আমার দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-৫

 
১৯ জুন জুমা’বার
লন্ডনে আজ আমাদের শেষ দিন। আলী আসগর তার কথামত ঠিক ছয়টার সময়ে এসে হাজির। আমরাও ভোর চারটার সময় উঠে ফযরের নামাজ-কালাম পড়ে বসে আছি। মাওলানা আবু আহমেদ সাহেবের গিন্নীও নানা রকম নাস্তা তৈরি করে বসে আছেন। ভদ্র মহিলা এত ব্যস্ততার মধ্যেও কীভাবে যে এত কিছু রান্না করতে পারেন! অতিথি পরায়ণতায় তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যে অসাধারণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাদেরকে তাদের অতিথিপরায়ণতার জন্য অশেষ জাজায়ে খায়ের দান করুন। আলী আসগর আসার পর তাকেসহ সকলে নাস্তা করলাম।
আমরা রেডি হয়ে ঠিক সাড়ে ছয়টায় রওনা হলাম।। সকাল বেলার খালি রাস্তায় আলী আসগর বেশ দ্রুত বেগেই গাড়ি চালিয়ে অনেকটা পথ অতিক্রম করে চলে গেছে। অকস্মাৎ আমার স্ত্রীর স্মরণ হল যে, পুরো তিন মাসের আমার ইনসুলিনগুলো মাওলানা আবু আহমদের ফ্রিজে রয়ে গেছে। ভুলে সেটা ব্যাগে তোলা হয়নি। আলী আসগরকে বলতেই গাড়ি আবার উল্টো পথে চলা শুরু করলো। বাসায় পৌঁছে দেখি মওলানা আবু আহমদ-দম্পতিও ঔষধের প্যাকেট নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূড় অবস্থায় দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ট্যাক্সি নিয়ে উনি এয়ারপোর্টে গিয়ে ঔষধগুলো আমাদেরকে  দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। ঠিক ঐ সময়ই আমরা সেখানে উপস্থিত হওয়ায় তারা দুঃশ্চিন্তামুক্ত হলেন। ঔষধগুলো নিয়েই আমরা আবার বিমানবন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ততক্ষণে আধঘন্টা সময় নষ্ট হয়েছে। তবু ভালো যে মাত্র আধঘন্টা সময় নষ্ট করেই আমরা আমাদের ভুলের খেসারৎ দিতে পেরেছি।
ইস্ট লন্ডন থেকে হিথ্রো বিমানবন্দর বেশ খানিকটা দূরে। স্বাভাবিক অবস্থায় এক ঘন্টা লাগে। যানজট থাকলে দেড় ঘন্টা বা তারও বেশি লাগে। সকাল বেলায় খুব বেশি একটা যানজট ছিল না। আমরা যখন বিমানবন্দরে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে পৌনে নয়টা বাজে। আর মাত্র দেড় ঘন্টা বাকি আছে বিমান ছাড়ার। আলী আসগর তাড়াতাড়ি করে মালপত্র বুকিং দিয়ে, বোর্ডিং পাস ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিল। আমরা হন্তদন্ত হয়ে সবকিছু সেরে আলী আসরগরকে গভীর আবেগে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে  আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলাম। কতকাল পরে ওর সঙ্গে দেখা হলো। আবার কবে কোথায় কখন দেখা হবে কে জানে !
