাড়িটি। বৃটিশদের কাছে যা কিছু প্রাচীন, তার কদর বেশি। বাড়ির সামনে বিশাল চত্বর, সেখানে বৃটেনের কয়েকজন জাতীয় বীরের বিশাল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। এরপর বাগান, দীর্ঘ প্রশস্ত পথ। প্রায় সর্বক্ষণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই আছে বাড়ির সামনের চত্বরে ও বাগানে। বাড়িটি একনজর দেখা, এখানে এসে কিছুক্ষণ ঘোড়াফেরা করা, ফটো তোলা-এতেই সবার আনন্দ।
রাণীর বাড়ি দেখে আমরা গেলাম ট্রাফালসার স্কয়ারে। এখানে বৃটেনের জাতীয় বীর নেলসনের মূতি টানিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের নৌযুদ্ধে নেলসন ছিলেন সেনাপতি এবং তিনি সে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। তাই তার বিশাল মূর্তি জনসমক্ষে টানিয়ে রাখা হয়েছে। মূতির কাছে এসে বৃটেন-ফ্রান্সের মধ্যকার সে ঐতিহাসিক জলযুদ্ধের কথা সকলে স্মরণ করে এবং সে যুদ্ধে বৃটেনের সেনাপতি নেলসন ও তার বাহিনীর বীরবিক্রমে যুদ্ধ করার ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। এ থেকে অনেকে অনুপ্রাণিত ও জাতীয় মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়।
ট্রাফালগার স্কয়ার থেকে আমরা গেলাম ফিলাডেলফিয়া এলাকায়। এটাকে লন্ডন শহরের কেন্দ্র মনে করা হয়। বিত্তবানদের এলাকা এটি। সারি সারি দোকনপাট ও অট্টালিকাসমূহ প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। লন্ডনের বিত্তবানেরা এমনকি, বহিরাগত বিশেষত ধনী আরবদের অনেকেই এ এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করে। এরপর আমরা মাদাম তুসোর পাশ দিয়ে, হাউস অব কমনসের গা ঘেঁষে, বিগবেন অতিক্রম করে ধীরে ধীরে ওবান স্ট্রীটে মাওলানা আবু আহমদের বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম।
ঐদিন বিকালে আমার দু'টো অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা। একটি সাতটায় আরেকটি সাড়ে আটটায়। ‘বাংলাপোস্ট’ পত্রিকার অফিসে আমার সম্মানে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে পত্রিকার লোকজন ছাড়াও লন্ডনে বসবাসকারী অনেক বিশিষ্ট বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী উপস্থিত হয়েছেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ‘বাংলা পোস্ট’ এর সম্পাদক জনাব আবু তাহের চৌধুরী। স্বাগত ভাষণ দেন সাপ্তাহিক বাংলা পোস্টের চেয়ারম্যান শেখ মুহম্মদ মফিজুর রহমান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ তাদের বক্তৃতায় আমাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। বাংলা সাহিত্যের গবেষণায় এবং বিশেষত ফররুখ গবেষণার ক্ষেত্রে আমার অবদানের প্রশংসা করেন। আমি তাদের বক্তৃতায়  মুগ্ধ ও অভিভূত হই। প্রতি উত্তরে আমিও সবিনয়ে কিছু বক্তব্য রাখলাম। আমার বক্তৃতায় আমি যা বলেছিলাম, তার সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ ঃ
আজকের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমরা পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে অনেককিছু করতে পারব বলে আমি আশা রাখি।  বাংলা সাহিত্যে ফররুফ আহমদ এক কালজয়ী প্রতিভা। তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মূল্যবান ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষত আমাদের জাতীয় পরিচিতি বিনির্মাণে এবং জাতীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বিকাশে ফররুখের ফররুখ আহমদের সাহিত্য আমাদের জন্য চির অনুপ্রেরণার উৎস। তাই ফররুখকে স্মরণ ও তাঁর সাহিত্যের চর্চা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এ উদ্দেশ্যেই ১৯৯৮ সনে ঢাকায় ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ, ফররুখের উপর গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ এবং ফররুখের জন্ম ও মৃত্যুদিবসের উপর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে এখন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সঙ্কট চলছে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য আজ নানা ষড়যন্ত্র চলছে। বিদেশী ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের উপর চরম আঘাত হানার অপপ্রয়াসে লিপ্ত। এ সঙ্কট উত্তরণে এবং আমাদের জাতীয় আদর্শ-ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রবাসীদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
আমার বক্তৃতা শেষে আমি বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন সম্পর্কে শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেই। উপস্থিত সকলেই ফাউন্ডেশনের সদস্য হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ফররুখ গ্রন্থাবলী পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। পরবর্তীতে গত ১৫ আগস্ট এক বৈঠকে লন্ডনে ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের শাখা গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য রফিক আহমদ রফিককে আহ্বায়ক, কবি আলিফ উদ্দিনকে সদস্য সচিব এবং ডক্টর আলী আজগর, আবু তাহের চৌধুরী প্রমুখকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠিত হয়।
দাওয়াতুল ইসলামের অনুষ্ঠানে আসতে আসতে মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেল। নামায পড়ে তারপর অনুষ্ঠান শুরু হলো। মূলত অনুষ্ঠানটি ছিল পারস্পরিক জানাশোনা, বাংলাদেশের খবরাখবর বিনিময় সম্পর্কিত। আমি বাংলাদেশে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা রাখলাম। সকলে শুনে খুব Demographic করলেন এবং এ কাজে জোরদার ভূমিকা রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করলেন। অবশেষে খাওয়া-দাওয়া শেষে অনুষ্ঠান শেষ হল। আমি এশার নামায পড়ে মাওলানা আবু আহমদের বাসায় ফিরে এলাম।
পরের দিন আমার আমেরিকা রওয়ানা হওয়ার কথা। আলী আসগর যাওয়ার সময় বলে গেল সে পরের দিন সকাল ছয়টায় আসবে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়ার জন্য। সকাল ১১টায় আমার ফ্লাইট। তাই, ৬টায় বাসা থেকে রওনা দেয়া প্রয়োজন।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.