বিশাল বিমানবন্দর এলাকা পেরিয়ে আমাদের প্লেনে উঠতে দশটা বেজে গেল। প্লেন ছাড়লো সোয়া দশটায়। বিশাল প্লেনের একপাশে সামনের সারিতে বেশ খোলামেলা জায়গায় হাত-পা ছড়িয়ে সীট বেল্ট বেঁধে আরামে বসে জানালা দিয়ে চারদিকের দৃশ্যপট অবলোকন করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে প্লেন আকাশে উড়লো। মেঘমুক্ত রৌদ্র-করোজ্জল সুনীল আকাশে মহাদানবের মত বিশাল প্নেনটি হাত-পা নেড়ে-চেড়ে যখন সদর্পে আকাশে উড়তে শুরু করল, তখন মনে হল যেন আমরা মহাশূন্যের দিকে এক অভিযানে বেরিয়েছি।
কিছুক্ষণ পরে নানা জাতীয় পানীয় নিয়ে হাজির হলো বিমানবালারা। আমার স্ত্রীর জন্য একটি আপেল জুশ এবং আমার জন্য একটি টমেটু জুশ নিয়ে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। একটু পরেই খাবার নিয়ে এল। আমাদের জন্য স্পেশাল মুসলিম খাবার। টিকিট কেনার সময়ই অর্ডার দেয়া ছিল। একমুঠো ভাত, একটুকরো মাছ আর কিছু সবজি। খাবার মন্দ নয়, তবে আমাদের কারোই পেট ভরল না তাতে। নয় ঘন্টার দীর্ঘ পথ। ভাবলাম, প্লেনে নিশ্চয়ই আর একবার খানা  দেয়া হবে। দেয়া হলো ঠিকই, নামার ঠিক একঘন্টা আগে। কিছু সালাত, একপিছ ব্রেড ও একপিছ চিকেন। চিকেন হালাল না হারাম বুঝতে না পেরে আমরা তা খেলাম না। শুধু চীজ দিয়ে পাউরুটি ও সবজি খেয়ে নিলাম। এবারও পেট ভরল না। আমেরিকায় চরম আর্থিক মন্দা শুরু হয়েছে। ভাবলাম, মন্দার প্রভাব কি প্লেনের মধ্যেও দেখা দিয়েছে? এতবড় বিলাসবহুল প্লেন, উচ্চমূল্যের টিকিট- এরপরও খাওয়া-দাওয়ায় এমন কার্পণ্য কেন ? অথচ বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লন্ডনে এলাম এমিরেইটসের ফ্লাইটে, সেখানে পর্যাপ্ত এবং রুচিসম্মত খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। ভাবলাম,  শিকাগো থেকে অন্য একটি প্লেনে মাত্র এক ঘন্টার বিমান-যাত্রার পর আমরা মেয়ের বাসায় গিয়ে আরামে পেট ভরে খেয়ে নেব।
শিকাগো এয়ারপোর্টে পৌঁছার বিশ মিনিট আগে খবর হল যে, সেখানকার আবহাওয়া খারাপ। তাই প্লেন নামতে অসুবিধা আছে। অতএব, বিশাল প্লেনটি যাত্রীসহ আকাশে উড়তে লাগল। প্রায় এক ঘন্টা ওড়ার পর গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে প্লেন বিমানবন্দরে অবতরণ করল। প্লেন থেকে নেমে আমার পায়ে অসুবিধার জন্য হাঁটতে কষ্ট হওয়ায় হুইল চেয়ার নিলাম। এক তরুণ আমেরিকান আমার হুইল চেয়ার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার লাগেজগুলো সে যথারীতি গুছিয়ে দিল। ফরম-টরম যা কিছু পূরণ করে দিল। পথ চলতে চলতে বার বার সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল-Dont worry, I will manage everything for you. You be seated  here and sleep in peace. খুব চটপটে স্বভাবের ছেলেটি তাড়াতাড়ি এবং খুব সুন্দরভাবে আমার ও আমার স্ত্রীর সবকিছু ঠিক করে Checking এর ব্যবস্থা করে আমাদেরকে Cedar Rapids-এ যাবার প্লেনের কাউন্টারে পৌঁছে দিল। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় জানালাম। এখানে বকশিশ দেয়ার নিয়ম নেই। নতুবা আমার ইচ্ছা হচ্ছিল তাকে কয়েকটি ডলার বকশিশ দিয়ে বিদায় করি। বকশিশ দেয়া আমাদের বাংলাদেশী কালচারের অংশ। প্রথমত এটা আমরা শুরু করি সওয়াবের নিয়তে। বর্তমানে এটা হয়ে গেছে এক বাধ্যতামূলক রেওয়াজে। প্রথমত এটা ছিল দাতার মর্জি মাফিক এখন এটা হয়ে গেছে গ্রহিতার চাহিদা মাফিক। তাই এখন আর এটাকে বকশিস না বলে ঘুষ বা চাঁদাবাজি বলাই ভাল, যা অনেকটা বাধ্য হয়ে সকলকে দিতে হয়। ঘুষ না দিলে বাংলাদেশে এখন আর কোন কাজই হয় না। ফলে এটা এখন একটি সামাজিক রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কেউ আর এখন এর প্রতিবাদ করে না। এটা আমাদের জাতীয় চরিত্রের অধঃপতনের মাত্র একটি দিক। আরো কতভাবে যে আমাদের নৈতিক চরিত্রে পচন ধরেছে, তা শুমার করে শেষ করা যাবে না।
সিডার র‌্যাপিডস-এর কাউন্টারে বসে মনে মনে খুব পরিতৃপ্তি লাভ করলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যের  শুরু যে এখানে তা পরে টের পেলাম। লন্ডন থেকে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে স্থানীয় সময় দুপুর ১২.২০ মিনিটের স্থলে ১.২০ মিনিটে ল্যান্ড করলো। লাগেজ চেক করে সাটল ট্রেনে আমাদের এখানে পর্যন্ত আসতে দুপুর দু’টা বাজল। সিডার র‌্যাপিডস-এর  প্লেন হলো বিকেল ৪.১৫ মিনিটে। সোয়া দুই ঘন্টা আমাদেরকে এখানে বসে থাকতে হবে। আমরা বসে আছি। কিন্তু সোয়া চারটার সময় বলা হল আবহাওয়ার কারণে ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে। আমাদেরকে বলা হলো ৮নং কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিতে। অতএব, আমরা চার নম্বর কাউন্টার থেকে ৮নং কাউন্টারে গেলাম। সেখান থেকে আমাদেরকে আবার পাঠানো হলো ২নং কাউন্টারে। এভাবে আমরা এখান  থেকে ওখানে ঘুরতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও কোন চান্স পাওয়া গেল না। অবশেষে আমাদেরকে ১৬নং কাউন্টারে যেতে  বলা হলো। সেখানে রাত ১০.২০ মিনিটে একটি ফ্লাইট সিডার র‌্যাপিডস যাবার কথা। কিন্তু সেখানে গিয়েও বিমুখ হলাম। ক্ষুধায় আমাদের পেট জ্বলছিল, ক্লান্তিতে সারা দেহ অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা বিপন্ন, অসহায় অবস্থায় তখন কাউন্টারে কর্মরত এক তরুণীকে আমাদের অবস্থার করা জানিয়ে বললাম, যদি আমাদের যাওয়ার কোন ব্যবস্থা না করতে পার তাহলে আমাদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করে দাও। তরুণী সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে হোটেলে যাবার বাসের ব্যবস্থা, হোটেলে থাকার বোর্ডিং পাস, ডিনার ও সকালের নাস্তার কুপন দিয়ে দিল। পরের দিন দুপুর দেড়টায় আমাদের ফ্লাইট। অতএব, অগত্যা আমরা হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম।
আমাদের সারা দেহ-মন অবসন্ন। নড়তে-চড়তে প্রায় অক্ষম। কাউন্টারে হুইল চেয়ারের কথা বলতেই হুইল চেয়ারের অর্ডার দেয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক আমেরিকান যুবক হুইল চেয়ার নিয়ে এল। আমেরিকান এ যুবক মুহূর্তের মধ্যে আমাদেরকে নিয়ে হোটেলের বাসে তুলে দিল। হোটেল শিকাগো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে কিছুটা দূরে শিকাগো শহরে অবস্থিত। কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয়! আমাদের যে হোটেলে নামার কথা সে হোটেলে যাবার আগেই আরেকটি হোটেলে থামানোর সাথে সাথে আমরা ভুলক্রমে সেখানে নেমে পড়লাম। কাউন্টারে গিয়ে বোর্ডিং পাশ দেখানোর পর রিসিপশন থেকে বলা হল, এখানে নয় অন্য আরেকটি হোটেল। অগত্য আমরা লরিতে বসে পরবর্তী বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিশ মিনিটের মধ্যেই পরবর্তী বাস এল। আমরা তাতে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ঈপ্সিত হোটেল ম্যারিডিয়ানে পৌঁছে গেলাম। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে, হোটেলের খাবার ঘর বন্ধ হবার উপক্রম। রিসিপশন থেকে বলল, অল্পক্ষণের মধ্যেই হোটেলের রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে, অতএব খেতে হলে তাড়াতাড়ি কর।
আমরা আমাদের মালপত্র নিয়ে রুমে না ঢুকে প্রথমে রেস্টুরেন্টে গেলাম। ক্ষুধায় আমাদের দু’জনেরই পেট চো চো করছিল। রেস্টুরেন্টের এক কোণায় একটি টেবিলের দু’পাশে দুজন বসে পড়লাম। আমাদের টেবিলের চারপাশে নানা জাতের পুরুষ-মহিলা নানারূপ খাবার ও পানীয় খাচ্ছে আর আয়েশী মেজাজে গল্প করছে। এক তরুণী এল আমাদের অর্ডার নিতে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম ভাত আছে কিনা? সে বলল না। আমরা বললাম, তাহলে রুটি-পাউরুটি সবজি ও মাছ দিতে। কিছুক্ষণ পর সে চার টুকরো পাউরুটি, চিজ ও দুই প্লেট ভর্তি তাজা শাক-পাতা নিয়ে এল। চিজ দিয়ে আমরা পাউরুটি খেলাম সাথে শাক-পাতা খাওয়ারও চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও ধরনের পাতা খেয়ে অভ্যস্ত নই বলে বেশি খাওয়া গেল না। খেয়ে-দেয়ে যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন ঐ তরণী ধেয়ে এল।  কোথায় যাচ্ছ? বস। তোমাদের জন্য মাছ আসছে। আমরা অবাক হলাম! এতক্ষণ পরে মাছ! আসলে অর্ডার দেয়ার পর এখানে মাছ রান্না করে সরবরাহ করা হয়, তাই দেরী হয়। আমরা আবার গিয়ে আমাদের জায়গাতে বসলাম। মাছটি তাজা এবং সুস্বাদু। তৃপ্তির সাথে খেলাম। তারপর হোটেলে আমাদের নির্দিষ্ট রুমে ঢুকে নরম তুলতুলে সফেদ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। দীর্ঘ পথ-যাত্রার সীমাহীন ক্লান্তির পর সে এক পরম আনন্দের মুহূর্ত। আল্লাহতায়ালার শোকর আদায় করলাম।
 
২০ জুন শনিবার
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ে আমরা সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। আসলে এখানে তো আমাদের কোন কাজ নেই। দেড়টায় আমার ফ্লাইট। কিন্তু হোটেলে বসে না থেকে আমরা আগে ভাগেই এয়ারপোর্টে যাবার প্রস্তুতি নিলাম, উদ্দেশ্য যদি দেড়টার আগে কোন ফ্লাইট পাওয়া যায়, সে চেষ্টা করা। তাই একেবারে রেডি হয়ে আমরা আমাদের মাল-সামান নিয়ে নিচে রিসিপশনে গেলাম। গতরাতে আমার ছেলেকে হোটেলের রুম থেকে একটা টেলিফোন করেছিলাম সেজন্য ১৫.৬০ ডলার পে করতে হলো। অথচ এ কলটি আমরা যদি বাইরে কোন পাবলিক বুথ থেকে করতাম, তাহলে আমাদের খরচ হতো মাত্র অর্ধ-ডলার। গত রাতে হোটেলের রুমে যাবার আগে আমি হোটেল লাউঞ্জে রাখা পাবলিক বুথ থেকে কলটি করতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু হোটেলের কোন একজন ব্যক্তি আমাকে বলল যে, আপনারা রুমে গিয়ে আরামে টেলিফোন করুন, সেখানে প্রত্যেক রুমেই টেলিফোনের ব্যবস্থা আছে। এটা শুনে আমরা খুশি মনে হোটেলের রুমে গিয়ে কল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু আমাদের জানা ছিল না যে, হোটেলের রুম থেকে টেলিফোন করলে এত মোটা অংকের বিল দিতে হবে। যাইহোক, ভুলের খেসারত দিয়ে আমরা হোটেলের রেস্টুরেন্টে গেলাম নাস্তা খেতে। সেখানে এক কোণায় নিরিবিলি একটা টেবিলের দু’পাশে দু’জনে বসলাম। এক তরুণী এলো খাবারের অর্ডার নিতে। আমরা রুটি, অমলেট ও কিছু ফলের অর্ডার দিলাম। খাবার এল। দেখি, আমাদের অর্ডার ছাড়াও কিচু আলু ভাজি দিয়েছে সাথে। আমরা বেশ উৎফুল্ল চিত্তে সব খেয়ে নিলাম। খাবার ভালই লাগল। পেটও ভরল। নয়টার সময় হোটেলের বাসে করে আমরা আবার শিকাগো এয়ারপোর্টে ফিরে এলাম। Domestic flight ধরার জন্য আমরা আমাদের নির্দিষ্ট কাউন্টারে গেলাম। দেড়টার আগে কোন ফ্লাইট পাওয়া যায় কিনা সে চেষ্টাও করলাম। কিন্তু হতাশ হতে হলো। দেড়টার আগে সব ফ্লাইট ফুল। তাই কোন আশা নেই। অগত্যা দেড়টার ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
গতকাল এখানকার আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। তাই কয়েকটি ফ্লাইট ক্যানসেল হয়েছে। কিন্তু আজকের  আবহাওয়া চমৎকার। দিনের আলোয় ঝলমল করছে সবকিছু। আপাতত, ঝড়-বৃষ্টির কোন লক্ষণ নেই। আমরা অনেকটা নিশ্চিন্তে ফ্লাইটের অপেক্ষায় বসে থাকলাম। কিন্তু অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কত যে বিড়ম্বনার তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
ঢাকায় প্লেনে ওঠার পর থেকে আমরা একটি অসুবিধা ভোগ করে আসছি। সেটা হলো টয়লেটের অসুবিধা। প্লেনে, হোটেলে, ওয়েটিং রুমে  সর্বত্রই টয়লেট আছে, পানিও আছে। কিন্তু পেশাব-পায়খানার পর পানি ব্যবহারের কোন ব্যবস্থা নেই। টয়লেট পেপার দিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ সারতে হয়। এতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পূর্ণ হয় না। ইসলামে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মূলত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সুরুচি ও সুন্দর জীবনের অভিব্যক্তি। তাই এটা মুসলমানদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংগ। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুরুচি সংস্কৃতিরও মূলকথা। ইসলাম সবকিছুতেই পরিচ্ছন্নতা, সুরুচি, সৌন্দর্য, ন্যায়পরায়ণতা, সুবিচার ও সদাচারের প্রবক্তা। আমরা শৈশবকাল থেকেই পায়খানা-পেশাবের পর যথাযথভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য পানি ব্যবহারে অভ্যস্থ। এছাড়া, ওযু ও গোছলেও পানির ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বাইরের দিকটা চাকচিক্যময় ও উজ্জ্বল হলেও ভিতরের দিকটা পায়খানা-পেশাব করে সম্পূর্ণ পরিষ্কার না হওয়ার মতই কদর্যময়। আমি এখানে যত সুবেশী-সুন্দর চেহারার নর-নারী দেখি, মনের অজান্তেই মনে হয়, এদের শরীরে পেশাব-পায়খানার কিছু চিহ্ন অবশ্যই লেগে রয়েছে। এটা তাদের কালচারÑযার মধ্যে কদর্যতার ছাপ স্পষ্ট। মুসলিম কালচার থেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পার্থক্য এখানেই।
বেলা একটা বাজার সাথে সাথে আমাদের চেক-ইন করার ডাক পড়লো। আমাদের দীর্ঘ অধৈর্য প্রতীক্ষার অবশেষে অবসান ঘটলো। আমরা চেক-ইন করে প্লেনে আমাদের নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলাম। ছোট এয়ারবাস। মাত্র ৪৫ জন যাত্রীর বসার ব্যবস্থা। সংকীর্ণ পরিসরে সবাই গাদাগাদি করে বসেছে। স্বল্প সময়ের যাত্রা, তাই প্লেনে খাবার কোন ব্যবস্থা নেই। যাইহোক, মাত্র ৪০ মিনিটেই আমরা আমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেলাম। আমাদের অধিকাংশ মালপত্র আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। অবশ্য কালো বড় স্যুটকেসটি তখনো পৌঁছেনি। এতে আমি এতটুকু চিন্তিত নই। কারণ আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা হলো এই যে, এখানে কোন কিছুই হারায় না। আমাদেরকে না পাওয়া সুটকেসের জন্য একটি স্লিপ দিয়ে বলা হল, এটা আগামীকাল তোমার ঠিকানায় যথারীতি পৌঁছে যাবে। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই দেখলাম, আমার ছোট ছেলে আবিদ, বড় মেয়ে সুমাইয়া, জামাই এনামুল কবীর, নাতি আইয়ান ও নাত্নি জারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা সবাই আবেগে আমাদেরকে জড়িয়ে ধরল। আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই সিডার র‌্যাপিডস্-এ আমার মেয়ের বাসায় এসে গাড়ি থামল।
একবিঘা জমির উপর বিশাল তিনতলা ভিলা। জামাই এবং মেয়ের নিজের বাড়ি। তারা একাই থাকে এখানে। অনেক জায়গা। আমরা বাড়িতে ঢুকলাম। ছেলেমেয়েরা আমাদের দু’জনের সেবা-যত্নে লেগে গেল। মুহূর্তে আমাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। গত দেড় দিনের দীর্ঘ পথ-যাত্রায় শরীর-মন ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। মেয়ের বাসায় এসে সকলের সান্নিধ্যে তা আবার ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠল।

No comments

নির্বাচিত লেখা

আফসার নিজাম’র কবিতা

ছায়া ও অশ্বথ বিষয়ক খ-কবিতা এক/ক. সূর্য ডুবে গেলে কবরের ঘুমে যায় অশ্বথ ছায়া একচিলতে রোদের আশায় পরবাসী স্বামীর মতো অপেক্ষার প্রহর কাটায় প্রাচী...

Powered by Blogger.